নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মাসিক মুকুল

সম্পাদনা করি আমিরাত-বাংলা মাসিক মুকুল। ভালবাসি মা, মাটি ও মানুষকে..

লুৎফুরমুকুল

আমি এক উদাসী পাখি নিঝুম রাতে নদীর তীরে করি ডাকাডাকি। আমি এক মুকুল সবুজ লালের বুকে আছি জুড়ে মায়ের দু'কূল। আমি এক স্বপ্নদেখা ছবি ভাল লাগে আকাশ বাতাস ভাল লাগে সবি।

লুৎফুরমুকুল › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রতিক্রিয়া

৩১ শে মার্চ, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:২৩

পাঠ প্রতিক্রিয়া-
ভং ছাড়ো কাঙ্গাল: বিধূভূষণের দূষণহীন সিলটী ছড়া
লুৎফুর রহমান

বাংলাদেশের মাতৃভাষা বাংলা হলেও সিলেটিদের মাতৃভাষা সিলেটি বা প্রচীন নাগরী। বাংলাদেশের নানা এলাকায় স্থানীয় মৌখিক ভাষা থাকলেও কারো লিখিত রূপ বা আলাদা বর্ণমালা নেই। যা একমাত্র আছে সিলেটের। ফ্রান্সের বিখ্যাত ভাষা যাদুঘরে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার উদৃতি রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের ভাষার বিবরণে উল্লেখ রয়েছে- বাংলাদেশে দুটি ভাষা প্রচলিত। এর একটি বাংলা এবং অন্যটি সিলেটি (নাগরী)। সিলেটি ভাষা নিয়ে দেশ- বিদেশে চলছে গবেষণা । সিলেটি (নাগরী) ভাষার উপর এ পর্যন্ত বেশ ক’জন পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেছেন। এর মধ্যে বৃটিশ নাগরিকও আছেন। সিলেটি ভাষার উপর ইতোমধ্যে যারা পিএইচডি নিয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন আব্দুল মোছাব্বির ভূঁইয়া । তিনি ভারতের গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি নিয়েছেন মোহাম্মদ সাদিক, তিনি বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি নিয়েছেন এস এম গোলাম কাদের । বৃটিশ নাগরিক জেমস লয়েড উইলিয়াম লন্ডনের সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন। এছাড়া সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করছেন সাংবাদিক মতিয়ার চৌধুরী ও রূপা চক্রবর্তি। বর্তমানে আরো অনেকে বিশ্বের বিভিন্ন খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি নিচ্ছেন। বৃটেনে সিলেটি ভাষা শিক্ষার কয়েকটি ইন্সটিটিউট থাকলেও বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানিকভাবে সিলেটি ভাষা শিক্ষার কোনো ক্ষেত্র নেই। যার ফলে সিলেটি ভাষা মানুষের মুখে থাকলেও এর বর্ণমালা (নাগরী লিপি) অনেকটা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হারিয়ে যাচ্ছে এর ইতিহাসও।

নাগরী ভাষার গবেষক ও সৃজনশীল প্রকাশক মোস্তফা সেলিম ও বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে সিলেটি নাগরী (Silôṭi Nagôri) বা নাগরী লিপি, বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে ব্যবহৃত একটি লেখ্য লিপি, যা বর্তমানে ব্যবহৃত হয় না। সিলেটের বাইরে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ভারতের আসামের কাছাড় এবংকরিমগঞ্জেও এই লিপির প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। লিপিটি মূলত বাংলা, আরবি, কাইথি এবং দেবনাগরী থেকে উদ্ভূত এবং এতে আরবি ও ফার্সি অক্ষরের মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। এই লিপি দিয়ে শুদ্ধ বাংলা, সংস্কৃত কিংবা প্রাকৃত নয়, বরং সিলেটি ভাষাই লেখা হতো। নাগরী পুঁথি রচয়িতাদের মধ্যে এ পর্যন্ত মুন্সী ইরফান আলী, দৈখুরা মুন্সী, আব্দুল ওহাব চৌধুরী, আমান উল্যা, ওয়াজি উল্যা, শাহ হরমুজ আলী, হাজী ইয়াছিনসহ ৫৬ জনের পরিচিতি পাওয়া গেছে। গোলাম হুসনের লিখিত ‘তালিব হুসন'কে প্রথম গ্রন্থ রুপে ধরে নেওয়া হয়।

আমার জানামতে, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে সিলেটী ভাষায় অনেকে ছড়া/কবিতা লেখেছেন। এ ক্ষেত্রে নগর সিলেটে আবদুল বাসিত মোহাম্মদ কে সিলটী ছড়া/কবিতার বইয়ের জনক হিশেবে ধরা হয়। কিন্তু সিলেট শহর ছাড়াও রাজধানী ঢাকা আর বিশ্বের নানা দেশে বসবাসরত সিলেটীরা সিলেটী ভাষায় (বাংলা অক্ষরে) বই বের করেছেন। এ ক্ষেত্রে তৃতীয় বাংলাখ্যাত বিলেত কম যায়না। ঢাকা থেকে লিখেছেন খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী ধ্রুব এষ (সুনাসগঞ্জ) শিশুসাহিত্যিক লোকমান আহম্মদ আপন (সিলেট) । দেশের সীমানার বাইরে থেকে লিখেছেন আব্দুল হাসিব (কানাডা) এম মোশাহিদ খান (যুক্তরাজ্য) লুৎফুর রহমান (দুবাই)। এছাড়াও সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের সবাই নিজ-নিজ এলাকা থেকে নিয়মিত লিখছেন। তবে আজকাল কেউ নাগরী লিপি ব্যবহার করছেন না বরং বাংলা অক্ষরে সিলেটী উচ্চারণে এসব বই লিখছেন। অনেকে আবার এসব উচ্চারণেও ভুল বানান লেখেছেন। যেমন-ধ্রুব এষ এর বইয়ের নাম 'সিলটী ছড়া, ফাইন্নে ভরা' । 'ফাইন্নে' শব্দটি সুনামগঞ্জের। সিলেট শহরে এটাকে 'ফানিয়ে' বলা হয়। অল্পপ্রাণ আর মহাপ্রাণ আর উচ্চারণে সিলেটীরা অনেকসময় সঠিক শুদ্ধ উচ্চারণ করতে ব্যর্থ হয়। তাই আমি মনে করি বাংলা অক্ষরে সিলেটী ভাষার ছড়া লেখতে হলে যেহেতু কোন ব্যাকরণ নেই বা নাগরী লিপি ব্যবহার করিনা সেখানে আমরা মুখে যা বলি ঠিক তাই লেখা উচিত। এ ক্ষেত্রে ছড়াকার বিধূভূষণ ভট্টচার্য একজন সফল কারিগর। তাঁর দূষণহীন 'ভং ছাড়ো কাঙ্গাল' আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমারও ঠিক এমন একটি বই ২০১৩ সালে ছিল 'সুরমা ফারর ছড়া'। সেখানে আমি যে বানানরীতি উচ্চারণের সাথে মিল রেখে করেছি বিধূদাও ঠিক তাই করেছেন।

বিধূ দা একজন প্রচার বিমূখ মানুষ। বিমূর্ত করে নিজেকে রাখা তাঁর পছন্দ। সেই পাকিস্তান আমল থেকে লেখালেখি করছেন। তাঁর ছড়া শুধু পাঠকদের নয় বরং গবেষকদেরও কাজে লা্গবে। আমার দেখামতে, তিনি-ই প্রথম যিনি কিনা সিলেটী ভাষার সাথে শুদ্ধ বাংলায়ও প্রতিটি ছড়ার অনুবাদ দিয়েছেন তাঁর বইয়ে। মাত্র ১ ফর্মার একটি বই। আকারে ছোট। কিন্তু শিল্প আর গুণগত মানে যেন-মধু। মধু যেমন অল্প হলে ভালো ঠিক তাই করেছেন তিনি তাঁর ছড়ায়। বইতে স্থান পেয়েছে মোট ১৩টি ছড়া। নাম যথাক্রমে-কূড়িয়া, ভং ছাড়ো কাঙ্গাল, ঝি'র দুঃখে মাই'র কান্দন, রং নাম্বার, টাউটামী মাত, বাঙ্গালীরে বিগড়াইও না, কিবা কইতাম সার, ছবি আঁকি লেইবায়, ইতা কিতা অইলো ভাইরে, দড়ি ছিড়তো কে, সাবুদ অই যাও, খুঁত ধরো আও। প্রতিটি ছড়ায় শুদ্ধ বাংলা অনুবাদ যেন সিলেটের বাইরের পাঠকদেরও কাছে টানবে। ২০১৫ সালের বইমেলাতে বইটি বের করেছে তুষারধারা। প্রচ্ছদ এঁকেছেন অরুপ বাউল। নামছড়ায় ছড়াকার লিখেছেন-ওউ দেখ কত জনে/ধরে কতো ভঙ্গি/ পেন্টর উপরেউ/ পিন্দিছে লঙ্গি। তামেশা করা জাতিকে তামেশা ছেড়ে নিজের মূলকে চেনার আর জানার আহবান তাঁর ছড়ায় স্পষ্ট। তিনি তাঁর জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতার বটবৃক্ষকে পাঠকের চোখে আয়না করে ধরেছেন। নগরজীবন ও পরবাসে জীবনে আমরা যে সিলটী শব্দ ভুলে যেতে বসেছি সেগুলো চমৎকার ভাবে টেনে এনেছেন ছন্দের মিলে। তাঁর এ আঞ্চলিক ছড়াতেও তাল, মাত্রা, পর্ব সব ঝরঝরে। ছড়া যেমন ঝর্ণার মতো বেগবান আর ছন্দময় হওয়া উচিত তার সবক'টি বিদ্যমান তাঁর বইতে। যেমন 'বাঙ্গালীরে বিগড়াইও না" ছড়ায় লিখেছেন- নেতা ফেতার তামসা দেখি/ গোসার হাওর উৎরার/ যেতা মনচায় অতা করে/ শরম নাইরে পুতরার'। আমাদের প্রজন্ম ক্ষয়ে যাচ্ছে তার বিষাদসুর বাজিয়েছেন এই ছড়ায়। আবার পুরো দেশের কথাও বলেছেন 'ইতা কিতা অইলো ভাই রে' ছড়ায়। ' এগু এ কয় বাপর স্বপন/আরগু এ কয় হাইর/ কামর লগে লগ নাই/ গদ্দি লইয়া মাইর'। আমাদের রাজনীতিতে আমরা জনতা যে সব সময় আবেগের আন্দোলন করি আর ঠিক অন্যরা নিজেদের ফায়দা হাসিলে ব্যস্ত। এটা চমৎকার ফুটিয়েছেন এই ছড়ায়। ঠিক প্রতিটি ছড়ার সরল সমীকরণ এমন।

বইটি খুব ভাল লেগেছে। মানসম্পন্ন কিছু সামান্য হলেও সুখপাঠ্য হয়। এটা এই বই-ই প্রমাণ। তবে বইতে ব্যতিক্রমী প্রিন্টার্স লাইন ব্যাক কাভারে আমার ভাল লাগলেও সূচি না থাকাতে পাঠকের হোঁচট খেতে হবে। এছাড়াও কিছু শব্দের চয়ন আমার ভাল লাগেনি। যেমন আমরা সিলেটীরা মেয়েকে 'ফুড়ি' বলি। পুড়ি নয়। ছেলেকে অনেক সময় 'ফুত' বলি পুত নয়। হয়তো দাদা উনার নিজের যুক্তিতে অবিচল আছেন তাই এমন শব্দের ব্যবহার করেছেন। তবে আমি সহজে যা বুঝি, নিজের মুখের রূপটাই লিখিত করতে হলে যা বরি ঠিক তেমনি লেখা উচিত। বইটি সিলেট ও সিলেটি গবেষকদের কাছে আকর হিশেবে স্থান করে নিক এই কামনা।

লেখক: ছড়াকর্মী, সম্পাদক, মাসিক মুুকুল-দুবাই।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.