![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ
দেশে কি গণতন্ত্র কখনো ছিল, ছিল গণতন্ত্রের মুখোশ। শুধু আমাদের গণতান্ত্রিক সভ্যতার মুখোস এবার খসে পড়লো। এর আগে ৮৮ বা ৯৬ তেও আমরা দেখেছি ইচ্ছে করলেই অগণতান্ত্রিক আচরণ করা যায়। এর মূল্য কাউকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে দিতে হয় না। নব্বই এর ব্যাপক আন্দোলনের পরেও জাতীয় পার্টি ৯১ এর পরে প্রায় একই পর্যায়ে রয়েছে। জামাত একাত্তরে ব্যাপক পরাজয়ের পরেও টিকে আছে কিছুটা দাপটের সাথেই। আজ তাকে আইন করে বন্ধ করতে হচ্ছে। বিএনপিতো ৯৬তে ব্যাপকভিত্তিক এক তরফা নির্বাচন করেও আবারও ৫ বছর পরেই ক্ষমতায় এসেছে। দলগুলোও বুঝে গেছে এদেশে তারা যত অপকর্মই করুক পরবর্তী ক্ষমতাসীনরা আরো ব্যাপক মাত্রার অপকর্ম করবে। সম্ভবানা থাকবেই ক্ষমতায় ফেরার। আওয়ামীলীগ বুঝেছে যত যাই করি, আমাদের অন্ধ সমর্থকরা তা সমর্থন করবে। মানুষ এসব ভুলে যাবে। যতদিন ক্ষমতায় থাকা যায় থাকলাম। আবারো ফিরে আসার সম্ভাবনাতো থাকলোই। আমাদের সাধারণের জন্য একটি বিরাট সমস্যা। যদি বলি, নির্বাচনতো শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠু হল না। সাথে সাথে আওয়ামীলীগের লোকেরা আখ্যা দিবে- রাজাকার, জামাতি, বিএনপি। ছিয়ানব্বইতে বললে, শুনতে হতো ভারতের দালাল, নাস্তিক, বাকশালী। এদেশে সত্য বলা সত্যিই কঠিন, জীবনের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের দেশে অন্ধরাই ভাল থাকে। দলকানা লোকেদের অনেক সুবিধা। তারা ক্ষমতায় থাকলে ব্যাপক অপকর্ম করে আবার বিরোধী দলে গেলেও সরকারি দলের সাথে একটা ভাও দিয়ে ফেলে। এখন তোমরা খাও, আগে আমরা খেয়েছি। কেউ কাউকে বাধা দিব না। খারাপ শুধু যারা দলান্ধ নন তারা। এই যে সারাদেশে সংখ্যালঘুদের নির্যাতনটা স্বাধীনতার সম বয়সী। আমরা এটাকো কোনভাবেই প্রতিরোধ করতে পারছি না। প্রধানত এর সাথে প্রধান সবগুলো দলই জড়িত। আমরা একটি তদন্ত রিপোর্টও পেলাম না। জানি না আসলে কারা কেন সংখ্যালঘুদের নির্মমভাবে নির্যাতন করছে। অনুমান করতে পারি জামাত-বিএনপি এসব করছে। আবার ডিসিদের রিপোর্টে নাকি আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের নামও এসেছে। কয়েকস্থানে আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের নাম পত্রিকাতেও এসেছে। তারমানে এবারও কোন বিচার হবে না। জাতি হিসাবে আমরা আসলে সভ্য হয়ে উঠিনি এটাই চূড়ান্ত সত্য। এরপরও আশার কথা, বেশ কিছু মানুষ দানব হয়ে উঠা ক্ষমতাসীনদের বারবারই ভোটের মাধ্যমে বিতাড়িত করছে।
আমাদের একটি বড় সংকট বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার। এখানে আমরা কেবলই দালালদের দেখি। যারা বিরোধী দলের দালালি করেন তাদের কণ্ঠটা কিছুটা মিনমিনে। যারা সরকারের দালাল তারা বেজায় বড় কলায় কথা বলছেন। মুক্তচিন্তাটা দেশ থেকে বিতারিত হয়েছে বলাই যায়। মুক্তচিন্তা করার যে সাহসটা প্রয়োজন এটা তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা ভয়ে আন্ডারওয়্যারের নিচের পকেটে রেখে দিয়েছেন। আগে ব্যবসায়ীরা আ-ারওয়্যারের গোপন পকেটে করে টাকা নিয়ে যেতেন ছিনতাইকারীদের ভয়ে। সুশীল সমাজও আসলে দেশে নেই। কেউ এখন সুশীল দাবী করলেই সরকার বলে, ঐটা জামাত-রাজাকার। সম্প্রতি দেখলাম আমাদের শ্রদ্ধেয় আব্দুল গাফফার চৌধুরীকে বেজায় চটে যেতে। তিনি অবশ্য চটেই থাকেন। সাবলিল ভাষার দক্ষতা থাকায় এবং বঙ্গবন্ধু সরকারকে অজনপ্রিয় করে তোলায় ভূমিকা রাখায় তার তার যোগ্যতা অনেক। ঈর্শায় মতিউর রহমানকে তিনি মেনে ও মনে নিতে পারেন না। তাকে অহেতুক নানা মিথ্যা কাহিনী ফেদে আক্রমন করেন এবং সরকার প্রধানের বিরাগভাজন করানোর চেষ্টা করেন। তিনি একবার দেশে এসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করে শুধু মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে বিষেদাগার করেন। এবার ধরেছেন মাহফুজ আনামকে। মাহফুজ আনাম প্রখ্যাত রাজনৈতিক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদের পুত্র। তবু ভাল লাগে তিনি যে পত্রিকায় বেশি বেশি লিখেন আস্তে আস্তে সেটি অচল হতে থাকে। আসলে বলতে চাচ্ছি কোনভাবে কেউ যদি কোনরূপ মুক্তচিন্তার চেষ্টা করেন তাহলে দলীয় দালালচক্র ঝাপিয়ে পড়েন তার উপরে। তিনি মুখ বন্ধ করতে বাধ্য হন প্রথমত দালালচক্রের চাপে, দ্বিতীয়ত সরকারী হয়রানীর ভয়ে। একটি রাষ্ট্রে যদি ভিন্নমত-মুক্তমত না থাকে তাহলে তাকে কি করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলি।
একানব্বই এ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারা চালু হওয়ার পরে বাংলাদেশের রাজনীতি যেন পুনরাবৃত্তির রাজনীতিতে পরিনত হয়েছে। মোটা দাগে কয়েকটি বিষয় বারবার ফিরে এসেছে। ক্ষমতাসীন সরকারী দলের ক্ষমতার অপপ্রয়োগ, দুর্নীতিতে নিমজ্জিত থাকা, বিরোধীদলকে নিশ্বেষ করে দেয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা এবং জনগণের রায়ে সেই বিরোধী দলই ক্ষমতায় ফিরে আসা। পার্থক্যের মধ্যে খারাপ দিকগুলো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। তা বুঝা যায় ক্ষমতাসীন দলের শোচনীয় থেকে শোচনীয়তর ভাবে পরাজিত হওয়া দেখেও। আসন সংখ্যাও ক্ষমতাসীনদের প্রতিবারই কমেছে। গতবার ছিল ত্রিশের কোঠায় এবার শূন্য। আমাদের জাতীয় সংসদে বিরোধী দল যাওয়া না যাওয়ার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। সরকারী দল বিরোধী দলকে দুচোখে দেখতে পারে না। তারা বিরোধিদলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের পিষে মারতে চায়। তারা কোন ভাবেই চায় না বিরোধী দল সংসদে থাকুক। বিরোধী দলও চায় না সরকার সংসদ ঠিকভাবে চালাচ্ছে সেই বাহবা দিতে। জাতীয় সংসদের সংসদসদস্যদের ভূমিকাও তেমন নয়। সরকারী দল এখানে বিরোধী দলের সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা রাখে না। সংখ্যায় বেশি হলে ক্ষমতায় যাওয়া যায় বাকীতো সব করে প্রধানমন্ত্রী, বেশি হলে মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। সংসদ আসলে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী বা পূর্ববর্তী কোন সংসদেই বিরোধীদলের কোন ভূমিকা ছিল না। একবার শুধু বিরোধীদল স্পীকার সাহেদ আলীকে হত্যা করতে পেরেছিল। আমাদের গণতান্ত্রিক চর্চা হল, যেকোন মূল্যে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা আর বিরোধীদলকে ধ্বংস করার চেষ্টা। যারাই সরকারের বিরুদ্ধে বলবে তারাই দেশ-জাতির শত্রু আর সরকারি দল যত অপকর্মই করুক তারা দেশপ্রেমিক।
অনেকেই বলেন, আওয়ামীলীগ ও বিএনপির অন্যান্য নেতাদের মধ্যেকার দূরত্ব বেশি নয়। বিএনপির এক নেতার দুর্নীতির অভিযোগে বিদেশ যাওয়ায় বাঁধা দেওয়ায় এক প্রতিমন্ত্রীকে চড় খেয়ে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয় মর্মে অভিযোগ রয়েছে। অর্থাৎ মূল দূরত্বই দুই নেত্রীর মধ্যে। তাদের মধ্যে আদর্শিক দ্বন্দ্ব স্বষ্ট নয়। দুজনই আধুনিক, স্মার্ট। দুজনই প্রিয়জনদের হারিয়েছেন নির্মমভাবে। তাদের মধ্যে ঘণিষ্ঠতা থাকতেই পারতো। হয়তো ব্যক্তিগত ঈর্ষা বা জিদ বা অপছন্দের কারণেই তারা পরস্পরের শত্রু হয়ে উঠেছেন। দুইজনই দুজনকে দখলে থাকা বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছেন। এই বাড়ি রক্ষার্থেই বিএনপি আন্দোলন শুরু করেছিল। তার আগে অবশ্য বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহারের জন্য বা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য হালকা চালে আন্দোলন ছিল। বিএনপির হাতে আন্দোলনের ইস্যু তুলে দেয় আওয়ামীলীগই। তারা তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে, নিজেদের অধীনে নির্বাচন করার আইন পাশ করে। বিএনপি এটা নিয়েই আন্দোলন করে আসছিল। একটি বিষয় বিস্ময়কর এই তত্ত্বাবধাক সরকার ব্যবস্থা আওয়ামীলীগেরই আন্দোলনের ফসল। তখন বিএনপি বলেছিল, তিন পাগলের আবিস্কার তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু মানুষ আওয়ামীলীগের দাবীটিকে গ্রহণ করেছিল। অথচ সেই আওয়ামীলীগই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করল। এটা স্পষ্ট ৫ জানুয়ারির বিস্ময়কর নির্বাচনে সরকার ক্ষমতায় থাকার আইনত অধিকার অর্জন করেছে। আমজনতা জানে কেমন ভোট হয়েছে, সরকারি নেতারা মুখে যাই বলুক তারাও জানে ভিতরের খবর। তারা এখন চেষ্টা করবে সরকারের ভাবমূর্তী উদ্ধার করার। তাদের ১শ দিনের কাজও সেই কথাই বলছে। এভাবে স্বল্প সময়ে জনপ্রিয়তা উদ্ধার হয় না, আরো তালগোল পাকায়। দশ হাত শাড়ি একদিকে টানলে অন্যদিকে আরো খাটো হয়ে পড়ে। জনপ্রিয়তা ফেরাতে গিয়ে দেশের উন্নয়ন বাঁধাগ্রস্থ হতে পারে। জনপ্রিয়তা উদ্ধারে প্রদত্ত টাকা লোটপাট হয়ে গেলে সরকার আরো জনপ্রিয়তা হারিয়েও ফেলতে পারে। আওয়ামীলীগের সমর্থকরা ধরেই নিয়েছিলেন এবার সুষ্ঠু নির্বাচনে তারা ক্ষমতা হারালেও আগামীতে তারা আবারও ফিরে আসবে। ক্ষমতায় থাকার তীব্র চেষ্টা তাদের সে আশায় জল পড়তে পারে।
বিএনপি ২০০৮ এর নির্বাচনে ব্যাপক পরাজয়ে মেরুদ- ভেঙ্গে ফেলেছিল। তাদের অবস্থা যে এতটা দুর্বল এটা আগে বুঝা যায় নি। আওয়ামীলীগ জনপ্রিয়তা হারানোর কারণে মনে হচ্ছিল বিএনপিতে জনপ্রিয়তার জোয়ার লেগেছে। অথচ তারা ঢাকা শহরে কোনরূপ আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। এর কারণ হতে পারে, তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ সত্য ছিল। তারা আর জেলজুলুম খাটার সাহস ও সামর্থ রাখেন না। তারা চেষ্টায় ছিলেন জেল থেকে বেঁচে থাকতে। শেষ পর্যন্ত অনেকেই পারেন নি, তারা জেলে ঢুকেছেন। এখন আশায় আছেন এই বুঝি ছাড়া পাবেন। তবে সততা না থাকলে, দেশপ্রেম না থাকলে আন্দোলন করা যায় না। বিরোধী নেতাদের রাজনৈতিক সততা প্রশ্নবিদ্ধ আর তারা ব্যাপকভাবে ক্ষমতা হারিয়েছিল অর্থনৈতিক অসততার অভিযোগে। বিরোধীদল যদি সাহসহীন হয় তাহলে সে জাতির ললাটে গণতন্ত্রর সুখ থাকার কথা নয়। আজ দেশে যে গণতন্ত্র হুমকীর মুখে পড়ল তার দায় শুধু সরকারের নয়, অর্ধেকটা অবশ্যই বিরোধীদলের। তারা সম্ভবত আশায় ছিল জনগণ ক্ষমতা পাকিয়ে প্লেটে করে তাদের সামনে হাজির করবে। তারা বিদেশিদের দিকে নির্লজ্জভাবে তাকিয়ে রয়েছে, বিদেশিরা ক্ষমতা ভাজাভাজা করে চাইনিজ বানিয়ে তাদের খেতে দিবে। আমরা জাতি হিসাবে যতটা সভ্য সচেতন গণতন্ত্র আমাদের সাথে ততটুকুই আচরণ করছে। আসলে মুক্তমত, ভিন্নমত না থাকায় এবং দেশ পরিচালনায় বিরোধীদলের ভূমিকা না থাকায় আমাদের গণতন্ত্র আসলে ছিলই না। ছিল নির্বাচিত স্বৈরতান্ত্রিক সরকার। গণতন্ত্রের একটা মুখোশ লাগানো ছিল। সর্বশেষ ৫ জানুয়ারি আরেকবার মাত্র সেটি খসে পড়েছে। এই মুখোশই টেনেটুনে ঠিক করে আবারো গণতন্ত্র দেখানো হবে। আমরা অপেক্ষায় থাকি সেই গণতন্ত্র দেখার জন্য।
©somewhere in net ltd.