নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

দরিদ্র দেশের জনসংখ্যা কে জনশক্তি তে পরিণত করতে হলে কর্মমুখী শিক্ষার বিকল্প নেই।

সৈয়দ কুতুব

নিজের অজ্ঞতা নিজের কাছে যতই ধরা পড়ছে প্রচলিত বিশ্বাসের প্রতি ততই অবিশ্বাস জন্মাছে!

সৈয়দ কুতুব › বিস্তারিত পোস্টঃ

নরসিংদী ভূমিকম্প: মধুপুর ফল্ট ও ঢাকার ঝুঁকি

২১ শে নভেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫২


২০২৫ সালের ২১ নভেম্বর শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ঢাকাসহ সারাদেশে একটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫.৭ এবং স্থায়িত্ব ছিল ২৬ সেকেন্ড। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা USGS এর হিসাবে মাত্রা ছিল ৫.৫। তবে দুই সংস্থাই একমত যে এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদী — আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে মাধবদী, আর USGS বলছে ঘোড়াশাল।

এই ভূমিকম্পের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর উৎপত্তিস্থল। সাধারণত বাংলাদেশে যেসব ভূমিকম্প অনুভূত হয় সেগুলোর epicenter থাকে সিলেট, চট্টগ্রাম, মিয়ানমার বা ভারতের দূরবর্তী অঞ্চলে। কিন্তু এবার epicenter ঢাকা থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার দূরে। এটাই এই ভূমিকম্পকে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।

নরসিংদী এলাকায় এই মাত্রার ভূমিকম্প এর আগে হয়নি বললেই চলে। বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী গত ১০০ বছরে এই এলাকায় সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প ছিল মাত্র ৪.৩ মাত্রার, যেটা এই বছরের এপ্রিলে হয়েছিল। তাহলে আজকের ৫.৫-৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প নরসিংদী এলাকায় গত এক শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী।

এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল গাজীপুরের একটি ভূচ্যুতির উপর, যা টঙ্গী থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। এই ভূচ্যুতি আসলে মধুপুর ফল্ট সিস্টেমের পূর্ব অংশ। মধুপুর ফল্ট কোনো একক রেখা নয়, বরং এটি একটি জোন বা সিস্টেম যা টাঙ্গাইল থেকে গাজীপুর হয়ে নরসিংদী পর্যন্ত বিস্তৃত।

বাংলাদেশে মোট ১৩টি ভূমিকম্প-প্রবণ ফল্ট লাইন রয়েছে। এর মধ্যে মধুপুর ফল্ট, ডাউকি ফল্ট এবং প্লেট বাউন্ডারি ফল্ট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত — ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং বার্মা প্লেট। ভারতীয় প্লেট প্রতি বছর প্রায় ৬ সেন্টিমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে সরে যাচ্ছে, যা এই অঞ্চলে ক্রমাগত চাপ তৈরি করছে।

মধুপুর ফল্ট নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা দরকার। এই ফল্ট প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ঢাকা থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে। এটি একটি blind fault — অর্থাৎ মাটির নিচে লুকানো, সরাসরি দেখা যায় না। ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল ভূমিকম্প, যার মাত্রা ছিল ৬.৯ এবং epicenter ছিল মানিকগঞ্জে, এই ফল্ট থেকে হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। মধুপুর ট্র্যাক্টের পশ্চিম প্রান্তে তাজা en-echelon fault scarp আছে যা recent tectonism এর প্রমাণ বহন করে এবং দক্ষিণ প্রান্তে ৯ মিটার throw পরিমাপ করা হয়েছে।

এই অঞ্চলে ঐতিহাসিকভাবে বেশ কয়েকটি বড় ভূমিকম্প হয়েছে। ১৬৬৪ সালের ঢাকা ভূমিকম্প, যার মাত্রা ছিল প্রায় ৬.৫, ঢাকার উত্তরে কেন্দ্রীভূত ছিল এবং মুঘল আমলের অনেক ভবন ধসে পড়েছিল। ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৬.৯। ১৯৫০ সালে ময়মনসিংহ অঞ্চলে একটি ভূমিকম্প হয়েছিল যার ফলে ব্রহ্মপুত্র নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে। এছাড়াও ১৭৬২ সালের চট্টগ্রাম-আরাকান ভূমিকম্প ছিল ৮.৮ মাত্রার, ১৮৯৭ সালের আসাম ভূমিকম্প ছিল ৮.৭ মাত্রার।

রাজউকের গবেষণা অনুযায়ী, মধুপুর ফল্টে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার ৪০% থেকে ৬৫% ভবন ধসে পড়তে পারে। সময়ভেদে প্রাণহানির সংখ্যা ব্যাপক হতে পারে — ভোরে হলে ২.১ থেকে ৩.১ লাখ, দুপুরে ২.৭ থেকে ৪ লাখ এবং রাতে হলে ৩.২ থেকে ৫ লাখ মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। অবকাঠামোর দিক থেকে ঢাকার ৪৯.৬% প্রধান সড়ক, ৫৯.৪% নগর সড়ক, ৯৬.২২% প্রধান সেতু এবং ৯৬.৭৯% নগর সেতু ধসে পড়তে পারে। Earthquake disaster risk index অনুযায়ী ঢাকা বিশ্বের ২০টি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শহরের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে।

তবে এই পূর্বাভাস নিয়ে কিছু অনিশ্চয়তা আছে। মধুপুর ফল্ট যেহেতু একটি blind fault, তাই এর সঠিক অবস্থান, দৈর্ঘ্য এবং সক্রিয়তা নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ৬.৯ বা ৭.৫ মাত্রার পূর্বাভাস অনেকটা worst-case scenario। তবে ঝুঁকি যে শূন্য না — আজকের ভূমিকম্প সেটাই প্রমাণ করেছে।

আজকের ভূমিকম্পে কিছু stress release হয়েছে — এটা সত্য। কেউ কেউ মনে করতে পারেন এটাই এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ মাত্রা এবং এর বেশি হবে না। নরসিংদী অংশে গত ১০০ বছরের ইতিহাস সেটাই বলে। তবে বিজ্ঞান এখনো ভূমিকম্প predict করতে পারে না। দুটি সম্ভাবনা সবসময় থাকে — হয় এটাই ছিল main event এবং stress release হয়ে গেছে, অথবা এটা ছিল foreshock এবং বড় ভূমিকম্প আসতে পারে। কোনটা হবে আগে থেকে বলা প্রায় অসম্ভব।

আগামী কয়েকদিন aftershock হতে পারে। সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী main event এর চেয়ে সবচেয়ে বড় aftershock ১.০-১.২ মাত্রা কম হয়। তাহলে আজকের ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের পর সর্বোচ্চ ৪.৫-৪.৭ মাত্রার aftershock হতে পারে। প্রথম ২৪-৭২ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি aftershock হয় এবং বেশিরভাগই ছোট হয় যা অনুভব নাও করা যেতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশ অঞ্চলের প্লেটে ৮+ মাত্রার ভূমিকম্পের সমান energy জমা হয়েছে এবং এই energy যেকোনো সময় release হতে পারে। এই তথ্য উদ্বেগজনক হলেও আতঙ্কিত না হয়ে প্রস্তুতি নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। ভবনের কলাম, বিম, দেয়ালে ফাটল আছে কিনা পরীক্ষা করা, ইমার্জেন্সি ব্যাগ রেডি রাখা, পরিবারের সবাইকে ভূমিকম্পে করণীয় সম্পর্কে জানিয়ে রাখা — এগুলো এখনই করা উচিত।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.