| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১.
ভালো মানুষ হওয়া, ভালো হয়ে চলা বা ভদ্র হওয়াকে সামাজিকভাবে উদ্বুদ্ধ করা হয়। ছোটকাল থেকেই এই শিক্ষা নিয়ে আমরা বেড়ে উঠি।
সুতরাং আমরা স্বাভাবিকভাবেই মনে করতে থাকি, ভালো হওয়াটা দরকার। ভালো হওয়াটা নিজের ও সমাজের জন্য প্রয়োজন।
এই ভালো হওয়ার বিভিন্ন কনসিকুয়েন্স আছে। আপনার ভালো হওয়ার প্রথম ফল ভোগ করে আপনার আশেপাশের লোকজন ও আপনার সমাজ। তারপর কিছুক্ষেত্রে আপনি ফল পেতে পারেন।
তবে যারা ভালো হয়, তারা সে ভালোর ফল পায় কম। আপনি ভালো হলে সমাজের লাভ, সেই তুলনায় আপনার লাভ অনেক কম বা নেই বললেই চলে।
আমরা অনেক ক্ষেত্রে মনে করি, “ভালো হওয়া মানেই নিরাপদ থাকা।”
কিন্তু বাস্তবে বিষয়টা এত সরল নয়।
২.
রেনেসাঁ যুগের দার্শনিক নিকোলো মাকিয়াভেলি এই সত্যটা গভীরভাবে বুঝেছিলেন।
তিনি লিখেছিলেন, ভালো নেতারা কিভাবে পতন ঘটায়, দয়ালু শাসকরা কিভাবে ধ্বংস হয়, আর উদার মানুষরা কিভাবে বারবার বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়।
তাঁর পর্যবেক্ষণ ছিল নির্মমভাবে বাস্তব।
তিনি লিখেছিলেন:
“আপনি যদি দয়ালু হন, কিন্তু কৌশলী না হন, তাহলে আপনি নিজের পতন নিজেই লিখছেন।”
আজও তাঁর এই কথাগুলো আমাদের জীবনের সঙ্গে অবিকল মিলে যায়।
আমরা অনেকেই ভাবি, ভালো হলেই সবাই আমাদের ভালোবাসবে।
কিন্তু পৃথিবী সেইভাবে চলে না।
এখানে নেকড়েরা আছে, এখানে ফাঁদ আছে।
যদি আপনি ভেড়া হন — আপনাকে গিলে খাওয়া হবে।
পৃথিবীতে সারভাইবালই সবার উদ্দেশ্য। সারভাইবাল ও রিপ্রোডাকশন হলো মানুষের ভেরি বেসিক ডেজায়ার। বাকিসব মিমেটিক ডেজায়ার।
সুতরাং আরেকজনের সারভাইভ করার জন্য সে আপনাকে ভালো হতে বলবে। কারণ আপনি ভালো, দয়ালু আর সৎ হলে আপনার এই ভালোত্ব, দয়া আর সততা ব্যবহার করে আরেকজনের সারভাইভালের সম্ভাব্যতা বাড়ে।
এখানে মূল ফোকাসের জায়গা হলো- আপনার নিজের ভালোত্ব, দয়া আর সততা ব্যবহার করে নিজের সারভাইভালের সম্ভাব্যতা বাড়াইতে হবে।
আপনার এইসব গুণ ব্যবহার করে আপনাকে ঠকিয়ে যেন আরেকজন এইগুলা আপনার বিরুদ্ধে ইউটিলাইজ করতে না পারে, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
মূলনীতি হলো, আপনি কৌশলগতভাবে ভালো হবেন, হরেদরে অন্ধভাবে নয়।
৩.
ভালো মানুষরা প্রায়ই একটা “জেনেরোসিটি ট্র্যাপে” (Generosity Trap) পড়ে যায়।
তারা ভাবে — “আমি যত দয়ালু হব, ততই সবাই আমাকে সম্মান করবে।”
কিন্তু বাস্তবে কী ঘটে?
মানুষ তাদের দয়াকে “দূর্বলতা” ভাবে
তারা ভাবে, “এই মানুষটা কখনো না বলবে না”
ফলে তারা বারবার সুযোগ নেয়
মাকিয়াভেলি বলেছিলেন:
“মানুষ কৃতজ্ঞ হয় না, তারা সুযোগসন্ধানী।”
যদি কেউ জানে আপনি কখনো প্রতিশোধ নেবেন না,
তাহলে তারা আপনাকে কখনো সম্মান করবে না — বরং ব্যবহার করবে।
৪.
চিন্তা করেন, আপনি যে মানুষটাকে দয়ালু বা ভালো হিসেবে চেনেন, তিনি কি সত্যিই সম্মানিত, নাকি সবাই তার কাছে শুধু সাহায্য চায় বা সবাই তাকে ব্যবাহার করে?
খেয়াল করলে দেখবেন, সে ভালো বা দয়ালু লোকটা প্রায়ই বঞ্চিত হয় তার আশেপাশের অন্যদের তুলনায়। সবাই তাকে ভালো বলে, কিন্তু ব্যবহার করে।
কিছুক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়ত থাকতে পারে। তবে আমি এখানে কমন প্যাটার্ন বলছি।
সত্যটা হলো, “অতিরিক্ত ভালো হওয়া আপনাকে নিরাপদ নয়, বরং অসুরক্ষিত করে।“
যখন আপনি বারবার দয়ালু আচরণ করেন, মানুষ আপনাকে “প্রেডিক্টেবল” বা অনুমানযোগ্য মনে করে।
তারা জানে —
আপনি লড়াই করবেন না,
“না” বলবেন না,
তাদের অন্যায় আচরণও মেনে নেবেন।
ফলাফল?
আপনি হয়ে যান অফিসের “দরজার ম্যাট” — যেখানে সবাই পা মুছে যায়।
বন্ধুদের মধ্যে আপনি সেই ব্যক্তি, যিনি সবসময় বিল দেন।
পরিবারে আপনি সেই সদস্য, যিনি নিজের ক্ষতি করেও সবার কাজ করেন।
টিমে যিনি ভালো, কাজে লয়াল, যিনি টিমকে নিজের চেয়ে প্রায়োরিটি দেন, এগিয়ে রাখেন, তিনি সাধারণত প্রমোশন পান না বা নেতা হন না। নেতা হন অন্য কেউ। প্রমোশন অন্যের জন্য।
কারণ “অতিরিক্ত ভালো মানুষদের সাধারণত নেতা হিসেবে দেখা যায় না,
তাদের দেখা যায় “সার্ভেন্ট” বা দাস হিসেবে। তারা অন্যকে সার্ভ করে।
মানুষ আপনার দয়াকে এবং ভালোত্বকে সম্মান করে না, তারা ব্যবহার করে।
যখন কেউ সবসময় সাহায্য করতে রাজি থাকে, তার সাহায্য আর অমূল্য থাকে না।
যে মানুষ কখনো সীমা টানে না, মানুষ বারবার সেই সীমা অতিক্রম করে।
যে কখনো দাঁত দেখায় না, মানুষ ভাবে তার দাঁতই নেই।
ফলে আপনার ভালোত্বই আপনার দুর্বলতার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
বিশ্ব আপনাকে সহজ শিকার মনে করে।
৫.
মাকিয়াভেলি বলেছিলেন:
“একজন শাসকের উচিত একই সাথে সিংহ ও শিয়াল হওয়া।”
অর্থাৎ,
সিংহের মতো শক্তিশালী হতে হবে যাতে কেউ আক্রমণ করতে সাহস না পায়, আর শিয়ালের মতো চতুর হতে হবে যাতে কেউ ফাঁদে ফেলতে না পারে।
ভালোত্ব মানে এই নয় যে আপনি সব মেনে নেবেন,
বরং ভালোত্ব মানে হলো আপনি জানবেন — কখন দয়া দেখাতে হয়, আর কখন কঠোর হতে হয়।
একজন সত্যিকারের ভালো মানুষ সেই যে,
ভালো — কিন্তু প্রয়োজনে দাঁড়াতে জানে;
দয়ালু — কিন্তু বোকা নয়;
ক্ষমাশীল — কিন্তু দুর্বল নয়।
৬.
ভালো হয়েও দূর্বল না হওয়া যায় কীভাবে? অর্থাৎ Strategic Goodness কী?
আপনি তো আর খারাপ বা হিংস্র হতে পারবেন না। আপনি মানুষ। আপনার ভিতর মানবিকতা থাকতে হবে। গুডনেস থাকতে হবে। কিন্তু সেটা স্ট্রাটেজিক গুডনেস।
ক.
দয়ালু হোন, কিন্তু সবাইকে সবকিছু দিতে যাবেন না। যে মানুষ সীমা জানে, তাকে মানুষ সম্মান করে।
যে সবকিছুতেই “হ্যাঁ” বলে, তার কথার মূল্য কমতে থাকে।
যখন আপনি কাউকে সাহায্য করবেন, নিজের ইচ্ছায় করবেন, নিজের ভালোলাগা থেকে করবেন, কোন অপরাধবোধ বা কাউকে দেখানোর জন্য নয়।
খ.
যদি আপনি এমন মানুষদের প্রতি বারবার দয়া দেখান যারা কখনো কোন প্রতিদান দেয় না, তাহলে সেটা আপনার ও দয়াগ্রহণকারী সবার জন্য ভয়ংকর হয়ে দাড়াবে।
আপনি যখন কাউকে দয়া করেন বা আপনার ভালোত্ব প্রকাশার্থে উপকার করেন, তখন প্রথমবারে দয়া গ্রহণকারী অনেক খুশি হয়। আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়।
তাদের ভালোলাগা দেখে আপনি যদি আপনার এই ভালোত্ব ও উপকার কন্টিনিউ করেন, একটা সময় আপনার করা এই উপকারকে তারা অধিকার মনে করে। এটাকে তারা টেক ফর গ্রান্টেড নিয়ে নেয়। হেডোনিক ট্রেডমিল তৈরী হয়।
একটা সময় আপনি ব্যক্তিগত কারণে উপকার করা বন্ধ করলে তারা আপনাকে গালমন্দ করে। একটা শত্রুভাবাপন্ন অবস্থা তৈরী হয়। তারা ভাবে তাদের অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে।
কাউকে উপকার করার বেলায় পিপাসার্তকে পানি দেওয়ার উদাহরণটা মাথায় রাখা যেতে পারে।
প্রচণ্ড পিপাসার্ত একজনকে আপনার পানি দেওয়া দায়িত্ব। তাকে আপনি পানি দিলেন, সে খুশি হলো।
দুই গ্লাস খাওয়ার পর আপনার পানি দেওয়ার কৃতজ্ঞতা তার কাছে কমতে থাকবে। কারণ ঐ মুহূর্তে তার আর চাহিদা নেই।
এখন পিপাসা পেলেই যদি সে নিজে পানি না খুজে আপনার কাছে পানির জন্য আসে আর আপনি ভালোত্বর খাতিরে তাকে পানি দিতেই থাকেন, তাহলে আপনার কাছ থেকে পানি পাওয়াকে সে অধিকার মনে করবে।
যখন কোন একসময় দিবেন না, তখন আপনাকে গালমন্দ করবে।
সুতরাং মানুষকে উপকার করতে হবে এক্সট্রিম বিপদে। যেটা তার রিয়েলি দরকার। তারপর তাকে নিজের মত চলার সবক দিতে হবে। নিজের ভালোত্ব প্রকাশে দয়ার মেশিন চালু রাখা যাবে না।
.
অফিসে খেয়াল করলে দেখবেন, যে ইমপ্লয়ী বেশি ভালো, বস ও কলিগরা সবাই তাকে কাজে লাগায়। কিন্তু প্রমোশন বা রিওয়ার্ডের ক্ষেত্রে ভাল বা লয়াল এমপ্লয়ী পিছনে থাকে।
কারণ বস জানে যে, সে তো এমনিতেই ভালো, কোন রিওয়ার্ড বা প্রমোশনে তাকে পিছনে রাখলেও সমস্যা নেই। সে টু শব্দ করে না, সে কাজ ছাড়া কিছু বোঝে না। সে আমাকে না বলতে পারবে না।
কিন্তু যেটা একটু ব্যাঁকা বা ঘাড়তেড়া তাদের ব্যাপারে বস সাবধান থাকে।
.
ধরেন আপনারা তিন ভাই।
আপনি ভদ্র, ভালো, লেখাপড়া শিখেছেন, বাপ মায়ের কথা শুনেছেন, চাকরি করেন, বাপ মাকে দেখাশুনা করেন।
বাপ মায়ের কথা মাটিতে পড়ার আগেই পালন করেন।
আপনার বাপ-মা এই ব্যাপারটাকে টেক ফর গ্রান্টেড নিয়ে নিবে। আপনার এই ভালোত্ব এই লয়ালিটি তাদের চোখে পড়বে না।
অথচ আপনার আরেকভাই নিজে স্বচ্ছল, সে কারো ধার ধারে না। সে নিজের মত চলে। ভালো আছে। বছরে দুয়েকবার বাপ মায়ের কাছে এসে খুব পিরীত দেখায়। এই দুয়েকবার পিরীত দেখানোতে আপনার বাপ মা একবারে তার ব্যাপারে বিগলিত হয়ে পড়েন।
বছরে এই দুয়েকবারে আপনার এই ভাই বাপমায়ের জন্য কী কী করেছে, সেই জিনিস তারা মনে রাখেন, এই গল্প তারা আত্মীয় স্বজনকে দেন।
অথচ আপনি যে সারাবছর তাদের টেক কেয়ার করছেন, আপনার প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতাবোধ বা ভালো লাগার বোধ দ্বিতীয় ভাই থেকে তূলনামূলক অনেক কম হবে। আপনার দায়িত্ব পালনে যদি কখনো সমান্য ত্রুটি হয়, তাহলে আপনাকে বিশোদগার করবে।
এবার তৃতীয় ভাইতে আসা যাক। ধরেন এই ভাই নিজেই চলতে পারে না। বাপ মার কথা শোনে নাই। লেখাপড়া করে নাই। দীনহীন জীবন যাপন করে। বাপ মাকে বিভিন্ন সময় কষ্ট দিয়েছে। এখনো সুযোগ পেলে কষ্ট দেয়। বাপ মায়ের সম্পদ সম্পত্তি নষ্ট করে।
আইরনি হলো, আপনার বাপ মায়ের সবচেয়ে বেশি দরদ হবে এই তৃতীয় ছেলের প্রতি।
এই প্যাটার্ন প্রায় স্বাভাবিক।
আপনাকে সমাজ ভালো হতে বলেই মূলত এই কারণে। যেন আপনাকে লুটে পুটে খাওয়া যায় এবং আপনার থেকে পাওয়া উপকারের উপর ভর করে যেন সমাজের এক ঐচ্ছিক অচল অংশ সচল থাকে।
এই কনসেপ্ট ক্লিয়ার থাকলে আপনি কেমন ভালো হবেন, কখন কতটুকু ভালো হবেন সেটা বুঝতে সহায়ক হবে।
.............।
মূল লেখা আমার সাবস্ট্যাকে। সাবস্ট্যাকে আমার অন্য সব লেখা পাবেন।
©somewhere in net ltd.
১|
১৫ ই অক্টোবর, ২০২৫ সকাল ১১:৪২
রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর লেখা।