নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নিজের সম্পর্কে কিছু বলা ধৃষ্টতা হবে বলে মনে করি। পথ চলাতেই আমাদের পরিচয় হবে...
‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০’এ প্রকাশিত হয়েছে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জীবন্ত ফসিল’। প্রকাশ করেছে পূর্বা প্রকাশনী ও প্রচ্ছদ করেছেন চারু পিন্টু। গ্রন্থ ও এর কবিতাগুলো সম্পর্কে অনেকেই জানতে চেয়েছেন, জানতে চেয়েছেন কী নিয়ে এসব কবিতা, কেন লিখেছি, না লিখলেই কি চলছিল না। এসব প্রশ্নের উত্তর বেশ কঠিন, তবুও উত্তর দিতে হয় বলে এই লেখাটি সামু’র পাঠকদের জন্য লিখছি।
বিনয় মজুমদার লিখেছিলেন, ‘যা-ই লিপিবদ্ধ করি... তা-ই আক্ষরিক অর্থে সুনির্দিষ্ট কর্তব্যে ভারপ্রাপ্ত দেবী অথবা দেবতা হয়ে তৎক্ষণাৎ জন্ম লাভ করে।’ বিনয়ের মতো আমার প্রলাপগুলো দেবতা হওয়ার ধৃষ্টতা না দেখালেও প্রলাপগুলোও যে ভাব-কথা-আজ্ঞাবহ অক্ষরমালা তা দাবি করতেই পারি
কবিতা যদি হয় কবির দেখা-শোনা-চেনা পৃথিবীটাকে অক্ষরমালায় উপস্থাপন, তবে জীবন্ত ফসিলও কতকটা আমার চেনা পৃথিবীকে যেভাবে দেখেছি, অনুভব করেছি- সেসবেরই প্রতিচ্ছবি মাত্র। আমি অবশ্য এই এলোমেলো অক্ষরগুচ্ছকে প্রলাপ বলতেই পছন্দ করি- তীব্র জ্বরের সময় অর্ধচেতন মগজের প্রলাপের মতো। এসব প্রলাপ কতোটা কবিতা হয়ে উঠতে পারলো তা এর পাঠকই বলতে পারবেন ভালো।
প্রলাপগুলো কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে উদ্দিষ্ট হয়ে লেখা নয়, বরং বলা যায়, স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিঃসৃত আমার একান্ত নিজস্ব ভাবনা নিকোটিনের হলদে বিষের সঙ্গে মিশ খেয়ে অক্ষরের কলেবর পেয়েছে মাত্র; অনুভূতির চাপে শ্রাবণ ঢলের মতো ঝরে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। এসব প্রলাপের কোনোটায় তাই ফুটে উঠেছে চেনা বাস্তবতার সঙ্গে আমার লালিত স্বপ্ন-বাসনাগুলোর সংঘাত; কোনোটায় জটিল জীবনের সরল স্বীকারোক্তি; কোনোটায় সভ্যতার হিপোক্রেসি; কোনোটায় আবার প্রকাশ পেয়েছে মধ্যবিত্ত প্রেমের চাওয়া-না পাওয়াগুলো।
আমার ভেতর আজন্ম একটা অভিমান কাজ করে আসছে- সভ্যতার প্রতি, সভ্য সমাজটার প্রতি, পচন ধরা রূপবতী রাষ্ট্রের প্রতি; সেসব অভিমান সাজিয়ে দিয়েছি অক্ষরে অক্ষরে, এই বইয়ের দু’ মলাটে। এ কথাও সত্যি যে, বইয়ের প্রলাপগুলোয় দীর্ঘদিন ধরে বদ্ধ থাকা স্যাঁতস্যাঁতে ঘরের গুমোট হাওয়ার গন্ধ পাওয়া যায়। তাই তো গ্রন্থটির নাম দিতে হয়েছে জীবন্ত ফসিল।
কেবল যে প্রলাপের মত আত্ম-কথন করে গ্যাছি, তা নয়। আমাদের এই পৃথিবীটারও হয়ত কিছু বলার ছিল, দেখাবার ছিল- কান পেতে শুনে দেখবার চেষ্টা করেছি, দ্যাখার চেষ্টা করেছি, অক্ষরমালার কলেবরে আপ্রাণ তুলে আনবার চেষ্টা করেছি। আমি বলতে চেয়েছি চেনা পৃথিবীর সেসব অব্যক্ত কথা যা আমার ব্যক্তিগত অনুভবকে আঘাতের পর আঘাতে চূর্ণ করেছে। আমি বলতে চেয়েছি কৃত্রিম মানুষের কথা, প্রাগৈতিহাসিক কালের কথা, পচে যাওয়া একটা রাষ্ট্র-সমাজ-সময়-সভ্যতার কথা, সভ্যতার বিগ্রহে মৃত পিতার অনাদৃত শিশুর কথা, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা শহুরে সড়ক বাতি ও একটা শহরের কথা, আপনার-আমার-আমাদের অতৃপ্ত আত্মার কথা, স্বপ্নে দেখা এক পৃথিবীর কথা।
আমি বলতে চেয়েছি খোদ কবিতার সঙ্গেই আমার মানসিক সংঘাতের কথা, আমাদের দ্বান্দ্বিক বসবাসের কথা। আমি বলতে চেয়েছি মধ্যবিত্ততার নাগপাশে আটকে পড়া আমার প্রাগৈতিহাসিক প্রেমিকা- সত্যবতীর কোমল হৃদয়ের অব্যক্ত হাহাকারনামা। আমি বলতে চেয়েছি আমাদের রোজকার জীবনের বৃথা আয়োজনের কথা। প্রলাপগুলোর গায়ে-গতরের কোথায় যেনো একটা বিষাদ- একটা না পাওয়ার হাহাকার- আঘাতের আর্তনাদ জড়িয়ে আছে খোদ নিজের অজান্তে; এসব প্রলাপের প্রাগৈতিহাসিক গা থেকে ভেঙ্গে-চুরে মাথা তুলে দাঁড়াবার অদম্য আকাঙ্ক্ষার বিকট গন্ধ অনবরত বেড়োয়!
জীবন্ত ফসিল -এর প্রলাপগুলো পড়তে পড়তে যদি কোথাও কোথাও পাঠক আচমকা জীবনানন্দের ট্রামে কাটা লাশের ভূতুরে ছায়াটি দেখতে পান, মার্জনা করবেন। আপনার-আমার-আমাদের রোজকার জীবনের আয়োজনে ঠিক কোথায় জীবনানন্দ নেই বলুন তো! তাই শঙ্কিত না হতে দু’ হাত জোড়ে অনুরোধ করি, সর্বব্যাপী হয়ে লাশ কাটা ঘরের দুর্গন্ধ আমাদের সবার গায়ে লেপ্টে থাকে। আমার মনস্তত্বের গায়েও বারেবার আঘাত করে কবি-গ্রাসী এক টামের নিদারুণ চাকা, তাই মস্তিষ্কজাত প্রলাপেও কতকটা জীবনানন্দের অস্তিত্ব পাওয়াটাকে পাঠক স্বাভাবিক বলে মেনে নিলে দুঃখবোধের ঋণ থেকে মুক্তি পাই।
কবিতাগুলো কেন পড়বেন? এর উত্তরে কবি শিবলী মোকতাদির জীবন্ত ফসিল-এর ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আগুনে আঙুল ভিজিয়ে এই গ্রন্থের কবিতার মধ্যে দিয়ে পাঠক শ্রেণিকে তিনি আঘাত করেছেন... রাজীবের কবিতাগুলো পাঠ করলে মনে হবে- তিনি তার নিজস্ব মহিমায় নিজেকে ব্যাপ্ত উদ্ভাসিত করে তুলতে জানেন; তার কবিতা আলোকিত করে পরিমণ্ডল; উদ্বুদ্ধ করে- আন্দোলিত করে- আনন্দিত করে- আনে হৃদয়ে আমাদের সঞ্জীবনী সুধা; নিজে ফোটে অন্যকে ফোটায় তার সৃজনপ্রতিভার কৃতিত্বে।’
আমার প্রলাপগুলোর প্রতি কবি শিবলী মোকতাদির এমন সদয় দৃষ্টি সত্যিই আমার নাজুক হৃদয়ে পুলক জাগায়, ভেতর ভেতরে অদম্য স্পৃহা জন্মায়। আশা করি পাঠকেরও হৃদয়েও পুলক, প্রশান্তি জাগাবে আমার বেদনাবিদগ্ধ প্রলাপের সংকলন- জীবন্ত ফসিল।
আমার কাছে মনে হয়, কবি আর পাঠকের একটা সম্পর্ক থাকে- উপলব্ধিতে। কবির উপলব্ধি সজ্জিত অক্ষরমালা হয়ে পাঠকের চোখের সামনে হাজির হয়, তারপর পাঠক তা অন্তর দিয়ে অনুভব করেন নিজের চেনা পৃথিবীর জৈবিক অভিজ্ঞতায়। এ-ই তো কবি-পাঠকের সরল সম্পর্ক। এমতাবস্থায়, জীবন্ত ফসিল আমার সেই-সব অনুভূতির সমাবেশ যা পাঠকের জন্য অনুভবের খোরাক হবার জন্য মুখিয়ে আছে।
এই অস্থির সময়ে কবির মত পাঠকেরও চেনা জীবনের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকে বিষাদ, না পাওয়ার হাহাকার আর স্বপ্নে দেখা একটা সরল পৃথিবীর আকাঙ্ক্ষা। আশা করি এই বইয়ের দু’ মলাটে মধ্যবিত্ত পাঠক তার জীবনের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব-নিকাশগুলো মেলাতে পারবেন অনায়াসে। কবির চেতনায় পাঠকের প্রতিচ্ছবি কতকটা প্রশান্তির হতে পারে বলে বোধ হয়। কারণ, জীবন্ত ফসিল -এর প্রতিটা পৃষ্ঠায় যে আপনার-আমার-আমাদের রোজকার জীবনের কথাগুলোই বলতে চেয়েছি অ-ঋদ্ধ কণ্ঠে।
আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করে আপনার সুখ বোধ হোক- এটাই প্রত্যাশা।
বিনীত,
খুর্শিদ রাজীব
©somewhere in net ltd.