![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সত্য ন্যায়ে সন্ধানে, আকাশে উড়িয়ে শান্তির নিশান। মুক্তমনে উদার কণ্ঠে, গেয়ে যাবো সত্যের জয়গান।
[১]
জ্ঞানকে দু’টি শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে,—
(ক) একাডেমিক জ্ঞান! সবাই যে জ্ঞান অর্জন করতে পারেন। অর্থাৎ 'যারা নিয়ম মাফিক ঐ বিষয়টি হাসিল করেন, তার চর্চা করেন এবং এর মাঝে অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতা অর্জন করেন।' এই জ্ঞান দিয়ে কোনো সমস্যার সমাধান করতে হলে— প্রমাণ, সূত্র, দলিল, উপাত্ত ও মাঝেমধ্যে যুক্তির প্রয়োজন হয়। মূলত এই জ্ঞান বা ই'লমকেই আমি সনদপ্রাপ্ত ই'লম বলেছি।
(খ) হিকমতী বা বুদ্ধিমত্তা জ্ঞান! যাবতীয় বিষয় বস্তুকে সঠিক জ্ঞান দ্বারা জানাকে হিকমাত বলে। অদম্য সাধনা, সহজাত প্রবৃত্তি ও সৃষ্টিগতভাবে কোনো বিষয়ের উপর অভিজ্ঞতা বা দক্ষতার অধিকারী হওয়া। হিকমতী বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান বলতে— আইকিউ (IQ) লেভেল যখন একাডেমিক লেভেলকে অতিক্রম করতে পারে। অভিজ্ঞতা এবং দলীল প্রমাণ ছাড়াই নিজেদের সহজাত যোগ্যতা, সঠিক অনুভূতি এবং বিশুদ্ধ বুদ্ধিমত্তার দ্বারা উক্ত বিষয়ের কোন একটি বস্তু দেখামাত্রই এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত দিতে পারে এবং তা অক্ষরে অক্ষরে সঠিক হয়। এরই নাম আপনি সুস্থ অনুভূতি এবং পরিচ্ছন্ন বুদ্ধিমত্তা রাখতে পারেন।
যেমন— প্রমাণ করো দেখি, (১১+২=১)।
ধরো, ঘড়িতে এখন ১১টা বাজে। ১১ এর সাথে ২ ঘণ্টা যোগ করলে; অর্থাৎ আর ২ ঘণ্টা পর ১টা বাজবে। সুতরাং ১১+২=১ (প্রমাণিত)
এভাবে প্রচলিত নিয়ম বা রুলের বাইরে গিয়ে লজিক্যলি অ্যান্সার দেওয়াকে প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা (হিকমত) বলা যেতে পারে।
হিকমত মানে— প্রজ্ঞা-জ্ঞান, চাতুর্য, কায়দা, ক্ষমতা, কর্মকুশলতা ইত্যাদি। হিকমত বলতে প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌছানো। হিকমতের আরেক অর্থ 'সুন্নাহ'। কারণ, রাসূলুল্লাহ (স)-এর সবচেয়ে বড় একটি গুণ ছিল হিকমত। এই গুণকে উদ্দেশ্য করে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “তিনি মুসলমানদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিতেন।” (সূরা জুময়া : রুকু-১)।
[২]
হযরত লোকমান (আ), যিনি লোকমান হাকিম নামে পরিচিত ছিলেন। তার সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেন, “আমি লোকমানকে প্রজ্ঞা প্রদান করেছি এই মর্মে যে, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হও। যে কৃতজ্ঞ হয়, সে তো কেবল নিজের কল্যাণের জন্যই কৃতজ্ঞ হয়। আর যে অকৃতজ্ঞ হয়, সেক্ষেত্রে আল্লাহ প্রকৃতপক্ষেই অমুখাপেক্ষী ও প্রশংসিত।”(সূরা লোকমান- ১২)
লোকমান হাকিম (আ.) চমৎকার চিত্তাকর্ষক প্রজ্ঞাপ্রসূত কথা বলতেন। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার গুরুত্ব প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘জ্ঞান মিসকিনকে বাদশাদের বৈঠকে বসার ব্যবস্থা করে।’
লোকমান হাকিম (আ.) সম্পর্কে ছোট্ট একটি ঘটনা জেনে নেওয়া যাক–
এক লোক এসে হযরত লোকমান (আ)-কে বলতে লাগলো, 'আপনি ওই ব্যক্তি না, যে আমার সঙ্গে মাঠে ছাগল চড়িয়েছ?'
– 'হ্যাঁ, আমি ওই ব্যক্তি।'
– 'লোকজন দূরদূরান্ত থেকে আপনারর কথা শুনার জন্য আসেন এবং আপনার এত বড়বড় মজলিস বসে। আচ্ছ বলেন তো, আপনি এত বড় হলেন কীভাবে?
– 'দুটি গুণের কারণেই আল্লাহ তায়ালা আমাকে এত বড় করেছেন। (এক) সদা সত্য কথা বলা। (দুই) অনর্থক কথা বলা থেকে বিরত থাকা।'
কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়— হযরত লোকমান (আ) বলেছেন, যে গুণগুলোর কারণে আল্লাহ তায়ালা আমাকে এত ওপরে উঠিয়েছেন, কোনো ব্যক্তি যদি সেগুলো অর্জন করতে পারেন তাহলে সেও আমার মতো মর্যাদার আসনে সমাসিন হতে পারবেন। সে গুণগুলো হচ্ছে,–
১। নিজের দৃষ্টিকে নিচের দিকে রাখা।
২। জবানকে বন্ধ রাখা তথা চুপ থাকা।
৩। হালাল আয়ের ওপর সন্তুষ্ট থাকা।
৪। লজ্জাস্থানের হেফাজত করা।
৫। সত্য কথা বলা।
৬। অঙ্গিকার পূর্ণ করা।
৭। মেহমানের ইজ্জত করা।
৮। প্রতিবেশিকে কষ্ট না দেয়া।
৯। অনর্থক কথা ও কাজ পরিহার করা।
[৩]
দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা (হিকমত) কাজে লাগাতে হবেঃ
কারণ, আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, 'তুমি (মুহাম্মদ) বলঃ হে আহলে কিতাব! আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে যে বাক্যে সুসাদৃশ্য রয়েছে তার দিকে এসো। তা হচ্ছেঃ আমরা আল্লাহ ছাড়া কারো বন্দেগী ও দাসত্ব করবো না। তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবো না।' (সূরা আল-ইমরান, ৬৪)।
এখানে খেয়াল করুন, আল্লাহ তায়ালা কিতাবিদের (বিধর্মী) দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার ব্যাপারে কীভাবে হিকমাত শিক্ষা দিচ্ছেন। প্রত্যেকটি মুসলমানকে আল্লাহ নির্দেশ করেছেন, আহলে কিতাব বা অমুসলিমদের সাথে শুধু মাত্র সাদৃশ্য গুলো নিয়েই আলোচনা করতে। প্রজ্ঞা ও নমনীয়তার সাথে বোঝাতে হবে। বিতর্কের প্রয়োজন হলে সর্বোত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক করতে হবে। এতে করে কি হবে? ধীরে ধীরে তারা সঠিকটা বুঝতে পারবে। অপরদিকে তাদের সাথে শুধুমাত্র অসাদৃশ্য বিষয় গুলো নিয়ে আলোচনা করলে তারা হয়তো মুখ ঘুরিয়ে নিবে। তখন আর দ্বীনের দাওয়াত-ই দেওয়া যাবে না। এজন্য আল্লাহ তাআলা বলেছেন,—
'তুমি প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা (হিকমত) এবং সদুপদেশ সহকারে তোমার রবের পথের দিকে দাওয়াত দাও এবং লোকদের সাথে বিতর্ক করো সর্বোত্তম পদ্ধতিতে। তোমার রবই বেশী ভালো জানেন কে তাঁর পথচ্যুত হয়ে আছে এবং সে আছে সঠিক পথে।' (আন-নহল, ১২৫)
শুধু তাই নয়, রাজনীতি করতে গেলে বা নেতৃত্ব দিতে গেলেও প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার (হিকমত) খুব বেশি প্রয়োজন। তাই শুধু বস্তাভর্তি সনদপ্রাপ্ত ই'লম অর্জন করলেই হবে না, ই'লম অর্জনের পাশাপাশি হিকমাহ অর্জনও জরুরি। নইলে দ্বীনের খেদমত করতে গিয়ে দ্বীনের ক্ষতি-ই বেশি হবে। রাজনীতি করতে গিয়ে বিপদে পড়তে হবে। নেতৃত্ব দিতে গিয়ে লাঞ্ছিত হতে হবে।
আমাদের নবী-রাসূলগণ (আলাইহিস সাল্লাম) এবং পূর্ববর্তী আকাবিরগণ হিকমাহ বা প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা প্রত্যুক্তি-পটুতা ও বিচক্ষণতায় ছিলেন ধ্রুপদী মহামানব। অথচ আমরা চরম নাজুক অবস্থার মধ্যে রয়েছি। কিছু সংখ্যক আলেম ছাড়া আমাদের অধিকাংশ আলেমদের মধ্যে সনদপ্রাপ্ত ই'লম পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকলেও হিকমত বা প্রজ্ঞা-জ্ঞান বলতে খুবি কম রয়েছে। দেশ-বিদেশ থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করছি ঠিকই, কিন্তু মাথায় ঘেঁলু বলতে আসলে কিছুই নেই। এমনটি কি হওয়ার কথা ছিল? রাসুলুল্লাহ (সা)-এর শিক্ষা তো এমন ছিল না।ইসলামের শুরু থেকেই মুসলমানদের হৃদয়ে শিক্ষার বিষয়টি ছিল সবার প্রথমে। ইসলামের ইতিহাস জুড়ে বুদ্ধিবৃত্তিক শিক্ষা ছিল একটি গর্বের বিষয়। এটি এমন এক ক্ষেত্র ছিল যেখানে মুসলমানরা সর্বদাই উৎকর্ষ সাধন করেছে। যাতে রাসুলুল্লাহ (সা) কর্তৃক তাদের উপর অর্পিত এই দায়িত্ব তারা যথোচিত পালন করতে পারে। কিন্তু আমরা কালের আবর্তে ক্রমশ সঠিক জ্ঞানচর্চা এবং শক্তিচর্চা থেকে নির্বল নিষ্কর্মা হয়ে যাচ্ছি। প্রজ্ঞাপ্রসূত জ্ঞানের অভাবে আমরা এখন মিসকিন হয়ে যাচ্ছি। আমাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য ভুলে যাচ্ছি। বীরত্বগাতা গৌরোবাজ্জল ইতিহাস ভুলে যাচ্ছি। এর দরূনে ভাববাদিরা পৃথিবী জুড়ে প্রতিপত্তি প্রদর্শনে এগিয়ে গেছে। আর তাদের পদতলে মোরা পিষ্ট হয়ে মরছি...।
.
“হিকমত তথা বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান”
– ‘কাওছার হাবীব’
©somewhere in net ltd.