নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নিজের সম্পর্কে কিছু বলা ধৃষ্টতা হবে বলে মনে করি। পথ চলাতেই আমাদের পরিচয় হবে...
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড় জেলায় মূলত ২টি প্রধান ভাষা প্রচলিত- রাজবংশী ও কুরুখ। এছাড়াও এই অঞ্চলে ব্যবহৃত ভাষার মধ্যে সাঁতালি ও মণ্ডারি ভাষার প্রচুর শব্দ ব্যবহৃত হয়। পাশাপাশি রাজবংশী ভাষার আপনবোন ‘সূর্যাপুর’ ভাষারও সুস্পষ্ট ও গভীরতর প্রভাব রয়েছে এই অঞ্চলে। এদের মধ্যে কুরুখ ভাষাটি পঞ্চগড় জেলার উত্তরাংশের তেঁতুলিয়ায় প্রচলিত। কুরুখ ভাষাটি মূলতঃ ওঁরাওদের মাতৃভাষা। তাই তারা যেসকল স্থানে বসবাস করেন সেখানেই কুরুখ ভাষাটি প্রচলিত। যেমন- দেশে ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও রংপুর অঞ্চলে এই ভাষা প্রচলিত। দেশের বাহিরে নেপাল ও ভূটান এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশেও এই ভাষা প্রচলিত।
ওঁরাওরা মূলতঃ আদি ভারতীয় জনগোষ্ঠী অস্ট্রিকদের পূর্বসুরী। তারা প্রথমে ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের পশ্চিম উপকূলে বসবাস করছিলেন। পরে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েন। তাঁদের সঙ্গে মুণ্ডা, মালপাহাড়ি ও সাঁওতালদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ নৃতাত্ত্বিক সম্পর্ক আছে। বাংলাদেশের মধ্যে পঞ্চগড়ের পশ্চিম ও উত্তর দিকের সীমান্ত এলাকায় ঐতিহাসিকভাবে কিছু ওঁরাও বসবাস করেন। যদিও এই অঞ্চলে ওঁরাওরা সংখ্যায় খুবই কম, কিন্তু সত্ত্বেও তাদের ভাষার একটি বড় প্রভাব আছে এই অঞ্চলের বাঙালিদের শব্দ ব্যবহার, প্রয়োগ ও উচ্চারণে।
কুরুখ ভাষাটি মূলতঃ দ্রাবিঢ় ভাষাগোষ্ঠীর একটি ভাষা। এই ভাষার মধ্যে একটি ভারতীয় কুরুখ ও অন্যটি নেপালী কুরুখ। এখন, পঞ্চগড়ে কোনটি প্রচলিত, নিশ্চিত বলতে পারছি না। নেপাল থেকে তেঁতুলিয়ার দূরত্ব মাত্র ৪০ কিলোমিটার হওয়ায় নেপালী কুরুখের প্রভাব থাকলেও থাকতে পারে। ভারতে এটি দেবনাগরী লিপিতে লেখা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এর কথ্যরীতি থাকলেও নিজস্ব লেখ্যরূপ নেই। বাংলাভাষার আগ্রাসনে আর দশটা ছোট ভাষার মত এটিও লেখ্যরূপে বিলীন হয়ে গেছে। এমনকি বাংলার প্রবাবে পঞ্চগড়ে শুদ্ধ কুরুখ ভাষাটিও থাকার কথা না। কেবল উচ্চারণ, শব্দ, প্রয়োগেই এই ভাষার প্রভাব রয়েছে।
নৃতাত্ত্বিকভাবে সাঁওতাল ও মুণ্ডারিদের সঙ্গে মিল থাকায় ভাষায়ও কিছুটা মিল পাওয়া যায়। এজন্যই পঞ্চগড়ের উত্তরাঞ্চলের তেঁতুলিয়ায় ওঁরাও প্রভাবপুষ্ট ভাষার সঙ্গে এই জেলার পশ্চিমাঞ্চলের আটোয়ারি উপজেলা এবং ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর জেলার পশ্চিমাংশের মুণ্ডারি ও সাঁওতালী ভাষার প্রভাবপুষ্ট এলাকার শব্দ ও উচ্চারণ ভঙ্গিতে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আবার, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ের পশ্চিমাঞ্চলের যে ভাষা ব্যবহৃত হয় তার সঙ্গে শত মাইল দূরের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীর মুণ্ডারি ও সাঁওতালী ভাষার অঞ্চলের ভাষার মধ্যেও ব্যাপক মিল পাওয়া যায়।
নিচের এই ছবিটিতে ঢাকা ট্রিবিউনের করা ভাষা-মানচিত্রটিতে ওঁরাও, সাঁওতালী ও মুণ্ডারী ভাষার অবস্থান লক্ষ্য করুন-
যেমন- বিহা (বিয়ে), ভাতার (স্বামী), মাইয়া (স্ত্রী), বাউধিয়া (বাউণ্ডুলে), ডাঙ্গুয়া (ঘর জামাই), বিষ (ব্যাথা) ইত্যাদি। এই শব্দগুলো ওঁরাও, সাঁওতাল ও মুণ্ডারী ভাষাতেও ব্যবহৃত হয় যা গোটা পঞ্চগড়ের মানুষ নিয়মিত ভাষা ব্যবহারে ব্যবহার করে। এমনকি ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাঁওতাল ও মুণ্ডারী ভাষাতেও কিছু কিছু শব্দ ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ক্রিয়াপদের ব্যবহার (যেমন- করিনু, খানু) ও উচ্চারণ ভঙ্গিতেও বৃহত্তর এই অঞ্চলগুলোতে মিল রয়েছে। তবে এই শব্দগুলোর কোনটি কোন ভাষার তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
আবার এই কুরুখভাষা পঞ্চগড়ের যে অঞ্চলে প্রচলিত, সেই তেঁতুলিয়া উপজেলাসহ ভারতের বিহার রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর, শিলিগুঁড়ি ও জলপাইগুড়ি অঞ্চলের কিছু অংশে সূর্যাপুরি ভাষাটি প্রচলিত। বাংলা ও অসমীয় যেমন আপন বোন, তেমনিই সূর্যাপুরী ও রাজবংশী আপনবোন। তাই এই দুটি ভাষার মিল আছে। আবার ওঁরাওদের ভাষার সঙ্গেও সূর্যাপুরীর মিল দেখা যায়। তবে একথাও সত্য যে প্রতিদিনকার লৌকিক ব্যবহারের এত সামান্য আয়তনে মানুষের মধ্যে কোনো ভাষাই শুদ্ধরূপে থাকার কথা নয়। শব্দ, ক্রিয়াপদ ও উচ্চারণে যে মিল-অমিল থাকবে, সেটা স্বাভাবিক।
নিচের এই বাক্যগুলো খেয়াল করুন। এগুলো একজন সূর্যাপুরী ভাষাভাষীর লেখা যার সঙ্গে ওঁরাওপ্রভাবপুষ্ট তেঁতুলিয়া অঞ্চলের মানুষের ভাষার সঙ্গে সিংহভাগই মিলে যায়। নিচে এটির রাজবংশী ও বাংলা ভাষায় অনুবাদও দেয়া হলো।
বুড়া-বুড়ি লোকের লুগি পুন্না কিসসা কাহিনি লেখপা পারেন। এলা এইলাই রহোক। ঠিকে বলিল হে মুয়ো এলা কসিস কারমু কিছু দাওয়ার তানে। আরহও বাড়বা পারে। লেকিন মুই তুমহার লা দেখে শুনে শিখওয়ার কসিস কারমু। ভুল ভাল হলে তুমরা এক খুদি মোক বাতাই দিবেন।
রাজবংশী ভাষায় হবে- বুড়হা-বুড়হি লোকলার তানে পুন্না কিসসা কাহিনি লেখিবা পারেন। এলা এইলায় রোহক। ঠিকে কহিচেন, মুইহ এলা চেষ্টা করিম কিছু দিবার তানে। আরহও বাহড়হিবা পারে। কিন্তু মুই তুমহার লা দেখে শুনে শিখিবার চেষ্টা করিম। ভুল-ভাল হইলে তুমহুরা কনেক মোক কহে দেন।
বাংলা- বুড়ো-বুড়ি লোকদের জন্যে পুরোনো কিসসা কাহিনি লিখতে পারেন। এখন এগুলোই থাকুক। ঠিক বলেছেন, আমিও এখন চেষ্টা করব কিছু দেয়ার জন্যে। আরও বাড়তে পারে। কিন্তু আমি আপনাদেরগুলো দেখে শুনে শেখার চেষ্টা করব। ভুল-ভাল হলে আপনারা একটা আমাকে বলে দিয়েন।
এই ভাষা কুরুখ বা সূর্যাপুরি যেটাই হোক, পঞ্চগড় জেলায় তেতুঁলিয়া অঞ্চলে প্রচলিত এই ভাষাটা সহজবোধ্য। তবে আটোয়ারি উপজেলা, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরের পশ্চিমাঞ্চলের সাঁওতাল, মুণ্ডারি ও ওঁরাওয়ের সঙ্গে বাংলার মিশ্রণে যে মিশ্র ভাষা গড়ে উঠেছে তা কিছুটা দুর্বোধ্য শোনায়। এমনকি পঞ্চগড়েরই পূর্ব অঞ্চলের রাজবংশী ভাষাভাষীদের পক্ষেও জেলার পশ্চিমাঞ্চলের ভাষাটি অনেক সময় বুঝতে কষ্ট হয়। এই অঞ্চলের ভাষাভাষীরা শব্দের শেষে একটি অতিরিক্ত টান দেয়, অনেকটা কোরিয়ানরা যেভাবে সুর টেনে কথা বলে। এ ধরণের বলার ভঙ্গি রাজবংশী ভাষাভাষীদের মধ্যে নেই বা কম।
পঞ্চগড়ের পশ্চিমাঞ্চলে কুরুখ, সাঁওতালী ও ওঁরাও ভাষা মিশ্রিত আটোয়ারি উপজেলার ভাষার একটি উদারণ দিচ্ছি। যেমন-
মি উয়াক কহিস্নু, ’তি এরং ভ্যালট্যাঙ্গা কিতায় রে! অইসতে অইসতে হসপে গেল। এনংকো দে হিড়িম করে তি হামাত্তি অসলো ত্যা বসলো নি!’ উয়া সেলা মোক কহিল, ’মি বসিমনি। বড়বাপ তোক ছাপেচিল।’ মি ভ্যালসা চ্যাংড়াটাক আরহ কহিস্নু, ’গোস রাইনচু, খাবো নি?’ আজলাডা কহিল, ’খামনি গে, ভোগ লাগে নি এলাও। মি বাড়িত তকা খায় অইচ্চু।’ মি সেলা গরম ধরে কহুনু, ‘তি মোক সাড়াইস না তো!’
রাজবংশী ভাষায় কথাগুলো হবে- মুই ওক কহিচিনু, ’তুই এনং ভ্যালট্যাঙ্গা কিতায় রে! আইসত্যে আইসত্যে হাপসে গেলো। এংকো রে হিড়িং কো তুই হামাত্তি আসিলো, ত্য বসিলো নাই!’ ওয় সেলা মোক কহিল, ‘মুই বসিবা নাহু। বড়বাপ তোক খুঁজেচিল।’ মুই ভ্যালসা চ্যাংড়াডাক আরহ কহিনু, ‘তরকারি আন্ধিচু, খাবা নাহিস?’ আজলাডা কহিল, ‘খাবা নাহু গে, ভোগ লাগে নি এলাও। মুই বাড়িত তকা খায় আইচ্চু।’ মুই সেলা গরম ধরে কহিনু, ‘তুই মোক রাও কাড়িস না তো!’
ওপরের কথাগুলোর প্রমিত বাংলায় এরকম দাঁড়ায়- আমি ওকে বলেছিলাম, ‘তুই এত বোকা কেন রে! আসতে আসতে হাঁফিয়ে গেলি। এভাবে যে হঠাৎ করে তুই আমাদের বাড়িতে আসলি তো বসলি না!’ সে তখন আমাকে বলল, ‘আমি বসবো না।’ আমি বোকা ছেলেটাকে আরও বলেছিলাম, ‘খাবো না রে, ক্ষুধা লাগেনি এখনও। আমি বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি।’ তখন আমি রাগ করে বললা, ‘তুই আমাকে কথা বলবি না!’
এবার আসি পঞ্চগড় জেলার আরেকটি প্রধান ভাষা ‘রাজবংশী’র বিষয়ে। তার আগে নিচের এই ছড়া-কবিতাটি লক্ষ করুন। এটি আমারই লেখা যাতে রাজবংশী ভাষায় লিখিত হয়েছে।
রাধিকা বিরহ
তোর বিরহ কান্দাছে মোক বন্ধু রাধিকা,
বাঁচায় দে তুই জিউ ভরিয়া কৃষ্ণপ্রাণাধিকা।
কান্দেছু মুই ওগে কান্দে মোর কালা বাঁশিখান,
কি যাদু তোর পিরিত বন্ধু ধড়ফড়ায়ছে পরাণ!
মোর মথুরা তুই যে মোর নির্বাসনের বাস,
তুইহে জোসনা মোর, পইসাঞ্ঝের আঁতাত।
তাহ কি শুনিস বন্ধু গে তুই চন্দ্রকান্তা,
বাঁচায়ে দে মোক তুই একবার আসিয়া।
শব্দার্থ- পইসাঞ্ঝ= রাত; জিউ= জীবন/দম/প্রাণ; মোর= আমার; ওগে= ওরে; বাঁশিখান= বাঁশিটা; মোক= আমাকে; কান্দেছু= কান্না করছি; তুই= তুমি বা তুই…
পুনশ্চঃ ০১ ‘রাধিকা বিরহ’ ছড়া-কবিতাটি লেখা হয়েছিল গান হিসেবে, প্রকাশিত হয়েছে ‘বন্ত ফসিল’র ৪৫ পৃষ্ঠায়। শ্রীকৃষ্ণলীলায় যেমন কৃষ্ণের প্রতি রাধার আকুলতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, এই ছড়া-কবিতায় রাধার প্রতি কৃষ্ণের আকুলতাকে তুলে ধরার দুঃসাহস করেছি। এটিকে গান হিসেবে রূপ দেয়ার চেষ্টা করে হয়েছিল যেখানে সাত মাত্রার তালে ভাওয়াইয়া সুর দেয়া হয়েছিল।
পুনশ্চঃ ০২ এটি একটি নবিস পর্যায়ের লেখা। সুতরাং অনেক ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে, তাই পাঠকের কাছ থেকে সংশোধনের অনুরোধ জানাই। একই সঙ্গে এই বিষয়ে কোনো গবেষণাপত্র, নিবন্ধ বা বইয়ের খোঁজ থাকলে জানানোর জন্য আকুল আবেদন জানাই। ধন্যবাদ।
চলবে…
দ্বিতীয় পর্বের লিংক
আরও দেখুন-
কুরুখ ভাষার বংশপরিচয়
রাজবংশী ও সূর্যাপুরী ভাষা
কুরুখ ভাষা, উইকিপিডিয়া
পঞ্চগড় জেলার ভাষা ও সংস্কৃতি
০৪ ঠা মে, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:৩০
খুর্শিদ রাজীব বলেছেন: ধন্যবাদ। লিখবো।
©somewhere in net ltd.
১| ১৪ ই এপ্রিল, ২০২৩ রাত ৯:১১
নিমো বলেছেন: ভালো লাগল আপনার আপনার এই ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বৈচিত্রময় লেখাটা। নিয়মিত লিখতে থাকুন।