ধর্ম অবমাননার নামে রাজনীতি চলছেই—কিন্তু রাষ্ট্র এখনো কুম্ভকর্ণের ঘুমে !

২৪ শে জুন, ২০২৫ রাত ৯:১৩

লালমনিরহাটের ঘটনার মতো ঘটনা নতুন কিছু নয়। আমাদের রাষ্ট্র-সমাজে "ধর্ম অবমাননা" এখন কেবল বিশ্বাস নয়, এটা এক অস্ত্র—যা দুর্বল, সংখ্যালঘু, অথবা বিরুদ্ধমতের ওপর প্রয়োগের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়। এই অস্ত্রের ব্যারেল অধিকাংশই দুর্বলের দিকে ঘোরানো। কারণ সে প্রতিরোধ করতে পারবে না, পাল্টা মব আনতে পারবে না, এবং রাষ্ট্রও তার পক্ষে দাঁড়াবে না। লালমনিরহাটের ঘটনায় একটি নাপিত পরিবার অভিযোগ করেছে; মাত্র ১০ টাকার দেনা-পাওনার জেরে তার ওপর ‘ধর্ম অবমাননার’ অভিযোগ তুলে তাকে টেনে হিঁচড়ে গণপিটুনি দেওয়া হয়।

আরেকদিক থেকে বলা হয়, সে নাকি ‘দীর্ঘদিন’ ধরে ইসলাম অবমাননা করে আসছে। প্রশ্ন জাগে—বাংলাদেশের মতো একটি দেশে, যেখানে একটি ফেসবুক পোস্টে এক কিশোরকে থানায় তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে কীভাবে কেউ বছরের পর বছর ইসলাম নিয়ে ‘অপমানজনক’ কথা বলে যেতে পারে? বাস্তবতা হলো, এ "দীর্ঘদিন" শব্দটা ছুতো—মব মানসিকতা তার শিকার ঠিক করে ফেলে, তারপর যুক্তির প্রয়োজন পড়ে না ।

বিগত দশমাসে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে একই রকম ঘটনা ঘটলেও বিভিন্ন মিডিয়ার মনগড়া প্রতিবেদনের কারণে প্রকৃত ঘটনা আড়ালে চলে গেছে। এসব ঘটনায় একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী আত্নহত্যা করেছে। কতৃপক্ষ কি গভীরভাবে তদন্ত করে দেখেছে যে ছেলেটির আসলে দোষ কতখানি? কেন সে আত্নহত্যা করতে বাধ্য হলো ? কারা তাকে বাধ্য করলো? কোন দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় নাই। এত এত ধর্ম অবমাননার অভিযোগ একবছরের মধ্যে খুব কম সময়ে শোনা বা দেখা গেছে। এতগুলো ধর্ম অবমাননার অভিযোগ কি সত্যিই ‘আকস্মিক’ বা ‘অজ্ঞতাবশত’? নাকি এই অভিযোগগুলো কাউকে নিশ্চিহ্ন করার মোক্ষম ফর্মুলা হয়ে উঠেছে ?

পাগলা কুকুরে কামড় দিয়েছে যে এতো মানুষ দলে দলে ‘ধর্ম অবমাননা’ করতে যাবে পরিণতি কি হতে পারে তা জেনেও ? যদি কেউ করে থাকে, তাহলে আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার হওয়ার কথা—তাকে ভয় দেখিয়ে আত্নহত্যা করানো কোনো ধর্মেই নেই। তাহলে প্রশ্ন থাকে—এই অভিযোগগুলোর পেছনে কারা আছে ? কারা এই ‘মব-যন্ত্র’ চালায়? কী তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক স্বার্থ ?

লালমনিরহাটের ঘটনার ঠিক পরেই মানিকগঞ্জে আরেকটি ভিডিও ভাইরাল হয়—একজন ব্যবসায়ীর দাড়ি ধরে টানাটানি ও মারধর করছে আরেকজন। এটি কি কাকতালীয়? নাকি সোশ্যাল মিডিয়ার মনোযোগ সরাতে ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকার’ অপচেষ্টা? ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব থাকতেই পারে, কিন্তু যখন একটি ধর্মীয় প্রতীকের অবমাননার ছবি ভাইরাল হয়, তখন তার ফলাফল মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে; বিশেষত যখন সমাজে মব সদা প্রস্তুত। রাষ্ট্র এসব বিষয়ে কী করছে ? দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রাষ্ট্র বরাবরই উদাসীন। নাগরিক নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব যাদের কাঁধে, তারা যদি কুম্ভকর্ণের ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে থাকলে এসব কারা দেখবে ?

এবারের মৌসুমে বাংলাদেশে যেন মব সংস্কৃতির বাম্পার ফলন হয়েছে। মানুষের জান-মাল, মান-সম্মান কোনোটিই নিরাপদ নয়। যে দেশে ‘জুলাই আন্দোলনে’ শহীদ নেতার কন্যাও ধর্ষণের শিকার হন, যে দেশে জুলাই আন্দোলনের সক্রিয় নারী কর্মীর লাশ ধর্ষণের পর নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়, সেখানে নিরাপত্তার উপদেষ্টা দাঁড়িয়ে বলেন, “এবার আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রোগ্রাম করতে পারেনি , ওরা দুর্বল হয়ে গেছে।” তিনি আম্লিক নামক ট্যাংকির ছেদা দেখতে পেলেও দেশ নামক মহা-ট্যাংকির ছেদা উহার চোখে পড়ছে বলে মনে হচ্ছে না।

বাংলাদেশ এখন একটি সামাজিক ও নৈতিক সংকটের সীমানায় দাঁড়িয়ে আছে। ‘ধর্ম অবমাননা’র মতো আবেগীয় ইস্যুগুলো যখন ন্যায়বিচারের পরিবর্তে উসকানি, প্রতিশোধ ও শত্রু নির্মাণের অস্ত্র হয়ে ওঠে, তখন রাষ্ট্রের মৌল কাঠামোই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই অস্ত্রের ঘায়ে আজ আর ধর্ম রক্ষা পাচ্ছে না, বরং হারিয়ে যাচ্ছে মানবতা, যুক্তি ও আইন।

১৮ টি +১/-০