নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সমাজ বদলাতে হবে। অনবরত কথা বলা ছাড়া এ বদ্ধ সমাজ বদলাবে না। প্রগতিশীল সকল মানুষ যদি একসাথ কথা বলতো তবে দ্রুতই সমাজ বদলে যেতো। আমি ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে, নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে অনবরত বলতে চ

মুজিব রহমান

মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ

মুজিব রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

কবিদের নিয়ে বাংলা সাহিত্যের প্রধান তিনটি উপন্যাস

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:১৯

কবিদের নিয়ে বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য তিনটি উপন্যাস রয়েছে। ‘কবি’ নামে প্রথমটি লিখেছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ১৩৪৮বাংলা সনে অর্থাৎ ৭১ বছর আগে। এর পরেরটি একই নামে লিখেন হুমায়ূন আহমেদ। শেষেরটি লিখেছেন হুমায়ুন আজাদ। তার উপন্যাসটির নাম ‘কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ’। হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, ‘বাংলা সাহিত্যে প্রকৃত কবিদের নিয়ে উপন্যাস শুধু আমিই লিখেছি, অন্যরা লিখেছে কবিয়ালকে নিয়ে।’ কথাটা অনেকটা সত্য। তারাশঙ্কর লিখেছেন প্রকৃত কবিয়ালকে নিয়েই। তিনি যে সময়ের কথা লিখেছেন সে সময়ে কবিরা সে অর্থে কবিতা রচনা শুরু করেনি। দেশজুড়ে তখন কবিয়ালদেরই রাজত্ব ছিল। মানুষ কবিয়ালদেরই চিনতো। হুমায়ূন আহমেদ এর ‘কবি’ একজন আধুনিক কবি হলেও সে নিজেই কবি স্বীকৃতি পায়নি । তার কোন কাব্যগ্রন্থও ছিল না। কবি হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার তাড়না ছিল সামান্যই। একটি সাহিত্য পত্রিকায় একটি কবিতা ছাপানোর প্রচেষ্টা ছিল। বহু চেষ্টায়, বহু সাধনায় উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে তার সফলতা আসে- একটি কবিতা ছাপা হয়। অর্থাৎ সে দেশের প্রধান কবি ছিল না। হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারাগার’ এ একজন কবিকে দেখেছি। তিনি আলোচ্য কবি উপন্যাসের কবির চেয়েও বড় কবি ছিলেন। তার কাব্যগ্রন্থ বিক্রি হতো, পত্রিকায় কবিতা ছাপা হতো অর্থাৎ সে কবি হিসাবে আলোচিত হয়ে উঠছিলেন। এই অর্থে হুমায়ুন আজাদই সর্বপ্রথম দেশের প্রধান কবিদের নিয়ে উপন্যাস লিখেন। সেখানে কবি বিভূতিভূষণের মধ্যে নির্মলেন্দু গুণকে সহজেই খোঁজে পাওয়া যাবে। পাওয়া যাবে দেশের আরো কয়েকজন প্রধান কবিকে। তিনি কবিদের ভিতরের দ্বন্দ্ব, মহত্ব, নীচতা, সম্পন্নতা, দীনতা, সন্মুখগতি, পিছুটান তুলে আনেন উপন্যাসে। তুলে আনেন একজন নপুংশক কবিকে যিনি দণ্ডিত অপুরুষ।



উপন্যাসগুলোর মধ্যে সেরাটি বাছাই করা খুবই সহজ। এটি একাত্তর বছর ধরে আলোচিত হয়ে আসছে। এটি তারাশঙ্করের ‘কবি’ যা একজন কবিয়ালকে নিয়ে লেখা। এই কবিয়াল ভালবেসেছে দুই নারীকে। তারপরও তিনি গেয়েছেন, ‘এই খেদ আমার মনে-/ ভালোবেসে মিটল না এ সাধ, কুলাল না এ জীবনে!/ হায়- জীবন এত ছোট কেনে?/ এ ভুবনে?

কবিয়ালের এই গান বহু তরুণকে ভাবিত করেছে- ‘ভালবেসে সাধ মিটল না’ কিংবা ‘জীবন এতো ছোট কেন?’। আরো অনেক গান পাঠকের ভাবনার খোরাক যোগায়, যেমন- কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কাঁদ কেনে? শুধু এখানেই নয় উপন্যাস জুড়ে তিনি একজন ব্রাত্যজনের কবিয়াল হয়ে হয়ে উঠা, তার চাওয়া-পাওয়ার আকুতি নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রথম দৃশ্যেই তিনি কবিয়াল হয়ে উঠেছেন, মাঝখানে কবিয়াল হিসাবেই বিচরণ করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত একজন কবিয়ালই থেকেছেন। টানটান উত্তেজনায় তিনি ভালবেসেছেন দুই নারীকে যাদের একজনকে পাওয়া হয়ে উঠেনি। কবিয়ালের বিরহেই পাগল হয়ে মারা গেছেন। কবিয়াল তাকে পাওয়া হবে না ভেবেই এই বিবাহিত নারীকে ছেড়ে চলে গেছেন এক ঝুমুর দলের সাথে। এই ঝুমুর দলেই ছিলেন আরেক নারী। তার সাথে গাঁট বেঁধেছিলেন। বলেছিলেন শুধু একজনের মৃত্যু হলেই আরেকজন এই গাঁটছড়া খুলবে। কবিয়ালকেই গাঁট খুলতে হয়েছে। শত কষ্ট গঞ্জনাই তাকে খাঁটি কবিয়ালে পরিণত করেছিল। তিনি নিজেই কবি গান লিখতেন, তাই তাকে কবি বলতেই হবে। তার মধ্যে কবিতা ছিল অফুরন্ত। নিজে লিখেছেন নিজেই তা গেয়েছেন। তার লেখা অন্যরাও গেয়েছেন। উপন্যাস জুড়েই তীব্র আকর্ষণ আর অফুরন্ত সৌন্দর্যতা, পাঠ শেষ হলেও ভাবতে হবে এই অসামান্য উপন্যাসকে নিয়ে। একজন কবিয়াল কেমন তা বুঝতে হলে এই উপন্যাস অবশ্যই পাঠ করতে হবে। কবিগানের মধ্যে কিভাবে এবং কেন ঢুকে গেল অশ্লিলতা? ঝুমুর দলের মেয়েরা কিভাবে জীবন যাপন করে সব কিছুরই নিখুঁত বর্ণনা রয়েছে তারাশঙ্করের কবি উপন্যাসে। এটি শুধু উপন্যাস নয় একটি ইতিহাস ও সংস্কৃতির বর্ণনাও বটে।



হুমায়ূন আহমেদের ‘কবি’ উপন্যাসে লেখক নিজেও কবি হয়ে উঠেছেন। বেশ কয়েকটি কবিতা রয়েছে এখানে। হুমায়ূন আহমেদ কোন কাব্যগ্রন্থ লিখেন নি। হুমায়ূন আহমেদ নিজেও এগুলোকে কবিতা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কবিতাগুলো তার উপন্যাসের মতোই সরল। একটি কাব্যগ্রন্থ হলে পাঠক কতটা গ্রহণ করতো বলা মুশকিল। যারা হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’ এবং ‘শঙ্খনীল কারাগার’ উপন্যাস দুটির খুব প্রশংসা করেন তাদের উচিত ‘কবি’ উপন্যাসটিকেও একই কাতারে ফেলা। এটিও একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের না-পাওয়া এবং হাজারো সমস্যার কথা নিয়ে রচিত এবং যথারীতি একটি আকস্মিক ইতিবাচক পরিনতি। তারাশঙ্করের কবিয়ালের যেমন কবি হওয়ার একটি তীব্র জ্বালা ছিল, কাতরতা ছিল হুমায়ূন আহমেদের কবি‘র তা ছিল না। উপন্যাসটির নাম কবি না দিলেও কিছু হতো না। কিন্তু তারাশঙ্করের উপন্যাসের নাম ‘কবি’ বা ‘কবিয়াল’ ছাড়া চলে না। হুমায়ুন আজাদের উপন্যাসটিতে যিনি কবি তিনিই দণ্ডিত অপুরুষ তাই উপন্যাসটির নাম ‘কবি এবং দণ্ডিত অপুরুষ’ হলেই আরো ভালো হতো। এটি শুরু হয়েছে প্রতিষ্ঠিত কবিদের জীবন যাবন নিয়ে। কবিরা মদ্যপান করে, যৌনাচার করে, তাদের ভিতরও শঠতা রয়েছে এগুলো প্রকাশ্যে আনেন হুমায়ুন আজাদ। এখানে গল্পের চেয়ে একজন কবি হয়ে অন্যকবিদের মুখোশ খুলে দেয়ার মতো বিষয়টাই প্রাধান্য পেয়েছে। এটি হুমায়ূন আজাদের গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হয়ে উঠেনি একারণেই। তারাশঙ্করের কবিয়ালও মদ্যপান করেছে। সেটা গল্পের প্রয়োজনে আবশ্যিক ছিল। মেলায় পচা খেউড় (অশ্লীল) গানের সাথে তাল মেলাতে না পেতে মাথা নত করে যখন কবিয়াল দলের সেই নাচনিওয়ালীর কাছে যায়, তখনই সে একটি থাপ্পর খায়। মদ্যপানই তাকে খেউড় প্রতিযোগিতায় ফিরিয়ে আনে এবং জয়ী করে। এগুলোকে আরোপিত মনে হয় নি। হুমায়ুন আজাদের কবিদের মদ্যপান এবং যৌনাচার বিরক্তিকর। অবশ্য তা বর্ণনায় নয় আচরণে। তারাশঙ্করের উপন্যাসটিতেও যৌনাচার ও মদ্যপানের উপস্থিতি অনেকবারই দেখা যায়। এগুলোকে মনে হয় গল্পেরই অংশ। এগুলো না থাকলে উপন্যাসটি এতো শক্তিশালী হয়ে উঠতো না। ঝুমুর দলের মেয়েরা নৃত্য পরিবেশন করে ঠিকই তবে তাদের প্রধান পেশা দেহব্যবসা। দেহপশারিণী মেয়েরা মদ্যপান করেই বেঁচে থাকে। এই ঝুমুর দলেই থাকে কবি। কদর্যতার মধ্যে নিজেও কদর্য হয়ে যান কিন্তু সেই কর্দমাক্ততার মধ্যেই পদ্মফুলের মতো তিনি পংক্তি রচনা করেন।



হুমায়ূন আহমেদের কবিই সবচেয়ে কম মেধাবী। কফি হাউজের সেই অমলের মতো- একটি কবিতা তার কোথাও হল না ছাপা, পেল না সে প্রতিভার দামটা। অবশ্য এই কবির প্রতিভা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তার কবিতা ছাপা হয় না, সে যোগ্য কবি নয় বলেই। কবি হিসাবে তিনি একজন প্রতিভাহীন অ-কবিকে দাঁড় করিয়েছেন। কবি ও কবিতার চেয়ে এই উপন্যাসে বৈষয়িক বিষয়ই প্রধান। এখানে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ, প্রেম-বন্ধুত্ব প্রধান, আত্মীয়তা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু কবি ও কবিতা কম গুরুত্বপূর্ণ। আমরা উপন্যাসটির প্রধান চরিত্রকে যতটা না কবি হিসাবে পাই তার চেয়ে বেশি পাই ভাই হিসাবে, পুত্র হিসাবে, প্রেমিক হিসাবে। হুমায়ুন আহমেদ নিজের সেরা কবিতাগুলো এই কবির রচনা বলে চালিয়েছেন অথচ তাকে গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করান নি। কবিতাগুলোই ভাল লেগেছে কিন্তু এগুলো ভাল কবিতা হিসাবে উপন্যাসে কোথাও দাগ কাটেনি। অথচ তারাশঙ্করের উপন্যাসের কবিতাগুলো যেমন তারাশঙ্কর রচনা করেছেন আবার এগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ রচনা হিসাবে দেখিয়েছেন যা বিশ্বাসযোগ্যই। তারাশঙ্কর কবিতা লিখলেও ভালই লিখতেন। হুমায়ূন আহমেদের কবিতাগুলোকে অনেকে প্রশংসাও করেছেন। কেউ কেউ মনে করেন হুমায়ূনের ভিতরের একজন কবি বাস করতেন। এটা হয়তো নিজের প্রতি আস্থার অভাব কিংবা জেনে শুনেই তিনি পাঠককে বিভ্রান্ত করেছেন। তিনি পাঠককে বিভ্রান্ত করতেতো পছন্দই করতেন। তিনিইতো লজিক মিসির আলি আবার এন্টি-লজিক হিমু। হুমায়ূন আজাদ এেেত্র কবিদের কবিতা প্রকাশ করেন নি। কয়েকজন কবির অকবি বিষয়কেই প্রাধান্য দিয়েছেন।



একই বিষয় নিয়ে তিনজন গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিক উপন্যাস লিখেছেন। বাংলা সাহিত্য এধরনের ঘটনা বেশি ঘটেনি। উপন্যাস তিনটিরই জমিন ভিন্ন, সেলাই ভিন্ন এবং নকশা ভিন্ন। তারাশঙ্করের কবি ইতোমধ্যেই কালোত্তীর্ণ উপন্যাস হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাকী দুটোর বর্তমানই শক্তিশালী নয় ভবিষ্যৎও উজ্জ্বল নয় বলেই মনে করি। এদুটি দুজন গুরুত্বপূর্ণ লেখকের উপন্যাস বলেই গুরুত্বপূর্ণ; উপন্যাসের মানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে এদুটো শুধু তারাশঙ্করের উপন্যাসটির সাথে তুলনা করার জন্য প্রয়োজন। রসআস্বাদন করার জন্য তিনটি উপন্যাস পাঠ করলে পাঠক মজাই পাবেন। তারা দেখবেন কিছু উপন্যাস প্রিয়তমার মতো। রসআস্বাদনের পরেও আনন্দটা শেষ হয়ে যায় না। ভাবতে হয়, রেশ থাকে বহু দিন। এগুলোই মহৎ ও কালজয়ী উপন্যাস। কিছু উপন্যাস পতিতার মতো। রসআস্বাদনের পরে বিরক্তই লাগে, কারো কারো মনে জেগে উঠে পাপবোধ কিংবা পকেটের পয়সা ব্যয় করে আর আসবো না- এর মতো মনে হয়। বহুগামী পুরুষ কয়জন সঙ্গিনীর মুখ মনে করে বিভাসিত হয়ে উঠে। এখানেই পাঠক সেই সুযোগটি পাবেন। পার্থক্য চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিবে, কাকে বলে কালোত্তীর্ণ উপন্যাস।



[মুজিব রহমান: কবি, সভাপতি- বিক্রমপুর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ]

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১১:১৭

মাহামুদ জয় বলেছেন: তারাশঙ্করের কবি এইমাত্র শেষ করলাম। বাকি দুটিও পড়ে নেবো শীঘ্রই আশা করি

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.