নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভাবনাহীন ভাবনাগুলো

মাহের ইসলাম

মাহের ইসলাম › বিস্তারিত পোস্টঃ

গণক

৩১ শে মার্চ, ২০১৯ রাত ১১:২১


কত আর বয়স হবে তখন? দশ কি বারো!
বাবা-মায়ের নিত্যদিনের ঝগড়াঝাঁটি আমার মনকে পুরোপুরি ভেঙ্গে দিয়েছে। মা যথাসাধ্য চেষ্টা করছিলেন বাবাকে সুপথে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু বাবা কোনমতেই মদ আর জুয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারছিলেন না। যার ফলে, স্বাভাবিকভাবেই দারিদ্র্যতা আর অশান্তির ছাপ পড়েছে, আমাদের সংসারের চারপাশের সব কিছুতে।

বেশিদিন লাগলো না, আমাদের এই দুরবস্থার কথা নানার কানে পৌঁছাতে। নানাবাড়ির অবস্থা তুলনামুলকভাবে সচ্ছল ছিল। আদরের ছোট মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নানা কিছু জমি বিক্রি করে তার জামাইকে বিদেশ পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। তবে বাউন্ডূলে টাইপের মানুষ আমার বাবা বিদেশে গিয়েও তেমন যুতসই কিছু করতে পারলেন না। অল্প দিনের মাথায়ই বিভিন্ন ধরনের চাকুরীতে ব্যর্থ হয়ে, শেষমেশ দু’বছরের মাথায় দেশে ফিরে এলেন।

আমি মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম – দু’বছর আগের সাংসারিক অশান্তি আর ঝগড়া-ফ্যাসাদের জন্যে। চরম খারাপ পরিস্থিতির জন্যে প্রস্তুত হলেও, আমার ছোট হৃদয়ে একটু আশাও ছিল। আশা এই যে, হয়ত বাবার মধ্যে পরিবর্তন হয়েছে, হয়ত আমিও অন্য বাচ্চাদের মত স্বাভাবিক হাসিখুশির একটা ‘আমার ছেলেবেলা’ পেতে যাচ্ছি।

বাবা দেশে ফেরার কিছুদিন পরে, তার এক বিদেশে থাকাকালীন পরিচিত কলিগের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ঠিক কি উপলক্ষে – তা এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। তবে, যতটুকু মনে পড়ে, কোন কিছু উদযাপন উপলক্ষে আরো কয়েকটি পরিবারের সাথে আমাদেরকে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ হলে, আমরা উঠানে খেজুর পাতার পাটিতে বসে গল্প করছিলাম। এর মধ্যে কেউ কেউ চলে যেতে শুরু করেছে।

হঠাৎ এক সময়, গৃহকর্তী আমার মাকে ঘরের ভিতরে গিয়ে হাত দেখানোর আমন্ত্রণ জানালো। ঘটনাচক্রে, আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে এক মহিলার হাত দেখার খ্যাতি ছিল। তাদের সবার সাথে প্রথম দেখা বলে, এর আগে আমার মায়ের হাত দেখানো হয়নি। আমি তাদের পিছু পিছু গিয়ে ঘরের বারান্দায় থেকে কান খাঁড়া করে রইলাম। তবে তাদের মধ্যে কি কথাবার্তা হলো, তার কিছুই শুনতে পেলাম না।

যাই হোক, আমার মায়ের হাত দেখা শেষ হলে, ঐ মহিলা আমার হাত দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। আমার মা বিনা বাক্যব্যয়ে রাজী হয়ে, ঘরের মধ্যে ঐ স্বল্প পরিচিতা মহিলার জিম্মায় আমাকে রেখে বাইরে চলে গেলেন, বাকিদের কাছে।

ঘরের ভিতরে এখন শুধুমাত্র দুইজন – আমি আর ঐ মহিলা। বাকী সবাই উঠোনে গল্প গুজবে ব্যস্ত। আমি একদিকে ভয় পাচ্ছি, আবার কৌতুহলও হচ্ছে। জানালা বন্ধ থাকায়, শুধুমাত্র দরজা দিয়ে বাইরের আলো প্রবেশ করতে পারছে। আলাদা কোনো বাতি জ্বালানো হয়নি। হালকা অন্ধকারের ঘরের ভিতরটা আমার কাছে কেমন ভুতুরে ভুতুরে ঠেকছিল। মহিলার দিকে তাকিয়ে একটু ভয় ভয়ও লাগছিল; কপালের টিপটা একটু বেশি বড়, গলার স্বরও যেন কেমন অদ্ভুত মনে হচ্ছিল।

আমার হাত সামনে মেলে ধরতে বলল, দুই তালু উপর দিকে খোলা। অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে দেখে, হঠাৎ ডান তালু ধরে নিজের দিকে টান দেয়ার আমি প্রায় চমকে উঠলাম। চোখের কাছে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে খুটিয়ে খুঁটিয়ে, টিপে টিপে দেখল। এর মধ্যেই আমার দিকে তাকালো কয়েকবার। কিছুটা উৎকণ্ঠা, কৌতুহল, আর দ্বিধার এক মিশ্রিত অনুভূতি আমাকে গিলে খেতে শুরু করেছে ততক্ষণে।

সিনেমায় গণকেরা ভয়ংকর কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করার পূর্বমুহূর্তে যেভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, মহিলা ঠিক তেমনিভাবে ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। আমার কৌতূহল উধাও হয়ে গেছে ততক্ষণে; উল্টো, আমি এখন পুরোপুরি উৎকণ্ঠিত এবং শক্ত হয়ে বসে আছি। আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। তার চোখমুখের অভিব্যক্তি দেখে আমি বুঝে গেছি, এই মহিলার কাছ থেকে আমাকে খুব ভয়ংকর কিছু শুনতে হবে, কিছুক্ষনের মধ্যেই।

এভাবেই আরো বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পরে তিনি আমার বাম তালুও নিজের হাতে তুলে নিলেন। আমার দুই তালু এখন তার দুই তালুর মধ্যে বন্দী, অনেকটা চ্যাপ্টা পান পাতার মতো করে ধরে রেখেছেন। কিছুক্ষণ, মাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। এর পর ধীরে ধীরে মাথা তুলে সরাসরি আমার চোখে চোখ রেখে দৃস্টি স্থির করলেন। এভাবে কেটে গেল, আরো কিছু মুহূর্ত। অজানা এক আতংক আমাকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলেছে, ততক্ষণে। মনে হচ্ছে, আমি শ্বাস নিতেও ভুলে গেছি।

শেষমেশ, তার গলা দিয়ে স্বর বেরুলো; গভীর এবং ভারাক্রান্ত সে কণ্ঠ,
- আদরের ছোট সোনা, যদিও আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, তবুও তোমার কাছ থেকে লুকানো ঠিক হবে না।
একটু সময় নিয়ে, তারপর সে বলল,
- আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই তোমার মা মারা যাবে। তোমার হাতের সকল রেখায় এটা পরিষ্কার, আমি নিশ্চিত।

আমার মনে হলো, কেউ একজন লোহার হাত দিয়ে আমার শরীরের ভিতর থেকে সমস্ত কিছু ছিড়ে ফেলছে। বাইরে থেকে কিছু বুঝা যাচ্ছে না, তবে ভিতরের একটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গও আর আস্ত নেই। তীব্র ব্যাথা আর হতাশার ঘন কাঁদা দিয়ে আমাকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলছে, কে যেন – আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমাকে কে যেন ফুটন্ত লাভার মধ্যে ছুঁড়ে ফেলল। তীব্র যন্ত্রণা, কিন্তু আমি একটুও নড়াচড়া করতে পারছি না।

কতক্ষন কেটেছে জানি না, আমি মহিলার চোখের দিকে তাকালাম। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করেছে, টপ টপ করে। কিন্তু মুখে কান্নার কোন শব্দ নেই। বড়রা যেভাবে নিঃশব্দে কাঁদে, আমি ঐ মুহূর্তে, ঐ বয়সেই সেই কান্না শিখে ফেললাম এবং কাঁদছি। এত বড় বিপদ, অথচ কারো সাহায্য চাইতে পারছি না, এতটাই অসহায় হয়ে পড়েছি।

তিনি ততক্ষণে আমাকে সাহস যুগাতে শুরু করেছেন। উৎসাহ ব্যঞ্জক কি কি যেন বলছেন,আমার কান দিয়ে কিছুই ঢুকছে না। শুধু এটুকু খেয়াল আছে, তিনি বলেছিলেন যে, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে তিনি আমাকে এটাও বুঝিয়ে ফেললেন যে, এমন একটা কথা আর যাই হোক, আমার মা’র কানে যেন না যায়।

উঠে দাড়িয়ে তিনি আমাকে টেনে তুলে ঘরের বাইরে নিয়ে এলেন। এরপর হাটতে হাটতে অন্যদের কাছে চলে গেলেন। আমি দরজার চৌকাঠে কিছুক্ষণ হেলান দিয়ে রইলাম। এরপর বারান্দার কোনায় চুপ করে বসে পড়লাম। সামনেই উঠানে আমার মা এবং অন্যরা বসে আছে। বিকেলের শেষে যখন অন্যরা উঠতে শুরু করল, আমি এগিয়ে গিয়ে মায়ের কাছে চলে গেলাম। এখনো ঠিকমত শ্বাস নিতে পারছি না, কথা বলা বা চিন্তাও করতে পারছি না।

চলে যাওয়ার সময়, উঠানের শেষ মাথা পর্যন্ত অন্যরা এগিয়ে এল আমাদের বিদায় জানাতে। তখন সেই মহিলা আমাকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
- ভয় পেয়োনা। সাহস হারিয়ো না।

আমরা চলে এলাম। শুরু হলো আমার উৎকণ্ঠিত দিন পার করার পালা।

ঐ ঘটনার পরে প্রায় ত্রিশ বছর পেরিয়ে গেছে। আমার মা এখনো বেঁচে আছে, সুস্থ আছে। যদিও আমার মা অদ্যবধি বেঁচে আছে, তবে আমি প্রতিটি দিন কাটিয়েছি, এক ভয়ের মধ্যে, আমার মা’কে হারানোর ভয়ে।

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ৮:০২

রাজীব নুর বলেছেন: ঠিক এরকম একটা ঘটনা আমারও ঘটেছিল।

০১ লা এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৯:১৭

মাহের ইসলাম বলেছেন: অনেক দিন পরে আপনাকে দেখলাম। ভালো লাগলো।
অনেক ধন্যবাদ, সময় দেয়ার জন্যে।

পদাতিক ভাইয়ের পরামর্শে অপেরা দিয়ে সামুতে আসতে পেরেছি।
দীর্ঘদিন আসতে পারছিলাম না, কি যে মিস করছিলাম !!

ভালো থাকবেন।

২| ০১ লা এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ৯:০১

পদাতিক চৌধুরি বলেছেন: শুভ সকাল প্রিয় মাহেরভাই,

অত্যন্ত সুন্দর বর্ণনা । এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। গণক মানেই ঢপের চপ। মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে কাল্পনিক ভাবে নিজেকে বিশ্বস্ত গড়ে তুলতে নানা রকম ফন্দি ফিকির করে থাকে।
আপনাকে ব্লগে পেয়ে ভীষণ ভালো লাগছে।

শুভকামনা ও ভালোবাসা জানবেন।

০১ লা এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৯:১৯

মাহের ইসলাম বলেছেন: আমার জন্যে অবশ্য শুভ সকাল বলার উপায় নেই, শুভ সন্ধ্যা বলতে পারি।

অনেক অনেক ধন্যবাদ।
প্রথমত, অপেরা ব্রাউজারের আইডিয়া দেয়ার জন্যে। নাহলে, হয়ত এখনো সামু'তে আসতে পারতাম না।
আর, অবশ্যই ধন্যবাদ জানাচ্ছি, সুন্দর মন্তব্যের মাধ্যমে আমাকে উৎসাহিত করার জন্যে।

শুভ কামনা রইল। ভালো থাকবেন।

৩| ০১ লা এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ১১:১৮

ভুয়া মফিজ বলেছেন: হাত দেখে ভাগ্য বলে দেয়া হলো একধরনের প্রতারণা। অনেকেই বিভ্ন্নি সময়ে আমার হাত দেখতে চেয়েছে। আমি কাউকেই দেখাইনি। অন্য অনেক কারনের মাঝে একটা কারন ছিল, আমার গোপন কথা আমার মাঝেই থাক। অন্যের জানার দরকার কি? আমি বিশ্বাস করি না....ঠিক আছে। কিন্তু সত্যি তো হতেও পারে!!

তবে আপনার এই ঘটনার একটা পজিটিভ দিক আছে। আমার ধারণা, ওই ঘটনার পড়ে মায়ের প্রতি আপনার ভালোবাসা কয়েকগুন বেড়ে গিয়েছিল....আমি নিশ্চিত।

০২ রা এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৮:০৭

মাহের ইসলাম বলেছেন: আমার আগেই বলে নেয়া উচিৎ ছিল, এই ঘটনা আমার জীবনে ঘটেনি।

তবে, এটা শোনার পরে, নিজের মায়ের প্রতি আলাদা ভালোবাসা অনুভব করেছি ঠিকই।

৪| ০২ রা এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ১১:৪০

ওমেরা বলেছেন: সবাই মারা যাবে, এটাই সত্য, তাই বলে একটা দশ/ বারো বয়সের বাচ্চার কাছে কেউ কি এমন কথা বলতে পারে !! এমন একটা কথা কাউকে বলাও যাচ্ছে না , এরকম মানসিক চাপে একটা বাচ্চা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে পারে । মহিলাকে ধরে পিটানো দরকার।

আল্লাহ আপনার মাকে নেক হায়াত বৃদ্ধি করে দিন।

০২ রা এপ্রিল, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৫৯

মাহের ইসলাম বলেছেন: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আপনার সাথে সহমত প্রকাশ করছি।

সরি, আগেই বলে নেয়া উচিৎ ছিল - এই ঘটনা আমার জীবনে ঘটেনি।
আমি আরেকজনের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা তুলে ধরেছি।


আল্লাহ্‌ আমাদের সকলের পিতামাতার নেক হায়াত বৃদ্ধি করুন।

৫| ০২ রা এপ্রিল, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:১৬

করুণাধারা বলেছেন: এই ঘটনা আপনার জীবনের নয়? ভাগ্যিস! আমার পড়ে খুবই খারাপ লাগছিল। না গণকের ভবিষ্যৎবাণীর জন্য নয়, প্রথম দুই প‍্যারার জন্য। যদিও এই গল্পের সাথে বাবার উড়নচণ্ডী বা ঊশৃংখল হবার তেমন কোনো যোগ নেই, কিন্তু সেগুলো উল্লেখ করলেন কেন জানিনা। বাবার বদনাম পড়তে ভালো লাগেনি, তাই আমি ভাবছিলাম নিজের বাবা সম্পর্কে কেউ এমন কথা লিখতে পারে!

গল্প হিসেবে চমৎকার হয়েছে। :)

০২ রা এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৮:০৯

মাহের ইসলাম বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ।

আমি যেভাবে শুনেছি, সেভাবেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
তবে হ্যাঁ, বাবার বদনাম না করেও গল্পটা লেখা যেত।

ভালো থাকবেন, শুভ কামনা রইল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.