নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভাবনাহীন ভাবনাগুলো

মাহের ইসলাম

মাহের ইসলাম › বিস্তারিত পোস্টঃ

তোরা বাঙালি হইয়া যা

০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১২:৩৩



পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা ও সঙ্কটের কারণ ও সূত্রপাত সম্পর্কে অনেক ইতিহাস গবেষক ও বিজ্ঞ লেখককে তোরা সব বাঙালি হইয়া যা- এই বাক্য বা বাকাংশের প্রতি ইঙ্গিত করেন। “তোরা সব বাঙালি হইয়া যা” – এই আহ্বানের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জ্ঞাত বাংলাদেশীর আনুমানিক সংখ্যা কী পরিমাণ কিংবা বাংলাদেশের মূল জনগোষ্ঠীর কী পরিমাণ মানুষ এই শব্দগুচ্ছের সাথে পরিচিত– সেটা জানার উপায় নেই। তবে অনেকেই ধারণা করেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ অংশের আবেগের সাথে এই আহবান ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলীর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন অন্যতম। দুই দশকের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে পাহাড়ি আর বাঙালি মিলিয়ে মৃতের প্রকৃত সংখ্যা অদ্যবধি নিরূপণ করা যায়নি। ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি পরবর্তী সময়ে সরকারের আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গৃহীত বহুবিধ রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নমূলক পদক্ষেপের পরেও অদ্যবধি পার্বত্যাঞ্চলে কাঙ্ক্ষিত শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি।

এমনকি যে জাতিগত অধিকার আর স্বাতন্ত্র্য রক্ষার দোহাই দিয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল এই অঞ্চলের কিছু মানুষ, সংবিধান সংশোধন করে ‘বাংলাদেশি’ জাতীয়তাবাদের প্রবর্তনের মাধ্যমে তাদের জাতিসত্ত্বা রক্ষার সাংবিধানিক রক্ষাকবচ দেয়া সত্ত্বেও তারা সশস্ত্র বিদ্রোহ থেকে সরে আসেনি। এতে বোঝা যায়, শুধু জাতিসত্ত্বার স্বীকৃতি নয়, তাদের দাবী ছিলো আরো বেশী কিছু। তাই আজ সেখানে তথাকথিত ‘জুম্ম জাতীয়তাবাদ’ আর ‘স্বাধীন জুম্মল্যান্ড’ এর আওয়াজ শোনা যায়। সঙ্গত কারণেই কৌতুহল জাগে যে, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর এহেন আহবানের ভূমিকা আদতে কতটুকু ছিল?

যে মানুষটি সারা জীবন বাঙালি জাতির কল্যাণ ও অধিকার নিয়ে ভেবেছেন, দেশের সকল মানুষের মৌলিক অধিকার পুরণের মাধ্যমে উন্নত জীবন নিশ্চিত করার চিন্তা যার মনে প্রতিনিয়ত ছিল, মানুষের দুঃখে যার মন কাঁদত, বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যিনি ১৩ বছর জেল খেঁটেছেন, যার বিশাল হৃদয়ের ঔদার্য নিয়ে তার নিন্দুকেরা পর্যন্ত কখনো কিছু বলতে পারেনি– জাতির সেই মহান জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুখে উচ্চারিত এহেন শব্দগুচ্ছের ইপ্সিত বার্তা ও প্রেক্ষাপট এবং বাস্তবতা অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। প্রাসঙ্গিকভাবেই বঙ্গবন্ধুর এহেন উচ্চারণে প্রকাশিত অসহিষ্ণুতার বিপরীতে উপজাতিদের অধিকার নিশ্চিত করা ও স্বার্থ রক্ষায় তিনি কতটা আন্তরিক ছিলেন তা খুঁজে বের করা তাই অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়।

মুক্তিযুদ্ধের চলাকালীন উপজাতিদের একটা বড় অংশ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করলেও পক্ষাবলম্বনকারীদের সিংহভাগই পাকিস্তানীদের সমর্থনে উপজাতীয় রাজাকার, মুজাহিদ বাহিনী ও সিভিল আর্মড ফোর্সে যোগদান করেছিল। বিশেষ করে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় এবং চাকমা সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সাধারণভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হয়। যার পরিণতিতে, যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশে উপজাতিরা কোন কোন ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের বিদ্বেষ এমনকি সহিংসতার শিকার হতে বাধ্য হয়।

বাঙালীদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের প্রস্তুতির খবরাখবর জানা থাকলেও ২৫শে মার্চের বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করার উপায় বঙ্গবন্ধুর ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নয়মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকাকালীন স্বাভাবিকভাবেই বাংলদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী তাঁর জানার সুযোগ ছিল না। স্বাধীনতার পরে, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।

দেশে ফিরে প্রত্যক্ষ করেছিলেন বাংলাদেশের চারদিকে যুদ্ধের ধ্বংসলীলা, শুনেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ আত্নত্যাগ, ৩০ লাখ শহীদের হত্যাযজ্ঞ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানীর করুণ কাহিনী। ধ্বংস, হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণের করুণ কাহিনীর পাশাপাশি জেনেছিলেন স্বাধীনতা বিরোধিদের কথা। সঙ্গত কারণেই রাজাকার, আল বদর, আল শামস, জামায়াতে ইসলামী আর শান্তি বাহিনীর স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি উঠে এসেছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা রাজা, বোমাং রাজা আর চাকমা সম্প্রদায়ের স্বাধীনতা বিরোধী নৃশংসতার বিবরণ আর বিশ্বাসঘাতকতার সমস্ত কাহিনী।

মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ত্রিদিব রায় পাকিস্তানে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং তার বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকা অব্যাহত রাখে। উল্লেখ্য যে, আওয়ামী লীগের টিকেটে নির্বাচনে অংশ নেয়ার বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে ত্রিদিব রায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং আওয়ামী লীগের প্রার্থী চারু বিকাশ চাকমাকে পরাজিত করে নির্বাচিত হন। (চাকমা শ. শ., ২০০৬) (। মুলত ত্রিদিব রায়ের বাংলাদেশের মূল জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্বাচরণ তখন থেকেই শুরু। এরপরে, তার প্ররোচণায় চাকমা সমাজের একাংশের বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকার কারণে সমগ্র চাকমা জাতি বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের কাছে জাতীয় আনুগত্যের প্রশ্নে সংশয়াবদ্ধ হয়ে পড়ে।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানী বাহিনী আত্নসমর্পণ করলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে তখনো যুদ্ধ শেষ হয়নি। বরং কিছু পাকিস্তানী সেনা, পূর্ব পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স (EPCAF) এবং রাজাকার বাহিনী পালিয়ে এসে পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল। এমনকি ভারতের মিজো বিচ্ছিন্নতাবাদীরাও স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকে। ( (ভৌমিক, ১৯৯৬), (আহমেদ, ১৯৯৩)। যার প্রতিফলন পাওয়া যায় মেজর জেনারেল উবান (২০০৫) এর কথায়,

“আমার সৈন্যরা তখনও গোলাগুলির সম্মুখীন হচ্ছিল। মিযো, রাযাকার এবং চাকমাসহ অনেক প্যারা মিলিটারি বাহিনীর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া কিন্তু সশস্ত্র লোক পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো গেরিলা যুদ্ধের আদর্শ ভুমিতে বিচরণ করছিল।” (উবান, ২০০৫, পৃ. ১১৭)।

লেখক জামাল উদ্দিনের গবেষণা গ্রন্থ ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস’ বইয়ে তিনি জানান,

“ঢাকা স্বাধীন হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর। অথচ ২২ ডিসেম্বরেও পার্বত্য এলাকায় যুদ্ধ হয়েছে।” (উদ্দিন, ২০১৬, পৃ. ৩৮১)

এহেন পরিস্থিতি মোকাবেলায় ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থানরত বাংলাদেশ বিরোধী সকল উপাদানকে শক্ত হাতে দমন করার জন্যে নির্দেশ দেয়া হয়- যা বাস্তবায়নে বিমান বাহিনীর সহায়তায় বোম্বিং পর্যন্ত করা হয়েছিল। জানুয়ারি ১৯৭২ এর প্রায় শেষের দিকে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয় (আহমেদ, ১৯৯৩)। যদিও ১৯৭২ সালের মার্চে বান্দরবানের রুমা’তে মিজো বিদ্রোহীরা এক পুলিশ স্টেশন আক্রমণ করে ১১ জনকে হত্যা করে এবং অস্ত্র-গোলাবারুদ লুট করে নিয়ে যায়। (Schendel, ২০১৫)। ইত্যবৎসরে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের নির্মূলের অভিযান চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পার্বত্য চট্রগ্রামের বেশ কিছু স্থানে নিরীহ উপজাতির লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ঠিক এই সময়কালে, ১৯৭২ সালের ২৯ জানুয়ারিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা চারু বিকাশ চাকমার নেতৃত্বে ৭ সদস্যের এক প্রতিনিধি দল রাস্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী এবং অন্যান্য উর্ধ্বতন আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎকালে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি জানাতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের অভিযোগ আর পাহাড়িদের ক্ষোভের কথা জানিয়ে তাদের রক্ষার জন্যে সাংবিধানিক রক্ষাকবচের অনুরোধ করেন। নিজ ঔদার্য আর মহানুভবতার গুণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই প্রতিনিধিদলকে তৎক্ষণাৎ আশ্বস্ত করে বলেছিলেন যে,

– পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের ঐতিহ্য ও কৃষ্টি পুরোপুরিভাবে সংরক্ষণ করা হবে।
– সরকারী চাকুরীতে উপজাতিয়দের ন্যায্য অংশ প্রদান করা হবে।
– তাদের ভূমির অধিকার আগের মতই ভোগ করতে থাকবে। (চাকমা, ১৯৯৩)।

মৃত্যুকে তুচ্ছ করে, জীবন বাজী রেখে, ৯ মাস জেল খেঁটে, ত্রিশ লাখ বাঙালির প্রাণের বিনিময়ে, ২ লাখ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত স্বপ্নের, সাধের দেশে ফেরার মাত্র ১৮ দিনের মাথায়, এমন এক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিবৃন্দ এমন এক দাবী নিয়ে এসেছিলেন(যা মূলত সেই দেশের অখণ্ডতাকে, সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়) যাদের রাজা এবং অন্যান্য নেতাদের ভুমিকার কারণে পুরো জনগোষ্ঠীকে ইতোমধ্যেই সাধারণভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এমন এক সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে নিপীড়নের অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, যখন নব্য স্বাধীনতালব্ধ দেশের আভ্যন্তরীণ গোলযোগ পুরোপুরি বন্ধ হয়নি, বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রামে। সমগ্র বাংলাদেশ যখন নয় মাসের এক যুদ্ধের ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে, দেশ যখন গোলযোগ আর স্থিতিশীলতার মধ্যে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখন এই প্রতিনিধিদল এসেছিল তাদের পৃথক জাতিসত্ত্বার রক্ষাকবচের দাবীতে, স্বায়ত্ত্বশাসনের নামে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোকে কুঠারাঘাত করতে।

এর মাত্র দুই সপ্তাহ পরে, ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুআরিতে মং রাজা মং প্রু সাইনের নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধিদল এক স্মারকলিপি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করতে যান। এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন, এম এন লারমা, বিনীতা রায়, জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, কে কে রায়, মং প্রু চাই, মং শৈ প্রু এবং সুবিমল দেওয়ান। প্রতিনিধি দলের সদস্য জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা নিশ্চিত করেছেন যে, “নির্ধারিত সময়ে তিনি জরুরী কাজে বাইরে থাকায়, প্রতিনিধিদল তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে পারেনি। ” (চাকমা জ. ব., ১৯৯১ পৃষ্ঠা ৫০)। তাই, ‘বাংলাদেশের ভাবি সংবিধানে উপজাতীয়দের ন্যায়সঙ্গত অধিকার সংরক্ষণের জন্যে’ এই প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তার কাছে স্মারকলিপি পেশ করে, যে স্মারকলিপিতে উল্লিখিত চার দফা দাবী ছিল নিম্নরূপঃ

১। পার্বত্য অঞ্চল একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হবে এবং এর নিজস্ব আইন পরিষদ থাকবে।
২। উপজাতীয় জনগণের অধিকার সংরক্ষণের জন্য ‘১৯০০ সালের পার্বত্য চট্রগ্রাম শাসনবিধি’র ন্যায় অনুরূপ সংবিধি ব্যবস্থা (Sanctuary Provision) শাসনতন্ত্রে থাকবে।
৩। উপজাতীয় রাজাদের দফতর সংরক্ষণ করা হবে।
৪। পার্বত্য চট্রগ্রামের জনগণের মতামত যাচাই ব্যতিরেকে পার্বত্য চট্রগ্রামের বিষয় নিয়ে কোনো শাসনতান্ত্রিক সংশোধন বা পরিবর্তন যেন না হয়, এরূপ সংবিধি ব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে থাকবে। (খীসা, ১৯৯৬)।

নব্য স্বাধীনতালব্ধ যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে কত ধরনের যে সমস্যা থাকতে পারে, তা জানতে আমাদের বেশী দূর যেতে হবে না। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের তৎকালীন সময়ের দিকে খেয়াল করলেই বরং বুঝতে সহজ হবে। এই রকম একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত সমস্যা-সংকুল দেশের প্রেক্ষাপটে, বঙ্গবন্ধু দেশে প্রত্যাবর্তনের প্রায় এক মাসের মধ্যেই কারা এমন দাবী করেছিল? যাদের রাষ্ট্রীয় আনুগত্য পাকিস্তান আমল থেকেই সন্দেহাতীত ছিলো না(ভারত ভাগে যারা পূর্ব পাকিস্তানের সাথে তথা বাংলাদেশের সাথে অন্তর্ভূক্তি অস্বীকার করে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারতে পতাকা উড়িয়েছিলেন) এবং যাদের একটা বড় অংশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে বিরোধিতা করেছিল।

তাই স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র দুই মাসের মধ্যেই দেশের এক- দশমাংশ অংশের জন্যে স্বায়ত্বশাসনের দাবী, স্বাভাবিকভাবেই অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। বাংলাদেশের প্রতি এই জনগোষ্ঠীর আনুগত্য নিয়ে প্রশ্নের সুযোগ সৃষ্টি হওয়া তাই একেবারে অস্বাভাবিক নয়। অথচ, বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে এই প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন তাদের ভুলের জন্যে ক্ষমা চাওয়া এবং সবাই মিলে নতুন দেশ গড়ার কাজে তাঁর হাত শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি দিতে পারতেন।

সঙ্গত কারণেই তৎকালীন সময়ের ঘটনাবলী, এবং নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা ও ভুলের কারণে সৃষ্ট অবিশ্বস্ততার ধারণা এবং পার্বত্য জনগোষ্ঠীর প্রতি বাংলাদেশের মূল জনগোষ্ঠীর সন্দেহের প্রেক্ষাপটে একজন মন্তব্য করেছিলেন,

“ দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনে শেখ মুজিব যদি আমাদের উপজাতীয় নেতাদের সেই সদস্যদের ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিতেন তা অমান্য করার স্পর্ধা কারো ছিল না। ” ( উপজাতীয় নেতৃত্ব: সশস্ত্র আন্দোলনের ইতিকথা, সুনীতি বিকাশ চাকমা)।

অথচ, বঙ্গবন্ধু নিজস্ব প্রজ্ঞা আর মহানুভবতা দিয়ে কালক্ষেপণ ব্যতিরেকেই তাদের স্বার্থ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, পরবর্তীতে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে তিনি যথেষ্ট আন্তরিকও ছিলেন।

পরের অংশ তোরা বাঙালি হইয়া যা (শেষ পর্ব)

তথ্যসুত্রঃ
১। জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, (১৯৯৩). ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় সরকার পরিষদ. রাঙামাটি: স্থানীয় সরকার পরিষদ, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।
২। শরদিন্দু শেখর চাকমা, (২০০৬). মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্রগ্রাম. ঢাকা: অঙ্কুর প্রকাশনী।
৩। উৎপল খীসা, (২০১৬). ফিরে দেখা শান্তি বাহিনীর গৃহযুদ্ধ স্বপ্নের অপমৃত্যু. ঢাকা: শ্রাবণ প্রকাশনী।
৪। মেজর জেনারেল (অব.) এস এস উবান, (২০০৫). ফ্যান্টমস অব চিটাগাং- দি ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ. (হোসাইন রিদওয়ান আলী খান অনুদিত), ঢাকা: ঘাস ফুল নদী।
৫। Aftab Ahmed, (1993, November). Ethnicity and Insurgency in the Chittagong Hill Tracts Region: A Study of the Crisis of Political Integration in Bangladesh. Journal of Commonwealth & Comparative Politics, 31(3), 32-66.
৬। Subir Bhaumik, (1996). Insurgent Crossfire North-East India. New Delhi: Lancer Publishers.
৭। S Mahmud Ali, (1993), The Fearful State: Power, People and Internal War in South Asia, New Jersey, Zed Books.
৮। Willem Van Schendel, (October 2015), A War Within a War: Mizo rebels and the Bangladesh liberation struggle. Modern Asian Studies, pp.1-43.

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:১৭

রাজীব নুর বলেছেন: খুব সুন্দর লেখা।
সহজ সরল সুন্দর লেখা। গোছানো ছিমছাম।

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:৩৮

মাহের ইসলাম বলেছেন: শুভ সকাল, রাজীব ভাই।
আপনাকে দেখে খুব ভালো লাগলো।

আপনাকে পাঠক হিসেবে পেলে এমনিতেই নিজেকে সম্মানিত বোধ করি।
তার উপরে, এত সুন্দর মন্তব্য! আবার প্রথম মন্তব্য।
রীতিমত গর্বিত বোধ করছি এবং অনেক অনেক খুশী হয়েছি।
অসংখ্য ধন্যবাদ।

ভালো থাকবেন, শুভ কামনা রইল।

২| ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:৪৯

নাদিম আহসান তুহিন বলেছেন: পড়লাম, জানলাম, পরের পর্বের জন্য অপেক্ষায় রইলাম।

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১২:৩২

মাহের ইসলাম বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ।
উৎসাহিত বোধ করছি।

ভালো থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.