নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভাবনাহীন ভাবনাগুলো

মাহের ইসলাম

মাহের ইসলাম › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছেলেবেলা (২য় পর্ব)

১৬ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ১০:১৫


প্রথম পর্ব - ছেলেবেলা

শুয়ে থাকতে থাকতেই হাজারো স্মৃতি আমাকে ঘিরে ফেলল।

স্কুলের নামতা শেখার স্মৃতি থেকে শুরু করে কড়া রোদ্রে চরের গরম বালিতে শুয়ে থাকা, শীতের সকালে বড়শি দিয়ে কই মাছ ধরা, বিলের ক্ষেত থেকে মাথায় করে ধান নিয়ে আসা ...... এমন হাজারো স্মৃতি মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে একের পর এক ভাসতে থাকে।

চাটাইয়ের ভাঙ্গা বেড়ার স্কুল ঘরের সামনে আম গাছের নিচে ক্লাশের সবাই গোল হয়ে দাঁড়াই, বৃত্তের মধ্যে থাকে আমাদেরই একজন। সে যা বলে , আমরা বাকীরা সমস্বরে তাই পুনরাবৃত্তি করি। আজকে সকালে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে, বালি মাটিতে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে আমার চার পাশে গোল দাগ কাটতে কাটতে এক মনে আঊড়ে গিয়েছি,
একে চন্দ্র।
দুইয়ে পক্ষ।
তিনে নেত্র।
চাইরে বেদ।
পাঁচে পঞ্চবাণ।
ছয়ে ঋতু।
সাতে সমুদ্র।
আটে অষ্টবসু।
নয়ে নবগ্রহ।
দশে দিক।
আমি একটা বলার পর পরই আমাকে ঘিরে দাঁড়ানো বাকীরা সমস্বরে কোরাস গাইতে থাকে। তাদের কোরাস থামলে, আমি পরেরটা বলি। প্রতিদিনই এটা চলে, আর বেশীরভাগ দিনেই আমাকে মাঝে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। কারণ অনেকেই কয়েকবার ভুল করলেও আমার ভুল কম হয়েছে।

স্কুলে পড়া লেখা কখনোই আমাকে টানেনি। তবে, স্কুলে যাওয়া আর বাড়ী ফেরার পথেই ছিল দুনিয়ার সব আনন্দ। বাড়ি থেকে কিছুদুর গেলেই স্বপনদের বাড়ির পিছনেই ছিল বিশাল বড় বাগান, হরেক রকম ফলের গাছে ভর্তি। অনেক সময় ভর দুপুরেও গা ছম ছম করে। বিশেষ করে আকাশে মেঘ থাকলে, কেমন যেন অন্ধকার নেমে আসে বাগানের কয়েকটা জায়গায়। স্কুলে যাওয়ার পথে না হলে, অন্তত ফেরার পথে হলেও এই বাগান থেকে প্রতিদিনই কিছু না কিছু চুরি করতাম। একবার কাচা কাঠ বাদামের বিচি গেয়ে ঠোঁট পুড়ে ফেলেছিলাম, পরে কয়েকদিন ঠিকমত খেতে পারিনি। আবার, মার বকুনির ভয়ে বাড়িতে বলারও সাহস পাইনি, কি যে দুঃসহ যন্ত্রণার কয়েকটা দিন কেটেছে !

গরুকে গোসল করাতে খালে নিয়ে যাওয়ার কাজে, আমার ভাগে মাঝে মধ্যে সহকারীর দায়িত্ব জুটে। খালের পাড়ে গিয়ে, গরুর পালকে পানিতে নামিয়ে দিয়ে সাঁতরে চলে যাই, খালের মধ্যে জেগে উঠা বালুচরে। চরের গরম বালিতে শুয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। উত্তপ্ত বালিতে পিঠ পুড়ে যাওয়ার উপক্রম না হওয়া পর্যন্ত উঠতাম না। এরপরে উঠেই দৌড়ে ঝাঁপিয়ে পড়তাম পানিতে। বালির উত্তাপ সহনীয় হলে, চোখে পানি না আসা পর্যন্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার প্রতিযোগিতা চলতে থাকত। চর থেকে ফিরতে হত, সাতার কেটে। তবে নিয়ম ছিল, সাতরে সোজা আসতে হবে। পানির স্রোতে ফেরার লাইন বাঁকা হওয়া যাবে না। যে লাইন সোজা রেখে আগে এই পাড়ে ফিরতে পারবে, সে হবে বিজয়ী। প্রতিদিনই মেচের জিতত – একদম কুকুরের মত লাইন সোজা রেখে সে সাঁতরে ফিরতে, শুধু একদিন সে জিততে পারেনি। এই কাজ করতে গিয়ে একদিন আমি স্রোতের ঘূর্ণিতে প্রায় ডুবে যাচ্ছিলাম। তখন মেচের এসে আমাকে বাঁচায়। আর এই কারণেই, সেদিন সে লাইন সোজা রেখে খালের এই পাড়ে ফিরতে পারেনি।

গতবার পশ্চিম পাড়ার বিল থেকে ফেরার সময় অন্যমনস্ক থাকায় বাকিদের থেকে কিভাবে যেন দলছুট হয়ে পিছনে পড়ে যাই। সম্বিত ফিরল, গোরস্থানের মধ্যে বাঁশ দিয়ে ঘেরা কবরের উপর খেজুরের ডাল দেখে। পাশের ঘন পাট খেত দিয়ে যেতে যেতে বার বার মনে হচ্ছিল, গোরস্থান থেকে কে যেন আমাকে দেখছে। প্রচন্ড ভয় পেয়ে, বুকে থুথু দিয়ে এক দৌড়ে সড়কে উঠে দম নেয়ার জন্যে থেমেছিলাম। তখন, মনে হচ্ছিল, অনেক দূর থেকে কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। প্রথমে ভেবেছিলাম, ভুল শুনছি, পরে যখন নিশ্চিত হলাম, আসলেই কে যেন ডাকছে ততক্ষণে ভয়ে প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল, পিছনে ফিরে তাকানোর সাহস পাওয়া তো দুরের কথা। এক দৌড়ে গুদারা ঘাটে এসে যখন বাকিদের দেখে থামলাম, আমি কোন কথা বলতে পারছিলাম না। কিছুক্ষনের মধ্যেই মাস্টার বাড়ির রাখাল আর পারুল এসে হাঁসির দমকে প্রায় কোন কথাই বলতে পারছিল না। অনেক পরে, কোন মতে বলল যে, পাটক্ষেতের ভিতর থেকে আমার দৌড় দেয়া দেখেই বুঝেছিল যে, আমি ভয় পেয়েছিলাম। তাই, ভয় ভাঙ্গানোর জন্যে তারাই আমাকে ডেকেছিল।

সেবার বন্যার পানি বেশী হওয়ায় আমাদের সড়ক পানিতে তলিয়ে যায়। নৌকা ছাড়া হাটে যাওয়ার উপায় নেই। হাটের দিনে, নৌকা নিয়ে জ্যাঠা আর দাদাকে হাটে পৌঁছে দিয়ে, ঘাটে নৌকা বেঁধে হাটের ভিতরে ঘুরতে লাগলাম, আমি আর আলতু। কিছুক্ষণ পরে দারোগালি’র পিঁয়াজুর দোকানের সামনে এসে, মনোযোগ দিয়ে পিঁয়াজু ভাঁজা দেখতে দেখতে জিভে পানি চলে আসল। ফুটন্ত গরম তেলে পিঁয়াজু ডুবিয়ে দেয়ার পরে ধীরে ধীরে যখন রং বদলানোর মধ্যেই সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পরে, তখন মনে হয় এ নিশ্চয়ই অপার্থিব কোন অমৃত। যা একবার দেখে ফেললে, না খেয়ে কোন আদম এর মোহ হতে মুক্ত হতে পারবে না।

দুজনের কারো কাছেই এক পয়সাও নেই। লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আলতুর বুদ্ধিতে তাড়াতাড়ি হাটের ঘাট থেকে নৌকা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম পুব পাড়ায় যাওয়ার জন্যে। যাদের নিজেদের নৌকা নেই, তাদেরকে আমাদের নৌকা দিয়ে হাটে আনতে পারলে, কিছু পয়সা পাওয়া যাবে। দাদা আর জ্যাঠা কয়েক বস্তা ধান এনেছে। সেগুলো বিক্রি করে, তাদের বাজার সদাই শেষ করার আগেই আমাদের কয়েকটা খ্যাপ মারা হয়ে যাবে। বেশিক্ষন লাগলো না, দুই খ্যাপেই কয়েক টাকা পেয়ে গেলাম। এক ঠোঙ্গা পিঁয়াজু কিনে দু’জনে নৌকায় ফিরে খেতে লাগলাম। সত্যিই অমৃত মনে হচ্ছিল। হাটের পিঁয়াজুগুলোই কিভাবে কিভাবে যেন এমন সুস্বাদু হয়, অন্য কোন পিঁয়াজুর স্বাদ এর ধারে কাছেরও হয় না।

গ্রীষ্মে মাঝে মধ্যে আমরা কুমোর পাড়ায় যেতাম কাসুন্দি আনতে। সরিষা দিয়ে তারা যে কাসুন্দি বানায়, তা অতুলনীয়। আমরা ছোট মাটির বাটি নিয়ে তিন-চার জন বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে কাসুন্দি চাইতাম। কখনো কোন বাড়ি থেকে খালি হাতে ফিরতে হত না। কেউ কেউ আবার একটু বেশী করেই দিত, যেন আমাদের জন্যেই বানিয়েছিল। তবে, হীরকদের বাড়িতে গেলে আমি একটু আলাদা তোয়াজ পেতাম। কাকিমা কখনো মোয়া বা নাড়ু ছাড়া ফিরতে দিত না। আর কিছুই না থাকলে, হাতে দু-একটা আম ধরিয়ে দিতেন, কাসুন্দি দিতেন পুরো এক বাটি। অনেক পরে অবশ্য জানতে পেরেছিলাম, কাকিমার বাবার বাড়ি আমার নানার বাড়ির পাশের গ্রামে,আমার মায়ের পরিচিত ছিলেন তিনি।

শীতের দিনে নানা বাড়িতে বেড়াতে যেতাম।
অনেক পথ হেটে যেতে হয়, যার বেশীরভাগই নদীর পাড় ধরে, সরিষা ক্ষেতের পাশ দিয়ে। পুরো দুনিয়াকে হলুদ চাদরে ঢাকা মনে হত, কোন কোন জায়গায়। নানা বাড়ির গ্রামের কাছে এসে নৌকা দিয়ে নদী পার হতে হয়। তবে কোন কোন হাটের দিনে হাটুরেদের নৌকায় করে নানা বাড়ি যেতে পারতাম। মামা-খালা’রা প্রায় সবাই এক পাড়াতেই থাকে। নানা বাড়ির উঠোনে পা রেখেই, মায়ের চোখে মুখে চাঁপা আনন্দের আভা টের পেতাম। সবাই খাওয়ার পরে, রাতে বাড়ির সব মেয়েরা একত্রে খেতে বসে, কি নিয়ে যেন প্রায়ই হাসাহাসি করত। হাঁসির কারণ আমি কখনোই বের করতে পারিনি, কিন্তু মার মুখের হাঁসি দেখে এতটুকু বুঝতাম যে, নিশ্চয় কোন আনন্দের ব্যাপার হবে, বিষয় বুঝার চেষ্টা করা এখানে অর্থহীন।

পিঠা খাওয়ার জন্যে ভোরে ঘুম থেকে ডেকে তোলার সময় যে বিরক্তি লাগত, ধোঁয়া উঠা গরম গরম ভাপা পিঠা মুখে দেওয়ার পরে তার চেয়ে অনেক বেশী ভালো লাগত। এর পরে সারাটা দিন কাটাতাম খালাত-মামাত ভাইবোনদের সাথে। তখনই শিখেছি যে, গাব গাছের ডাল সহজে ভাঙ্গে না, কিন্তু আতা গাছের ডাল ভেঙ্গে যায়, কারণ আমি নিজেই একবার ডাল ভেঙ্গে পড়ে গিয়েছিলাম। চটের বস্তার মধ্যে ধানের কুড়া দিয়ে খাল থেকে চিংড়ি ধরা আর পানির নিচে ডুব দিয়ে মাটির গর্তে হাত দিয়ে মাছ ধরে আনতে পারার অনুভূতি – মানব জীবনের অন্য কোন সাফল্যের সাথে তুলনা করার উপায় নেই।

রাতে, মামা-খালারা নানা-নানীর সাথে মিলে সবাই যখন একত্রে বসে গল্প করত, তখন বাচ্চাদের কেরামতি জাহির করার সুযোগ আসতো মাঝে মধ্যে। মুরুব্বীরা প্রত্যেকেই সবচেয়ে বেশী তারিফ করত, খালাত ভাই আব্দুল্লাহ’র সুরেলা কণ্ঠে সুরা ফাতিহা পড়া। টিপু খুব সুন্দর করে ‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর’ কবিতা বলতে পারত।

আমি সবচেয়ে ভালো পারতাম গল্প বলতে।
টোনা-টুনির গল্প আর কাক-চড়ুই এর গল্প ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয়।

পরের পর্ব- ছেলেবেলা – তৃতীয় পর্ব ( কাক ও চড়ুইয়ের গল্প )

ছবিঃ ভোরের কাগজ, জুলাই ২৩, ২০১৮ (গুগল থেকে সং গৃহীত)।
(চলবে)

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ১১:১৮

পদাতিক চৌধুরি বলেছেন: মাহেরভাই,

শৈশবের স্মৃতিময় স্মৃতিকথা পড়তে ভালো লাগলো। আমিও আপনার মত পড়া না করে গরু নিয়ে মাঠে যেতাম আর স্কুলে যাওয়ার সময় পার করে বাড়ি ফিরতাম। সেসব দিন কী আর পাবো ফিরে। যাক স্মৃতিকথা চলতে থাকুক।

শুভকামনা জানবেন ।

১৬ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ১১:২৭

মাহের ইসলাম বলেছেন: অসংখ্য ধন্যবাদ।
আপনাকে দেখে ভাল লাগলো।

শুভ কামনা রইল, আপনার প্রতিও।

২| ১৭ ই আগস্ট, ২০১৮ দুপুর ২:০৫

রাজীব নুর বলেছেন: মানূষের ছেলেবেলাটাই সবচেয়ে আণন্দময় হয়।

১৭ ই আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৩:০৪

মাহের ইসলাম বলেছেন: আপনাকে দেখে ভালো লাগল।
আসলেই তাই, ছেলেবেলার দিনগুলোই সবচেয়ে আনন্দের ছিল।

ভালো থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.