নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নিজের সম্পর্কে কিছু বলা ধৃষ্টতা হবে বলে মনে করি। পথ চলাতেই আমাদের পরিচয় হবে...
সবাইকে শিরুয়া বিশুয়া’র শুভেচ্ছা।
শিরুয়া বিশুয়া অর্থ শুভ নববর্ষ। পৃথিবীর আর কোনো অঞ্চলে এই নববর্ষের প্রতিশব্দ হিসেবে এই শব্দযুগল ব্যবহৃত হয় কি না জানা নেই। পঞ্চগড়ে আমার মাতৃভাষায় এটি বহুল প্রচলিত। এখনকার তরুণদের মধ্যে খুব একটা প্রচলিত না হলেও প্রবীণরা এখনও পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ বোঝাতে ’শিরুয়া বিশুয়া’ শব্দ দুটি ব্যবহার করেন। তবে ঠিক বলতে পারবো না, ’শিরুয়া বিশুয়া’র অর্থ পহেলা বৈশাখ, নাকি নববর্ষ। এটাও বরা মুশকিল এটি পঞ্চগড়ে প্রচলিত রাজবংশী, সূর্যাপুরী, কুরুখ, মুণ্ডারী নাকি সাঁওতালি ভাষার শব্দ। তবে এটি যে বাংলা শব্দ নয় তা এক প্রকার নিশ্চিত।
এই শিরুয়া বিশুয়া পঞ্চগড়ের সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ দিন। হালখাতা আর মেলা তো বটে, এই দিনটির বিশেষ আকর্ষণ চাল-কলাই-ছোলা’র একটি পদ। পান্তা ভাত খাওয়াটা শহুরে মানুষের একদিনের ’শখের বাঙালি’ সাজার প্রয়াস হতে পারে। কিন্তু চৈত্র-বৈশাখের গরমে পান্তা ভাত এই অঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষের নিত্যদিনকার খাবার। তাই শিরুয়া বিশুয়ার সকালে বিশেষ আকর্ষণ এই চাল-কলাই-ছোলা’র তৈরী বিশেষ পদ। আমার জন্মস্থান পঞ্চগড়ের মানুষেরা এই খাবার খেয়েই বছরের প্রথম দিনটি শুরু করত, ছোটবেলায় দেখেছি। এখন তো সব সোনালী অতীত!
এই লেখায় ‘শিরুয়া বিশুয়া’র সংস্কৃতি যে অঞ্চলটি পালন করে/করত, সে-ই অঞ্চলের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে। গত পর্বে মূলত পঞ্চগড়ে প্রচলিত কুরুখ ও সূর্যাপুরী ভাষা নিয়ে আলাপ তুলেছিলাম, রাজবংশী ভাষার আলাপটাও শুরু হয়েছিলো (নিচে লিংক দেয়া থাকলো)। এই লেখায় কথা হবে পঞ্চগড়ের পূর্বাঞ্চলের মানুষদের প্রকৃত মাতৃভাষা, রাজবংশী ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে।
রাজবংশী ভাষাটি মূলতঃ আমার জন্মভূমি পঞ্চগড় জেলার মধ্য ও পূর্বাঞ্চলের ভাষা। গ্লটোলগ বা ভাষার শ্রেণিবিন্যাসগুলোতে একে রংপুরী বা অম্পুরী, কামতা বা কামতাপুরী, কোচ-রাজবংশী ভাষা নামেও ডাকা হয়েছে। গ্লটোলগ অনুযায়ী, যে গৌড়ীয়-বাংলা একটি শাখা থেকে দুই বোন- অসমীয়া ও বাংলা ভাষার জন্য, সেই গৌড়ীয়-বাংলারই একটি শাখা থেকে দুই বোন- রাজবংশী ও সূর্যাপুরীর জন্ম। পঞ্চগড়সহ রংপুর বিভাগের অন্য জেলাগুলো উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, ভারতের উত্তর দিনাজপুর ও জলপাইগুঁড়ির কিছু অংশে সূর্যাপুরী ভাষার বিস্তার। (এ নিয়ে গত পর্বে কিছুটা আলাপ হয়েছে, লিংকে প্রবেশ করে পড়ে ফেলতে পাড়েন।) আর রাজবংশী ভাষার বিস্তার মূলতঃ তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের উত্তর-পূর্ব পারের অঞ্চল অর্থাৎ আমার জন্মভূমি পঞ্চগড়সহ রংপুর বিভাগের জেলাগুলোর পূর্বাংশে এবং ভারতের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও আসামের গোয়ালপাড়া পর্যন্ত। এমনকি নেপালেও এই ভাষা প্রচলিত।
সহসা এই রাজবংশী বা রংপুরী ভাষাটি অনেকটা বাংলার মত শোনালেও মোটেও তা বাংলা কিংবা বাংলার আঞ্চলিক রূপ নয়। রাজবংশী বা রংপুরী ভাষাটি মূলত তা বাংলা (৪৮-৫৫%), মৈথিলী (৪৩-৪৯%) ও নেপালী ভাষার শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। বলতে গেলে বাংলা নয়, বরই এটিই আমার এবং পঞ্চগড়ে আমার মা-চাচী, বাপ-দাদা, পাড়া-প্রতিবেশির ভাষা। কারণ বাংলাদেশের যে প্রমিত বাংলা, সে-তো আমরা স্কুলে গিয়েই শিখেছি। সুতরাং এই অঞ্চলের আদি মানুষদের প্রকৃত মাতৃভাষা বাংলা নয়, বরং রাজবংশী বা রংপুরী ভাষা।
উচ্চারণ ও শব্দগত প্রয়োগে এই ভাষাটি চারভাগে বিভক্ত- পূর্ব, মধ্য, পশ্চিম এবং পাহাড়ী (কোচ)। (তথ্য সংগ্রহের সীমাবদ্ধতায় এখনও জানা হয়ে ওঠেনি এই চারটি ভাগের অবস্থান ঠিক কোন কোন অঞ্চলে এবং পঞ্চগড়ে রাজবংশীর কোন ভাগটি প্রচলিত।)
কোচ-বিহার আমাদের বাড়ি থেকে একদম কাছে হওয়ায়, আমার বাড়ির মানুষরা যে ভাষাটি ব্যবহার করেন তা অনেকটাই কোচবিহারের রাজবংশীর সঙ্গে মেলে। অন্য ভাগগুলো বাদবাকি অঞ্চলগুলোতে মানুষ ব্যবহার করে। লেখার ক্ষেত্রে ভারতে এই ভাষাভাষীদের অনেকেই অসমীয়া বর্ণমালা ব্যবহার করেন। যেমন-
বাংলায় যদি বলি- ‘আমার সবগুলো লেখা পড়ার জন্য নিচের লিংকে ক্লিক করলে দেখতে পারবেন।’
এটাকে বাংলা লিপিতে পঞ্চগড়ের ভাষায় হবে- 'মোর তামান/গটা লেখালা পড়হিবার তানে তলের লিংকডাত ক্লিক করিলে দেখিবা পারিবেন।'
আর সেটা রাজবংশী ভাষায় অসমীয়া লিপিতে সেটা হবে- 'মোর গটা লেখালা পড়হিবাৰ তানে তলেৰ লিংকটাত ক্লিক কৰিলে দেখিৰ পাবেন।'
এবার কোচ-রাজবংশী ভাষায় লেখা একটি কবিতা পড়ুন। কবি অতুল চন্দ্র বর্মণের "আ-হৈয়া"। (যতটা সম্ভব আক্ষরিক অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি, তবুও দুই একটি শব্দ পাঠোদ্ধার করতে পারি নি।)
আ-হৈয়া আ-হৈয়া আ-হৈয়া!
সমবাৰে জন্ম তোৰ,
(সোমবারে জন্ম তোমার,)
সমবাৰু থুলুং তোৰ নাম।
(সোমবারু রাখলাম তোমার নাম।)
কিবা কাৰণত গোসা হলু?
(কী কারণে রাগ করলি)
হাম্বা হাম্বা হাম্বায়া,,,,,
মাৰ ডাকোতো সাৰা নাদিলু।
(মায়ের ডাকে তো সাড়া দিলে না।)
কোঠাই জায়া নুকালু,
(কোথায় গিয়ে লুকোলে)
আ-হৈয়া আ-হৈয়া আ-হৈয়া
কতো জাগাত ডাকানু,
(কতো জায়গায় ডাকলাম,)
নাদিস কোনোসাৰা।
(দিলে না কোনো সাড়া।)
মহা বিপদত পৰি আজি
(মহা বিপদে পড়ে আজ)
গোন্নাত ঠাকুৰক মানিলুং।
(*** ঠাকুরকে মানত করলাম)
দুই ঢাকি খৈ দিম এক ঢাকি মুড়ি,
(দুই ঝুড়ি খৈ দিব এক ঝুড়ি মুড়ি,)
মোলাদিম এক ঢাকি কলা ঝুকি ঝুকি।
(*** এক ঝুড়ি কলা ঝুঁকে ঝুঁকে।)
দশজনক ডাকে পুজা দিম
(দশজনকে ডেকে পূজা দেব)
সিগ্গীৰ সমবাৰুক দে বেৰ কৰি ।
(শিগগিরই সোমবারুকে বের করে দিন।)
অল্পো খানিক পৰে ডাকে থাকোং তোক,
(অল্পক্ষণ পরপর ডাকতে থাকি তোকে)
আ-হৈয়া সমবাৰু সমবাৰু সমবাৰ...
(ওরে ও সোমবারু সোমবারু সোমবারু)
জঙল ঝাৰ ভাঙালু হিৰিৎ কৰি বিৰি আসলু
(জঙ্গল ঝাড় ভেঙ্গে হঠাঠ করে বের হয়ে আসলি)
কোঠাই জায়া মৰাৰ ঘুম ঘুমিয়াছিলু?
(কোথায় গিয়ে মরার ঘুম ঘুমিয়েছিলি?)
জিউটাৰ মোৰ ধ্ক্-ধ্কী তোলালু,
(প্রাণটাতে আমার ধক-ধক তুললি)
বাঃ সমবাৰু বাঃ সমবাৰু!!
(বাবা সোমবারু বাবা সোমবারু)
কবিতাটির দুই একটি বাদে প্রায় সবগুলো শব্দই পঞ্চগড়ের পূর্বাঞ্চলের মানুষ প্রতিদিনের যোগাযোগে ব্যবহার করে। সুতরাং কবিতাটি এই এলাকার মানুষের বুঝতে একদম কষ্ট হবে না। মূলতঃ এই কবিতায় সোমবারে জন্ম নেয়া সোমবারু নামের এক গরুর জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া ও খুঁজে পাওয়ার বর্ণণা উঠে এসেছে। আহা! কি চমৎকার।
এই যে জন্মবারের নামেই নাম রাখা, এটি যে কেবল গৃহপালিত পশুর ক্ষেত্রে চলে তা নয়। পঞ্চগড় ও আশপাশের এলাকায় প্রায়শই কিছু লোক পাওয়া যাবে যাদের নাম জন্মবার দিয়েই হয়েছে। যেমন- মঙ্গলবারের মোংগোলু, বুধবারে বুধারু, বিষুধবারের (বৃহস্পতিবার) বিষু; শুক্রবারের শুকুরু, সোমবারের সোমারু ইত্যাদি।
চলবে…
প্রথম পর্বের লিংক
২| ১৪ ই এপ্রিল, ২০২৩ দুপুর ১:১১
শায়মা বলেছেন: পঞ্চগড় ঠাকুরগাও বা সেতাবগঞ্জের ঐ দিকে অনেক চাকমাদেরকে মানুষ পলিয়া ডাকতো। এমনি দেখেছিলাম আমার ছেলেবেলায়।
০৪ ঠা মে, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:৩২
খুর্শিদ রাজীব বলেছেন: তারা চাকমা নয়। তারা পলিয়া-রাজবংশী। অনেকেই এটা ভেবে ভুল করে। নৃতাত্বিকভাবে চাকমা ও পলিয়া-রাজবংশীদের কিছুটা মিল আছে। তাদের মধ্যে ভোট-চীনীয় বৈশিষ্ট্যগুলোই প্রকটভাবে দেখা যায়।
৩| ১৪ ই এপ্রিল, ২০২৩ দুপুর ১:২৪
রাজীব নুর বলেছেন: কবি জসীম উদ্দীন বলেছেন- নানান বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ ;. জগৎ ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত।
শুব নববর্ষ। ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।
০৪ ঠা মে, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:৩২
খুর্শিদ রাজীব বলেছেন: আপনিও ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।
৪| ১৪ ই এপ্রিল, ২০২৩ বিকাল ৪:০৮
জ্যাক স্মিথ বলেছেন: শুভ নববর্ষ। আপনাকে মঙ্গল শোভাযাত্রার শুভেচ্ছা, মঙ্গল শোভাযাত্রারা কল্যাণে আপনার মঙ্গল হউক।
শুভ নববর্ষ।
০৪ ঠা মে, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:৩৩
খুর্শিদ রাজীব বলেছেন: ধন্যবাদ।
৫| ১৪ ই এপ্রিল, ২০২৩ রাত ৯:০৭
নিমো বলেছেন: আপনাকেও শিরুয়া বিশুয়া'র শুভেচ্ছা। গোটা দেশের সকলের ভাষা-সংস্কৃতি টিকে থাকুক স্ব স্ব মহিমায়। মহাশ্বেতা দেবীর লেখায় আপনার উল্ল্যেখকৃত ভাষাভাষীদের কথা এসেছে বারবার।
০৪ ঠা মে, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:৩৫
খুর্শিদ রাজীব বলেছেন: বটে। আদিবাসি ও প্রাচীন ভারতীয়দের নিয়ে তাঁর অনেক কাজ আছে শুনেছি। রাজবংশীদের উল্লেখ তাঁর কোন রচনায় আছে জানালে উপকৃত হই। ধন্যবাদ।
৬| ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৩ বিকাল ৫:১৭
ভাস্কর রায় ( সৌরভ রাজধন ) বলেছেন: তোমহাকেউ শিরুয়া বিশুয়ার শুভেচ্ছা
তবে আমি যতদূর জানি শিরুয়া বলতে চৈত্র সংক্রান্তিকে বোঝায় আর বিশুয়া হলো বৈশাখের প্রথম দিন। নাকি আমি ভুল জানি ?
০৪ ঠা মে, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:৩৪
খুর্শিদ রাজীব বলেছেন: অনেকটাই ঠিক। শিরুয়া বলতে রঙ্গের উৎসবকে বোঝায়। আর বিশুয়া পুজা হয়। সংক্রান্তি ও পহেলা দিনের সঙ্গেই এই উৎসব ও পুজা জড়িত।
©somewhere in net ltd.
১| ১৪ ই এপ্রিল, ২০২৩ দুপুর ১:০৯
শায়মা বলেছেন: নববর্ষের শিরুয়া বিশুয়া শুভেচ্ছা !!