![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সকাল থেকেই এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার দেখা গেছে যুদ্ধ বিমান। এই মাত্র আরেকটা দেখে হামসার ভড়কে গিয়েছিলো।আজ কিছু না কিছু একটা হবেই। পুরো এলাকায়
ভয়ংকর আতংক বিরাজ করছে।
এদিকে সকালেই কয়েকডজন ভিনদেশী মানুষ কে দেখা গেছে বলে শুনেছে হামসার। বাঁচার জন্য মাটির নিচে যে আশ্রয়কেন্দ্র তৈরী করছিলো সেটা সম্পন্ন হতে নাকি আরো দিনেবিশেক সময় লাগবে। আরাফের পরিবারের সাথে আরো কয়েকটি পরিবার সকালেই বেরিয়ে গেছে এলাকা ছেড়ে। হামসারদেরকে ও যেতে বলেছিলো কিন্তু ওর বড়বোন অন্তসত্ত্বা আবার হাম্মাদ নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে ওর বাবা মায়ের অবস্থাও ভালো না। মৃত্যুর প্রহর গুনছে ওরা। সবকিছু মিলিয়ে বড় গোঁজামিলেই পড়ে গেলো হামসার।কি করবে কিছু ভেবে কূলকিনারা করতে পারছে না হামসার।কোথাও সরে পড়াও সম্ভব নয়।
- হাম্মাদের কোনো খবর পেলি!?
আফসানার কথাই ঘোর কাঁটলো হামসারের। সে চোখ তুলে তাকালো মায়ের দিকে। নিরাশায় সিক্ত মুখ। একটু তীব্রভাবে বেঁকে বসলো হামসার,
- না মাম্মি!!
ডুকরে কেঁদে উঠলো হামসারের মা। ভাঙা গলায় বলে উঠলো,
- হাম্মাদের লাশটাও কি দেখমু না আল্লাহ! ও হাম্মাদরে আমার হামমাদ কই!! ক.......
শূন্য দৃষ্টিতে হামসার সমানে সামনে তাকিয়ে আছে।
বুকের ভিতর উত্তাল ঢেউ। চিৎকার করে কাঁদতে মন চায় তাঁর। নাকের উপরে ডান পাশে কেমন একটা ব্যাথা অনুভব করে। হয়তো বা চোখের পানি আর আওয়াজ কে আটকে দিচ্ছে শক্ত এই ব্যাথাটা। হামসার আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করে দিগভ্রান্ত হয়ে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে হাম্মাদের সাথে করা দুষ্টুমি গুলো। শা শা করে তার সামনে দিয়ে আরকেটা জীপ চলে গেলো সরকারি জীপ। চোখের কোণে কিছু পানি টলমল করছে। হাম্মাদের আওয়াজ শুনে হামসার দাঁড়িয়ে গেলো।সামনে পাশে কয়েকটা বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে। বিল্ডিং বললে ভুল হবে ধ্বংস স্তুপ বলা যায়।হামসারের বন্ধুদের বিল্ডিং ছিলো এটা।হামসার ঘুমাচ্ছিলো হঠাৎ কয়েকটা বিকট শব্দে হামসারের ঘুম ভেঙে যায়। এরই ফল এই ধ্বংসস্তূপ।
ওদিক থেকেই এ আওয়াজটা এসেছে।দৌড় দিলো হামসার পাগলের মতো খুঁজতে লাগলো হাম্মাদের ডাকের উৎস।না কোথাও নেই, হাম্মাদ কোথাও নেই।তাহলে মনের ভুল ছিলো।হ্যাঁ হয়তো বা মনেরই ভুল ছিলো।প্রায় সময় এ ডাক শুনে হামসার।কিন্তু হাম্মাদকে কোথাও পায় না।সে জানে হাম্মাদ নেই এ পৃথিবীতে কিন্তু তার মন মানে না।সে মানতেই চায় না হাম্মাদ হারিয়ে যেতে পারে। হামসারের সময় কাটেনা হাম্মাদ কে ছাড়া। ওর মনে প্রাণে শুধু একটাই শব্দ প্রতিধ্বনি হয় হাম্মাদ।তার একমাত্র ছোট ভাই হাম্মাদ।
সূর্যটা পশ্চিম দিকে হেলে গেছে। হামসার বসে আছে। শূন্য দৃষ্টি সামনে।আজানের আওয়াজ শুনে তার হুশ ফিরলো। সামনে একটা খানকা আছে ওখান থেকে এই ধ্বনি হামসারের কানে আসছে।আজানের ধ্বনি।আসরের সময় হয়ে গেছে।
হামসার আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো।সামনেই খানকা। দিগভ্রান্ত উদাস বিভ্রান্ত মন।কিছু একটা যেনো সে তীব্র ভাবে চায়।তার দু'হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়।দাঁত গুলো একে অপরের সাথে ঘর্ষণ খায়।নিমিষেই আবার তা আগের মতো হয়ে যায়। হঠাৎ চোখ দু'টো ঝাপসা হয়ে যায় হামসারের।হামসার চিৎকার করে কাউকে কিছু বলতে চায় কিন্তু সে পারেনা।তার গলা শুকিয়ে যায় মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হয় না।পানির তিরাশি লেগে যায় হামসারের।হামসার রোজা। নামাজ পড়ে বের হতেই তার বাবা কে দেখে হামসার। খানকার বারান্দার এককোণে বসে আছে।হামসার কে দেখেই চোখ মুছে।কিছু লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে। হামসার কে তার দিকে ইশারায় ডাকে ।খানকায় যে কজন মুসল্লি ছিলো সবাই বেরিয়ে গেছে।আগে খানকা পুরিয়ে যেতো মুসল্লিতে।এখন এক কাতার ও হয় না। পরিচিত মুখ খুলো এখন এলাকায় আর দেখা যায় না।কিছুদিন আগে হাম্মাদ ও ছিলো খানকার নিয়মিত মুসল্লি।কিন্তু এখন হাম্মাদ কোথায় কেউ জানে না, কেউ না।
হামসার তার বাবার সামনে গিয়ে বসে।দু'জনেই নিরব।এলাকাগুলো যেনো একেকটা কবরস্থান। হঠাৎ করে খানকার মধ্যে একজন লোক হাফাতে হাফাতে আসে।হামসারদের দেখে তাদের দিকে যায়। রাফাত এসে বসে হামসারের সাথে। রাফাত ওদের দু'বিল্ডিং পরে থাকে। কিছু দিন আগে রাফাতের ছোটভাই একেবারে ছোট বয়স তিন কি চার হবে হায়েনাদের গুলিতে তুলতুলে নরম দেহটা ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায়।
দেহথেকে হাতটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। চলে যায় না ফেরার দেশে।রাফাতের ছোট ভাই আর রাফাতের কাছে ফিরে আসে না। ভাইয়া ভাইয়া বলে রাফাতকে এখন আর কেউ ডাকে না। মাঝে মধ্যে রাফাতকে দেখা যেতো রাস্তায় প্রলাপ বকতে।
হামসার রাফাতের দিকে ফিরে বসলো।
- কি হয়েছে রাফাত?
রাফাত ডুকরে কেঁদে উঠে। ভাঙা গলায় বলে
- আজকে নাকি এখানে কিছু হতে পারে।
কিছুক্ষণ আগে উপরে প্লেনজাতীয় কি একটা নাকি সবাই দেখেছে।
হামসার আগেই ধারণা করেছিলো।সকাল থেকেই তৎপরতা দেখছে হামসার। হামসারের বাবা আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
- হামসা ইফতার টা নিয়ে আসিস।
হামসার মাথা নেড়ে সায় দিলো। হামসার আস্তে আস্তে বিপণী কেন্দ্রের দিকে হাঁটা দিলো।এখানে এখন ইফতার বিতরণ করে।আগে হাম্মাদ সহ একসাথে আসতো দু'ভাই।
এখন হাম্মাদ নেই।
মুহূর্তেরর জন্যেও হাম্মাদের কথা ভুলতে পারে না হামসার। চোখের নোনা জল মুছে ফেলে হামসার।
হামসারের বাবা-মা বোন বসে আছে। ইফতারের অপেক্ষায়। বিষন্ন সবার মন।হামসারের দুলাভাই মারা গেছে মাস তিনেক হয়ে গেছে। আকসায় নামাজের পর সংঘর্ষে মারা যায় তার দু্লাভাই। সবাই বসে আছে। আফসানা বেগম এককোণে বসে গুন গুন করে কুরআন শরীফ পড়ছে। হাম্মাদের জন্য খতম দিচ্ছেন তিনি।
হামসার ইফতার নিয়ে জোরে জোরে হাঁটতে থাকে। ইফতারের আর বেশি সময় নেই।জোরে জোরে পাঁ চালায় হামসার। হঠাৎ বিকট একটা শব্দে হামসার কেঁপে উঠে। হাত থেকে ইফতার পড়ে যায় হামসারের।পরপর কয়েকবার বিকট এ শব্দ শুনতে পায় হামসার।দৌড় দেয় হামসার। তাদের আশে পাশের বিল্ডিং গুলো ধ্বসে পড়ছে।হামসার চিৎকার করে দৌড়াতে থাকে।পায়ের মধ্যে পেরেক ঠুকে যায় হামসারের সেদিকে খেয়াল নেই হামসারের।না কোথাও দেখা যাচ্ছে না তার বাবা-মাকে, অন্তসত্ত্বা বোনকে।ধ্বংস স্তূপের উপর এদিক ওদিক দৌড়াদোড়ি করছে হামসার। সব পাথর মানুষের কোনো চিহ্নই নেই। হঠাৎ হামসারের হুশ ফিরলো মিষ্টি একটা ডাকে। হাম্মাদ সহ সবাই তাকে ডাকছে, হামসার এদিকওদিক ফিরে দেখছে না কোথাও হাম্মাদদের দেখা যাচ্ছে না।হঠাৎ বিকট একটা শব্দ শুনলো হামসার।অস্ফুট স্বরে তার মুখ থেকে একটা শব্দ বেরিয়ে গেলো, "আআ"!!
ধ্বংস স্তূপের সাথে হামসারের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন দেহটি মিলিয়ে গেলো।হামসাররা ইফতার করেছে তবে তা শহীদিস্বাদের ইফতার।
মাহমুদুল হাসান মিলহান
©somewhere in net ltd.