নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কথা কবিতা

অধ্যাপক

কথা কবিতা › বিস্তারিত পোস্টঃ

পহেলা বৈশাখ, আমাদের সংস্কৃতি --------

১৪ ই এপ্রিল, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২২

মাস ভিত্তিক খাদ্যাভাস, নানা রকমের আয়োজন আর উৎসবের আবেষ্টনীতে বাঁধা ছিল বাঙালি জীবন। এর জন্য যে অনেক খরচ করতে হতো, তা কিন্তু নয়। দেখা যায়, বনে বাদাড়ে,নদীর ধারে,পুকুর পাড়ে যে সব লতা গুল্ম,শাক সবজি প্রাকৃতিক ভাবে গজায় তাই দিয়ে সে ক্ষুধা নিরাবরণের পাশাপাশি আনন্দ উৎসবও করতো। একেই বলে সহজানন্দ। হতে পারে, এমন প্রাকৃতিক সহজ আনন্দই হয়ত এক সময় সহজিয়া ধর্মের মোক্ষলাভে পরিণত হয়।
প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যের অঙ্গন জুড়ে ছিল সাধারণ মানুষের জীবন চিত্র। হোক সেটা বাঙলা ভাষায় রচিত বা প্রাকৃত বা শৌরসেনী অপভ্রংশে। মানুষের অকৃত্রিম জীবনবোধে প্রাচুর্য ছিল না, বরং অল্পে সন্তুষ্টির ঢেঁকুর ছিল। সেজন্য বাঙালিরা কখনো বহির্গমনে আগ্রহী ছিল না।
সহজ অভ্যস্থ জীবনে আজ ডাল ভাতের কথা বলা হলেও, প্রাচীন সাহিত্যের খাদ্যাভাসে ডাল - আলুর উল্লেখ নেই। ডাল মধ্যযুগীয় আর্য ভারতের দান, আর আলুর প্রচলন করেছিল পুর্তগিজরা। বাঙালির খাদ্যতালিকায় ঘি মাখা গরম ভাত, নালিতা (পাট) শাক আর মোরল্যা মাছের উল্লেখ পাওয়া যায়। ---
ওগগর ভত্তা রম্ভা পত্তা
গাইক ঘিত্তা দুগ্ধ সুজত্তা
মোইণি মচ্ছা নালিচ গচ্ছা
দিজ্জই কন্তা খাই পূন্যবন্তা। (প্রাকৃতপৈঙ্গল, শৌরসেনী অপভ্রংশে রচিত)
অর্থাৎ, কলাপাতার উপর দুধ-ঘি মাখা গরম ভাত, মোরল্যা মাছ আর নালতা শাক দিয়ে খাচ্ছেন পূণ্যবান, আর পরিবেশন করছে কান্তা (প্রেমময়ী নারী)।
ভাতই ছিল বাঙালির প্রধান ও পছন্দনীয় খাবার। তাই তো ভাতের জন্য হাহাকার প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে। ---
ঘরেতে ভাত নাহি নিতি আবেশী,(চর্যাপদ, প্রাচীন যুগ)
আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে ( অন্নদামঙ্গল, ভারতচন্দ্র রায় গূণাকর, মধ্যযুগ)।
বাংলায় নববর্ষ বা নতুন বছর শুধু ক্যালেন্ডার পরিবর্তনের বিষয় নয়। আসল বিষয় সংক্রান্তি। গ্রামের সাধারণ মানুষ সময়কে চিনে মাস দিয়ে,জীবনের স্মৃতিগুলো মনে রাখে ঘটনা দিয়ে। যদি কোন গ্রামীন মহিলাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তোমার বিয়ে কবে হয়েছে? তখন সে বলবে, যে বছর লাল পানির বন্যা হয়েছিল সে সময়। আর সন্তানের কবে জন্ম হয়েছে তা জিজ্ঞাসা করলে বলবে, পাট শুকানোর সময় ভাদ্রমাসে। শুধু তাই নয়, ফসল লাগাবার সময়, কোন মাসে মেয়েকে নাইওর আনার সময়, কোন মাসে পিঠা বানাতে হবে এবং আত্মীয়-স্বজনকে খাওয়াতে হবে সেটা বাংলা মাসের নাম ধরেই বলতে হয়।
চৈত্র মাসে রবিশস্য ঘরে তোলার পর পুরা মাঠই শুকনা খর খরে হয়ে যেতো। বৈশাখে আউশ ধানের বীজ বোনার পর ধান আসতো তিনমাস পর। কাজ নেই বলে এসময় বাংলার ঘরে ঘরে অভাব থাকতো। এই অভাবের দিনগুলোতে বাংলার মেয়েরা শাক কুড়াতে বেরুতো। নিয়ম ছিল তাকে চৌদ্দ রকম শাক কুড়াতে হবে। আবাদী নয় কিন্তু অনাবাদী, অর্থাৎ রাস্তার ধারে, ক্ষেতের আইলে, চকে,ঘরের আলান পালান, মাঠের আনাচে কানাচে, আপনজালা শাক তুলতে হবে। অর্থাৎ নিজে থেকে হয়ে ওঠা শাক। এই চৌদ্দ রকমের শাক হলো,কচু,কলমি, নেটাপেটা, ঢেঁকিশাক, দন্ডকলস, তেলাকুচা, বাইতা, খৈরাকাটা, নুনিয়া, ব্রাহ্মী,শুশনি,থানকুনি,দুধিয়া,কাঁটানেটে ইত্যাদি। এসব শাক ভেষজও বটে। গরীব অভাবী মানুষের এই দিয়ে ক্ষূণ্নবৃত্তিও হতো। পুষ্টিসাধনও হতো। আবার চৈত্র সংক্রান্তির নামে ব্রতও পালিত হতো।
এছাড়াও বাঙালি কার্তিক মাসে তিতা খেতো দাওয়াই হিসেবে। চাউল ভাজার সাথে নিম,নিশিন্দা,গুলঞ্চ --- এর সাথে পেয়াজ, রসুন কাঁচা মরিচ মিশিয়ে গুড়া করা হতো।
মাস ওয়ারি তরকারি খাওয়ারও সে প্রচলন ছিল তা একটা প্রবাদের মধ্যেই প্রমাণ পাওয়া যায় ---- "আশ্বিনে ওল, কার্তিকে খলিসার ঝোল।
পৌষ সংক্রান্তি কেন্দ্র করে নবান্ন উৎসব গড়ে উঠলেও, বৈশাখ কেন্দ্রিক হাল খাতা বা পূন্যাহর প্রচলন হয়েছে বৈষয়িক অর্থনীতির কারণে।
বাংলার ভাব অনুযায়ী সরলরেখার মতো সময় বয়ে গিয়ে বছর শেষ হয়ে যায় না, বা নতুন কোন বছর আসে না। সরলরেখার সময় নয়, বরং ফিরে ফিরে প্রত্যাবর্তন করা ঋতুর ধারণাই আমাদের সময় সংক্রান্ত ধারণার ভারকেন্দ্র। সেই কারণে নববর্ষ বরণ করাই নয়, সংক্রান্তিই গণমানুষের সংস্কৃতি। ঔপনিবেশিক আমলে জমিদার ও মহাজনরা বছর শেষে পাওনা আদায় ও নতুন হিশাবের খাতা খুলবার জন্য - প্রধানত হালখাতা, টাকা আদায় ইত্যাদির প্রয়োজনে - বৈশাখ মাসের পয়লা তারিখে নতুন বছর পালন করে। এর পাশাপাশি বছরের শুরুতে একটু ভালো রান্না করা হতো। মিষ্টি হিসেবে আখের গুড়ের পায়েস, জিলিপি, রসগোল্লা ---- খাজা গজা মোয়া,নানা রকম চিনির তৈরি সাজ ---- যার যেমন সামর্থ্য অনুযায়ী কিনতো। তখনকার নতুন বছর উদযাপনের দিনটিতে বাঙালি আপন সত্ত্বার পরিচয় থাকতো, আপন শিকড়ের টানে -- যা আজ বিকৃতির প্রাবল্যে বিলুপ্তির পথে।
এককালে সম্মিলিত ভাবে একই দিনে পহেলা বৈশাখের হালখাতা/পূন্যাহ উদযাপন করলেও এখন আর নির্বিশেষে তা করা হয় না। অধিকাংশ বাঙালি গ্রহ নক্ষত্রের হিসেব কষে পহেলা বৈশাখ আলাদা তারিখে ধর্মীয় সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবেই পালন করে।
আমাদের বিভেদ কমুক, আমাদের সংস্কৃতি অক্ষুণ্ন থাকুক ---- এই প্রত্যাশা করি ১৪২২ সালের বাঙলা নববর্ষে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.