| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
"মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড দুর্ঘটনার তদন্ত কিভাবে হওয়া উচিত"
https://bangla.bdnews24.com/opinion/e03cc30fbd0a
ঢাকার মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড পতন কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনা নয়; এটি পরিকল্পনা, ডিজাইন ও বাস্তবায়নের সমন্বয়হীনতার প্রতিফলন। কার্যকর তদন্তের জন্য দরকার নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ দল—যাদের সঙ্গে নেই কোনো স্বার্থের সংঘাত, আছে কেবল পেশাগত সততা।
= মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড দুর্ঘটনার তদন্ত যেভাবে হওয়া উচিত =
ফার্মগেট মেট্রোরেল স্টেশন এলাকায় বিয়ারিং প্যাড খসে পড়ে এক যুবকের মৃত্যু; দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে গঠিত তদন্ত কমিটি নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
মেট্রোরেলের উঁচু ট্র্যাকে হঠাৎ একটি বিয়ারিং প্যাড খসে পড়ে—নিহত হন এক তরুণ। ২৬ অক্টোবর দুপুরের ঘটনা। ঢাকার আকাশে তখনও ভরদুপুরের আলো, কিন্তু ফার্মগেটের আকাশ যেন হঠাৎ ভারী হয়ে উঠল। বিয়ারিং প্যাড খসে পড়ার এটিই প্রথম ঘটনা নয়; মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার ঘটল একই ঘটনা, একই স্থাপনায়। প্রশ্ন জাগে—ত্রুটি কি প্রযুক্তিতে, নকশায়, না কি তদন্ত সংস্কৃতিতেই? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্যই এখন দরকার এমন একটি তদন্ত কাঠামো, যা হবে নিরপেক্ষ, দক্ষ এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন।
তদন্তের এমন দাবি করার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তবু শুরুতেই বলে রাখি, আমি বর্তমানে পেশায় একজন ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট (আরসিআইসি-আইআরবি) হলেও বাংলাদেশ এবং কানাডায় আমার দীর্ঘদিনের স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং (কাঠামো প্রকৌশলী) প্রাকটিস করার সুযোগ হয়েছে। দাবিটা হৃদয়ঙ্গম করার জন্য পাঠকের প্রকৌশলী হওয়া নিষ্প্রয়োজন।
ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট (আরসিআইসি-আইআরবি) হওয়ার আগে আমি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং মেজর নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করার পর কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করি। আমার কাজের ক্ষেত্র মূলত বিল্ডিং ও বিল্ডিংয়ের ফাউন্ডেশন হলেও ব্রিজ ডিজাইন সম্পর্কেও আমার কমবেশি ধারণা রয়েছে। তবে, কোনভাবেই আমি ব্রিজ বা সেতু বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী নই। কাঠামো প্রকৌশলী হিসেবে দেশ-বিদেশে প্রায় বিশ বছর কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সহভাগ করতে চাইছি যা ঢাকায় মেট্রোরেলে বিয়ারিং প্যাড পতন বা দুর্ঘটনা তদন্তে সামান্য হলেও দিকনির্দেশনা দিতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।
আমার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করি যা এ লেখার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। আজ হতে প্রায় বিশ বছর আগে আমি কানাডার আলবার্টা প্রদেশের এডমন্টন শহরে একটি জনগুরুত্বপূর্ণ ভবনের স্ট্রাকচারাল বা কাঠামো ডিজাইন সম্পন্ন করেছিলাম। ভবনটির নাম আলবার্টা টিচার্স এসোসিয়েশন বিল্ডিং। কানাডার আলবার্টা প্রদেশের কয়েক হাজার স্কুল শিক্ষকের নিয়মিত আনাগোনা হয় এই ভবনে। এ কারণে, ভবনটি এডমন্টন শহরের গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলোর অন্যতম। বলা বাহুল্য, এডমন্টন কানাডার আলবার্টা প্রদেশের রাজধানী।
এটি ছিল আমার কানাডায় কাঠামো প্রকৌশলী হিসেবে কাজ আরম্ভের শুরুর দিকের অভিজ্ঞতা। কাজেই, কানাডার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন অফিসের (কনসাল্টিং ফার্ম) কালচার বা সংস্কৃতি সে সময়ে আমার কাছে এক প্রকার নতুন ছিল। স্ট্রাকচারাল ডিজাইন কাজ শেষ হলে ক্যাল্কুলেশনের কাগজপত্র খসড়া ড্রয়িংসহকারে আমাদের ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজারকে (টিম লিড) যথাসময়ে হস্তান্তর করি। দেরি না করে তিনি আমাদের কোম্পানির ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশে অবস্থিত ভিন্ন এক অফিসের এক সিনিয়র স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারের কাছে আমার হিসাবনিকাশ ও ডকুমেন্টগুলো পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য পাঠালেন।
এ পর্যায়ে আমি ম্যানেজার সাহেবের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের এডমন্টন অফিসে অনেক সিনিয়র প্রকৌশলী থাকার পরও কেন আমার ডিজাইন/কাজ পরীক্ষার জন্য ভিন্ন প্রদেশের আরেক প্রকৌশলীর কাছে ডকুমেন্টগুলো পাঠানো হল?
উত্তরে ম্যানেজার বললেন, আমাদের এডমন্টন অফিসের সব প্রকৌশলী আমার সেই প্রজেক্ট সম্পর্কে কমবেশি অবগত। তাই, তাদের পক্ষে আনবায়াস্ড বা নিরপেক্ষ পর্যালোচনা বা পরীক্ষা করা সম্ভব নাও হতে পারে। তাই, এমন একজনকে আমার ক্যালকুলেশন ও ডকুমেন্টগুলো পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে যার এ প্রজেক্ট সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই। নির্ভরযোগ্য ও বস্তুনিষ্ঠ চেকিং নিশ্চিত করার জন্য এটি করা হয়েছে। সোজা কথা, ম্যানেজার চাইছেন আমার স্ট্রাকচারাল ডিজাইনটি চেক করার সময় যেন কোন প্রকার কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের সংঘাত না ঘটে, যা হতে পারে টেকনিক্যাল বা ব্যক্তিগত।
এ লেখায় ওপরের ঘটনাটি কেন উল্লেখ করলাম আশা করি বোদ্ধাপাঠক ধরতে পেরেছেন। তারপরও লেখাটি সহজবোধ্য ও হৃদয়গ্রাহী করার প্রয়োজনে নিজের কিছু পর্যবেক্ষণ দিতে চাই।
কানাডাসহ পৃথিবীর উন্নতদেশগুলোতে স্ট্রাকচারাল ডিজাইন কোম্পানিগুলোকে (কনসাল্টিং ফার্ম) প্রতিটি প্রজেক্ট বা কাজের বিপরীতে বড়ো অংকের ইন্স্যুরেন্স বা বীমা কিনতে হয়। কোনোকারণে স্ট্রাকচার ভেঙে পড়লে, বা এর ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচিত হলে সংশ্লিষ্ট বীমা কোম্পানি এগিয়ে আসে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের জন্য। এমন ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে অনেক নামিদামি কনসাল্টিং বা কনস্ট্রাকশন কোম্পানিও ব্যাংকরাপ্ট বা দেউলিয়া হয়ে যাবার নজির রয়েছে এসব দেশে। এজাতীয় অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে কনসাল্টিং কোম্পানিগুলো তাদের করা ডিজাইন যথাযথভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে চায় যে তাতে কোন ধরণের টেকনিক্যাল ফল্ট বা কারিগরি ত্রুটি নেই।
জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের ক্ষেত্রে, প্রকল্পটির মূল ডিজাইনে জড়িত ছিলেন না এমন কোন প্রকৌশলী দিয়ে ডিজাইন কাজের পক্ষপাতহীন চেকিং বা পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। কেননা, যিনি বা যারা মূল কাঠামো ডিজাইনটি করেছেন তারা সহজে নিজেদের ত্রুটিবিচ্যুতি ধরতে পারার কথা নয়। উন্নতদেশগুলোতে একই ধরণের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় কোন প্রকারের স্ট্রাকচারাল ফেইল্যুর বা দুর্ঘটনা, যেমন, ঢাকার মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খসে পড়ার মতো ঘটনায়। এসবের তদন্ত তারা এমন কোন প্রকৌশলী বা ফার্মকে দিয়ে করে যারা মূল ডিজাইন বা প্রকল্প বাস্তবায়নে জড়িত ছিলেন না। তদন্ত কাজের স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতেই এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে।
তাহলে প্রশ্ন জাগে, ঢাকার মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড দুর্ঘটনার তদন্ত কাদের দিয়ে করানো উচিত?
ওপরের আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলতে হয়, এক্ষেত্রে তদন্ত কমিটি গঠিত হতে হবে এমনসব ব্যক্তিবর্গ দিয়ে যাদের এজাতীয় মেট্রোরেল প্রকল্পের নকশা প্রণয়ন, স্ট্রাকচারাল ডিজাইন ও বাস্তবায়ন কাজের বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং যারা ইতিপূর্বে আলোচ্য প্রকল্পটির সঙ্গে কোনভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। টেকনিক্যাল ব্যক্তিবর্গের পাশাপাশি তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি ও প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধনের জন্য একজন দক্ষ নন-টেকনিক্যাল ব্যক্তিও প্রয়োজনে তদন্ত দলের অংশ হতে পারেন।
সংবাদমাধ্যমে জানা গেল, মেট্রোরেল দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের লক্ষ্যে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। এ কমিটিতে আছেন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক এ বি এম তৌফিক হাসান, এমআইএসটির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. জাহিদুল ইসলাম, ডিএমটিসিএলের লাইন-৫-এর প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব এবং উপ-সচিব আসফিয়া সুলতানা। আমরা জানি না, অনুরূপ মেট্রোরেল প্রকল্পের নকশা প্রণয়ন, স্ট্রাকচারাল ডিজাইন ও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন কাজের অভিজ্ঞতা এদের রয়েছে কিনা, যা অর্থবহ তদন্তের স্বার্থে একান্তই প্রয়োজন।
বাংলাদেশে মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড পতনের ঘটনা এটি প্রথম নয়। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসেও মেট্রোরেলের একটি বিয়ারিং প্যাড খসে পড়েছিল। ওই ঘটনায় কেউ হতাহত হননি, তবে ট্রেন চলাচল ১১ ঘণ্টা বন্ধ ছিল। ঘটনা তদন্তে যথারীতি একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। আমার ধারণা, সে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি না ঘটায় যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তদন্তকাজ সম্পন্ন করা হয়নি; অর্থাৎ, দায়সারা গোছের তদন্ত হয়েছে। অন্যথায়, কেবল এক বছরের ব্যবধানে একই প্রকল্পে একই ধরনের আরেকটি দুর্ঘটনা ঘটার কথা নয়।
গতবছরের দুর্ঘটনার চেয়ে বর্তমান দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপকমাত্রায় বেশি। কারণ, এবারের দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছে। রাজধানীর ফার্মগেট মেট্রোরেল স্টেশন এলাকায় মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড মাথায় পড়ে আবুল কলাম আজাদ নামের এক টগবগে যুবক ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারিয়েছেন; খালি হয়েছে তার মায়ের বুক, শোকের সাগরে ভাসিয়েছেন তার তরুণী স্ত্রী ও দুই অবোধ শিশুকে। আহতও হয়েছেন কয়েকজন। ২৬ অক্টোবর দুপুরে এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। সরকারের পক্ষ থেকে যতোবড় অংকের আর্থিক সহায়তাই দেওয়া হোক না কেন, প্রাণহানির ক্ষতি কোনোভাবেই পুষিয়ে উঠার নয়।
কিভাবে এমন দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তিরোধ সম্ভব–তা খুঁজে বের করতে হবে। তাই এবারের দুর্ঘটনায় একটি শক্তিশালী ও কার্যকর তদন্ত দল গঠন সময়ের দাবি। তদন্ত দলে থাকা দরকার দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ যাদের মেট্রোরেলের অবকাঠামো ডিজাইন ও বাস্তবায়নের বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে। যেহেতু জাপানি প্রযুক্তির ব্যবহার ঢাকার মেট্রোরেল প্রকল্পে হয়েছে, তাই জাপানের এক বা একাধিক বিশেষজ্ঞও তদন্ত দলে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। কেননা, জাপানি বিশেষজ্ঞ সেদেশের ডিজাইন কোড সম্পর্কে অন্য যে কোন দেশের বিশেষজ্ঞের চেয়ে ভালো ধারণা রাখবেন, এটাই স্বাভাবিক। তবে, তা যেন কোনোভাবেই মেট্রোরেল প্রকল্পের সঙ্গে আগে থেকে সংশ্লিষ্ট কোন বিশেষজ্ঞ বা কনসাল্টিং ফার্ম না হয়। সেক্ষেত্রে, কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের সংঘাত ঘটার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।
কাঠামোগত ডিজাইনের পাশাপাশি প্রকল্পের নির্মাণ কাজে কোন প্রকার গাফেলতি হয়েছে কিনা তাও একই প্রক্রিয়ায় খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। একটি প্রকল্পের নকশা প্রণয়ন বা ডিজাইন যত উন্নতমানেরই হোক না কেন, মাঠ পর্যাযে তার যথাযথ বাস্তবায়নও একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রকল্পে ব্যবহৃত মালামালের গুণগতমানও হতে হয় গ্রহণযোগ্য মানের।
পত্রিকান্তরে জানা গেল, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর অধ্যাপক সামছুল হক ও অধ্যাপক আহসানুল কবির প্রমুখ এ দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ নিয়ে তাদের মতামত দিয়েছেন। এ ধরণের প্রকল্পের ডিজাইন বা বাস্তবায়নে তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকলে, এবং একই সঙ্গে, প্রকল্পটিতে ইতিপূর্বে তারা জড়িত হয়ে না থাকলে তাদেরও তদন্ত কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে।
এও জানা যায়, আলোচ্য প্রকল্পের বিয়ারিং প্যাডের গুণগত মান নিয়ে বুয়েটের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়েছিল। কিন্তু, তাদের সে আপত্তি পাশ কাটিয়ে প্রশ্নবোধক সেই বিয়ারিং প্যাডই এ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে, বা ব্যবহৃত প্যাডগুলোর মধ্যে যেগুলো মানসম্মত নয় তা সরিয়েও নেওয়া হয়নি। অভিযোগটি সত্য হয়ে থাকলে এ এক ভয়াবহ দুঃসংবাদ। নতুন তদন্ত দল এবিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে পারে।
কোন কোন বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করছেন, বাঁকের কারণে ঘটনাস্থলে কম্পন ও চাপের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বিয়ারিং প্যাড খসে পড়তে পারে। এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, বাংলাদেশে মেট্রোরেল তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও জাপানসহ পৃথিবীর বহুদেশে মেট্রোরেল রয়েছে যেখানে এ ধরনের বাঁক বিদ্যমান। বিশেষ কিছু ভয়াবহ ঘটনা, যেমন, ১৯৯৫ সালে সংঘটিত জাপানের কোবে ভূমিকম্প, বাদ দিলে মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খসে পড়ার মতো দুর্ঘটনা পৃথিবীতে বিরল, যা বাংলাদেশে এক বছরের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে দুই বার ঘটে গেল। কাজেই, স্রেফ কম্পন বা অতিরিক্ত চাপের দোহাই দিয়ে এমন দুর্ঘটনা জায়েজ করার সুযোগ আছে মনে হয় না। এখানে কারিগরি ত্রুটি রয়েছে অবশ্যই।
জাপানের মেট্রোরেল স্থাপনাসমূহে এ ধরণের দুর্ঘটনা না ঘটলেও সেদেশের কোম্পানির সহায়তায় বাংলাদেশে নির্মিত অনুরূপ স্থাপনায় কেন বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে তা যথাযথভাবে খতিয়ে দেখতে হলে জাপানের যেসব কোম্পানিকে এ কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তাদের অভিজ্ঞতার ব্যাপ্তি এবং গভীরতাও খতিয়ে দেখার অবকাশ রয়েছে। প্রশ্ন জাগে, যেসব বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশের মেট্রোরেল কাঠামো ডিজাইন ও নির্মাণ কাজের দায়িত্ব পেয়েছিল তারা কি আদতেই যথাযথ যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ছিল, নাকি কনসালটেন্ট নিয়োগের সময়ও প্রভাবিত হয়ে আপস করা হয়েছে?
স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং প্র্যাকটিসের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে ঢাকার মেট্রোরেল দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে আমার অভিমত হল, অনতিবিলম্বে বিয়ারিং প্যাডগুলোর স্ট্রাকচারাল ইন্সপেকশনের উদ্যোগ গ্রহণ করে কোথাও দৃশ্যমান সমস্যা থাকলে তা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া। ত্রুটিপূর্ণ কিছু প্যাড সরিয়ে নিয়ে নতুনভাবে স্থাপনের প্রয়োজনও হতে পারে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এড়িয়ে যত দ্রুত সম্ভব এ কাজটি করা দরকার।
পাশাপাশি, এ ধরণের প্রকল্পের নকশা প্রণয়ন, কাঠামো ডিজাইন ও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নে অভিজ্ঞ দেশি-বিদেশি টেকনিক্যাল ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে শক্তিশালী কমিটি গঠন করে দুর্ঘটনার কারণসমূহ বস্তুনিষ্ঠভাবে খতিয়ে দেখার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দুঃখজনকভাবে বলতে হচ্ছে, সরকারের গঠন করা তদন্ত দলে দেশ-বিদেশের কোন সুপরিচিত কনসাল্টিং ফার্মে মেট্রোরেলের স্থাপনা ডিজাইন বা বাস্তবায়নের কাজ করেছেন এমন কোন কাঠামো প্রকৌশলীর নাম না দেখে হতাশ হয়েছি।
পরিশেষে বলবো, তদন্ত দল মানসম্পন্ন না হলে তদন্তের ফলাফলও অতীতের মতো দায়সারা গোছের হতে বাধ্য। সরকারের পক্ষ হতে বর্তমানে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে মাঠ পর্যায়ে তাদের অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকলে কমিটি পুনর্বিন্যাস করে একে আরো উপযোগী ও মানসম্পন্ন করা একান্ত প্রয়োজন। ভবিষ্যতে মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড, পিলার (পিয়ার) বা অন্য কোন অতিপ্রয়োজনীয় অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে নতুন কোন মায়ের বুক খালি না হোক সে প্রত্যাশা রইল।
©somewhere in net ltd.