নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

দরিদ্র দেশের জনসংখ্যা কে জনশক্তি তে পরিণত করতে হলে কর্মমুখী শিক্ষার বিকল্প নেই।

সৈয়দ কুতুব

নিজের অজ্ঞতা নিজের কাছে যতই ধরা পড়ছে প্রচলিত বিশ্বাসের প্রতি ততই অবিশ্বাস জন্মাছে!

সৈয়দ কুতুব › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রক্সি

২৮ শে জুন, ২০২৫ রাত ২:১৩


শিক্ষাব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে শিক্ষাবোর্ডগুলো যে কতটা সচেষ্ট, তা আমরা সবাই জানি। তেমনই এক মহৎ উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছে ভিজিল্যান্স টিম, যার কাজ হলো চলমান এইচএসসি পরীক্ষাগুলোতে কোনো ধরনের অসঙ্গতি হচ্ছে কিনা, তা কড়া নজরদারিতে রাখা। সম্প্রতি এমনই এক টিমের সঙ্গে আমিও যুক্ত হয়েছিলাম, আর সেই অভিজ্ঞতা এতটাই রোমাঞ্চকর ছিল যে, তা আপনাদের না বললেই নয়!

আমাদের টিমের প্রধান ছিলেন কাদের নওয়াজ স্যার, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক অত্যন্ত বিচক্ষণ মানুষ। মাইক্রোবাসে যখন সবাই জড়ো হলাম, স্যারের প্রথম বাক্যটিই ছিল ঐতিহাসিক: “আমি তো আপনাদের সবাইকে চিনি না। তাই অর্ডার দেখে দেখে নাম পড়ছি। আপনারা সাড়া দিয়েন।” ভাবুন একবার, সহকর্মীদের নামও যেখানে কাগজের টুকরো দেখে পড়তে হয়, সেখানে সততার কষ্টিপাথর দিয়ে পরীক্ষার্থীদের যাচাই করা: এ যেন এক মহাভারত !

যাই হোক, একে একে সবাই পরিচয় দিলেন। সবশেষে এলো এক তরুণ প্রভাষকের পালা। নাম, মো. রফিকুল ইসলাম। বয়স কম, দেখে মনে হলো সদ্য কলেজ গেট পেরিয়েছেন। স্যার বেশ কৌতুক করে বললেন, “নতুন চাকরি বুঝি? বয়স একেবারে কম মনে হচ্ছে!” রফিকুল সাহেব বিনয়ের সঙ্গে জানালেন, “জি স্যার। দুমাস হলো জয়েন করেছি।” বাহ! তরতাজা নতুন রক্ত, আশা জাগানিয়া!

টিম লিডার হিসেবে কাদের নওয়াজ স্যার আমাদের কিছু গুরুগম্ভীর উপদেশ দিলেন। মূল কথা হলো, আমরা বোর্ড-প্রতিনিধি, তাই কোনো খারাপ ব্যবহার চলবে না। কোনো অনিয়ম দেখলে কেন্দ্র সচিবকে জানাতে হবে, আর গুরুতর কিছু হলে স্যার নিজেই নাকি রিপোর্ট করবেন। সবাই ‘জি স্যার’ বলে সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো। আমার মনে হলো, আমরা বোধহয় এবার সত্যিই কিছু একটা করে ফেলবো!

প্রথম পরীক্ষাকেন্দ্রে ঢুকেই রফিকুল সাহেব একটি কক্ষে প্রবেশ করলেন। ঢুকেই তার চক্ষু চড়কগাছ! পরীক্ষার্থীরা একে অন্যের খাতা দেখাদেখি করছে, যেন এক সম্মিলিত মেধা-বিনিময় অনুষ্ঠান চলছে! রফিকুল সাহেব একজন ছাত্রকে মোলায়েমভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “এই ছেলে, তুমি ওর সঙ্গে কথা বলছ কেন?” ছেলেটি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিল, “স্যার, আমি কথা বলছিলাম না। রাবার চাইছিলাম ওর কাছে।”

রফিকুল সাহেব অবাক ! “রাবার ? আজ তো অঙ্ক পরীক্ষাই না।”ছাত্রটি আরও এক ধাপ এগিয়ে, “স্যার, আমি উত্তরগুলো প্রথমে পেনসিলে লিখেছিলাম। সেগুলো আন্দাজে লিখেছিলাম। এখন ওর খাতা দেখে দেখে সঠিক উত্তর লেখার জন্য রাবার প্রয়োজন।”

কী বলবেন বলুন! এই আত্মবিশ্বাস দেখে আমি মুগ্ধ! এরপর রফিকুল সাহেব রুম পরিদর্শককে ধরলেন, “আপনি দেখছেন না সবাই দেখাদেখি করে লিখছে!” পরিদর্শকের জবাবটি তো আরও ক্লাসিক, “দেখেছি স্যার। ওদের লেখাপড়ার যা অবস্থা, দেখাদেখি করে লিখলেও পাস করতে পারবে না!”

যেন তিনি দয়া করে খাতা দেখাদেখির সুযোগ দিয়েও তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছেন! রফিকুল সাহেব যখন প্রক্সি পরীক্ষার্থীর বিষয় তুললেন, তখন এক ছাত্র হেসে বললো, “স্যার, উনি কি প্রক্সি পরীক্ষার্থী ধরবেন ! উনি নিজেই তো আরেকজনের হয়ে প্রক্সি ডিউটি দিচ্ছেন!” গোটা পরীক্ষা হল হাসিতে ফেটে পড়লো! বুঝলেন তো, এই হলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরের চিত্র !

রফিকুল সাহেব ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে কন্ট্রোলরুমে গেলেন। সেখানে মাত্র একজন লোক বসে। "আমি বোর্ড থেকে এসেছি। এই পরীক্ষার কনভেনর কে?" লোকটা শান্তভাবে জানাল, "কনভেনর হলেন সিনিয়র শিক্ষক মো. আবু রেজা।"তিনি কোথায়?" রফিকুল সাহেব রীতিমতো গর্জে উঠলেন, "২০২ নম্বর রুমে কক্ষ পরিদর্শকের বদলে আরেকজন প্রক্সি ডিউটি দিচ্ছে। এটা কি ঠিক হচ্ছে?"

এবার এলো সেই মহাকাব্যিক উত্তর, "স্যার ওই রুমে যে ডিউটি দিচ্ছিলেন, তার স্ত্রী হাসপাতালে ভর্তি। তাই তিনি প্রক্সি হিসেবে আরেকজনকে রেখে গেছেন। অসুবিধা নেই স্যার। তিনি আমাকে বলেই হাসপাতালে গেছেন।"

রফিকুল সাহেব স্তম্ভিত। "আপনি কে?" লোকটি বিনয়ের সাথে উত্তর দিলেন, "স্যার, আমি কনভেনর স্যারের প্রক্সি দিচ্ছি। তিনি বাজারে গেছেন। আজ তার মেয়ে জামাই আসবে তো। বাজার করে দিয়েই ফিরে আসবেন।"

রফিকুল সাহেব এরপর সোজা প্রধান শিক্ষকের কক্ষে। ভাবলেন, অন্তত এখানে বোধহয় আসল লোকটিকে পাওয়া যাবে। ঢুকেই প্রশ্ন করলেন, "এখানে প্রধান শিক্ষক কে? আমি বোর্ড থেকে এসেছি পরীক্ষার ভিজিলেন্সের কাজে।"

ভেতর থেকে উত্তর এলো, "জি বলুন।"
রফিকুল সাহেব সব ঘটনা খুলে বললেন। আর প্রধান শিক্ষকের উত্তর? "জি স্যার। আমি ওদের চিনি। ওরা বেশ ভালো মানুষ। সত্যি কথাই বলেছে। সত্যি সত্যিই ওরা প্রক্সি দিচ্ছে।"

রফিকুল সাহেব এবার ব্যঙ্গ করলেন, "আমার তো সন্দেহ হচ্ছে আপনিও বুঝি এখানকার হেডমাস্টার নন।"
আর ভদ্রলোকও নির্লিপ্তভাবে স্বীকার করলেন, "জি স্যার, ঠিক ধরেছেন। হেডস্যার ডায়াবেটিসের রোগী। ডাক্তার বলেছেন দিনে এক ঘণ্টা হাঁটতে। উনি তাই হাঁটতে বেরিয়েছেন। আসলে আমি এই স্কুলের হেড ক্লার্ক।"

অবশেষে রফিকুল সাহেব বিষণ্ন মনে মাইক্রোবাসের কাছে ফিরে এলেন। কাদের নওয়াজ স্যার একপাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলেন। রফিকুল সাহেব তাকে পুরো ঘটনা খুলে বললেন। আর কাদের নওয়াজ স্যারের মন্তব্যটি ছিল এই গল্পের চরমতম স্যাটায়ার: "প্রক্সির এই দুনিয়ায় কে যে কার প্রক্সি দিচ্ছে বোঝা দায়। এই আপনিই যে রফিকুল হিসেবে কারও প্রক্সি দিচ্ছেন না তার কী নিশ্চয়তা? আপনার গায়ে তো আর নাম লেখা নেই।"

এবং তখনই ঘটলো শেষ চমক! রফিকুল সাহেব কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, "স...সরি স্যার। আপনাকে আমার আগেই বলা উচিত ছিল। মো. রফিকুল ইসলাম আসলে আমার বড় ভাই। তিনি একটা ট্রেনিংয়ে গেছেন। বললেন তুই আমার হয়ে প্রক্সি ভিজিলেন্স দিয়ে আয়।"

টিম লিডার কাদের নওয়াজ স্যার (যিনি নিজেও সম্ভবত কারোর প্রক্সি হিসেবেই এসেছিলেন) একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বাদ দেন। পরীক্ষা ঠিকমতো হচ্ছে কি না সেটাই বড় কথা। প্রক্সি আগেও ছিল। বর্তমানেও আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। চলুন অন্য পরীক্ষা কেন্দ্রে যাই।”

তারপর মাইক্রোবাসে উঠলেন কাদের নওয়াজ। পকেট থেকে মোবাইল বের করে মেসেজ লিখলেন, "কাদের, আমি তোর প্রক্সি হিসেবে এসেছি—কেউ বুঝতে পারেনি। চিন্তা করিস না।"

এই হলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার এক টুকরো চিত্র। যেখানে পরীক্ষার্থীরা নকল করে, পরিদর্শক প্রক্সি ডিউটি দেন, কনভেনর বাজার করতে যান, প্রধান শিক্ষক হাঁটতে যান, আর ভিজিল্যান্স টিমের সদস্যরাও একে অপরের প্রক্সি হিসেবে কাজ করেন! ভাবুন একবার, এই ব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে আমরা কেমন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বপ্ন দেখছি?


# collected


---

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে জুন, ২০২৫ রাত ৩:২৫

এইচ এন নার্গিস বলেছেন: ভালো লিখেছেন ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.