নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সত্যেই সুন্দর সুন্দরই আমার সৌন্দর্য

মো: মেহেরুল ইসলাম

আমি খুবই সাধারন একটা মানুষ।জ্ঞানের দিক থেকেও অতি ক্ষুদ্র ও নগন্য।তবে স্বপ্ন দেখি অনেক বিশাল।কারন স্বপ্ন দেখতে কোন খরচাপাতি লাগে না।আমি ধর্মের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল তবে ধর্মান্ধ নই।

মো: মেহেরুল ইসলাম › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছাগল চোরের শাসন

২১ শে অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১২:৩৫

চারদিকে সবুজ ধানক্ষেত, সন্ধ্যায় বাঁশবনে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, আর মানুষের মুখে অভাবের গল্প। গ্রামের মানুষ সোজাসাপ্টা, পরিশ্রমী, কিন্তু দারিদ্র্য যেন তাদের নিয়তি।

‎এই বছর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন সামনে। চারজন প্রার্থী মাঠে—হেলাল, মাজু, নইমদ্দি আর জাফর।

‎হেলাল গ্রামের সবার প্রিয় মানুষ। কলেজে পড়ে শহর থেকে ফিরেছে, উচ্চ শিক্ষিত, শান্ত স্বভাবের, নির্লোভ। দরিদ্রের পাশে থাকে, স্কুলের ছেলেমেয়েদের বই কিনে দেয়, কারও অসুখ হলে নিজের পকেট থেকে ওষুধ দেয়। অনেকেই বলে, “হেলালেরই মেম্বার হওয়া উচিত।”

‎মাজু আগাগোড়া কৃষক, সকালে মাঠে যায়, বিকেলে ফসল নিয়ে ফেরে। ভোটে দাঁড়িয়েছে গ্রামের সাধারণ মানুষের কথা বলতে। কিন্তু টাকা-পয়সা নেই, তাই খুব একটা জোর দেখাতে পারে না।

‎নইমদ্দি পড়াশোনা না করলেও ভালো মানুষ। সৎ, সহজ-সরল। তার বংশের লোকজন প্রচুর, ভোটে তার কিছু জোর আছে।

‎আর চতুর্থ প্রার্থী—জাফর। দাদা ছিলেন একসময় চেয়ারম্যান, সেই সুবাদে পরিবারে প্রভাব অনেক। কিন্তু মানুষ জাফরকে ভরসা করে না। তার নামে একসময় ছাগল চুরির অপবাদ উঠেছিল। কেউ কেউ এখনো বলে, “চোরের বংশে চোরই জন্মায়।”

‎এই কথাই জাফরের বুকের ভিতর আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে। সে মনে মনে শপথ করেছে—“এইবার আমি মেম্বার হবই। সবাইকে দেখাব, কে কত বড়।”

‎নির্বাচনের আগের সপ্তাহে জাফরের বাড়িতে যেন উৎসব শুরু হলো। রাতদিন গেটে গেটে ভিড়। কেউ চাল নিতে এসেছে, কেউ টাকা। জাফর সবাইকে হাসিমুখে স্বাগত জানায়, বলে—
‎“এই নেন, পাঁচশ টাকা। ভোটের দিন ভুল করবেন না কিন্তু!”

‎লোকজন টাকা হাতে নিয়ে হাসে, কেউ বলে, “ঠিক আছে ভাই, আপনিই আমাদের মেম্বার।”

‎কিন্তু জাফরের মাথায় আছে আরও ধূর্ত পরিকল্পনা। সে প্রতিটি ভোটারকে বলে,
‎“আপনাদের ভোট আমি গুনে গুনে দেখব। এই লাল সুতা রাখেন, ভোট দেবার সময় ব্যালটের ভাঁজে রাখবেন। বুঝব কে আমাকে দিয়েছে।”

‎মানুষ অবাক। কেউ ভয় পায়, কেউ হাসে, কেউ ভাবে—“যদি সত্যিই চেনে?”
‎অভাবের সংসারে পাঁচশ টাকা মানে এক সপ্তাহের বাজার। সেই টাকার মোহে লাল সুতোর ভয় ভুলে যায় অনেকে।

‎হেলাল গ্রামে ঘুরে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করে—
‎“ভাই, ভোট আপনার অধিকার। টাকায় বিক্রি করলে পাঁচ বছর ভুগবেন।”
‎কেউ শোনে, কেউ চুপ থাকে। কেউ বলে, “হেলাল ভাই, আমরা আপনাকে ভালোবাসি, কিন্তু পেট তো মানে না।”

‎ভোটের দিন সকাল থেকেই স্কুল মাঠে লম্বা লাইন। মহিলারা পরনে রঙিন শাড়ি, পুরুষেরা মাথায় গামছা। হেলাল এক কোণে দাঁড়িয়ে দেখে, অনেকের হাতে লাল সুতা বাঁধা। বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার।

‎বিকেল গড়াতে ভোট শেষ হয়। সন্ধ্যায় ব্যালট গোনা শুরু। ভোটের বাক্স খোলা হলো, আর বেরোতে লাগল একের পর এক লাল সুতোর ভাঁজে মোড়া ব্যালট। সবাই হতবাক। শেষে ঘোষক চিৎকার করে উঠল—
‎“জাফর ১৮০০ ভোটে নির্বাচিত!”

‎হেলাল চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখে পানি, কিন্তু মুখে কোনো কথা নেই। মাজু পাশে এসে বলল,
‎“মানুষ টাকার দাস হয়ে গেছে ভাই।”

‎গ্রাম তখন আতশবাজি আর ঢাকের শব্দে মুখর। জাফরের বাড়িতে উৎসব। খাসির মাংস রান্না হচ্ছে, সাউন্ড বক্সে গান বাজছে, আতিথেয়তায় ব্যস্ত সবাই।

‎জআফর হাসছে, গলায় ফুলের মালা, পাশে দাঁড়ানো কয়েকজন দালাল হাসছে আরও জোরে। একসময় সে হেলালের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
‎“বড় সাহেব, এখন বোঝেন, কে গ্রামের নেতা?”

‎হেলাল কোনো উত্তর দেয় না। শুধু দূরে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে।

‎দুই বছর পর—

‎জফর এখন মেম্বার। তার দোতলা বাড়ি হয়েছে, নতুন মোটরসাইকেল, চারদিকে প্রভাব। কিন্তু গ্রামে শুরু হয়েছে দুর্ভোগের দিন। রাস্তা মেরামতের বাজেট গায়েব, ত্রাণের চাল বিক্রি হয়ে যায় বাজারে। দরিদ্রদের তালিকায় নিজের লোকজনের নাম।

‎একদিন মাজু এসে হেলালকে বলে,
‎“জাফর ত্রাণের চাল বিক্রি করে দিয়েছে। আমি প্রতিবাদ করেছিলাম, রাতেই পুলিশ এসে আমার ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে। মাদক মামলার ভয় দেখায়।”

‎হেলাল চুপ করে। তার চোখে ক্ষোভ নয়, করুণা।
‎“মাজু ভাই,” সে বলে, “এটাই আমাদের ভুলের শাস্তি। যে চোরকে আমরা মেম্বার বানিয়েছি, সে আজ আমাদের ঘর চুরি করছে।”

‎গ্রাম ধীরে ধীরে ভয়ে ঢেকে যায়। কেউ কিছু বলে না। সবাই জানে, জাফরের পেছনে প্রভাবশালী লোক আছে। কেউ প্রতিবাদ করলে তার নামে মামলা হয়, পুলিশ আসে, হুমকি দেয়।

‎তবু সময় থেমে থাকে না। একদিন ইউনিয়নের স্কুলে হেলাল বক্তৃতা দিতে আসে—“সততার মূল্য” বিষয়ে। সেখানে তরুণদের ভিড়। সে বলে,
‎“ভাইয়েরা, যেদিন তোমরা তোমার ভোটের মূল্য বুঝবে, সেদিন জাফরদের শেষ হবে। টাকার লোভে একদিনের সুখ কিনে নেওয়া মানে, পাঁচ বছরের কান্না।”

‎এই কথাগুলো আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামে নতুন সচেতনতা জাগে। তরুণরা রাতে বৈঠক করে, মহিলারা বাজারে আলোচনা করে, “আমরা এবার ভুল করব না।”

‎'জাফর টের পায়, বাতাস বদলে যাচ্ছে। তার লোকজন কমে আসছে। সে ভয় পায়, কিন্তু গলায় অহংকার লুকায় না। বলে,
‎“এই গ্রামের মানুষ আমার ঋণী। টাকা দিয়েছি, চাল দিয়েছি—এখন আমিই আইন।”

‎তবু এক রাতে বৃষ্টির মধ্যে হঠাৎ তার বাড়িতে আগুন লাগে। কে লাগিয়েছে কেউ জানে না। মানুষ ছুটে আসে পানি ঢালতে, কিন্তু আগুনে পুড়ে যায় তার ভোটের খাতা, টাকার হিসাব, আর সেই লাল সুতা।

‎বৃষ্টি শেষে হেলাল এসে দাঁড়ায় দূর থেকে। জাফর বসে আছে ভাঙা উঠোনে, কাদা মাখা শরীর নিয়ে, চোখে ফাঁকা দৃষ্টি। হেলাল এগিয়ে গিয়ে শুধু বলে,
‎“দেখো জাফর, লাল সুতা দিয়ে মানুষ বেঁধে রাখা যায় না।”

‎'জাফর কিছু বলে না। তার মুখ থেকে একফোঁটা চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে।

‎পরের নির্বাচনে জাফর আর দাঁড়ায় না। গ্রামের মানুষ নিজের বিবেককে ভোট দেয়। হেলাল নির্বাচিত হয় মেম্বার।

‎গ্রামের রাস্তা ঠিক হয়, স্কুলে নতুন ঘর হয়, বিধবা ভাতা পায় যারা সত্যিই দরিদ্র। মানুষ আবার হাসতে শুরু করে। কেউ আর টাকার বিনিময়ে ভোট বিক্রি করে না।

‎এক সন্ধ্যায় মাজু বলে,
‎“হেলাল ভাই, এবার বুঝলাম, শিক্ষা বড় সম্পদ। জাফর আমাদের শিখিয়েছে, চোরকে ভোট দিলে নিজের ঘরই চুরি হয়।”

‎হেলাল হেসে বলে,
‎“এই শিক্ষাই আমাদের মুক্তি।”

‎বেতগ্রামের আকাশে তখন লাল সূর্য ডোবে, কিন্তু সেই লাল আর রক্তের নয়—বিবেকের জাগরণের আলো।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.