![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নিজের অজ্ঞতা নিজের কাছে যতই ধরা পড়ছে প্রচলিত বিশ্বাসের প্রতি ততই অবিশ্বাস জন্মাছে!
ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে যখন কলেজে পা রাখলাম, দু'চোখ ভরা ছিল হাজারো স্বপ্ন। নতুন বন্ধু, নতুন শিক্ষক, নতুন পরিবেশ: সবকিছুই ছিল রোমাঞ্চকর। কলেজ লাইফ যেহেতু ব্যস্ত এবং সংক্ষিপ্ত, তাই সবার সম্পর্কে গভীরভাবে জানা সম্ভব হয় না। কিন্তু কিছু মানুষ এমনভাবে আপনার জীবনে প্রভাব ফেলে যে তাদের ভুলে যাওয়া অসম্ভব। কামাল স্যার ছিলেন ঠিক এমনই একজন শিক্ষক। ফিজিক্স সেকেন্ড পেপার পড়াতেন তিনি। প্রথম দিকে কামাল স্যারকে আমি প্রচণ্ড অপছন্দ করতাম। কারণ ? তিনি ক্লাসে শুধু আমাকেই পড়া ধরতেন। সবার সামনে আমার দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে যেত, যা মোটেও ভালো লাগত না।
স্যার যত প্রশ্ন করতেন, তার মধ্যে জ্যামিতি থাকতই। আর আমার দুর্বলতা ছিল ঠিক এই জ্যামিতিতে, বিশেষত উপপাদ্যে। স্কুল লাইফে কিছুটা ফাঁকি আর শিক্ষকদের অবহেলায় উপপাদ্য নিয়ে আমার বেশ সমস্যা ছিল। যদিও সম্পাদ্য দিয়ে সেটা কাভার করে এসেছিলাম। কিন্তু কলেজে উঠার পর কামাল স্যার ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে আমাকে সেই জ্যামিতিতেই নিয়ে যেতেন, যা আমার জন্য অস্বস্তিকর ছিল।
স্যারের সাথে আমার প্রথম কনফ্লিক্ট হয় ফিজিক্স ল্যাবে। ফিজিক্সের ল্যাব টিচার ছিলেন থার্ড ক্লাস একজন লোক। তিনি কখনও সঠিকভাবে কাউকে কিছু বুঝাতেন না। তাঁর মনে হতো যে বেতন পান সেটা অনেক কম। কোনো স্টুডেন্ট তাঁর কাছে ব্যাচ পড়তে চাইত না। স্কুল লেভেলে আমাদের শিক্ষকরা ভালোভাবে ল্যাব ক্লাস নিতেন না। কেমিস্ট্রি ল্যাব ছিল আমার প্রচণ্ড পছন্দের জায়গা। ল্যাব ক্লাসে আমি সবসময় উপস্থিত থাকতাম। এখন ফিজিক্স ল্যাব ক্লাসে স্যারকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই তিনি শুনিয়ে দিতেন; "ভালো করতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটে পড়। তোমাদের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়া ছাড়া গতি নেই। তোমরা কিছুই পারো না।" তিনি নিজেও ন্যাশনাল থেকে পাস করা।
একদিন আমি ফিজিক্সের মূল শিক্ষক কামাল স্যারকে দেখে বোকার মতো ল্যাব টিচারের নামে কিছু কথা বলে ফেলি, যা সঠিক ছিল না। ফিজিক্স ল্যাব স্যার চরম অপমান বোধ করেন। সেদিন থেকে আমি কামাল স্যারের নজরে পড়ে যাই। স্যার ক্লাসে কাউকে পড়া না ধরলেও আমাকে ধরতেন। মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয় যখন তিনি আমার গাইড টিচার হন। এবার আমার মার্কশিট এবং অ্যাটেনডেন্স দেখার সুযোগ তাঁর হাতে চলে আসে। চলতে থাকে আমার উপর জ্যামিতির চাবুক। আমি বাধ্য হয়ে ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত সকল উপপাদ্য নিয়ে আবার পড়া শুরু করি। ইউটিউব দেখে দেখে কিছুটা ইমপ্রুভ করার চেষ্টা করি। কিন্তু স্যারের হাত থেকে মুক্তি নেই।
পরে ভাবলাম, স্যার বুঝি প্রাইভেট ব্যাচে যাওয়ার জন্য এমন করছেন। এক বন্ধুর সাথে স্যারের ব্যাচে গেলাম। স্যার কেবল বললেন, "এসো।" এরপর আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। ব্যাচে আমার পড়া তিনি ধরতেন না, কিন্তু কলেজে আমাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতেন । কামাল স্যার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিক্সে গ্র্যাজুয়েশন এবং পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। আবার বুয়েট থেকেও ডিগ্রি নিয়েছেন। স্যারকে নিয়ে তাঁর বাবার মনেও দুঃখ ছিল: তিনি বিসিএস দিলেন না তাই।
আমার সাথে একই বেঞ্চে বসত এক ছেলে , শুভ। একদিন শুনি তার নাকি ক্যান্সার ধরা পড়েছে । ছেলেটার স্বপ্ন ছিল গেইম ডেভেলপার হবে। সারাদিন তার মুখে কেবল গেইমের গল্প। আমরা তার গেইম সেন্স দেখে অবাক হয়ে যেতাম। সেই ছেলেটার ক্যান্সার আক্রান্ত শুনে আমি প্রচণ্ড ভয় পাই। চিন্তা করে দেখুন, আপনার একজন সহপাঠি যে আপনার সাথে একই বেঞ্চে বসত, কিন্তু কয়দিন পর সে আর বসবে না; এমনটা ভাবতেই কেমন লাগে। আমার রাতে ভয়ে ঘুম হতো না। শুভকে দেখতে আমরা মিরপুর বারো গিয়েছিলাম তার বাসায়। শুভর বাবা নেই। মা আর বড় ভাই আছে। বড় ভাই উত্তরা ব্যাংকে চাকরি করত। শুভর কন্ডিশন দেখে আমরা চমকে উঠি। নিষ্ঠুর ক্যান্সারের সাথে আমাদের বন্ধু যেন লড়াই করে হাঁপিয়ে গেছে। এই দৃশ্য দেখে আমার চোখে পানি চলে এলো।
একদিন যথারীতি কামাল স্যারের ব্যাচে প্রাইভেট ক্লাস করছিলাম। প্রায় ২০-২৫ জনের মতো একটা রুমে ক্লাস করতাম। বেশ বড় রুম ভাড়া করেছিলেন স্যার। সবাই তাঁর কাছে পড়তে চাইত কারণ তিনি আধুনিক জ্ঞান সম্পন্ন শিক্ষক ছিলেন। স্যার সবাইকে বললেন, "আগামীকাল তোমরা সবাই এই মাসের বেতন নিয়ে আসবা।" আমরা খুব অবাক হই। স্যার কখনও এমনভাবে বলতেন না। কেউ কেউ তাঁর বেতন মাসের বিশ তারিখে দিত। স্যার কিছু বলতেন না। একজন স্যারকে জিজ্ঞেস করে, "স্যার, আপনার কি কোনো সমস্যা?" স্যার বললেন, "না, আমার কোনো সমস্যা না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি শুভকে সাহায্য করব।" আমরা আরো অবাক হয়ে যাই। আরেকজন বলে উঠে, "কিন্তু স্যার, আমরা চাইলে স্কুলে টাকা উঠিয়ে দিতে পারি শুভর ট্রিটমেন্টের জন্য।"
স্যার রিপ্লাই করেন, "ক্যান্সারের ট্রিটমেন্ট ব্যয়বহুল। তোমাদের ১০/২০/৫০/১০০ টাকায় কিছু হবে না। তাছাড়া তোমরা আমাকে বেতন দিচ্ছ, আমি কারো কাছে চ্যারিটি চাই না। কেবল সবাই একদিনে বেতন দেবার চেষ্টা করবা।" মাসও শেষ হয়ে এসেছিল বলে ১৮-১৯ জন স্যারকে একদিনে বেতন দেয়। স্যার আমাদের বলে, "চাইলে আমার সাথে শুভর বাসায় যেতে পারো তোমরা।" কিন্তু পাচ জনের বেশি কেউ যেতে রাজি হলো না। এদের মধ্যে আমিও ছিলাম। আমি শুভর বাসা চেনায় বাকিদের গাইড করে নিয়ে গেলাম ।
আমার মাথায় কেবল একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল: ক্যান্সারের ট্রিটমেন্ট করাতে কত টাকা লাগে? স্যারকে দেখে শুভর পরিবারের সবাই খুব অবাক হয়। শুভর অবস্থা ভালো না। কেমোথেরাপি দিতে দিতে মাথার চুল নেই। স্যার যখন টাকা দিতে চাইলেন, শুভর ভাই নিতে চাচ্ছিলেন না। স্যার বললেন, "আমার কাছে যারা প্রাইভেট পড়ে, সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা শুভকে সাহায্য করবে। তাদের সরল মনে এভাবে আঘাত করা উচিত না।" শুভর ভাই টাকাটা নেয়।
আমাদের বন্ধু শুভকে বাঁচানো গেল না। তবে সেদিন আমি এক মহান হৃদয়ের মানুষের সন্ধান পেয়েছিলাম, যিনি উপর থেকে দেখতে খুবই কঠোর, কিন্তু ভেতরে একজন বড় মনের মানুষ। স্যারের কথা আমার আজও মনে পড়ে। এটা খুব বিরল ঘটনা যে কেউ তাঁর প্রাইভেট পড়ানোর এক মাসের টাকা পুরোটাই একজনের ট্রিটমেন্টের জন্য দিয়ে দিলেন। এই ভালো মানুষগুলোর জন্যই এখনও পৃথিবী সুন্দর। তবে শুভ মারা যাওয়ার ট্রমা যতদিন কলেজে ছিলাম, আমাদের সাথে ছিল। আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবসে কামাল স্যারের মতো শিক্ষকদের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। যিনি শুধু পড়াননি, জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা দিয়েছেন: মানবিকতার শিক্ষা।
০৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:২৯
সৈয়দ কুতুব বলেছেন: দেশে এরকম মানুষ আছেন জেনেই ভালো লাগে ।
২| ০৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:২১
কামাল১৮ বলেছেন: আমরা যখন স্কুল কলেজে পড়ি বিজ্ঞান ও অংকের বেশির ভাগ শিক্ষক ছিলো হিন্দু।
০৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:২৮
সৈয়দ কুতুব বলেছেন: কলেজে ইংরেজি এবং বাংলার টিচার সনাতন ছিলো। ইংরেজি টিচার আপনার মানসিকতার ছিলো।
৩| ০৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৩০
জেনারেশন একাত্তর বলেছেন:
এঁদের শতকরা হার কতজন হতে পারে?
০৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৩৩
সৈয়দ কুতুব বলেছেন: কলেজে একজনকেই পেয়েছিলাম; শতকরা ২০ ভাগ মানুষ আছেন মনে হয় এমন ।
৪| ০৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৮
জেনারেশন একাত্তর বলেছেন:
সামনের দিনগুলোতে এদের সংখ্যা বাড়বে, নাকি কমবে?
০৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৮:০৮
সৈয়দ কুতুব বলেছেন: সামনের দিনে এসব মানুষ কে দেখতে জাদুঘরে যেতে হবে ।
৫| ০৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৮:১৪
এইচ এন নার্গিস বলেছেন: কামাল স্যার কে শ্রদ্ধা জানায় ।
০৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৮:১৮
সৈয়দ কুতুব বলেছেন: ধন্যবাদ ।
৬| ০৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৮:৩৬
মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্ বলেছেন: শ্রদ্ধা কামাল স্যারকে।
০৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৯:০৭
সৈয়দ কুতুব বলেছেন: ধন্যবাদ ।
৭| ০৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৮:৫০
মাথা পাগলা বলেছেন: বিনম্র শ্রদ্ধা।
০৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৯:০৭
সৈয়দ কুতুব বলেছেন: ধন্যবাদ ।
৮| ০৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৯:০৯
রূপক বিধৌত সাধু বলেছেন: দুঃখজনক ব্যাপার হলো আমি এমন ভালো শিক্ষক একজনও পাইনি। মোটামুটি ভালো একজন প্রাইভেট শিক্ষক পেয়েছিলাম। শিক্ষকতায় আমার আগ্রহ ছিল না। তবে দীর্ঘসময় বিভিন্ন বেসরকারি স্কুলে পড়াতে হয়েছে পেটের তাগিদে। সেসব প্রতিষ্ঠানে উপর্যুক্ত শিক্ষকের মতো হওয়ার চেষ্টা করেছি। মিশুক হওয়ায় শিক্ষার্থীরা আমাকে পছন্দও করেছে। তবে অর্থকষ্ট পিছু ছাড়েনি।
ইংলিশ পড়িয়েছি অথচ আমার অনার্স-মাস্টার্সে সাব্জেক্ট ছিল এইচআরএম। এই সাবজেক্টে পড়া কাউকে তো রাজধানীর কোনো স্কুলে নেবে না। ইংলিশে বা বাংলায় অনার্স করে সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে ঢুকতে পারলে হয়তো মানসিক অস্বস্তিটা থাকত না।
০৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৯:১৭
সৈয়দ কুতুব বলেছেন: আমি কেবল একজনকেই পেয়েছিলাম। সবাইকে বাহিরে থেকে বুঝা যায় না । আমিও কামাল স্যারকে শুরুতে বুঝতে পারে নি । উনার শিক্ষা আমাকে ইনসপায়ার করেছে ।
টিচার দের আসল কাজ শিক্ষাদান করা । কিনতু আমাদের টিচারদের বেশিরভাগ মনে করেন তাদের কাজ কেবল হাজিরা নেওয়া । আপনি তাদের থেকে আলাদা ছিলেন দেখেই শিক্ষার্থীরা আপনাকে পছন্দও করেছে।
৯| ০৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১০:৩০
জেনারেশন একাত্তর বলেছেন:
আমার জীবনে আমি ১টি খারাপ শিক্ষক পেয়েছিলাম আমেরিকায়; পড়ালেখায় ভালো ছিলো; সে ভারতের ছাত্রছাত্রীদের খুব একটা সহ্য করতো না।
০৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১০:৩৬
সৈয়দ কুতুব বলেছেন: খারাপ শিক্ষক বেশ কয়েকজনকে পেয়েছি । তবে ভালো শিক্ষক একজনকেই পেয়েছিলাম।
১০| ০৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১১:৩৪
জেনারেশন একাত্তর বলেছেন:
এই ব্লগে অনেক শিক্ষক ছিলো এক সময়ে, ইউনিভার্সিটি প্রফেরসরও ছিলেন; আমার সাথে অনেকের মন্তব্য বিনিয়ময় হতো; এখন এরা আর আসে না।
০৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১১:৩৮
সৈয়দ কুতুব বলেছেন: ঠিকই আপনার লেখা তারা চুপিসারে পড়ে যান। হয়তো সময় পান না নিজেরা লিখার কিংবা ইছছা নেই ।
১১| ০৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১১:৪১
সন্ধ্যা রাতের ঝিঁঝিঁ বলেছেন: আমার মনে হয় আমি ভালো শিক্ষক কয়েকজন পেয়েছি। তবে হাইস্কুলে একজন ও পাইনি, জঘন্য ছিল। স্কুলে প্রাইভেট না পড়লে যা তা শুনাতো। প্রাইমারি স্কুল আর কলেজে অনেকের স্নেহ পেয়েছি। প্রাইমারী স্কুলের হেড স্যার ছিলেন আজীবন শিক্ষক, এই মানুষটার কোনো তুলনা হয় না।
০৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১১:৪৮
সৈয়দ কুতুব বলেছেন: জেনে ভালো লাগলো আপনিও ভালো শিক্ষকদের সান্নিধ্য পেয়েছেন। একজন ভালো শিক্ষক জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ । এখন বেশিরভাগ শিক্ষক কেবল ডিউটি পালন করছে ।
©somewhere in net ltd.
১|
০৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:১১
বিজন রয় বলেছেন: কামাল স্যারকে শ্রদ্ধাঞ্জলি।