নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সত্যেই সুন্দর সুন্দরই আমার সৌন্দর্য

মো: মেহেরুল ইসলাম

আমি খুবই সাধারন একটা মানুষ।জ্ঞানের দিক থেকেও অতি ক্ষুদ্র ও নগন্য।তবে স্বপ্ন দেখি অনেক বিশাল।কারন স্বপ্ন দেখতে কোন খরচাপাতি লাগে না।আমি ধর্মের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল তবে ধর্মান্ধ নই।

মো: মেহেরুল ইসলাম › বিস্তারিত পোস্টঃ

বিশ্বাসের দাম

০৫ ই নভেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:১৬

‎বাংলার সাধারণ মানুষ আজও বিশ্বাসে বাঁচে, বিশ্বাসে মরে। জমি-জিরাত, ধান-চাল, দোকান-পাট—সবকিছুর মাঝেই বিশ্বাসের জায়গাটা যেন স্বর্গের মতো পবিত্র। কিন্তু এই বিশ্বাসই কখনও কখনও হয় জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ।


‎হারুন একজন সাধারণ মানুষ। তারা সরকারের কীটনাশকের দোকানে কাজ করে। ভোরে দোকান খোলে, রাতে তালা মারে। সংসার চলে অল্প টাকায়, তবু সততার বুকে গর্ব আছে তার। তারা সরকার, তার দোকানের মালিক, গ্রামের প্রভাবশালী মানুষ। জমিজমা, টাকা-পয়সা, রাজনীতির হাত—সবই আছে তার।

‎একদিন দোকানে বসে তারা বলল,
‎“হারুন, আমার কয় বিঘা জমি বন্ধক রাখতে হবে। গ্রামের কয়েকজন লোক টাকা দিতে রাজি, তুই একটু দেখে-শুনে দিস।”

‎হারুন, মালিকের প্রতি আনুগত্য আর গ্রামবাসীর প্রতি বিশ্বাসের জায়গা থেকে রাজি হয়ে যায়।

‎জিল্লুর, সাজু, সাইদুল ও মতিয়ার—গ্রামের চারজন মানুষ, দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে কিছু সঞ্চয় করেছে। তারা শুনল তারা সরকার তার জমি বন্ধক রাখতে চায়। গ্রামে চায়ের দোকানে বসে আলাপ হলো,
‎“তারা ভাইয়ের জমি হলে সমস্যা হবে না। টাকা নিরাপদ থাকবে।”
‎একজন বলে উঠল, “দলিলের দরকার আছে?”
‎অন্যজন বলে, “তারা ভাই, আমাদের গ্রামের মানুষ। কথার চেয়ে বড় কাগজ কী আছে?”

‎এভাবেই, এক বিকেলে হারুনের হাতে সম্মিলিতভাবে তুলে দেওয়া হয় ১১ লক্ষ টাকা।
‎কোনো দলিল নয়, কোনো সাক্ষী নয়—শুধু কথার ওপর ভরসা।
‎হারুন পরদিন শহরে গিয়ে তারা সরকারের হাতে সেই টাকা দিয়ে আসে।

‎তারা সরকারের মুখে মিষ্টি হাসি—
‎“ঠিক আছে হারুন, সব বুঝেছি। তুই ভালো কাজ করছিস।”

‎এভাবেই জমি বন্ধকের চুক্তি শেষ হয় শুধু মুখে মুখে।

‎দশ বছর কেটে যায়। জিল্লুর, সাইদুল, সাজু ও মতিয়ার সেই জমি চাষ করে জীবিকা চালায়। ধান, আলু, পাট—সব ফসলেই তাদের ঘাম মিশে থাকে।
‎জমিটা যেন তাদেরই হয়ে উঠেছিল, যদিও তারা জানতো এটা বন্ধকী জমি।

‎গ্রামে সবাই জানতো—এই জমি দশ বছর আগে তারা সরকার বন্ধক রেখেছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারার মনেও পাল্টে যায় হিসাব।

‎এক সকালে খবর আসে—তারা সরকার তার গুন্ডা দল নিয়ে জমিতে গাছ লাগাচ্ছে।
‎জিল্লুর, সাইদুল, সাজু ছুটে যায় সেখানে।

‎জিল্লুর চিৎকার করে বলে,
‎“তারা ভাই! এই জমি তো আমাদের বন্ধক রাখা! আপনি গাছ লাগাচ্ছেন কেন?”
‎তারা ঠান্ডা স্বরে বলে,
‎“তোমরা কী বলছো আমি বুঝি না। আমি কারো কাছে কোনো টাকা নেইনি আর জমি বন্ধকও রাখিনি।”

‎সবাই হতবাক।
‎সাইদুল বলে, “হারুনের হাতে দিয়েছি, আপনি জানতেন!”
‎তারা হেসে উঠে,
‎“হারুন কে? প্রমাণ আছে? কাগজ দেখাও! আমি কারো সঙ্গে কোনো লেনদেন করিনি।”

‎চারজনের মুখের রঙ পাল্টে যায়। বিশ্বাসের জায়গা যেন মুহূর্তেই গলতে শুরু করে।

‎পরদিন গ্রামের মসজিদে সবাই জড়ো হয়। মুরুব্বিদের সামনে সালিশ বসে।
‎এক পাশে চারজন কৃষক, অন্য পাশে হারুন।

‎মুরুব্বি জিজ্ঞেস করলেন,
‎“হারুন, সত্যি তুই ১১ লক্ষ টাকা নিয়েছিলি?”
‎হারুন মাথা নিচু করে বলে,
‎“হ্যাঁ, নিয়েছিলাম। সেই টাকা আমি তারা ভাইয়ের হাতে শহরের বাসায় গিয়ে দিয়ে এসেছি।”

‎একজন মুরুব্বি আবার জিজ্ঞেস করেন,
‎“প্রমাণ আছে?”
‎হারুন নিঃশব্দে মাথা নাড়ে।
‎“না, প্রমাণ নেই। কিন্তু দশ বছর ধরে ওরা জমি চাষ করছে, যদি বন্ধক না থাকতো, তারা এমনি এমনি জমি দিতো?”

‎মসজিদে নীরবতা নেমে আসে।
‎সবাই জানে, হারুন মিথ্যা বলার মানুষ নয়। কিন্তু কাগজ নেই, সাক্ষী নেই।

‎অবশেষে মুরুব্বিরা বলেন,
‎“এই বিষয় চেয়ারম্যানের কাছে নিয়ে যাও। সে বিচার করবে।”

‎চেয়ারম্যান তারা সরকারেরই লোক। গ্রামের প্রভাবশালী মানুষ।
‎চারজন কৃষক ও হারুন গিয়ে সব ঘটনা খুলে বলে।

‎চেয়ারম্যান প্রথমে রেগে যান,
‎“তারা অন্যায় করছে! তোমরা মামলা কোরো না। আমি বিচার করবো। আগামী জুম্মার দিন সবাই আসো।”

‎মানুষের মনে আশার আলো জ্বলে ওঠে।
‎“চেয়ারম্যান নিজে বলেছে, নিশ্চয়ই বিচার হবে”—এই ভরসায় কেউ থানায় মামলা দেয় না। আর মামলা দেবে কোথা থেকে কারণ তাদের হাতে কোন উপযুক্ত দালিলিক প্রমাণ নেই। আইন তো মুখের কথায় বিশ্বাস করবে না।

‎জুম্মার দিন সালিশ বসে, কিন্তু তারা সরকার সেই সালিসে আসে না।
‎চেয়ারম্যান সবার কথা শুনে একাই ঘোষণা দেন,
‎“হারুন, তুই টাকা নিয়েছিস, তারা সরকার কে টাকা দিছিস তার কিন্তু প্রমাণ নেই। তাই এই টাকা তুই ফেরত দিবি। তারা বলে সে কোনো টাকা নেয়নি। তারা ভাই মিথ্যা বলবে কেন?”

‎মুহূর্তেই ঘরটা ভারী হয়ে ওঠে। হারুন হতভম্ব হয়ে যায়।
‎চেয়ারম্যান নির্ধারণ করেন—হারুনকেই ১১ লক্ষ টাকা ফেরত দিতে হবে, কারণ টাকা তার হাত দিয়েই গিয়েছিল।

‎হারুনের চোখে পানি চলে আসে।
‎“চেয়ারম্যান চাচা, আমি তো কেবল মাঝখানে ছিলাম। জমি চাষ করেছে এরা, টাকা নিয়েছে তারা ভাই।”
‎কিন্তু কেউ শোনে না।

‎বিচারের পর হারুন নিজের বাড়ি, জমি, ঘর সব বিক্রি করে ১১ লক্ষ টাকা যোগাড় করে দেয়।
‎যে তারা সরকার তার সারা জীবনের মালিক, তার হাতেই তুলে দেয় টাকাগুলো—
‎“এই নিন, আপনার মতো লোকের জন্যই আজ আমি নিঃস্ব।”

‎যখন জিল্লুর,সাজু,সাইদুল,মতিয়ার যখন জমি বন্ধকীর টাকা ফেরত চাইতে আসে তখন তারা ঠান্ডা গলায় বলে,
‎“সব টাকা দিতে পারব না। তোমাদের জমি চাষের সময় শেষ। বিদায় হও।”

‎হারুনের বুকের ভেতর যেন আগুন জ্বলে ওঠে।
‎চারজন কৃষক চুপচাপ বাড়ি ফিরে যায়। কারো মুখে কথা নেই।
‎শুধু চোখে চোখে বিষাদ—
‎“বিশ্বাসের দাম এত বেশি কেন?”

‎গ্রামের মানুষ চুপ হয়ে যায়। কেউ প্রকাশ্যে তারা সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে না।
‎কারণ সবাই জানে, অন্যায় বলার সাহসেরও একটা দাম আছে—যা সবাই দিতে পারে না।

‎রাতে হারুন মসজিদের পাশে বসে থাকে। বাতাসে ফিসফিস করে কেউ বলে,
‎“হারুন মিথ্যা বলেনি, কিন্তু মিথ্যার বিচারই হলো সত্য।”

‎হারুন এখন নিঃস্ব।
‎একটা ছাপড়া ঘরে ভাড়া থাকে। তার চোখের নিচে কালো দাগ—জীবনের ক্লান্তি আর অবিচারের ছাপ।

‎বছর ঘুরে যায়, জমিতে আবার ধান ফলায়, কিন্তু সেই জমির ফসলেও যেন তৃপ্তি নেই।
‎গ্রামের লোকেরা বলে, “তারার জমিতে শান্তি নাই, ফসলেও রোগ লাগে।”

‎লোকমুখে শোনা যায়—যেদিন হারুন নিজের বাড়ি বিক্রি করে টাকা দিল, সেদিন রাতে সে কেঁদে বলেছিল,
‎“আমি শুধু টাকা হারাইনি, আমি হারিয়েছি বিশ্বাস।”

‎গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েরা এখন গল্প শোনে—
‎“একটা সময় ছিল, যখন মানুষ কাগজে নয়, কথায় বিশ্বাস করতো।”
‎তাদের কেউ জানে না, সেই কথার বিশ্বাসই একদিন হারুন নামের মানুষটাকে কবরের আগেই মেরে ফেলেছিল।

‎বিশ্বাস এখন আর ধর্ম নয়, লেনদেনের হিসাব।
‎যেখানে টাকা আছে, সেখানে সত্য—আর যেখানে কেবল সততা, সেখানে শুধু হারুনের মতো মানুষদের দীর্ঘশ্বাস

‎--এম এম মেহেরুল





মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.