নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মানুষ হয়ে জন্মানোর মর্যাদাবোধের খোঁজে,,,,,
সে বছর আমরা ম্যাট্রিক দেবো। বিদায় অনুষ্ঠানের দিন। স্যারেরা একে একে আমাদের কান ভর্তি করা 'বকবক' করে যাচ্ছেন। ইংরেজির ইদ্রিস স্যার আমাদের স্কুলে যোগ দিয়েছিলেন শেষের দিকে। আমরা কম ক্লাস পেয়েছিলাম। বড়জোর সাত/আট মাস!
বয়স্ক লোক। তখন উনার চাকরির বোধ হয় আর বছর দুয়েক ছিল।
যাইহোক, বুঝাতেন খুব সুন্দর। কিন্তু ছাত্রদের 'বকা দেয়া'র বিপরীতে তিনি 'বুঝানো'র নীতিতে চলতেন। তার তত্ত্ব ছিল, 'যারা শেখার তারা এমনিতেই শিখবে। ধানের মধ্যে কিছু চিটে থাকা ভালো! চাষের ক্ষুধা বাড়ায়।'
ফলাফল... তার কথা আমরা কেউ তেমন একটা শুনতাম না। গল্প করতাম পেছনের দিকে বসে বসে।
কিছু বলার জন্য উনার নাম ঘোষণা হল।
বক্তৃতার পরিবর্তে উঠে গিয়ে স্টেজের পেছনের দেয়ালে কালো বোর্ডে সাদা চকে নামতা লিখতে শুরু করলেন তিনি।
৯×১= ১
৯×২= ১৮
ছেলেমেয়ে শিক্ষক সবাই একটু অবাক হলাম। উনি একটু আলাদা নিয়মে পড়ান। সবাই জানে; তাই চুপ মেরে গেলাম। কিন্তু উনি যেই "৯×৪= ৩৬ না লিখে ৩৪ লিখলেন, পেছনের দিকে আমরা ক'জন হাসাহাসি শুরু করলাম। আমি অংকের মকবুল স্যারের দিকে চেয়ে দেখি উনি স্টেজের হেড স্যারের দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখে তার 'সুধরে দেবার নিরব অনুমতি'র প্রার্থনা।
কিন্তু হেড স্যার কোন 'রা' করলেন না। শুধু দেখছেন।
স্টেজে হেড স্যারের পাশে ইউএনও বসা। প্রধান অতিথি।
৯×৩= ২৭
৯×৪= ৩৪
এর দু' ঘর পরে গিয়ে আবারো স্যার আরেকটা ভুল করলেন। ছয় ন'য়ে ৫৪'র পরে সাত ন'য়ের পরিবর্তে লিখেছেন ৯×৬= ৬৩..!
এবার আমাদের দলেরি লোক বেশি। অধিকাংশই হেসে উঠলাম। হেড স্যারের লাল চোখে হাসির ধমক যা একটু কমলো তবে তাকে ঠিক 'চুপ করা' বলা যাবে না।
৯×৫= ৪৫
৯×৬= ৫৪
৯×৬= ৬৩
৯×৮= ৭২
৯×৯= ৮১
৯×১০= ৯০
লেখা শেষ করে মুচকি হাসতে হাসতে চলে গেলেন বক্তৃতা দেবার নির্ধারিত স্থানে। আমরা পাজিরা তখনো মিটিমিটি হেসে চলেছি!
"দেখো, আমি মাত্র দুটো ভুল করেছি।"___সম্মুখের সবার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে শুরু করলেন।
"তাতেই তোমরা সবাই হাসতেছ।"____আমাদের দুষ্টুমিকে পাত্তা না-দেয়া চিরচেনা সেই হাসি দেখা গেল। "কিন্তু আটবার সঠিক লিখেছি আমি। আটবার...! তার মানে আমি ৮০% ঠিক...তাই তো মকবুল সাহেব?"_____বা'পাশে দাঁড়ানো অংক স্যারের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন। স্যার যেন উদ্ভ্রান্তভাবে শুধু ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন।
"হ্যাঁ, ৮০ শতাংশ সফল আমি।"___ স্বগোতোক্তির মতো করে নিজেকে স্বীকৃতি দেবার মতো বললেন। "কিন্তু আমি মাত্র দু'টো ভুল করেছি আর তাতেই তোমরা হেসে খুন!" এখন একদম নিরব সবাই।
"আজ তোমরা আরো বড় লক্ষ্যে অন্যত্র যাবে। বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে এটা থেকে শিক্ষা নিয়ে যাও। বাইরের দুনিয়া অনেকাংশে এমনি পাবে।"____স্বভাবগত তার সেই ব্যাখ্যা প্রথম খেয়াল হল আমার। "তোমরা যদি ৮০ টা ঠিক কাজ করার পরে মাত্র দু'-একটা ভুল করো তো সবাই তোমাদের ওই ভুলটা নিয়েই কথা বলবে। সাফল্য দিয়ে বিচার করার লোক পৃথিবীতে কমই পাবে।"
"আবার কেউ কেউ বলবে 'ন'য়ে ছ'য়ে তেষট্টি' করো।" ______বোর্ডে ইশারা করলেন। "মানে তারা শুধু ফলটাই চাইবে। তাদের কাছে ফলটাই আসল; কী উপায়ে করেছো, কার ক্ষতি করে করেছো, সেটা তারা দেখবে না! ...দেখতে চাইবে না!"
"সব সময় মনে রাখবে, ভুল তো ভুল-ই। কেউ তা জানুক আর না-জানুক, কেউ তা মানুক আর না-মানুক; তুমি তো জানো। তুমি তো অস্বীকার করতে পারো না!____অন্তত নিজেকে ভুলিও না। নিজেকে ফাঁকি দিও না। কেউ না মানলেও ভুল কখনো ঠিক হয়ে যায় না। ঠিক যেমনে আমার 'ন'য়ে ছ'য়ে তেষট্টি'র ভুলকে তোমরা ঠিক মানলে না___ঠিক সেভাবে।"
একটু যেন থামলেন।
"ভালো থে...।" ____কথা শেষ করতে পারলেন না।
স্যারের চোখ অনুসরণ করে দেখি, আমার পরের সারিতে বসা ভোলা "হাত তুলে" আছে। সব কিছুতেই ওর একটা-না-একটা প্রশ্ন থাকবেই থাকবে! তাই বলে বিদায় অনুষ্ঠানেও...! ___বিরক্তি লাগলো।
"কে? রওসদ?"____হাসলে স্যারকে অসম্ভব সুন্দর লাগে! ওর প্রশ্ন বানের কথা স্যার এ ক'দিনেই জেনে গেছেন। পছন্দও করেন।
"বলো রওসদ। বলো..."
"স্যার! এমন পরিস্থিতিতে করণীয় কী, তা তো বললেন না।"
'ঠিক এমনটাই যেন আশা করেছিলেন'___এমনিভাবে মাথা দুলিয়ে মুচকি হেসে বললেন, "কী করছো' সেটা যদি তুমি পরিপূর্ণ সচেতনভাবে করতে পারো তাহলে কী করণীয় তা তোমাকে খুঁজতে হবে না। আশপাশের লোকজন যে যাই ভাবুক, যে যাই করুক না কেন, দিন শেষে এমনিতেই আসবে।" ___তিনি নিজের মুখের হাসির দিকে ইঙ্গিত করলেন।
"শুধু সচেতনভাবে কোরো।"
"ঠিকাছে। আই অ্যাম প্রাউড অল অফ ইউ, বয়েস! ভালো থেকো।"
স্যার সবার উদ্দেশ্যেই সেদিন ওই "প্রাউড অল অফ ইঊ" বলেছিলেন। কিন্তু জীবনের মধ্য গগণে এসে কাল বুঝলুম, স্যারের সেদিনের ওই "প্রাইডটা"র আসল উদ্দেশ্যটা ছিল ভোলা। আমরা ছিলেম মাত্র শুধুই শ্রোতা। কেন?___ সেটা না হয় অন্যদিনের জন্য তোলা রইলো।
পুনশ্চ: লেখাটি "ভোলার ডায়েরি" নামে একটা সিরিজ গল্পের অংশ। এই অংশে বর্ণিত "রওসদ" তার বন্ধুদের কাছে "ভোলা" নামে পরিচিত।
২| ০৫ ই জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৪:৫২
স্থিতধী বলেছেন: মনে হচ্ছে প্রায় সব স্কুলেই একজন ইদ্রিস নামক স্যার থাকেন । আমার স্কুলের একজন গণিত শিক্ষকের নামও ছিলো ইদ্রিস । ভোলার ডায়েরীর প্রথম পাতা পড়ে ভালোই লাগলো।
৩| ০৫ ই জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৫:২৫
কাজী ফাতেমা ছবি বলেছেন: অনেক ভালো লাগলো
৪| ০৫ ই জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৫:৫৩
আমি সাজিদ বলেছেন: স্থিতধী ভাইয়া, আমার স্কুলের গণিতের স্যারের নামও ছিল ইদ্রিস।
স্যারের কথাগুলো মনের বেশ গভীরে গিয়ে লাগলো।
৫| ০৫ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ৯:১৫
নেওয়াজ আলি বলেছেন: স্যালুট ইদ্রিস স্যারকে। সেই সোনালি অতীত আর ফিরে আসার নয়
৬| ০৫ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ৯:৪০
রাজীব নুর বলেছেন: সমস্ত ইদ্রিস স্যারকে শ্রদ্ধা জানাই।
৭| ০৫ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১০:৫৫
ঢুকিচেপা বলেছেন: খুব সুন্দর লাগলো গল্পটা। দারুণ..........
৮| ০৬ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ৩:১৪
রানার ব্লগ বলেছেন: আমি আমার স্কুলের শিক্ষকদের অসম্ভব ভাবে মিস করছি। প্রতিটি মুখ চোখের সামনে ভেসে আসছে, কেউ মারা গেছেন কেউ বেচে আছেন কিন্তু বৃধ্য, ভালো থাকুন আপনারা সকলেই ভালো থাকুন যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন। বাংলাদেশে শিক্ষকদের জরিয়ে ধরার রেওয়াজ নাই, থাকলে আমি তাদের একবার জরিয়ো ধরতে চাই।
৯| ০৬ ই জানুয়ারি, ২০২১ সকাল ১০:০২
মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন: জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া জরুরী।
১০| ০৭ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১১:০৭
কল্পদ্রুম বলেছেন: ইদ্রিস স্যার একজন প্রকৃত শিক্ষকের মত কাজ করেছেন। আপনার গল্পও ভালো লাগলো।
©somewhere in net ltd.
১| ০৫ ই জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৪:৫০
এম. হাবীব বলেছেন: মানুষ নেগেটিভ সাইডকে আগে সামনে নিয়ে আসে; অসাধারণ...