![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী। ফিচার এডিটর- বাংলাপোস্ট, যুক্তরাজ্য।
ইনবক্সে আল্পনা তিনটা ছবি পোষ্ট করল। বলল দেখতো কোনটা বেশী ভাল? আমি বললাম 'সবগুলো'। মাঝের ছবিটা মনে হল আমার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসছে। তাই পরে বললাম মাঝেরটা একটু বেশী ভাল।
ও বলল শড়িটা ও ইন্ডিয়া যে এবার বেড়াতে গেল তখন কিনে এনেছে। শাড়িটাতে ওকে অদ্ভুদ সুন্দর দেখাচ্ছে। আমাকে বলল আমি দেশে গেলে ও যখন দেখা করতে আসবে তখন এই শাড়িটা পড়ে আসবে। আমি বললাম 'হুম, এস'। আল্পনার সাথে আমার অনেক বছর দেখা হয়না। ও অবাক করা অদ্ভুত মায়াবতী মেয়ে। ওর কথা ভাবলে আমার চোখ এমনিতেই ভিজে আসে। আমার মায়ের কথা মনে পড়ে। মা'র সাথে শাড়ি বিষয়ক আমার একটা স্মৃতি আছে। সেই স্মৃতির আগে বা পিছনেও কিছু ঘটনাও আছে।
আমি যখন ক্লাস থ্রি বা ফোর-এ পড়ি তখন থেকেই হাস-মুরগী পোষতাম। একেবারেই আমার নিজের। ঐগুলির জন্য আলাদা ঘর, খাবারের ব্যবস্থা সহ যত্ন-আত্তি সবই আমি করতাম। ঐগুলি ও ঐগুলির ডিম বেচার পয়সা আমি জমাতাম। ডিম, মুরগী বেচার পয়সাগুলো লুকিয়ে রাখাটা বেশ ঝামেলার ছিল। আমি সাধারণত মোটা ইংরেজী বা বাংলা ব্যাকরণ বইয়ের পাতার ফাঁকে না রেখে বই খোলার পরে বাইরের দিকে বই ও মলাটের মাঝে যে ফাঁকের তৈরী হত সেখানে রাখতাম। আমরা ৩ ভাই খুব কাছাকাছি বয়সের। এবং প্রত্যেকেই কমবেশি বিচ্ছু। ওদের দৃষ্টি এড়ানোর জন্য টাকা লুকানোর এই সাদামাটা প্রক্রিয়াটা বেশ কার্যকরী ছিল। খুব বেশী দুষ্টু থাকার কারণে বাবা মাঝে মাঝেই প্রচন্ড রাগ করতেন এবং কখনো কিঞ্চিৎ প্রহারও করতেন। একবার রাগ করে বললেন 'তোর আর পড়াশোনার দরকার নেই, দাড়া আজই তোর সব বই পত্র আগুনে পুড়ুম।'
বইর মধ্যে দেড় দুই বছরের জমানো ৭/৮ শত টাকা। উপায়-অন্তর না দেখে ছোট চাচাকে বললাম 'কাকা পড়া শোনা না করি ক্ষতি নাই। বইগুলাতো কুন দোষ করে নাই, ঐগুলাতো অন্য কেউ পড়তে পারবো; আপনে বাবারে বইগুলা পোড়াইতে মানা করেন'। সেই যাত্রায় ছোট চাচার হস্তক্ষেপে বাবার কাছ থেকে ছোট খাট একটা রাম ধোলাই থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম। আর সন্ধ্যেবেলা বইর ফাঁকে রাখা চক চকে একখানা ৫০০টাকার নোট আর ২ খানা ১০০টা নোটে চুমো খেয়ে চাচার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিাম।
ক্লাস সেভেনে বা এইটে পড়া অবস্থায় আমার মাথায় মাস দুয়েকের জন্য সিনেমা দেখার একটা ভূত চেপে বসে। আমরা সব ভাইরা একসাথে ফুটবল খেলতাম। এখানে বলে রাখা ভাল আমাদের ধানুকা ক্লাব তখনকার সময়ে ফুটবল ও ক্রিকেটে হরহামেশাই শরীয়তপুর জেলা চ্যাম্পিয়ন হত। শরীয়তপুর কলেজের সামনে যে মাঠ তখন সেটা ধানুকা মাঠ হিসেবেই সমধিক পরিচিত ছিল। ঐ দুইমাস যখন সিনেমার ভূত মাথায় চেপেছিল তখন ৩ টার দিকে তাড়াহুড়া করে ফুটবল খেলার নাম করে সপ্তাহে অন্তত ২ দিন বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতাম। বাসায় ফেরতাম সন্ধ্যে ৬টার আগে। কেউ টেরই পেতনা। আমার সঙ্গী থাকত প্রাইমারী স্কুল জীবনের সহপাঠী আছাল উদ্দীন। দুই বন্ধু মিলে যেতাম আর আসতাম। সপ্তাহে ২ সিনেমা, একদিন ও খরচ দিত আর আরেক দিন আমি। এভাবেই চলছিল, অঞ্জনু ঘোষ, সাবানা, ববিতা, রাজ্জাক, ফারুক এদের প্রতি প্রেমে বেশী দিন আঁটকে থাকতে পারলাম না। নেশাটা কেটেও গেল মাস দুয়েকের মধ্যে। আমার জমানো টাকা দিয়ে একাজ করতাম বলে বাবা মা কেউ বুঝতেই পারতো না।
আমার মেঝ দুলাভাইর খুব ইচ্ছে ছিল আমি যাতে ডক্তার বা ইঞ্জিয়ার হয়ে দেশ ও জাতীর খেদমত করি। মূলত তাঁর ঢুকিয়ে দেওয়া হিসেব-নিকেশে আমি এতটাই মন্ত্রমুগ্ধ হলাম যে আমি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। ক্লাস টেনের ফাইনাল পরীক্ষায় আমি যখন বিজ্ঞানে ৬৫% আর ইলেক্ট্রিভ ম্যাথে ৫৮% মার্কস পেলাম তখন আমি ডাক্তার বা ইঞ্জিয়ারের গজ ফিতা বা ধারালও ছুরির পরিবর্তে চোখে কালো ফ্রেমের চশমা চাপিয়ে গেরুয়া পাঞ্জাবী অবস্থায় কিংবা কালো কোট আর গাউন পড়া অবস্থার নিজেকেই বেশী দেখতে শুরু করেছিলাম। ভাবছিলাম বাবা হয়ত খুব সহজে রাজী হবেন না। তাই চুড়ান্ত যুদ্ধ শুরু করার আগে ভাবলাম একটু ভ্রমনে বেড়ুলে খারাপ হবেনা। সিদ্ধান্ত নিলাম মাদারীপুরে মেঝ আপার বাসায় ২/৩ দিন থেকে ঢাকায় বড় আপার বাসায় সপ্তাহ দুয়েক থেকে আসব। বাবার জমি ও ব্যাবসা সংক্রান্ত কাজের জন্য মাঝেমাঝেই সকাল বেলায় অফিস পাড়ায় ছুটাছুটি করতে হত। বাবা অফিসমুখো হওয়ার আগে সকালে গোসল করার জন্য পুকুরে যেতেন। বাবা গোসল করতে গেছেন আর মা রান্নায় ব্যাস্ত এমন একটি সময়ে আমি বাবার সিন্দুকে রাখা অনেকগুলো ৫০০ টাকার নোটের মধ্য থেকে ২টি ৫০০ টাকার নোট নিয়ে ঝটপট ওখান থেকে কেটে পড়লাম। আমি আগে থেকেই ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলাম। বাবা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পরেই আমিও ঝটপট বাবার থেকে চুরি করা ১০০০ টাকা ও আমার ১০০০ টাকা নিয়ে মাদারীপুর হয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বাড়ী থেকে শরীয়তপুর মেইন রোড প্রায় ৮/১০ মিনিটের হাটা। পুরোটাই আমাদের বাড়ীর সীমানা ও সবুজ গাছপালায় ভর্তী রাস্তা। আমি হাটছি আর ভাবছি আসলে ঢাকাতেতো আমার ৭০০/৮০০ টাকার বেশী লাগবেনা। তাহলে এত টাকা দিয়ে আমি কি করবো? যখন আমি বাড়ীর দিকে ফিরে এলাম তখন প্রথমেই আমার সাথে দেখা হলো সেজ কাকীর। আমি কাকীকে কোন কিছু ভাব্বার অবকাশ না দিয়েই বললাম 'চাচি আপনে মায়রে এই ৫০০ টাকা দিয়া দিয়েন।' চাচী আমাকে কি জিজ্ঞেস করল না করলো তা না শুনেই আমি হন হন করে হাটা শুরু করলাম মেইন রোডের দিকে। যখন দেখলাম মাও পিছু নিয়েছে তখন ব্যাগ কাঁধে করেই শুরু করলাম দৌড়ানো। অধিকাংশ সময় বিপদে ভাগ্য খোলেনা, কিন্তু আমার খুলে গেল, মেইন রাস্তায় ওঠার সাথে সাথেই পেয়ে গেলাম রিক্সা। মা চেচিয়ে বলছেন 'এই ওরে থামা, আমি রিক্সাওয়ালাকে বললাম এই জোড়ে চালা, না চালাইলে খবর আছে।' মাদারীপুর এসে আপাকে বললাম 'পালিয়ে এসছি, ঢাকা যাব'। আপা বললেন 'কয়েকদিন থাক, তারপর যা। 'বাড়িতে খবর পাঠানো হল আমি ঠিক আছি। মাদারীপুরে খবর আসল সারা গ্রামে রটে গেছে আমি নাকি মাকে ঈদের শাড়ি কেনার জন্য ৫০০টাকা দিয়ে এসেছি।
মেঝ আপা মিটিমিটি হেসে বলল 'তুই যেই কিপটা ক দেহি ভাই এই ৫০০ টাহা বাবার পকেট মারা টাহা নাতো?
আমি একটু মুচকি হাসা ছাড়া আর কিছুই বললাম না।
২৭শে অক্টোবর ২০১৬
যুক্তরাজ্য।
©somewhere in net ltd.