নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কখনো গল্প লেখার চেষ্টা করি।

মাহবুব আলী

মাহবুব আলী

মাহবুব আলী › বিস্তারিত পোস্টঃ

কাঠ কয়লা ছাই ৩

০৬ ই আগস্ট, ২০২০ ভোর ৬:২১


সেও এক সন্ধের কাহিনি। সেদিন আকস্মিক বিবর্ণ পাঁশুটে চেহারা নিয়ে ঘরে এসে দম ছাড়ে মামুনের বাপ আবদুর রশিদ। পঁচিশ বছরের টোনাটুনি জীবন। মুনার বয়স পাঁচ-সাড়ে পাঁচ। অনেকদিনের পর বাবাকে পেয়ে নাচতে নাচতে কোলে গিয়ে বসতে চায়। পিঠের পেছনে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। সবকিছু তেমনই, যেমন দেখে এসেছে, কিন' সেদিন সে-সবের মধ্য দিয়ে বেসুরো খাপছাড়া কোনো ছন্দপতন প্রতিভাত হতে থাকে। পথ হারানো দিশাকুল ভুলে যাওয়া বলে উঠে কেউ, -
‘তুমার কী হইছে? মাথাব্যথা-জ্বর? শরীল খারাপ?’
‘কিছু হয় নাই মামুনের মা কিছু না।’
‘তুমারে এমন দেখি নাই। আসতে কুনো অসুবিধা হইছে?’
‘তেমনকিছু না গো...শোনো, এই ট্যাকা কয়ডা তুইল্যা রাখো।’
মানুষ বড় কাহিল। অনেক দূরের রাস্তা। যেতে আসতে নয়-দশ ঘণ্টা। তারপর আজকাল যানজট। নাইটকোচ রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আকলিমা কপালে হাত দিয়ে কোনোকিছু পরখের চেষ্টা করে। বুঝতে পারে না। সে অনেককিছুই বুঝতে পারে না। তারপর একসঙ্গে এতগুলো টাকা দেখে চমকে ওঠে। সে টাকার বান্ডিল টিনের বাক্সে কাপড়ের ভাঁজে রেখে দিতে দিতে কৌতূহল চোখে তাকায়। আবদুর রশিদের শরীরজুড়ে ক্লান্তি। চেহারায় আবছায়া হাসি। আকলিমার মন ভরে যায়। কত পুণ্যে এমন মানুষ তার সঙ্গী।
‘বোঝলা মামুনের মা, এই কয়ডা টাকাই শেষ সম্বল। সাহেব আমারে বিদায় দিছে। বাইশ বছর নয় মাস চাকরির পুরস্কার।’
‘মানে?’
‘আমার চাকরি নাই আকলিমা।’
এই ছোট একটি কথায় ঘরের ছায়া ছায়া আলো-বাতাস কোনো কপিশ অন্ধকার আঙিনায় ডুবে যায়। অন্ধকার কালো হয়ে আসে চারপাশ। মুনা তখন বাবার পিঠে চড়ে আনন্দের কত কথা বলে। আবদুর রশিদের কোনো বিরক্তি নেই। কত আনন্দে মেয়েকে একবার কোলে নেয় একবার জড়িয়ে ধরে। ভালবেসে গালে চুমো দিতে থাকে। আকলিমার মনে হয়, আজও মানুষটিকে বুঝতে পারল না। এত ভালবাসা বুকে তার।
‘তুমার চাকরি নাই? কেমনে চলব আমাদের?’
‘আল্লা আছে আকলিমা।’
‘তুমার চাকরি কেমতে গেল? ঠিক কইরা বলো তো কী করছ তুমি? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।’
‘মালিক এ্যাহন কোম্পানির অফিস নতুন কইরা সাজাইব। বিবিএ-এমবিএ অফিসার থাকব অফিসে। স্যুটেড-বুটেড জেন্টলম্যান। এইডা ডেকোরেশন। তুমি বুঝবা না। সাধারণ অ্যাকাউন্টিং-ম্যানেজমেন্ট পড়া লোকজন রে বিদায় কইরা দিতাছে। এডাই এখনকার ফ্যাশান। গুডবাই উইথ থ্যাংকস্।’
আকলিমা সত্যি এসব বোঝে না। স্কুলে পড়তে পড়তে ঘটকালির বিয়ে। তখন সবে ক্লাস সিক্সে উঠেছে। বিয়ের কল্পনা ছিল না। বোঝেও না তেমন। সেই সন্ধেয় মানুষজনের ভিড়ে ছাপানো একটি কাগজে স্বাক্ষর করতে হয়। কেউ মাথায় টোকা মেরে বলিয়ে নেয় ‘কবুল’। আকলিমার সব মনে আছে। মায়ের দু-একটি গয়না হাতে-কানে-গলায়। নিজেকে বেশ দামি মনে হতে থাকে তার। শরীর-মন জুড়ে অচেনা শিরশির লাজুক ভাবনা। পড়ার সাধ ছিল, তেমন বলেছিল কেউ; বিয়ের পর পড়তে পারবে। সেই কথা আর থাকেনি। তিন-সাড়ে তিন বছরের মাথায় কোলে এলো মামুন। পেছন ফিরে আর তাকানো হলো না। পৃথিবীর সকল সুখ-আনন্দ-ভালবাসা-ত্যাগ তার সন্তান। আবদুর রশিদ ঢাকায় চাকরি করে। সিগারেট কোম্পানির বড় অফিসার। বছরের কয়েকটি দিন আসতে পারে। সেই দু-চারটি দিন আনন্দ-হাসি-গল্পগুজবে দ্রুত শেষ হয়ে যায়। কোনোদিন সন্ধেয় আবার বেদনা-বিষাদ প্রহর নেমে আসে। আবদুর রশিদের ছুটি শেষ। ঢাকায় যেতে হবে। আকলিমা ব্যাগ গুছিয়ে দেয়। টিফিন বাক্সে দুটো পরোটা-তরকারি। একলা বিরহী প্রহর গোনার প্রস্তুতি নিতে নিতে বারবার বলে, ‘মনে কইরা খাইবা কিন'।’ তারপর মনের শুকনো দৃষ্টির প্রান্তসীমায় শেষ কষ্টের বিদায়বেলা। আকলিমার অনেক সাধ, আরও দুটো দিন বেঁধে রাখে, এটা-ওটা রাধে, কোনোকিছু করা যায় না; পারে না। এই অদ্ভুত বেঁচে থাকা সভ্যতার দিনকাল। সব মেনে নিতে হয়। মেনে নিয়েছিল হাতে গোনা কয়েকটি দিন। সুখ বলো স্বস্তি যা সব তো ছিল। সেই মানুষ একেবারে চলে এসেছে। চাকরি নাই।
‘কিন' চাকরি না থাকলে আমাগো চলব কেমনে? এই বয়সে আর কোথায় চাকরি খুঁজবা? কেউ দিব?’
‘তুমি চিন্তা কইরো না মামুনের মা। খোদার দুনিয়ায় কেউ বইসা থাকে না। উপায় একটা অবশ্যই হইব।...তারপর কী রাধছ? আমার ক্ষিদা লাগছে।’
‘হায় রে আমি যে কী! যাও মুখ-হাত ধুইয়া আসো, তুমারে ভাত দিই।’
‘আকলিমা, আইজ একখান সিগারেট খাইছি। সিগারেট কোম্পানিতে চাকরি করলাম, কুনোদিন খাই নাই। শেষবেলা আসার পথে এক প্যাকেট লইছি। বেশ ভালোই। বুজছো দুইন্যায় মন্দ জিনিসের স্বাদ বেশি। তুমার অসুবিধা হইব না তো?’
‘যাও...আমি যে কী ভাবতাছি, আর তুমি? কেমনে চলব...কুনো চিন্তা নাই।’
‘চিন্তা কিয়ের? হা হা হা!’
আকলিমার মনে কি বিরহকাতর দিনযাপনের প্রহর শেষ হয়ে যায়? কে জানে। তার মনে হাজার ভাবনা-দুর্ভাবনা এসে ভিড় করে। যার বুকে জীবনের সকল নির্ভরতা-আস্থা, তার নির্ভার চোখ-মুখ, চিন্তার ছায়ারেখা নেই; আকলিমার তো কেমন ভয় ভয় করে। অচেনা আশঙ্কার বিষকাঁটা খাবলে ধরে স্বস্তি। কোনো বুদ্ধি পায় না। আবদুর রশিদ এখন হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকা বেকার মানুষ। কীভাবে দিন যাবে? কী ভাবে চলবে? ছেলেমেয়ের ভরা সংসার। সেই সন্ধেয় এইসব হাজার চিন্তা-দুশ্চিন্তার জটিল গুল্মলতা সারারাত ঘুমোতে দেয় না। তার সকল ভাবনার আগামিকাল বিদঘুটে ছায়াচিত্র হয়ে দেয়ালে ভেসে ওঠে। পথ হারানো অন্ধকার গোলকধাঁধা।
আবদুর রশিদ লক্ষ্য করে। সেও নির্ঘুম গুনে যায় রাতের সময়। এপাশ-ওপাশ কাত হয়ে স্বস্তি খোঁজে। তারপর নিজের কাঁধে যেমন সবকিছু তুলে নিয়েছে, তেমনভাবে আকলিমার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলে, -
‘তুমি অত ভাইবো না আকলিমা। ঘুমাও। আল্লার দুনিয়ায় যত মুশকিল...তত আশান। আমার একার চাকরি তো যায় নাই, চার-পাঁচজনের গেছে। মালিক যার যেমন বেতন, তেমন হিসাব কইরা ট্যাকা দিছে। ট্যাকা হইল শক্তি। আমি যা ট্যাকা পাইছি, দেখি কোনো দোকান-টোকান দেওন যায় কি না।’
(চলমান)

আগের পর্ব: কাঠ কয়লা ছাই ২

মন্তব্য ২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই আগস্ট, ২০২০ দুপুর ২:২৪

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: জীবন বাস্তবতার ছবি কথার তুলিতে আঁকা

ভাল লাগলো

++++

০৮ ই আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৫৫

মাহবুব আলী বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা জানবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.