নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

করুণাধারা

করুণাধারা

জীবন যখন শুকাইয়া যায় করুণাধায় এসো

করুণাধারা › বিস্তারিত পোস্টঃ

নতুন জীবন- ষোল

২৪ শে এপ্রিল, ২০২০ সকাল ৭:১৯

আগের পর্ব: নতুন জীবন- পনের

যিল্যান্ড
সব শুনে উনি বললেন, ওরা যেন প্রান্তিক মানুষদের সাথে কোন ঝামেলায় না জড়ায়, এবং ওরা যেন সময় ক্ষেপণ করতে থাকে যতক্ষণ না উনি এসে পৌঁছান। উনি খুবই জোর দিয়ে বললেন, বাচ্চা মেয়েটা, অর্থাৎ পেট্রা খুবই মূল্যবান, ওর নিরাপত্তা যে কোন মূল্যে নিশ্চিত করতে হবে। উনার কথা শেষ হলে রোজালিন প্রশ্ন করল,
- কিন্তু আপনারা কারা? এই যিল্যান্ড কী?
- আমরা এক নতুন প্রজাতির মানুষ, যারা একসঙ্গে ভাবতে পারে, তোমাদের মত করে। আমরা এক নতুন পৃথিবী গড়ে তুলছি, প্রাচীন মানুষের পৃথিবীর চেয়ে তা অনেক ভালো। প্রাচীন মানুষেরা প্রতিভাবান ছিল, কিন্তু তাদের অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল, যেমন একজন আরেকজনের সাথে যোগাযোগ করার জন্য তারা ভাবনা চিত্র বানাতে জানতো না, তারা মুখে কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করতো। তারা বিভাজিত হয়ে পড়েছিল অনেক রকম ভাষা আর বিশ্বাসের বিভিন্নতার কারণে। তারা প্রত্যেকে নিজের মতো ভাবনা আর বিশ্বাস নিয়ে থাকত, অনেকের সাথে একযোগে ভাবতে পারত না। সময়ের সাথে সাথে তারা অনেক বিষয়ে উন্নতি লাভ করছিল, কিন্তু উন্নতির সাথে সাথে তারা পৃথিবীতে অনেক জটিলতা তৈরি করছিল, কারণ মানুষের বৃহত্তর স্বার্থে তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারতো না। তাদের স্বার্থপরতা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা শেষ পর্যন্ত পৃথিবীতে মহা দুর্যোগ ডেকে এনেছিল। অবশ্য এভাবে দুর্যোগে ধ্বংস না হলেও তাদের অপরিণামদর্শিতার কারণে তাদের জীবনে দুর্যোগ নেমে আসতো, প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করার ফলে তাদের শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে হত অভাব  আর নানারকম রোগবালাইয়ের সাথে লড়াই করে। মোদ্দা কথা হলো, তাদের মতো অযোগ্য প্রজাতি ধ্বংস হতোই, কোন না কোন ভাবে...
- কিন্তু আপনারা টিকে রইলেন!! কিভাবে?
- আমাদের পূর্বপুরুষেরা ভাগ্যবান ছিলেন বলতে হবে, কারণ তারা দুই বড় দ্বীপে বাস করতেন যা বাকি পৃথিবী থেকে অনেকটা আলাদা ছিল। অবশ্য ধ্বংসের প্রভাব অন্য জায়গার মতো তীব্রভাবে না হলেও তাদের উপরও পড়েছিল, ফলে বিচ্ছিন্ন ভাবে টিকে থাকতে গিয়ে তাদের মধ্যে নানারকম পরিবর্তন দেখা দেয়। একসময় কিছু মানুষের উদ্ভব হয়, যারা একসাথে ভাবতে পারত। যারা একাজে বেশি দক্ষ তারা কম দক্ষদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষতা বাড়াত, এভাবে প্রায় সকলেই দক্ষ হয়ে ওঠে।

 দীর্ঘকাল পর তাদের সাথে অন্য এলাকায় বসবাসকারী ভাবনা চিত্র বানাতে পারে এমন মানুষের সাথে যোগাযোগ হয়, যারা বেশিরভাগ সময়ই তারা তাদের সমাজে নির্যাতিত হয়ে নৌকায় করে পালিয়ে আমাদের দ্বীপে আসত। পরবর্তীতে আমরাও কখনো আমাদের বাহনে করে এমন মানুষদের উদ্ধার করে এনেছি। কিন্তু এতদূরে...,
আমরা কখনো ভাবতে পারিনি এতদূরে তোমাদের মত কেউ থাকতে পারে!! কিন্তু এখন আর কথা নয়, আমরা শীঘ্রী তোমাদের কাছে পৌঁছে যাব, ততক্ষণ পর্যন্ত বাচ্চা মেয়েটার নিরাপত্তা যেকোনো মূল্যে রক্ষা করবে! মনে রেখ, মেয়েটা অনন্যসাধারণ, অমূল্য!! 

উনার ভাবনা- চিত্র হালকা হয়ে এল। এতক্ষণ মাইকেলও মহিলার কথা শুনছিল, ও ওদের খবর জানাল, ওদের সব লোক জমায়েত করা হয়ে গেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা ডেভিডদের ধরার জন্য অভিযান শুরু করবে।

মাকড়সা- মানব
 প্রায় আড়াই ঘণ্টা যাবত অদ্ভুত দর্শন গাছপালার মধ্যে দিয়ে, উঁচুনিচু পাথুরে ভূমির উপর দিয়ে, কখনো জলাভূমির উপর দিয়ে যেতে যেতে ওরা একটা মোটামুটি সমতল ভূমিতে পৌঁছে যাত্রা শেষ করল। ওদের তিনজনকে ঘোড়া থেকে নামানোর পর দেখল ময়লা, ছেঁড়াফাটা কাপড় পরা সাত আট জন মানুষ তীর ধনুক হাতে ওদের ঘিরে রেখেছে, আর গভীর বিস্ময় নিয়ে মানুষগুলো দৈত্য ঘোড়া দেখছে!! 

এই কজনের মানুষের মধ্যে একজনের দেখা যাচ্ছিল ছয় আঙ্গুল, একজনের মাথা ডিমের মত মসৃণ আর একজনের বিশাল হাত-পা; বাকিদের কোন অস্বাভাবিকতা বোঝা যাচ্ছিল না। ডেভিড আর রোজালিন, বিশেষ করে পেট্রা তখন দেখল প্রান্তিক মানুষেরা মোটেই দৈত্য দানব না, তখন বেশ আশ্বস্ত হল। ইতিমধ্যেই দুজন লোক ডেভিডদের বলল ওদের সাথে যেতে, কিছুদূর ওদের সাথে যাবার পর যেখানে এসে পৌঁছাল সেটা জঙ্গলের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গা, ফাঁকা জায়গার একপাশে নিচু পাহাড়, তাতে কয়েকটা গুহা দেখা যাচ্ছিল। এদিক ওদিকে গাছের ডাল দিয়ে কোনমতে ঠেকা দিয়ে বানানো কিছু কুটির বা তাঁবুর পাশে দুয়েকটা চুলায় রান্না হচ্ছিল, নারী-পুরুষদের পোষাক দেখলেই বোঝা যায় যে দীর্ঘ দিন তারা একই পোষাক পরে আছে। সবচাইতে বড় তাঁবু বানানো হয়েছে গাছের ডালের উপর একটা গালিচা বিছিয়ে, কোনোকালে গালিচাটা হয়ত লুট করে এনেছিল! সেই তাঁবুর ভেতরে একটা ভাঙ্গাচোরা টুলে যে লোকটা বসে ছিল তাকে দেখে ডেভিড প্রথমে ওর বাবা ভেবে ভীষণ চমকে গেল, তারপর মনে পড়ল এ সেই মাকড়সা- মানব, সাত/ আট বছর আগে ওয়াকনুকে যাকে বন্দী হিসাবে দেখেছিল। লোকটা ডেভিডদের তিনজনকে কিছু সময় ধরে দেখল, তারপর ডেভিডের সাথে কথা বলল, জানতে চাইল ডেভিড তাকে চেনে কিনা! ডেভিড তাকে চেনে বলে জানাল; বলল,ও জেনেছে উনি তাঁর বাবার বড়ভাই, তিন-চার বছর বয়সে যার শারীরিক বিকৃতি ধরা পড়ে, দেখা যায় উনার হাত-পা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি লম্বা। লোকটা বলল, নিয়মমাফিক ইন্সপেক্টর উনাকে ধরে নিয়ে যাবার কথা ছিল, কিন্তু তারা উনাকে ধরতে এসে দেখল উনি নিখোঁজ!!

মাকড়সা- মানব বলে চললেন, তার মায়ের এক বিশ্বস্ত লোক তাকে প্রান্তভূমিতে পৌঁছে দিয়েছিল, প্রাণে বেঁচে গেলেও উনি হারালেন ওয়াকনুক, বাড়ির বড় ছেলে হিসাবে যে বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবার কথা ছিল তার!! উনি জানতে চাইলেন,  ডেভিড বড় ছেলে কি না। ডেভিড জানাল যে, সে তাঁর বাবার একমাত্র ছেলে, ওর পরে একটা ভাই জন্মেছিল কিন্তু স্বাভাবিকতা সার্টিফিকেট না থাকায় তাকে আর কোথাও কখনো কেউ দেখেনি!

মাকড়সা- মানব আরো কিছুক্ষণ ওয়াকনুক থেকে বিতাড়িত হবার কারণে তার হতাশার কথা বললেন। তারপর প্রশ্ন করলেন, ডেভিডদের ধরার জন্য এতদূর পর্যন্ত এত বড় বাহিনী কেন ছুটে আসছে, কারণ শারীরিক বিকৃতি সম্পন্ন যেকোনো মানুষ একবার প্রান্তভূমিতে চলে গেলে তাকে নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামায় না, এভাবে পিছু ধাওয়াও করে না। ডেভিড বলল, এমন মরিয়া হয়ে পিছু ধাওয়া করছে কারণ ডেভিডদের বিকৃতির ধরণটা ওদের নিজেদের লোকদের খুব বিপজ্জনক বলে মনে হয়েছে। ওদের মতো আরও কেউ আছে কিনা সেটা জানবার জন্য ওদের ধরতে এমন উঠেপড়ে লেগেছে!!

ডেভিড বলতে বাধ্য হল যে, ওর মত আরো মানুষ আছে, তাদের একজন মাইকেল এই আক্রমণকারী বাহিনীর সাথে আছে, তার কাছ থেকে ডেভিডরা সর্বক্ষণ সব খবর জানছে। মাকড়সা- মানব বললেন, বহুদিন ধরে উনি অপেক্ষায় আছেন, ডেভিডের বাবার মুখোমুখি হয়ে সব হিসাব মেটাবার। বড়ছেলে হিসাবে যা ন্যায়ত তার পাওয়া উচিত ছিল, তা পেয়েছে ডেভিডের বাবা, অতএব তাকে দাম চুকাতেই হবে...

এইসব বলে মাকড়সা- মানব কিছুসময় নির্নিমেষ দৃষ্টিতে ডেভিডকে দেখলেন, তারপরই তার নজর ঘুরে গেল রোজালিনের দিকে। রোজালিন কিছুক্ষণ চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ চোখ নামিয়ে নিল। ভাবনা চিত্রে ডেভিড দেখল, রোজালিন প্রচন্ড ভয় পেয়েছে। তৎক্ষণাৎ ডেভিড মাকড়সা- মানবের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মুখে একটা ঘুষি মারল, কিন্তু আর কিছু করার আগেই দুজন লোক ওকে ধরে ফেলল। লোকটা তার সরু পা ল্যাগব্যাগ করতে করতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
- বাহাদুরি দেখাচ্ছ না?? এই মেয়েটাকে আমার মনে ধরেছে, এখানে মেয়েদের সংখ্যা খুব কম, বাইরে গেলেই দেখতে পাবে... তাছাড়া আমার অনেক দিনের সখ বাবা হবার, বাচ্চারা দেখতে আমার মত হলেও আপত্তি নেই...
বাহাদুরি করতে এসো না, আমি দ্বিতীয়বার কাউকে সুযোগ দেই না!!

ডেভিডকে যে দু'জন ধরে রেখেছিল মাকড়সা মানব তাদের বলল ওকে বাইরে নিয়ে যেতে, আর ঝামেলা করলে মেরে ফেলতে। লোক দুজন তাঁবুর বাইরে নিয়ে যাবার পর ডেভিড পালানোর চেষ্টা করল, কিন্তু ওরা ডেভিডকে মাথায় বাড়ি দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলল।

সোফি
একসময় ডেভিড টের পেল কেউ ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ও মাথা একটু উঁচু করে দেখল একটা মেয়ে; ওকে তাকাতে দেখতে মেয়েটা টানা থামিয়ে দিল। অস্তগামী সূর্যের আলোয় মেয়েটার মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না, শুধু দেখা যায় যাচ্ছিল রোদে পোড়া মুখ ঘিরে রাখা গুচ্ছ গুচ্ছ কালো চুল, আর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা একজোড়া চোখ। মেয়েটার কাপড় ময়লা, দাগওয়ালা, এতটাই ছেঁড়া যে জামার দুই হাতা গায়েব! মেয়েটা দুঃখিত ভাবে বলল,
- আমাকে চিনতে পারলে না ডেভিড?
ওর কথার ভঙ্গিতে তৎক্ষণাৎ ওকে চিনতে পারল ডেভিড।
- সোফি!! তোমার সাথে আবার দেখা হলো...

সোফি ডেভিডকে বলল হাত-পা নেড়ে দেখতে কিছু ভেঙ্গেছে কিনা। হাত-পা না ভাঙলেও ডেভিডের গায়ে মাথায় খুব ব্যথা আর কপাল কেটে গেছিল, সোফি বলল অন্ধকার না নামা পর্যন্ত এভাবে শুয়েই থাকতে হবে লোকের নজর এড়ানোর জন্য। সোফি প্রশ্ন করল ডেভিডের সঙ্গী দুজন সম্পর্কে, শুনেই ডেভিডের মনে পড়ে গেল রোজালিন আর পেট্রার কথা। আতঙ্কিত হয়ে ওদের সাথে যোগাযোগ করতে চাইল কিন্তু কেউ সাড়া দিল না।

মাইকেল এসে ডেভিডকে আশ্বস্ত করল,
-  ওরা দুজন ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে, চিন্তা করো না।
- কিন্তু রোজালিন...
- ও ঠিক আছে। তোমার কী হয়েছিল?
ডেভিড মাইকেলকে সব বলল, কয়েক সেকেন্ডে বলা হয়ে গেল। এসময় সোফি আবার জানতে চাইল রোজালিন সম্পর্কে, ডেভিড ওকে বলল রোজালিনের সাথে ওর সম্পর্কের কথা। একটু ভেবে সোফি বলল,
- এই মেয়েটাকে ওনার ভালো লেগেছে, উনি এখন ওকে চান, এই মেয়েটা ওনাকে সন্তান দেবে, আমাকে উনি আর চাইবেন না...
সোফির কথায় হতাশা আর দুঃখ ফুটে উঠছিল, ডেভিডের ওর জন্য কষ্ট হলো।
- সোফি, তুমি কি তাকে ভালবাস? এই মাকড়সা মানবকে!!!
- এভাবে বোল না ডেভিড, আমাদের চেহারার বিকৃতির জন্য আমরা কেউ তো দায়ী না!! উনার নাম গর্ডন, উনি খুব দয়ালু, আমাকে খুব পছন্দ করেন। আমার কথার অর্থ তুমি ঠিক বুঝতে পারবেনা... তুমি তো একাকীত্ব কাকে বলে জানো না, তুমি তো জানোই না কী গভীর শূন্যতা  আমাদের জীবনে। একফোঁটা ভালবাসার জন্য আমরা কাঙাল হয়ে থাকি... আমি তাকে চাই, কিন্তু তিনি এখন আর আমাকে আর চাইবেন না... কেন আমার জীবন এমন হলো! এর চাইতে তারা আমাকে মেরে ফেললেও ভালো হতো...

সোফি নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো। ডেভিডের মনে পড়ল সোফিদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার সময় ওর মনের কষ্টের কথা, ক্রন্দনরত সোফিকে দেখে সেদিনের কষ্ট ওর মনে আবার ফিরে এল, ও দুহাতে সোফির হাত ধরে বলতে লাগলো,
- সোফি, এমন কিছু রোজালিন কখনোই হতে দেবে না, তুমি কি বুঝতে পারছ না এটা হওয়া অসম্ভব, তুমি নিশ্চিত থাকো সোফি...
- তুমি কী করে এত জোর দিয়ে বলছ ডেভিড, তুমি তো ওর মনের কথা জানো না...
কাঁদতে কাঁদতে সোফি বলল। তখন ডেভিড ওকে বুঝিয়ে বলল কিভাবে ও আর রোজালিন একে অন্যের মনে কী আছে তা জানতে পারে,  কিভাবে ওরা একসাথে কোনোকিছু নিয়ে ভাবতে পারে।

ইতিমধ্যে অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে, সোফি ডেভিডের হাত ধরে রেখে হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে পাহাড়ের পাশে চলে এল; সেখানে একটা ঝুলন্ত মই দেখিয়ে ফিসফিস করে বললো,
- আমার সাথে এসো।
মই বেয়ে ডেভিড একটা গুহায় পৌঁছাল। সোফি চকমকি পাথর ঠুকে মোমবাতি জ্বালালো, প্রচন্ড ধোঁয়া আর বিকট গন্ধে দম আটকে আসলেও মোমের আলোয় ডেভিড আশপাশে নজর দেবার সুযোগ পেল। দেখল গুহার ভেতরে সামান্যই জিনিস আছে, কিছু ঘটিবাটি, গাছের পাতার উপর পশুর চামড়া বিছানো একটা শোবার জায়গা, গুহার দেয়ালে গোঁজা কয়টা ছোরা, একটা বর্শা, তীরধনুক। গুহার ছাদের একটা ফাটল দিয়ে অল্প অল্প পানি চুঁইয়ে নীচে রাখা একটা কাঠের বালতিতে পড়ছে, তারপর বালতি উপচে বাড়তি পানি মেঝের উপর দিয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ছে। সব দেখে ডেভিডের মনে পড়ল ওয়ার্নারদের পরিচ্ছন্ন সুন্দর বাসাটার কথা।

সোফি ততক্ষণে বালতি থেকে একটা বাটিতে করে পানি আনল, কোন জায়গা থেকে একটা মোটামুটি পরিষ্কার কাপড় এনে ডেভিডের মাথার ক্ষত ধুয়ে দিল।
- ক্ষিদে পেয়েছে, ডেভিড?
- খুব। সারাদিন কিছু খাইনি।
- একটু বসো, আমি খাবার আনতে যাচ্ছি।

রোজালিনের মুক্তি
এই দীনহীন, নোংরা গুহায় বসে প্রান্তিক মানুষের কষ্টময় জীবন ডেভিড বুঝতে পারছিল। মনকে অন্যদিকে ফেরাতে মাইকেলের সাথে কথা শুরু করল; মাইকেল জানাল তারা রাতের জন্য অভিযান স্থগিত করেছে, কারণ প্রান্তিক মানুষেরা  চোরাগুপ্তা হামলা চালিয়ে মাইকেলদের দলের তিনজনকে হত্যা আর কয়েকজনকে আহত করেছে। তবু অভিযান চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত হয়েছে, কারণ যেকোন মূল্যে ডেভিডদের ধরতে হবে। মাইকেল বলল, ও রেচেলের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে, কারণ দূরত্ব বেড়ে যাওয়ায় ও আর রেচেলের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না।

এইসময় সোফি উঠে এল অদ্ভুত একটা খাবারসহ, একটা বাটিতে করে  খেতে দিল ডেভিডকে। মাংস আর কিছু গাছের শিকড় দিয়ে রান্না, কিন্তু খেতে খুব ভালো লাগছিল ডেভিডের। খাবার মাঝখানে ভীষণ চমকে হাত কেঁপে কাপড়ে ঝোল পড়ে গেল, চমকানোর কারণ পেট্রার গগণবিদারী আতঙ্কিত আর্তনাদ, ঘুম ভেঙ্গে ডেভিডকে দেখতে পায়নি তাই !! ডেভিড সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া দেওয়ায় আর্তনাদ বদলে গেল খুশির উচ্ছ্বাসে, তার এমন জোর যে ডেভিডের মনে হলো সমুদ্রের গর্জনের ভেতর দিয়ে রোজালিন, মাইকেল আর যিল্যান্ডের মহিলার ক্ষীণ কন্ঠ শোনা যাচ্ছে। পেট্রা অবশ্য তাড়াতাড়িই নিজেকে সামলাতে পারল, তখন ডেভিড রোজালিনের ভাবনা ধরতে পারল। রোজালিনের ভাবনায় মিশে ছিল আনন্দ আর আতঙ্ক, ডেভিড ঠিক আছে দেখে আনন্দ আর মাকড়সা মানবের জন্য আতঙ্ক। ও জানাল, মাকড়সা মানব একটা ধবল- চামড়া লোককে ওদের পাহারায় বসিয়ে কোথাও গেছে। মাকড়সা মানবের কথা বলতে গিয়ে ভয়ে রোজালিন কেঁপে উঠলো, বলল এই জানোয়ারের মত মানুষটা ওর দিকে হাত বাড়ালে ও নিজেকে হত্যা করবে। এই সময় মাইকেল কথা বলে উঠলো,
- নিজেকে না রোজালিন, তুমি ওকে হত্যা করবে।
একথা বলে মাইকেল ওর সব শক্তি দিয়ে যিল্যান্ডের মহিলার কাছে পৌঁছে জিজ্ঞেস করল,
- আপনি কি সত্যিই পৌঁছাতে পারবেন বলে মনে করেন?
- অবশ্যই, মহিলার জবাব অনেক দূর থেকে হলেও স্পষ্ট শোনা গেল।
- কতক্ষন লাগবে পৌঁছাতে?
অল্প কিছু হিসাব করে মহিলা জানালেন, আরো ষোল ঘন্টা লাগবে। শুনে মাইকেল ডেভিডকে বলল, এই ষোল ঘণ্টা সময় ওদের কোথাও নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিতে হবে। ডেভিড এবার সোফির সাথে কথা বলল, ওকে জানাল যে মাকড়সা- মানব মাইকেলদের বাহিনীর সাথে লড়াই করতে গেছে রোজালিন আর পেট্রাকে পাহাড়া দেবার জন্য লোক বসিয়ে, মাকড়সা মানবের হাত থেকে রোজালিনকে বাঁচাতে হলে সে ফেরার আগেই ওদের দুজনকে উদ্ধার করতে হবে। সোফি কিছুক্ষণ গভীরভাবে ভাবল, তারপর বলল,
- এটা করতেই হবে, এটা আমাদের সবার জন্যই ভালো হবে।

ডেভিড গুহার দেয়ালে রাখা বর্শা হাতে নিতেই সোফি বাঁধা দিয়ে বলল, কাজটা ও করবে! কারণ ডেভিডকে কেউ দেখে ফেললে ঝামেলা হবে, কিন্তু সোফিকে কোথাও যেতে দেখলেও কেউ সন্দেহ করবে না। দেয়ালে গুঁজে রাখা একটা ঝকঝকে ছোরা, নিয়ে ও কোমরে কাপড় দিয়ে বেঁধে নিল, ডেভিডের মনে হলো এই ছোরা কোন খামারবাড়ি থেকে লুট করে আনা।

সোফি ডেভিডকে বলল ও যেন রোজালিন আর পেট্রাকে ভালভাবে বুঝিয়ে বলে যে যাই ঘটুক, ওরা দুজন যেন চুপ করে থাকে, তারপর নিঃশব্দে সোফিকে অনুসরণ করে।

 


মন্তব্য ২০ টি রেটিং +১০/-০

মন্তব্য (২০) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে এপ্রিল, ২০২০ সকাল ১০:৩৪

রাজীব নুর বলেছেন: সোফি মাকড়সামানবকে অবশ্যই ভালোবাসে।

০২ রা মে, ২০২০ দুপুর ১২:১৮

করুণাধারা বলেছেন: অবশ্য অবশ্যই ভালোবাসে।

২| ২৪ শে এপ্রিল, ২০২০ সকাল ১১:২৫

মনিরা সুলতানা বলেছেন: পদ পদে বিপদ ! আশার কথা সাথে সোফী আছে।
ভালোলাগা আপু ।

০২ রা মে, ২০২০ দুপুর ১২:২৬

করুণাধারা বলেছেন: উত্তর দিতে এত দেরি করায় খুব দুঃখিত মনিরা। রোজার আগের দিন তিনটা পোস্ট দিয়েছি, তখন আর মন্তব্যের উত্তর করা হয়নি। তারপর নানা কারণে ভুলেই গিয়েছিলাম যে এই পোস্টে উত্তর করা বাকি আছে।

সোফি না থাকলে ওদের বড় বিপদ হতে পারতো! বিপদ পুরোপুরি কাটতে আরও কিছু সময় লাগবে।

এতগুলো পর্বে সাথে থেকে অনুপ্রেরণা দেয়ায় অনেক ধন্যবাদ। শুভকামনা রইল।

৩| ২৪ শে এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ১২:১৩

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: হারিয়ে যাওয়া সোফির পরিণতিও জানা গেল!
চরম ক্লাইমেক্সে এসে দেখী আর পর্ব নেইই :((
এখন টেনশন নিয়ে অপেক্ষা .... :)

+++

০২ রা মে, ২০২০ দুপুর ১২:৩০

করুণাধারা বলেছেন: পর্ব দিয়েছি ভৃগু! কিন্তু সেটা জানাতে অনেক দেরি করে ফেললাম। একটা পুরো পোস্টেই কোন মন্তব্যর উত্তর দেই নি, এটা কি করে করলাম জানি না। আন্তরিক দুঃখিত এত দেরি করার জন্য। শুভকামনা রইল।

৪| ২৪ শে এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ২:২২

নেওয়াজ আলি বলেছেন: চরম বিপদেও বিতর্ক করা কিছু লোকের পছন্দ

০২ রা মে, ২০২০ দুপুর ১২:৩২

করুণাধারা বলেছেন: ঠিকই বলেছেন। আসলে নানারকম মানুষ মিলেই তো সমাজ গড়ে ওঠে।

৫| ২৪ শে এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৫:৫৯

মুক্তা নীল বলেছেন:
আপা,
আপা ,
ডেভিডের সাথে আবার সোফি'র দেখা হয়ে গেলো ।
দেখা যাক সোফি কিভাবে রোজালিন ও পেট্রাকে মাকড়সা
মানবের হাত থেকে রক্ষা করে।
ধন্যবাদ ও শুভকামনা জানবেন।

০২ রা মে, ২০২০ দুপুর ১২:৩৫

করুণাধারা বলেছেন: হ্যা, ডেভিডের সাথে সোফির দেখা করিয়ে দিয়ে লেখক খুব ভালো করেছেন। নাহলে পাঠকের মনে প্রশ্ন থেকেই যেত সোফি সম্পর্কে।

মন্তব্য আর প্লাসে অনুপ্রাণিত করায় অনেক ধন্যবাদ মুক্তা নীল। শুভেচ্ছা রইল।

৬| ২৪ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ৮:৫৩

সোহানী বলেছেন: বাকিগুলো পড়তে গেলাম....

০২ রা মে, ২০২০ দুপুর ১২:৩৬

করুণাধারা বলেছেন: ওকে!

৭| ২৪ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ১১:৪১

পদাতিক চৌধুরি বলেছেন: চূড়ান্ত উত্তেজনা। হারিয়ে যাওয়া সফির খোঁজ জানা গেল। এখন দেখার মাকড়সা মানবকে শেষ করার কাজটিও ঠিকঠাক করতে পারে কিনা।
দুর্দান্ত ফিনিশিং...

০২ রা মে, ২০২০ দুপুর ১২:৩৮

করুণাধারা বলেছেন: দেখা যাক শেষে কী হয়!

মন্তব্য আর প্লাসের জন্য অনেক ধন্যবাদ পদাতিক চৌধুরী। ভালো থাকুন, শুভকামনা।

৮| ২৮ শে এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৩:১১

নীল আকাশ বলেছেন: ভুলে শেষ পর্ব আগে পড়ে ফেলেছিলাম। এখন এসে পড়ে গেলাম।
ধন্যবাদ।

০২ রা মে, ২০২০ দুপুর ১২:৩৯

করুণাধারা বলেছেন: সেটা জানিয়ে যাবার জন্য, আর সাথে প্লাস দেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ নীল আকাশ। শুভকামনা রইল।

৯| ১৭ ই জুন, ২০২০ রাত ১০:৫৫

খায়রুল আহসান বলেছেন: এখন দেখার বিষয়, সোফি কিভাবে রোজালিন ও পেট্রাকে মাকড়সা মানবের হাত থেকে রক্ষা করে!
আমার সাম্প্রতিক নিউযীল্যান্ড সফরকালে সেখানকার মাউরি সম্প্রদায়ের কয়েকজন ইংরেজী জানা শিক্ষিত নারী পুরুষের সাথে কথা বলেছিলাম। এ পর্বটা পড়ে ওদের কথা মনে পড়ে গেল!
পোস্টে নবম ভাল লাগা + +।

২৫ শে জুন, ২০২০ রাত ৯:০০

করুণাধারা বলেছেন: আপনার নিউজিল্যান্ড সফরের কাহিনী পড়া হয়নি। মাউরি সম্প্রদায়ের সাথে আপনার কথা হয়েছে জেনে তাদের সম্পর্কে জানার আগ্রহ হচ্ছে। আশাকরি এ সম্পর্কে লিখবেন।

মন্তব্ করে আর প্লাস দিয়ে অনুপ্রাণিত করার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই। ভালো থাকুন।

১০| ২৬ শে আগস্ট, ২০২০ রাত ৯:৪৩

আখেনাটেন বলেছেন: সোফি এখনও বেঁচে আছে............

২৮ শে আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৪:২৭

করুণাধারা বলেছেন: গল্পে যদি চমক না থাকে তাহলে তো ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে যাবে, লোকে বই কিনবে কেন? এজন্যই সোফিকে ফিরিয়ে আনা...

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.