![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমার বিশেষ কোন গুন নাই
কবির সুমনের ‘জাতিস্মর’ গানটা আমি শুনছি অনেক আগে থেকেই। ভীষণ ভালোলাগা একটি গান। যদিও গানটা পুরোপুরি বুঝতে পারছিলাম না, তবুও এটুকু মোটামুটি বুঝতে পেরেছিলাম যে, একটি প্রেমের অপূর্ণতা এবং তার পূর্ণতার আকুতিই এ গানের মূল প্রতিপাদ্য ছিল। আর এই প্রেমের পূর্ণতার জন্য তিনি বারবার এই বাংলায় জন্ম নেয়ার আশাও করেছেন। জাতিস্মর গানটির পটভূমিকায় ‘জাতিস্মর’ মুভিটি বানানো হয়েছে। মুভিটি পরিচালনা করেছেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়।
আমি অনেক মুভি আমি দেখেছি। কিন্তু এই মুভিটা আমাকে যেভাবে সম্মোহিত করেছে তা এর আগে কোন মুভি আমাকে করতে পারে নি।
বাংলা সাহিত্যের ৩ যুগের বর্ণনায় আমরা ১২০০ হতে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়টাকে অন্ধকার হিসেবে জেনেছি। মধ্যযুগের শেষে এবং আধুনিক যুগ শুরুর পূর্বে অর্থাৎ ১৭৫৭ সালে বৃটিশদের ক্ষমতা দখলের পর থেকে প্রায় ৭০ বছর সময়কালকে বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় অন্ধকার যুগ বলা হয়। এর কারণ এই সময়ের মধ্যে বাংলা সাহিত্যের লেখ্য তেমন কোন নিদর্শন পাওয়া যায় নি।
এবার আসি কবির সুমনের প্রসঙ্গে। তিনি নিজেকে নাগরিক কবিয়াল বলে দাবী করেন। তাঁর এ দাবীর পেছনের গল্পটা এতদিন জানতাম না। বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় যে অন্ধকার যুগের বর্ণনা আমরা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী(লাল লীল দীপাবলি)তে পেয়েছি সেই অন্ধকার যুগটাই হল তাঁর মূল্ আলোচ্য বিষয়। এই সময়টাতে উল্লেখযোগ্য ও গুরুগম্ভীর সাহিত্য পাওয়া যায় নি বটে, কিন্তু এত বেশি সোনালী ফসল ফলেছে যে, সাহিত্যের ক্ষেত্রে এটি অন্ধকার যুগ হলেও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সোনালী যুগই বলা যায়। কারণ, আমাদের আজকের এই সংগীত, আজকের সংস্কৃতির শুরুটা কিন্তু ওই যুগেই।
“এন্টনি ফিরিঙ্গি (১৭৮৬-১৮৩৬)” নামে এক পর্তুগীজকে নিয়েই এ ছবির কাহিনী। তখন সাধারণভাবে ইউরোপীয়দেরও ফিরিঙ্গি বলা হতো। এন্টনি একজন হিন্দু বিধবাকে সতীদাহের চিতা থেকে উদ্ধার করে এনে বিয়ে করেন। এই এন্টনি ফিরিঙ্গিই সর্বপ্রথম সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। যদিও পরবর্তীতে বিভিন্ন পুস্তিকার মাধ্যমে রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথার অযৌক্তিকতা ও অনৈতিকতা বিশ্লেষণ করেন এবং আইন করে হিন্দু ধর্মে সতীদাহ প্রথা রোধ করেন। কিন্তু এন্টনি ফিরিঙ্গির নাম ইতিহাসে সেভাবে ওঠে আসে নি। এন্টনির আমলে কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কবিয়ালদের বেশ প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। হরু ঠাকুর, ভোলা ময়রা, দাশরথি রায়, রাম বসু প্রমুখ বিখ্যাত কবিয়াল তাঁর সমসাময়িক ছিলেন। এন্টনি কবিগানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গান গাইতে শুরু করেন। প্রথমে জনৈক গোরক্ষনাথ তাঁর গান বেঁধে দিতেন। পরে তিনি নিজেই গান রচনা করে গাইতেন। এন্টনি একাধিক কবির লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেন। তাতে ভোলা ময়রা, রাম বসু, ঠাকুর সিংহ প্রমুখ ছিলেন তাঁর প্রতিপক্ষ। কেবল বাংলা ভাষা আয়ত্ত নয়, বাঙালির ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কেও তিনি যে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন, অন্য কোনো বিদেশীর ক্ষেত্রে সেযুগে এমনকি এর পরেও তেমন দেখা যায় না। কিন্তু এ যুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য তথা বাঙালি সংস্কৃতি আয়ত্ব করার জন্য একজন বিদেশি হিসেবে তাঁকে কতটুকু পরিশ্রম করতে হয়েছে সে কথা বর্ণনাতীত। এতসব পরিশ্রমের পরেও নিচের চেষ্টা ও দৃঢ়প্রত্যয় তাঁকে ৯০ ভাগ সফল করেছিল। তবু তৎকালীন গোঁড়া হিন্দু সম্প্রদায় তাঁকে নিরুপদ্রব থাকতে দেয় নি। কবির লড়াইয়ে এন্টনি সব ব্যক্তিগত আক্রমনাত্মক ও কটু প্রশ্নের জবাব এত যৌক্তিকতা ও ভদ্রতার সাথে দিতেন যে, প্রায় প্রত্যেক লড়াইয়েই গোঁড়া হিন্দুরা পরাজিত হয়ে যেত। সবশেষে কোনভাবে এন্টনিকে পরাজিত করতে না পেরে পেরে তাঁর স্ত্রীসহ ঘর-বাড়ি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল তারা। একজন বিদেশি হয়ে বাংলাকে, বাংলার মানুষকে ও বাংলার সংস্কৃতিকে এতটুকু আপন করে নিয়েছিলেন যে, যা আমরা এ যুগে এসেও পারি নি। তিনি বারবার এই বাংলায় জন্ম নেয়ার আশাও করেছেন।
স্যালুট, কবির সুমন। স্যালুট নাগরিক কবিয়াল।
©somewhere in net ltd.