নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মানুষ মরে গেলে পঁচে যায় আর বেঁচে থাকলে বদলায়

সৈয়দ কুতুব

নিজের অজ্ঞতা নিজের কাছে যতই ধরা পড়ছে প্রচলিত বিশ্বাসের প্রতি ততই অবিশ্বাস জন্মাছে!

সৈয়দ কুতুব › বিস্তারিত পোস্টঃ

মৌলবাদি মোদির রাজত্বে সংখ্যালঘু সমাজ কেমন আছে ?

২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৪৫


যখন ব্লগটি লিখতে বসেছি তখন বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে টান টান উত্তেজনা চলছে। বাংলাদেশে ভারতীয় হাই-কমিশনার কার্যালয় ঘিরে তুমুল আন্দোলন হওয়ার প্রতিবাদে ভারতীয়রা দিল্লী, কলকাতায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার কার্যালয়ে তীব্র আন্দোলন হচ্ছে। যারা আন্দোলন করছেন বাংলাদেশ-ভারতের হয়ে তাদের কিন্তু উদ্দেশ্য ভিন্ন। বাংলাদেশে যারা ভারতীয় হাইকমিশনার কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছিল তারা ডানপন্থি মুসলিম তরুণ নেতা ওসমান গণি হাদির খুনীকে ভারতে আশ্রয় দেয়ার অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ করেছে। আবার ভারতে যারা আন্দোলন করছে এরা ময়মনসিংহের ভালুকায় একজন সনাতনী শ্রমিক দিপু দাস কে ধর্ম অবমাননার ভুয়া অভিযোগ তুলে হত্যা করেছে; এরপর তার লাশে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। যাই হোক এদিকে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মূল প্রসঙ্গে আলোকপাত করা যাক।

ভারতের বিহারে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকদের সার্টিফিকেট প্রদান অনুষ্ঠানে গত ১৬ই ডিসেম্বর ঘটে গিয়েছে একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার একজন মেয়ে চিকিৎসককে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। মুসলমান মেয়েটি তার ধর্মীয় বিধান অনুসারে পোশাক পড়ে স্টেজে উঠে যখন সার্টিফিকেট নিতে যাবে তখন নিতীশ কুমার মেয়েটির মুখের নেকাব নিজ হাতে টেনে সরিয়ে দেন! যারা মেয়েটির আশেপাশে ছিলো তারা নিতীশ কুমারকে বাধা দিয়ে ব্যর্থ হন। আবার কতিপয় গান্ডু এই ঘটনায় হেসে ফেলেন। মেয়েটি তীব্র অপমান বোধ করে। এই ঘটনা পরে ভাইরাল হলে মেয়েটি সিদ্ধান্ত নেয় সে চাকুরিতে যোগদান করবে না। নিতীশ কুমারের কি বুড়া বয়সে ভীমরতি দেখা দিয়েছে?

নিতীশ কুমারের অতীত রাজনীতির দিকে তাকালে দেখা যায় নারীদের উন্নয়নের জন্য তিনি বেশ গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন। নারী শিক্ষার অগ্রগতির জন্য তিনি মেয়ে শিশুদের সাইকেল দিয়েছিলেন; এতে বিহারে নারী শিক্ষার হার বেড়ে গিয়েছে। বিহারের সরকার এই বছর নারীদের জন্য স্বল্প মেয়াদে মুখ্যমন্ত্রী মহিলা রোজগার যোজনা, জীবিকা প্রকল্প, মদের উপর নিষেধাজ্ঞা, সরকারি চাকুরিতে ৩৫ শতাংশ মহিলা আসন সংরক্ষণ, বিধবা ও বয়স্কদের ভাতা বৃদ্ধি সহ নানারকম পদক্ষেপ নিয়েছেন। এতে সকল জাতের নারীরা উপকৃত হয়েছেন বলে ধরে নেয়া যায়। যদি মুসলিম সমাজের জন্য কি কি পদক্ষেপ নিয়েছেন সেটা দেখি তাহলে যা জানা যায় সংখ্যালঘুদের জন্য বাজেট বাড়ানো, কবরস্থানে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, ভাগলপুর দাঙ্গায় মুসলিমদের ক্ষতিপূরণ দেয়া, মুসলিম সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের উৎসাহ ভাতা প্রদান, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হ্রাস, তালাক প্রাপ্ত নারীদের ভাতা সহ কিছু ইতিবাচক কাজ রয়েছে। তবে তালাক প্রাপ্ত নারীদের মধ্যে মাত্র ৭৪৫ জন এই ভাতা পেয়েছেন যা একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন রেখে যায়। প্রশ্ন উঠে, তাহলে একজন মুসলিম নারীর সাথে নিতীশ কুমারের এমন আচরণ কেন?

বিজেপি অনেকদিন ধরেই মুসলিম নারীদের হিজাব-নেকাব, পুরুষদের দাঁড়ি টুপি নিয়ে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার জনতা দল ইউনাইটেড চালান। ইহা এখন বিজেপি মোর্চার অংশ। আচার-আচরণ যে বিজেপির মতো হয়ে যাচ্ছে ইহা কোনো অবাক করার বিষয় নয়। তাই মুসলিম নারীর কাপড় ধরে টান মারা যৌন হয়রানি হিসাবে মুখ্যমন্ত্রীর মনেই হয়নি। উনার নিকট মেয়েটি কন্যার মতো তাই হয়তো মনে করেছেন বাপের আবার মেয়ের মুখ দেখতে কিসের বাধা? কিন্তু তিনি একবারও চিন্তা করেননি অন্য ধর্মের অনুভূতিতে এটা কি ধরণের আঘাত করতে পারে ! জন্মদাতা পিতা বাদে কেউই আসলে বাবার মতো হয় না ।

যদি উক্ত অনুষ্ঠানে নেকাব করে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে যাওয়া নিষেধ ছিলো তবে সেটা অনুষ্ঠানের পূর্বে বলে দেয়া যেত। যদি স্টেজে একান্তই মেয়ের মুখ দেখার ইচ্ছা বাবার হতো তবে মেয়েটিকে অনুরোধ করা যেত। একজন নারীও পারবেন না ভরা মজলিসে অপর নারীর নেকাব টেনে মুখ দেখতে! আর পুরুষের ক্ষেত্রে এটা পুরোপুরি যৌন হয়রানি হিসাবে বিবেচিত হবে। কিন্তু নিতীশ কুমার যৌন হয়রানি করেছেন এটা বলার সাধ্য কার ?

এই ঘটনা তিনটি স্তরে সমস্যাজনক। প্রথমত পুরুষতন্ত্রের দিক থেকে এটি একজন পুরুষের নারীর শরীর ও পছন্দের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রদর্শন। নারীকে শিশু হিসাবে দেখা যাকে বলে ইনফ্যান্টিলাইজ করা। ক্ষমতার অপব্যবহার একজন মুখ্যমন্ত্রী বনাম একজন তরুণ ডাক্তার। দ্বিতীয়ত সাম্প্রদায়িকতার দিক থেকে মুসলিম নারীদের ধর্মীয় চিহ্নকে লক্ষ্য করা হয়েছে। বিজেপি আরএসএস এর হিজাব-বিরোধী এজেন্ডার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এই ঘটনা। মুসলিমদের প্রতি ক্রমবর্ধমান ইসলামোফোবিয়ার অংশ এটি। তৃতীয়ত ক্ষমতার রাজনীতি থেকে রাজনৈতিক স্বার্থে মুসলিম ভোট চাওয়া কিন্তু তাদের সম্মান না করা। প্রকাশ্যে একজন পেশাদার নারীকে অপমান করা তার সাফল্যের মুহূর্তে।

এটি একটি ইন্টারসেকশনাল সমস্যা যেখানে লিঙ্গ এবং ধর্ম উভয়ই জড়িত। নীতীশ কুমার একজন মুসলিম নারীর শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন এটি জেন্ডার এবং রিলিজিয়ন উভয় স্তরে আক্রমণ। এটি ইন্টারসেকশনাল অপ্রেশন যেখানে পুরুষতন্ত্র এবং সাম্প্রদায়িকতা একসাথে কাজ করে মুসলিম নারীদের দ্বিগুণ ভালনারেবল করে তোলে। একজন নারীর মর্যাদা এবং সম্ভ্রম খেলনা নয়। ক্ষমতা সীমানা লঙ্ঘনের অনুমতি দেয় না।

এই ঘটনার পর দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সাবেক অভিনেত্রী সানা খান তার ইনস্টাগ্রাম স্টোরিজে একটি ভিডিও শেয়ার করে বলেছেন ভিডিও দেখে আমার মনে হচ্ছিল আমি তাদের দুই কানের নিচে লাগাই। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে সবাই কীভাবে এই ঘটনা নিয়ে হাসছিল এবং প্রতিটি মেয়ের এতে রাগ অনুভব করা উচিত। অভিনেত্রী রাখি সাওয়ান্ত ইনস্টাগ্রামে একটি ভিডিও শেয়ার করে নীতীশ কুমারকে প্রশ্ন করেছেন এবং মেয়েটির কাছে ক্ষমা চাইতে বলেছেন। তিনি বলেছেন আপনি একজন মুসলিম নারীকে ডেকে পুরস্কার দিচ্ছেন, সম্মানিত করছেন। আপনার কি পাঁচ পয়সার জ্ঞানও নেই? আপনি কি জানেন না যে ইসলামে একজন নারী নেকাব পরে যায়? কুরআন-এ-পাকে লেখা আছে। তার নেকাব, তার আবায়া কেউ স্পর্শ করতে পারে না ।

নীতীশ কুমার একজন রাজনৈতিক সারভাইভালিস্ট। তিনি নারীদের জন্য ভালো কাজ করেছেন কারণ নারী ভোট ব্যাংক বিশাল। বিহারের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী। সাইকেল যোজনা তাকে জাতীয় খ্যাতি এনে দিয়েছে। নারী কল্যাণ তার সুশাসন বাবু ইমেজ তৈরি করেছে। কিন্তু মুসলিম নারীদের সাথে এরকম আচরণ করেছেন কারণ বিজেপির সাথে থাকার চাপ রয়েছে। তিনি জানেন বিজেপি হিজাব-বিরোধী। হিন্দু ভোট রক্ষা করতে চান। উচ্চবর্ণ এবং ইবিসি হিন্দু ভোটার হারাতে চান না। মুসলিম ভোট এমনিতেই যাবে। ৭৭ শতাংশ মুসলিম ইতিমধ্যেই আরজেডিকে ভোট দেয়, তাই নীতীশ মনে করেন মুসলিমদের খুশি রাখার দরকার নেই।

নীতীশ কুমারের এই হিজাব ঘটনা প্রমাণ করে যে তার নারী কল্যাণ বাছাইকৃত এবং রাজনৈতিক সুবিধাবাদী। তিনি মুসলিম নারীদের মানবিক মর্যাদা স্বীকার করেন না। তাদের শুধু ভোট চান, সম্মান নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নীতীশ কুমার এখনো কোনো ক্ষমা চাননি বা কোনো বিবৃতি দেননি। তার দল জেডিইউ শুধু বলেছে যে তিনি সবসময় সংখ্যালঘুদের সমর্থন করেছেন যা এই ঘটনার পরে ফাঁপা শোনাচ্ছে। দেশজুড়ে মানুষ, সেলিব্রিটি, নারী অধিকার কর্মী, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা সবাই ক্ষমা দাবি করছে কিন্তু নীতীশ কুমার নীরব। এই নীরবতা আরও বেশি ক্ষতিকর কারণ এটি দেখায় যে তিনি তার কাজে কোনো ভুল দেখেন না। এটি দেখায় যে একজন মুসলিম নারীর মর্যাদা তার কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করে না।

এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ভারতে হিন্দুত্ববাদের উগ্র রূপ কতটা গভীর হয়ে গেছে। ২০১৪ সালের পর থেকে মোদির নেতৃত্বে যে মৌলবাদি রাজনীতি চলছে তার প্রভাব এখন রাজ্য পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। নীতীশ কুমার যিনি একসময় ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক ছিলেন তিনিও এখন গেরুয়া রঙে রঙিন হয়ে গেছেন। মুসলিম নারীরা এই রাজনীতির সবচেয়ে বড় শিকার কারণ তারা লিঙ্গ এবং ধর্ম উভয় দিক থেকে নিপীড়িত। একজন মুসলিম নারী যখন তার যোগ্যতা দিয়ে ডাক্তার হয়, তার কৃতিত্বের মুহূর্তে যখন তাকে প্রকাশ্যে অপমান করা হয় তখন এটি শুধু সেই নারীর অপমান নয়, পুরো মুসলিম সম্প্রদায়ের অপমান। এটি সেই সমস্ত মুসলিম মেয়েদের জন্য একটি ভয়ংকর বার্তা যারা পড়াশোনা করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। বার্তা হল তোমরা যতই যোগ্য হও না কেন, তোমাদের ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য তোমাদের অপমান করা হবে।

এ ধরণের ঘটনাগুলো বাংলাদেশে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে, কারণ অন্তর্বর্তী সরকার ও ভারতের বর্তমান সরকারের সম্পর্ক দুর্বল হচ্ছে এবং ভবিষ্যতের সরকারের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক কেমন হবে, তা আর নিশ্চিত নয়। ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদের উত্থানের প্রতিধ্বনি বাংলাদেশেও দেখা যাচ্ছে, আর সেই সুযোগে কিছু গোষ্ঠী খণ্ডিত ও বিকৃত প্রচারণা চালিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ভারতবিদ্বেষ উসকে দিতে পারে । এই পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে কিছু রাজনৈতিক শক্তি ভারতবিরোধী আবেগকে পুঁজি করে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে , যা দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিপূর্ণ ।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৫৩

জ্যাক স্মিথ বলেছেন: মৌলাবদি কোন রাষ্ট্রেই সংখ্যালঘুদের ভালো থাকা সম্ভব নয়।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.