নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সমাজ বদলাতে হবে। অনবরত কথা বলা ছাড়া এ বদ্ধ সমাজ বদলাবে না। প্রগতিশীল সকল মানুষ যদি একসাথ কথা বলতো তবে দ্রুতই সমাজ বদলে যেতো। আমি ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে, নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে অনবরত বলতে চ

মুজিব রহমান

মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ

মুজিব রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

আড়িয়াল বিলের সম্পদ ও সৌন্দর্য

২৬ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ৮:৪৯

কোথায় আড়িয়াল বিল?
আড়িয়াল বিল বর্তমানে ঢাকা জেলার দোহার উপজেলার পূর্বে, নবাবগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ-পূর্বে এবং মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার উত্তর-পশ্চিমে ও সিরাজদিখান উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে ১৩৬ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে অবসি'ত। একদা বিলের চাষের জমি ৮৫ হাজার একর ছিল বলে বলা হতো। বর্তমানে অন্তত ৩০ হাজার একর জমি হ্রাস পেয়েছে বসতবাড়ি নির্মিত হওয়ার জন্য। পদ্মা থেকে ধলেশ্বরী পর্যন্ত দুই নদীর মধ্যবর্তী স্থানে এর অবস্থান। এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতো আরেকটি নদী ইছামতি। ইছামতির ক্ষীণধারা কোথাও কোথাও দেখা গেলেও অনেক স্থানেই এখন এর অস্তিত্ব নাই। ঢাকা থেকে বিলের উত্তর দিকের দূরত্ব মাত্র ২০ কি.মি. এবং দক্ষিণ দিকের দূরত্ব ৪২ কি.মি.। এর অবস্থান ২৩.৫৭ উত্তর ও ৯০.২৭ পূর্ব দ্রাঘিমায়। এটি একদা ইছামতি/পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গমস'ল ছিল। পরে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হলে এটি বিলে পরিণত হয়। বর্তমানে এটি ঢাকা বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিল এবং বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিল। এটি পূর্ববঙ্গের মধ্যাঞ্চলের সবচেয়ে বড় জলাভূমি হিসাবে পরিচিত। তবে যতীন্দ্র মোহন রায়, তাঁর ১৯৯২ সালে প্রকাশিত ‘ঢাকার ইতিহাস’ গ্রন্থে' একে ঢাকা বিভাগের প্রাচীনতম বিল কেন বলেছেন? তার কোন তথ্য জানা নেই। এই বিলে ষড়ঋতুর আলাদা সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। বর্ষায় যেমন পরিপূর্ণ বিল আবার শীতে পরিপূর্ণ শস্যক্ষেত্র। বিলের উত্তর দিকে ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বাড়ি এবং দক্ষিণে ড. জগদীশচন্দ্র বসু ও ড. হুমায়ুন আজাদের বাড়ি। পূর্ব দিকে প্রতিভা বসু, রাবেয়া খাতুন, চন্দ্রমাধব ঘোষ ও সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের বাড়ি। প্রতিভা বসু, হুমায়ুন আজাদ ও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখায় উঠে এসেছে আড়িয়াল বিলের কথা। প্রতিভা বসুর আত্মজীবনীমূলক গ্রন' ‘জীবনের জলছবি’তে আড়িয়াল বিলের বর্ণনা পাই। হুমায়ুন আজাদ শুভেচ্ছাসহ বিভিন্ন কবিতায়, স্মৃতিকথা ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ উপন্যাস ‘সবকিছু ভেঙ্গে পড়ে’, ‘শ্রাবণের বৃষ্টিতে রক্তজবা’, ‘পাকসার জমিন সাদবাদ’সহ বিভিন্ন লেখায় তিনি আড়িয়াল বিলের কথা লিখেছেন। প্রতিবছরই পলিমিশ্রিত নদীর পানি প্রবেশ করায় বিলটি অত্যন্ত উর্বর এলাকায় পরিণত হয়েছিল। সাধারণভাবে বলা হয়, এই বিল সারাদেশের মানুষের ৭ দিনের অন্নের সংস্থান করে থাকে। এই বিলে তেমন কোন পতিত জমি নেই। বর্ষা মৌসুমের আমন ধানের পরেই বিপুল পরিমাণ ইরি ও বোরো ধান উৎপন্ন হয়। বিলটি জুড়ে অসংখ্য ছোট-বড় ডাঙা বা ডেঙা (বড় পুকুর) রয়েছে। বর্ষায় বিলব্যাপী ঘুরে বেড়ানো মাছেরা আশ্রয় নেয় এইসব ডাঙায়। আড়িয়াল বিলে প্রচুর পরিমাণে উৎকৃষ্ট বাক্‌সা ঘাস উৎপন্ন হয়। এই ঘাসটি অত্যন্তপুষ্টিগুণ সম্পন্ন। এই ঘাস, ধানের খড় এবং বর্ষা মৌসুমের দল ঘাস এর কারণে শ্রীনগর এখন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দুধ উৎপাদন এলাকা হিসাবে পরিগণিত হচ্ছে। এখানে দৈনিক প্রায় দুই লক্ষ লিটার দুধ উৎপন্ন হয়। এখানে মিল্কভিটার দুধ ক্রয় কেন্দ্র রয়েছে। এছাড়া রস, সর, বিক্রমপুর ডেইরিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিপুল পরিমাণ দুধ ক্রয় করে। মান্দ্রা গ্রামটিতে ঢাকা বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুধ উৎপাদন হয়। কৃষির কারণেও এই বিলটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায়ও বিলটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বন্যার প্রকোপ কমাতে ধরে রাখছে বিপুল পরিমাণ পানি। বিলটি ধ্বংস হলে জীববৈচিত্রও ধ্বংস হয়ে যাবে। এই বিলে স্থানীয় বিপুল পরিমাণ বিভিন্ন জাতের পাখি বসাবাস করে। রয়েছে বহু রকমের সরীসৃপ। সারিসারি সাদা ও কানি বকের দেখা পাওয়া যায় এখানে।

কেমন বিল আড়িয়াল?
আড়িয়াল বিলের মাটি অত্যন্ত নরম। এই মাটির বৈশিষ্ট্য পিট কয়লা মিশ্রিত নরম কাদামাটি। নদীর গতিপথ থাকায় এবং পলি পড়ে বিলটি তৈরি হওয়ায় এটির নিচেও পাথুরে মাটি নেই। গত একশ বছরে পদ্মা উত্তর দিকে বেশ কয়েক কিলোমিটার এগিয়েছে। ভাগ্যকুলের জমিদারদের বসতবাড়িও কয়েকপত্তন ভেঙ্গে যাওয়ায়, সর্বশেষ আড়িয়াল বিলের দক্ষিণ প্রান্তে নিতে হয়েছে। এলাকাটির নাম ছিল ছাগলছিড়া। বর্তমানে উত্তর বালাশুর নামে পরিচিত। সামান্য বন্যা হলেই মাওয়া-দোহার বেড়িবাঁধটি ভেঙ্গে অথবা উপচিয়ে প্লাবিত হয় বিলটি। এছাড়া ধলেশ্বরীর কূল উপচিয়েও পানি ঢুকে। বিলটির উত্তরে ও দক্ষিণে নদী থাকায় এটি অত্যন্ত বন্যাপ্রবণ এলকা। প্রতিবছরই ১৫/২৫ ফুট কখনো কখনো আরো বেশি পানিতে ডুবে যায়। ১৯৮৮ এবং ১৯৯৮ এর বন্যায় এই বিলে পানি ছিল ৩৫ ফুট।
অনেকেই এখন এই বিলের অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তিত। তারা মনে করেন ভূমিদস্যুরা এই বিলটি খেয়ে ফেলবে। ভূমি দস্যুরা যাতে বিলটি নষ্ট না করে সে দিকেও সবার নজর রাখতে হবে। পরিবেশের কথা বিবেচনা করে শীঘ্রই বিলটিকে সংরক্ষিত এলাকা হিসাবে সরকারের ঘোষণা করা উচিত। বিলটি নিয়ে বহুবিধ গবেষণাও প্রয়োজন। বিলটি বাঁচিয়ে রাখাও প্রয়োজন।

বিলের নাম আড়িয়াল কেন?
আড়িয়াল বিলের নামটির দুটি বানান আমরা দেখি। ডক্টর হুমায়ুন আজাদ ‘আড়িয়ল বিল’ নামটি গ্রহণ করেছেন তাঁর বিভিন্ন লেখায়। তবে বিভিন্ন নথিতে আড়িয়াল নামটিই বেশি দেখা যায়। দক্ষিণাঞ্চলের ফরিদপুর, মাদারীপুর ও বরিশাল জেলার উপর দিয়ে প্রায় একশো মাইল দীর্ঘ আড়িয়াল খাঁ নদ প্রবাহিত হচ্ছে। এ নদের পূর্বনাম ছিল ভুবনেশ্বর নদ। ১৮০১ সালে ঠগি দমনের জন্য আড়িয়াল খাঁ নামক একজন জমাদারকে সরকার নিযুক্ত করে। তিনি ভুবনেশ্বর নদ থেকে একটি খাল খনন করে তা প্রাচীন গঙ্গা/পদ্মা নদীর সাথে সংযোগ করেন। এই খালটিই প্রবল রূপ ধারণ করে আড়িয়াল খাঁ নদ নামে পরিচিতি পায়। আড়িয়াল খাঁ নদের উত্তরে পিয়াজখালী এরপর পদ্মার উত্তরতীরেই আড়িয়াল বিল। কাছাকাছি স্থান হওয়ায় নামের মিল থেকে নামকরণেরই মিল থাকাও অসম্ভব নয়। প্রাচীন ইছামতি/পদ্মার সাথে ব্রহ্মপুত্র নদের সংগমস্থল হিসাবে বর্তমান আড়িয়াল বিলকেই যেহেতু ধরা হয়। আঠারো শতকের শেষাশেষি নিম্ন ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহপথেও নাটকীয় পরিবর্তন আসে। এর ফলে পদ্মার সঙ্গে এর সরাসরি সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। ১৭৮৭ সালের ভয়াবহ বন্যায় তিস্তা নদের প্রবাহপথটি বদলে যায়। এই নদী আগে পদ্মার উপনদী ছিল। গতিপথ বদলে দক্ষিণের পরিবর্তে পূর্ব দিকে গিয়ে এটি ব্রহ্মপুত্রে পড়ে। ব্রহ্মপুত্র আরো দক্ষিণে সরে আসে এবং একটি বৃহৎ নদীপথের সৃষ্টি হয় যমুনা নামে। এটি পদ্মায় মিলিত হয় গোয়ালন্দে। পুরাতন ব্রহ্মপুত্রটি ময়মনসিংহ শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বর্তমানে মেঘনায় পড়েছে। রেনেলের মানচিত্রে আমরা দেখি পূর্ববর্তী ব্রহ্মপুত্র নদ বিক্রমপুরে ইছামতি নদীর উপর পড়েছিল বর্তমান আড়িয়াল বিলে। ওই গতিপথ পরিবর্তনে পদ্মার শাখা নদী কালিগঙ্গা, যেটা চাঁদপুরের কাছে মেঘনায় পড়েছিল তা বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং পদ্মানদী বিক্রমপুরকে দ্বিখণ্ডিত করে কালিগঙ্গা নদীতেই মূল ধারা হিসাবে প্রবাহিত হতে থাকে। এ সময়েই সৃষ্টি হয় আড়িয়াল বিল। এই ঘটনার মাত্র ১৪ বছর পরেই জমাদার আড়িয়াল খাঁর খাল খনন হয় এবং খালটি একটি নদে রূপান্তর হয়। ফলে বিক্রমপুরের বিলটির নামকরণে আড়িয়াল খাঁর নাম জড়িয়ে থাকার সম্ভাবনা অনেকখানিই। স্থানীয়ভাবে এটি আইড়ল/আইরল বিল নামে পড়িচিত। বিলটি উত্তর পশ্চিমে কিছুটা আড় মানে তেরছা থাকার কারণেও নাম হতে পারে কিংবা আইড় মাছ থেকেও আইড়ল বিল নাম হতে পারে। এগুলো বাড়তি অনুমান। আড়িয়াল বিলের একটি গ্রাম গাদিঘাট। স্থানীয়রা বলে, এটি একসময় পদ্মানদীর তীরবর্তী গ্রাম ছিল। গদিঘাট থেকে গাদিঘাট নামটির উৎপত্তি হয়েছে। এসব থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় আড়িয়াল বিলটি মূলত পদ্মা/ইছামতি ও ব্রহ্মপুত্র নদের পরিত্যাক্ত গতিপথ।

কত বিল আড়িয়ালে?
এখন পুরো বিলটিই আড়িয়াল বিল নামেই পরিচিত। তবে অঞ্চল হিসাবে বিলের বিভিন্ন দিকের মানুষের কাছে বিভিন্ন নামে একসময় পরিচিত ছিল। চুরাইন এলাকার মানুষ বলতো চুরাইন বিল। আবার খণ্ডখণ্ড এলাকাকে সংলগ্ন গ্রামের নামেই বলা হতো। যেমন দামলা সংলগ্ন বিলকে বলা হতো দামলার বিল। বিলটি পূর্ব-পশ্চিশে দীঘল অর্থাৎ সূর্যদীঘল। পূর্ব-পশ্চিমে ১২ মাইল এবং উত্তর দক্ষিণে ৭ মাইল অর্থাৎ ৮৪ বর্গ মাইল। বিলের চারদিকের গুরুত্বপূর্ণ গ্রামগুলোর মধ্যে বিলের দক্ষিণ প্রান্তে রয়েছে শ্রীনগর উপজেলার দয়হাটা, শ্যামসিদ্ধি, প্রাণিমণ্ডল, গাদিঘাট, রাঢ়ীখাল, বালাশুর; উত্তরে- শ্রীনগর উপজেলার শ্রীধরপুর, বাড়ৈখালী, মদনখালী, আলমপুর, সিরাজদিখান উপজেলার- তেঘরিয়া, কেয়াইন, শেখরনগর, চিত্রকোট ও রাজানগর রয়েছে; পূর্বপ্রান্তে হাঁসাড়া, ষোলঘর, কেউটখালী, সিরাজদিখানের মোহনগঞ্জ, পশ্চিমে রয়েছে ভাগ্যকুল ইউনিয়নের কামারগাঁও, জগন্নাথপট্টি, কাঁঠালবাড়ি, দোহার উপজেলার হাঁসী, ঝনকী, শিমুলিয়া, ঘাটা, সুতারপাড়া, দামুয়া, মুন্সিকান্দা, পশ্চিমমোড়া, লস্করকান্দা, ইউসুফপুর ইত্যাদি। অর্থাৎ বিলটি মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর-সিরাজদিখান ও ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ-দোহার উপজেলার মধ্যবর্তী স্থানে অবসি'ত। বিভিন্ন প্রান্ত দিয়ে বিলমুখী বসতি গড়ে উঠেছে। সম্প্রতি গড়ে উঠা গ্রামগুলোর মধ্যে উত্তর বালাশুরের উত্তরদিকেই বেশি বসতি গড়ে উঠেছে। মূলত পদ্মানদী ভাঙ্গনের শিকার বিপুল সংখ্যক মানুষ এখানে বসতি স্থাপন করেছে। চারটি উপজেলার ২০টি ইউনিয়নের ৭০টি গ্রাম রয়েছে বিলের চারদিকে। ২০ টি ইউনিয়নের মধ্যে শ্রীনগর উপজেলায় রয়েছে ৮টি যথা- বাড়ৈখালি, হাঁসাড়া, ষোলঘর, শ্রীনগর, শ্যামসিদ্ধি, রাঢ়ীখাল, ভাগ্যকুল ও বাঘড়া। দোহার উপজেলার রয়েছে ৪টি ইউনিয়ন যথা- নারিশা, সুতারপাড়া, মুকসুদপুর ও রাইপাড়া। নবাবগঞ্জ উপজেলার রয়েছে ৪টি ইউনিয়ন যথা- বক্সনগর, চুড়াইন, গালিমপুর ও কলাকোপা ইউনিয়ন। সিরাজদিখান উপজেলার ৪টি ইউনিয়ন যথা- রাজানগর, শেখরনগর, চিত্রকোট ও কেয়াইন। চারটি উপজেলার ১০ লক্ষাধীক মানুষ কোন না কোন ভাবে এই বিলের উপর নির্ভরশীল হয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।

আড়িয়াল বিলের দিঘি হল ডাঙা
খোলা বিল ছাড়াও বিলজুড়ে রয়েছে মাছ চাষের জন্য বড় বড় দিঘী যাকে বিলের মানুষ বলে ডাঙা বা ডেঙা। খোলা বিলের হরেক রকম মাছ ধরার জন্য থাকে বহু ভেসাল। ছোট ছোট ডিঙ্গী বা কোষা নৌকা নিয়ে একজন/দুইজন দিনভর বরশি দিয়ে ধরে কৈ মাছ। একেকটা নৌকা দৈনিক দেড়/দুই হাজার টাকার কৈ মাছ ধরতে পারে। বিল থেকে বছরে প্রায় এক হাজার মেট্রিকটন মাছ উৎপন্ন হয়। এরজন্য বিলের চারদিকে গড়ে উঠেছে অনেক মৎস কেনা-বেচার আড়ৎ। এরমধ্যে বাড়ৈখালি, আলমপুর, হাঁসাড়া, ষোলঘর, শ্রীনগর, উত্তরবালাশুর নতুন বাজার, মরিচা, আলামিনসহ বহু বাজারে বিলের মাছ কেনাবেচা হয়। বিলে রয়েছে ছোটবড় মিলিয়ে দুই শতাধিক ডাঙা। কতগুলো ডাঙা আছে বিশালাকৃতির। এগুলোর আয়তন শত বিঘা। মাঝারিগুলো ১৫-২০ বিঘার। সাগরদিঘি, পরশুরাম, খালেকসাব, কলাগাছিয়া, নারকেলগাছিয়া, তালগাছিয়া, মনসা, কালাচান দিঘি, বৈরাগীর দিঘি, সানুবান্ধ, বসুবালা, আঠারোপাখি, বাড়ই ডাঙা, কেফা ডাঙা, পুলিন বাবুর ডাঙা, মোল্লার ডাঙা এমনসব নাম। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় ডাঙা সাগরদিঘি। ডাঙাগুলোতে পরিকল্পিতভাবেই মাছের চাষ হয়। ডাঙাগুলোতে বিলের পানি ও মাছ ঢুকার জন্য জান রয়েছে। জান হল ডাঙার পানির সাথে বিলের পানির সংযোগ নালা, যেনো ডাঙার প্রাণ আসে এ পথে। জান দিয়ে ডাঙায় পানি প্রবেশ করে। মাছ প্রবেশ গুরুত্বপূর্ণ নয় বরঞ্চ ডাঙার মালিকরা মাছ প্রবেশ ঠেকাতে চায়, যাতে ডাঙায় রাক্ষুসে মাছ না ঢুকে। অনেক ডাঙার পাড়ে রয়েছে হিজল-বরুণসহ বিভিন্ন গাছ। নারকেলগাছিয়ার চারদিকে নারকেল গাছের সারি আবার তালগাছিয়ার চারপাশে তালগাছের সারি রয়েছে। ডাঙার পাশে অনিবার্য হল হিজল গাছ। হিজল গাছের ডাল কেটে, পাতা ঝরিয়ে ডাঙায় ফেলা হয়। এর বাকল যেমন মাছে খায় আবার জাল ফেলে অন্যরা এ কারণে মাছও ধরে নিতে পারে না। অবশ্য এখন ডাঙা মাছচোরদের হাত থেকে রক্ষার জন্য বাঁশের আড়া দেয়া হয়। ডাঙাগুলোর অধিকাংশের মালিকই বিক্রমপুরের। তবে অন্য জেলার মানুষও ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক হওয়ায় ডাঙা খরিদ করেন। যেমন সাগরদিঘির মালিক বরিশালের। এ ডাঙার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা। কলাগাছিয়ার মতো কিছু ডাঙার মালিক সরকার। ভাগ্যকুলের জমিদার পুলিন বাবুর ডাঙা দেবোত্তর সম্পত্তি কিনা তা নিয়ে মামলা চলছে। স্থানীয়দের মধ্যে কেফা ডাঙ্গার মালিক ছিলেন ঈশ্বর পাল। কয়েক বছর আগে স্থানীয় দেলোয়ার হোসেন খানের পুত্ররা তা কিনে নেন। বাড়ই ডাঙ্গার মালিক এখন নারিশার ইঞ্জিনিয়ার মাহবুব, মোল্লার ডাঙার মালিক তাসের বেপারীসহ কয়েকজন।

বর্ষায় অপরূপ আড়িয়াল বিল
টলটলে জলে কখনো জলজ জঙ্গল ঠেলে জেগে উঠে ভোরের লাল সূর্যের মতো শাপলা। কোথাও সাদা সাদা শাপলা আকাশের তারার মতো মিটমিট করে। সাদা শাপলার রাজ্য আর আকাশের শাদা মেঘের ভেলার মাঝ দিয়ে উড়াল দেয় যখন সাদা বক তখন মনে জেগে উঠবে এক অনাবিল সফেদ নিঃসর্গের কথা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাদা বক একাই উড়াল দেয় মাঝে মধ্যে ঝাঁকেও উড়ে। বরুণের (বউন্না গাছ) সাদা ফুল সূর্যের সাদা আলোতে ঝিকমিকিয়ে উঠে। অন্য কোথাও এতো বরুণ গাছ একসাথে চোখে পড়ে না। বর্ষা শেষ হলে এ গাছেই কদবেলের মতো ঝুলতে থাকে বরুণ ফল। গভীর ঘন হিজল গাছগুলো ছোটখাটো টিলার মতো ঝিম মেরে থাকে। জলের মধ্যে পড়া প্রতিবিম্বও জলদগম্ভীর। হিজলের লাল, গোলাপী, হলদেটে ফুল ঝুলতে থাকে কানের দুলের মতো। অগুণিত হিজল ফুল পানিতে পড়ে ভাসতে থাকে। বরুণ আর হিজল ফুলের গন্ধ কিছুটা কটু, সুঘ্রাণ নয় তবে কটু ঘ্রাণও আকৃষ্ট করে। অভাবের সময় বরুণ ফুল ভাজি করে খাওয়ার কথাও শোনা যায়। সারা বছরই আড়িয়াল বিলের আকাশে দেখা মেলে সোনালী ডানার ভূবন চিল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বিলের বুকে রেখে দূর আকাশে বিশাল বৃত্ত টেনে উড়তে থাকে। যখনই সুযোগ আসে, ঝাঁপিয়ে পড়ে ধরে নেয় সাপ, ব্যাঙ অথবা কোন মাছ। ওরা বাসা বানায় উঁচু গাছের ডালে। বিলে গুইসাপ, আরজিনা, গিরগিটিসহ বিভিন্ন সরীসৃপ দেখা যায়। বিলের মধ্যে থাকা ভিটিতে বর্ষার আগে বোনা হয় ধঞ্চে গাছ। বর্ষায় এর হলুদ ফুল, যার উপর দিকে কালো/বাদামী ফুটি থাকে, ভাসতে থাকে বিলের জলে। বর্ষায় টুনটুনি, বুলবুলি, দোয়েল, ফিঙের দেখা মিলবে ধঞ্চেসহ বিভিন্ন ডালে। ফিঙের সংখ্যাই বেশি দৃশ্যমান। তারা দলবল নিয়েই থাকে, অথবা কখনো দেখা মিলে একা বসে আছে কোন মাথাভাঙ্গা ধঞ্চের কাণ্ডে। টুনটুনি দোয়েল থাকে ডাঙাগুলোর কাছাকাছি। বুলবুলিরও দেখা মিলে হরহামেশায়। মাছরাঙা বেশি থাকে ডাঙার ধারে। পুরো বিলেই বিভিন্ন প্রজাতির মাছরাঙা দেখা যায়। এখনো কালেভদ্রে মিলে যায় ডাহুকের দেখা। বিলে অহরহ দেখা যায় আরেকটি পাখি- পানকৌড়ি। এটি ডাঙা ও বিলের বিপুল মাছ খেয়ে সাবাড় করে। শ্রীনগর কলেজের কাছে একটি শিরিস গাছে শতশত পানকৌড়ি রাত্রীযাপন করে। এটি তাদের অভয়ারণ্য। স্থানীয়রা বিলকে কেন্দ্র করেই পালে পাতিহাঁস, যা পানিতে ভেসে বেড়ায়। অতিথি পাখি খুব একটা দেখা যায় না এ বিলে। বর্ষায় লকলকে সাপের ফণার মতোই মাথা ঝাঁকায় কলমির ডগা। প্রচুর কলমী জন্মে আড়িয়াল বিলে। কখনো কলমী আর কচুরির দল বেড়াতে আসা ট্রলারকেও আটকে দেয়। কলমির নীল সাদা বেগুণি ফুল তীব্র গরমে চোখকে শান্তি দিবে। কচুরি ফুল ফুটে ঝাঁকে ঝাঁকে। রঙ কলমীর মতো হলেও ফুলটি ঝাড়বাতির মতো, হুমায়ুন আজাদ বলতেন, ‘পুকুরের ঝাড়বাতি’। অশোক ফুল যেমন সূর্যের মতো লাল কিন্তু মনোমুগ্ধকর। কচুরির ফুলও মুগ্ধকর। কচুরি ফুলও গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের সমষ্টি। একটি ফুলে ১০/১৫টি করে ছোট ফুলের সম্মিলন ঘটে। প্রতিটি ফুলে ছয়টি করে পাপড়ি। উপরের পাপড়িটিতে সাদা বেগুণী নীলের পর মাঝখানে একটি হলুদ ফোটা একে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে। কলমি শাক হিসাবেও খুবই পুষ্টিকর। বিল থেকে শাক তুলেও অনেকে বাজারে বিক্রি করে। বিলে ঢুকলেই দেখা যাবে বিভিন্ন স্থানে সবুজের স'প পড়ে আছে। ওগুলোর ভিতরে আসলে ডাঙা, মানে বিশালাকার দিঘী। এগুলো কাটা হয়েছে মূলত মাছ চাষের জন্য। এই সবুজ চোখ জুড়িয়ে দিবে। তবে বর্ষায় বিলের মূল আকর্ষণ এর জলমণ্ডল। এখন শুধু শ্রীনগর খাল দিয়েই পদ্মার ঘোলা পানি ঢুকে। ফলে বর্ষায় খাল সংলগ্ন পূর্ব দিকের বিলের পানি কিছুটা ঘোলাটে সাদা থাকে। পশ্চিম দিকের খালগুলো সবই বন্ধ থাকায় এখান দিয়ে মূলত পানি ঢুকে না। ফলে প্রকৃতিগতভাবে পশ্চিমদিক অনেকটা বদলে গেছে। এখানকার বদ্ধপানি কালচে এবং কম স্বচ্ছ। এখানে খোলা বিলে মাছদের বিচরণও কম। বর্ষায় অনেকটাই অগম্য হয়ে যায় পশ্চিমাঞ্চল। তখন ছোটছোট ডিঙ্গি/কোষা নিয়ে মানুষ ঢুকে শাপলা তুলতে, নিকটবর্তী ডাঙায় বা জমিতে যেতে। পূর্বাঞ্চল দিয়ে ট্রলার নিয়েই ভ্রমণপিপাসুরা অনায়াসেই বিলে ঢুকে যেতে পারে। ফলে শ্রীনগর, আলমপুর, বাড়ৈখালি দিয়ে যেভাবে বর্ষায় বিলে ভ্রমণ করা যায় সেটা গাদিঘাট, বালাশুর, রাঢ়ীখাল দিয়ে পারা যায় না।

শীতের শস্য ভাণ্ডার আড়িয়াল বিল
ডাঙাগুলো বাদ দিলে শীতে বিলের সব কিছুই বদলে যায়। আড়িয়াল বিলে বিপুল পরিমান ধান জন্মে। বিলের বসতির নিকটবর্তী এলাকায় পাটও হয়। ঢাকা শহরের কুমড়া ও লাউয়ের চাহিদা মেটায় এই বিল। বিলে অনেক ভিটা (উচু জমি) আছে। এসব ভিটায় অনেক শীতকালীন শব্জি জন্মে। ডাঙার পাড়েও জন্মে বিভিন্ন শাকশব্জি। এর মধ্যে আড়িয়াল বিলের কুমড়া দেশবিখ্যাত। একেকটি কুমড়া দুই মণেরও বেশি ওজনের হয়ে উঠে। ভাইদ্যইরা কুমরা ছোট আকৃতির হয়। বিলের ভিটায় অথবা ডাঙার পাড়েই লাগানো হয় কুমড়া, লাউ, ঢেরস, ওস্তা, পটল, খিরাই, টমেটো, বাঙ্গি, লালশাক, পালং শাক, পুঁই শাক, কচুশাক, মরিচ ইত্যাদি। শীতকাল জুড়েই এসব শাকসবজি পাওয়া যায়। অনেক কলা ও পেঁপের চাষও হয় বিলে। লাউডগা ও কুমড়া ডগাও শাক হিসাবে জনপ্রিয়। হেলেঞ্চা, জলকচু, শাপলা, সেঁচিশাক এমনিতেই বিলে হয়ে থাকে। শাপলা উৎপন্ন হয় শালুক থেকে। সেই শালুকও পুড়িয়ে খাওয়া যায়। শাপলা ফুল থেকেও ঢেপের খই বানানো হয়। বিলে লাগানো হয় সরিষা। সে সরিষা ও পাট গাছের চারাও শাক হিসাবে খাওয়া হয়। পঁচা কচুরির স'পে লাগানো হয় লাউ-কুমড়া গাছ। কোন কৃত্রিম সার ছাড়াই লকলক করে বেড়ে উঠে ডগা। বিলে শাকসবজির উৎপাদন হয় প্রায় এক লক্ষ মেট্রিক টন। প্রকৃতির হাতের করতলের মতো এক সুবিশাল সবুজ প্রান্তর। শরতের শেষ থেকে হেমন্ত জুড়ে পানি শুকিয়ে যাওয়া জমিতে লাগানো শুরু হয় শীতের শাকসবজিসহ রবিশস্য। একসময় যব, কাউন, তিল, তিসি, ছোলা, মুশরি লাগানো হতো, এখন এগুলো তেমন চোখে পড়ে না। এখন শাকসবজি ছাড়া বিল জুড়ে ইরি, বুরো ধান। বর্ষার আগে লাগানো আমন ধান বর্ষার সাথে সাথে প্রতিযোগিতা করে বাড়তে থাকতো। বর্ষা শেষে কাটা হতো। এ ধানের লম্বা লম্বা খড় গরুর খাবার ছাড়াও জ্বালানী ও বেড়া নির্মাণসহ বিভিন্ন কাজে লাগতো। ফলন কম বলে এখন আমন বপন কমে গেছে। আগে বোরো আসতো বৈশাখে। এখন বেশিরভাগ ধানই ইরি। আড়িয়াল বিলে ফুলকপি, বাঁধাকপি সামান্য উৎপাদান হলেও আলু চাষ চোখে পড়ে না। আলুচাষ শুরু হওয়ার আরো পরে বিলের পানি শুকানোর কারণেই এখানে তা হয় না। আড়িয়াল বিলের আশপাশের বাড়িগুলোও পুকুরওয়ালা। পুকুর কেটে, সেই মাটি দিয়ে বাড়ি বানানো হয়েছে। বাড়িগুলো থাকে গাছপালায় ঠাসা। পর্যাপ্ত পানি গাছগুলোর বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে, মানুষও রক্ষা পায় রোদের তীব্রতা থেকে। শীত আসলেই বিল ও পুকুরে মাছ ধরার উৎসব শুরু হয়। পলো দিয়ে আগে শতশত মানুষ মাছ ধরতে নেমে যেতো। এখন এমনটা চোখে পড়ে না। এখন কেউ কেউ নিচু ক্ষেতেই আল দিয়ে পুঁটিমাছ চাষ করে। ফাঁকা রাখে কিছু অংশ বা মুখ। বিলের পানির পানির সাথে পুঁটি ঢুকে এসব নিচু ক্ষেতে। যাকে বলা হয় ডকা। রুপালী পুঁটি এসব ক্ষেতে হাজার হাজার জড়ো হয়। শেষ দিকে শুধু পুঁটির মুখ আর মুখ। যেন পুঁটির রাজ্য। পুকুরগুলোতেও পুঁটি, টেংরা, খলসে, মেনি, কৈ, শিং, শোল, গজার, বোয়াল, রুই, কাতলা, চিতল, ফলি, টাকির মহামেলা। সরপুঁটি মাছটি এখন কালেভদ্রে মিলে। বিলের তিনসনি ও চারসনি বয়ষ্ক হলুদাভ কৈ মাছের কদর প্রচুর। এখন পুকুরগুলোতেও মাছ চাষ হয় আধুনিক প্রযুক্তিতে। সেখানে দেশি বহু মাছেরই ঠাই হয় না। বিলে শীতের সময় প্রচুর পরিমানে ফড়িং ও প্রজাপতিরও দেখা পাওয়া যায়। বিলে ভেন্না ও বনতুলশীর মতো অনেক প্রায় বিলুপ্ত গুল্মজাতীয় গাছও চোখে পড়বে। বিস্তৃর্ণ বাক্‌সা ঘাসের গাঢ় সবুজের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের দোলায় সৃষ্ট ঢেউ দেখতে খুবই আকর্ষণীয়। সরিষা ক্ষেতগুলো ফুলে ভরে উঠলে মনে হবে, হলুদের ডাকা বান।

আড়িয়াল বিলের আতঙ্ক
আড়িয়াল বিলে দাড়াস, ঢোঁড়া, মাটিয়াপোড়ার মতো বিষহীন সাপ অহরহই আছে। আছে গোখরাসহ বেশকিছু বিষধর সাপ। প্রতি বছরই বিলে অথবা বিলের ধারের গ্রামগুলোতে বিষধর সাপের ছোবলে প্রাণহারায় কিছু মানুষ। সাপের উৎপাত বেড়ে গেলে কৃষকদের ফসল কাটতেও সমস্যা হয়। সাপ ছাড়াও বিলে ডাকাতের আতঙ্ক রয়েছে। কয়েকটি ডাকাত দল বিলের মাছ লুট ও চাঁদাবাজি করে। এজন্য ডাঙার মালিকদের কাছে আগেই হুমকী প্রদর্শন করে। ডাকাত ও সাপের ভয়ে বিলে দর্শনার্থীরা কেউ রাত্রীযাপন করে না।
এখনো মধ্য বৈশাখে কৃষক ঘরে তুলে পাকা বোরো ধান। তবে এখন বিল অনেকটাই সমতল হয়ে যাওয়ায় বৈশাখে বেশি বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় হাজার হাজার হেক্টর জমির পাকা ধানের ক্ষেত। বেড়ে যায় বিষধর সাপের বিচরণ। অনেক সময় সাপের ভয়ে ধান কাঁটতে সাহস পায় না কৃষক। এখন আড়িয়াল বিলের অধিকাংশ কৃষি শ্রমিকই আসে দূরদূরান্ত থেকে। আবহাওয়া প্রতিকূল হলেই শ্রমিকদের মজুরী বেড়ে যায়। এখন ৫শ টাকার নিচে শ্রমিক পাওয়া যায় না। কখনো ৭০০/৮০০ টাকায়ও শ্রমিক পাওয়া যায় না। আড়িয়াল বিলে ৩০ হাজার একর জমিতে বোরো চাষ হয়। এ বিলে বিঘা প্রতি প্রায় ২৫ মন বোরো উৎপাদন হয়। বছরে বোরো ধানের উৎপাদন এখানে এক লক্ষ মেট্রিকটনের বেশি। অনেক সময় আগাম জোয়ারের পানিতেও নিচু জমিগুলোর ফসল তলিয়ে যায়। বৈশাখ মাসে আড়িয়াল বিলে বোরো তোলার ধুম পড়ে যায়। বিলের ধান কুড়িয়েও বহু মানুষ জীবীকা নির্বাহ করে। বিলে চাষবাস করা অধিকাংশই বর্গাচাষী। এখানে লক্ষাধীক বর্গাচাষী রয়েছেন। এই উৎপাদন দিয়ে তারা সারা বছর স্বাচ্ছন্দে চলেন।

আড়িয়াল বিলে ধারে স্থাপনা
শ্রীনগর বাজার থেকে কিছুটা পশ্চিম দিকে শ্যামসিদ্ধি গ্রামে এর অবস্থান। এটি শ্যামসিদ্ধির ধনাঢ্য ব্যবসায়ী শম্ভুনাথ মজুমদার তাঁর পিতার সমাধীর উপর নির্মাণ করেন। ২৪১ ফুট উচু মঠটির প্রথম পর্বে রয়েছে পূজার কক্ষ। সেখানে বর্তমানে সংস্কার করে ভিতরে বাহিরে টাইলস লাগানো হয়েছে। এর উপরে মঠের দেয়ালে রয়েছে খোড়ল। সেখানে শতশত টিয়াপাখি বাসা বানিয়ে থাকে। এর কাছাকাছি মাইজপাড়ার মঠটিও বিখ্যাত ছিল। কয়েক বছর আগে এটি এটি ভেঙ্গে যায়। বালাশুর চৌরাস্তা থেকে এক কিলোমিটার উত্তরে ভাগ্যকুলের বিখ্যাত জমিদার সীতানাথ রায়ের দুই পুত্র যদুনাথ রায় ও প্রিয়নাথ রায় তৎকালিন ছাগলছিড়া গ্রামে একই রকম দেখতে দুটি সুদৃশ্য ভবন নির্মাণ করেন। ড. হুমায়ুন আজাদ যাকে বলেছেন, ‘বিলের ধারে প্যারিশ শহর’। এখানে জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ ও পানি উত্তলনের ব্যবস্থা ছিল। ল্যাম্পপোস্ট, সোয়ারেজ লাইন, দিঘী আর শিবলিঙ্গ-অশোক ফুল আলোচিত ছিল। গ্রামটি এখন উত্তর বালাশুর হিসাবে পরিচিত। এ বাড়িতেই অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন স্থাপন করেছে বিক্রমপুর জাদুঘর।
আড়িয়াল বিল উন্নয়নের জন্য পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। যার পরিকল্পনা শেষ হয় ১৯৮৫ সালে। প্রকল্পটি দেশের তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মধ্যে অন্তর্ভূক্ত ছিল অর্থাৎ ১৯৮৫-১৯৯০ সালের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বাজেট ছিল তৎকালীন ৬৯ কোটি টাকা। খরচের সম্পূর্ণ টাকাই দাতা সংস্থা ইইসি ও সিডা দিয়েছিল। এই প্রকল্পে আড়িয়াল বিলের ৭৫ হাজার একর জমিতে ফসল ফলানোর জন্য, বন্যা প্রতিরোধ বাঁধ হবে ৬০ কিলোমিটার, সেচ ও পানি নিষ্কাষণ খাল হবে ২১০ কিলো মিটার, রেগুলেটর হবে ৯টি ও পাইপ সুইচ হবে ১৫টি। জমিগুলিতে সেচ সুবিধা পাবে। বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ উঠে প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে। শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটির কোন সুফলই পাওয়া যায়নি। এর আগেও বিলের কচুরি প্রবেশ রোধের জন্য বিলে বিপুল পরিমাণ গজারী খুঁটি পোতা হয়েছিল। তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময় এসব খুঁটি বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল।

আড়িয়াল বিল রক্ষার আন্দোলন
আকস্মিকভাবেই ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের স্থান হিসাবে বিক্রমপুরের আড়িয়াল বিলের নাম চলে আসে। বিলের উপর নির্ভরশীল ও স্থানীয় মানুষ গঠন করে, ‘আড়িয়াল বিল রক্ষা কমিটি’। এই কমিটির ব্যানারে ২০১০ সালের ২৭ ডিসেম্বর ঢাকা মাওয়া সড়কের হাঁসাড়া নামক স্থানে প্রায় ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ মানববন্ধন এবং প্রতিবাদ মিছিল করা হয়। এতে লক্ষাধীক লোকের সমবেত হওয়ার দাবী করেন এলকাবাসী। মিডিয়ায় ৩০ হাজার লোকের সমবেত হওয়ার কথা বলা হয়। ২০১১ সালের ২৬ জানুয়ারি মুক্তাঙ্গনে সমাবেশে বাধা এলে ঢাকা মাওয়া মহাসড়কে বিক্ষোভ ও ভাংচুর হয়। এর প্রেক্ষিতে মামলা হয়। এই মামলার প্রতিবাদে সমাবেশে একজন পুলিশ নিহত হলে সরকার পরিকল্পনা পরিত্যাক্ত ঘোষণা করে। এতোসব কাণ্ডকারখানায় আড়িয়াল বিলটিকে দেশবাসী আরো ভালোভাবে চিনে নিয়েছে এটা বলাই যায়। ২০১১ সালের ২১ জানুয়ারি শুক্রবার বিকেলে আড়িয়াল বিল রক্ষা কমিটির উদ্যোগে শ্রীধরপুরে এক জনসমাবেশের আয়োজন করা হয় যেখানে দেশ বিদেশের বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ উপসি'ত ছিলেন। তাঁরা তাদের অভিমত রাখেন। তাঁরা সকলেই আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের বিরোধীতা করেন। পরিবেশ, ভৌগলিক, অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি বিশ্লেষণ করেন। এই সভায় উপসি'ত ছিলেন ড. অধ্যাপক মজিবুর রহমান ভূইয়া, চেয়ারম্যান পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, সুলতান কাবুচ বিশ্ববিদ্যালয়, ওমান; ড. শহিদুল ইসলাম, অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পরিবেশ ও ভূগোল বিভাগ: জাকির হোসেন, সিইও নাগরিক উদ্যোগ, সম্পাদক বাপা; ড. ফয়জুল হাকীম, সাধারণ সম্পাদক জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল; ড. মো. আব্দুল মতিন, সাধারণ সম্পাদক বাপা; প্রকৌশলী এনামুল হক, পানি বিষেশজ্ঞ; ড. কামরুল হাসান, অস্ট্রেলিয় পরিবেশবিদ। এছাড়াও বিল রক্ষায় ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং আব্দুল্লাহ আবু সাইদ স্যার ভূমিকা রাখেন। মিডিয়াও বিল রক্ষায় ভুমিকা রাখে। ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীসহ অনেককে আসামী করে মামলা করা হলেও তার চার্জশীট এখনো দেয়া হয়নি। ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মুন্সিগঞ্জ কোর্ট থেকে জামিন নেন। ২০১৯ সালে এসে সেই মামলায় শ্রীনগর থানার পুলিশ ১২জনকে গ্রেফতার করে।

আড়িয়াল বিলের সেকাল একাল
সেকালে আড়িয়াল বিলের দিঘিকে কেন ডাঙা বলা হতো? অনুমান করি বর্ষায় বিলের সর্বত্র এমনকি ভিটার উপরেও পানি আর পানি। তখন দিঘিগুলোর চারিধারেই থাকতো ডাঙা। হতে পারে এ থেকেই দিঘির নামই হয়েছে ডাঙা। বিলের পানি কমে গেলে পুঁটিসহ বিভিন্ন মাছ যে নিচু জমিতে ঢুকে পড়ে তাকে কেন ডকা বলে? ইংরেজি ডক থেকেই হয়তো ডকা। বিপন্ন জাহাজ আশ্রয় নেয় ডকে আর পুঁটি ডকায়! আড়িয়াল বিলের বিখ্যাত সরপুঁটিসহ অনেক মাছই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। সুখবর যে, প্রায় বিলুপ্ত হওয়া রয়না মাছ আবারো ফিরে এসেছে। আড়িয়াল বিলে বর্ষায় অনেক নৌকা বাইচ হতো। এখন কোথাও অনিয়মিত, কোথায় বন্ধ। বিলের দক্ষিণ দিকে ঈশ্বর পালের জলবিন্দু, টলটল ঠাকুরের কোষা, ভাগ্যকুলের জমিদারদের লক্ষ্মীনারায়ণ খুব বিখ্যাত বাইচের নৌকা ছিল।
আড়িয়াল বিলে পদ্মার পানি ঢুকানো, বের করা ও নৌপথে যাতায়াতের জন্য আগে বিক্রমপুরের খালগুলো প্রকৃতপ্রস্তাবেই জালের মতো ছড়ানো থাকতো। পদ্মা ও ধলেশ্বরীর পানি বৃদ্ধির সাথে সাথেই খালগুলো দিয়ে বিপুলভাবেই পানি ঢুকতো বিলে। ইছামতি নদী দিয়ে সরাসরিই বিলে পানি পড়তো। বাঘড়ার খাল, নাগরনন্দীর খাল, ভাগ্যকুলের খাল, রাঢ়ীখালের খাল, শ্রীনগরের খালই ছিল বড় ও লঞ্চ চলার উপযোগী। তার আগে ঢাকায় যেতো গয়না নৌকা। সন্ধ্যায় রওনা হয়ে ভোরে পৌঁছে যেতো ঢাকায়। কেরাইয়া নৌকা দিয়ে বিলের এদিক ওদিক যাওয়া যেতো। এই সেদিনও বালাশুর থেকে শ্রীনগর পর্যন্ত চলতো কেরাইয়া নৌকা। বিল অনতিবিলম্বেই পানিতে থৈ থৈ করতো। সম্পূর্ণ বিলকে মনে হতো সাগরের মতো। পানির সাথে পাল্লা দিতে আমন ধান। পানি নেমে গেলেই পানির সাথে আসা নদীর পলিতে বোনা হয় বোরো ধান। বর্ষায় খালগুলো হয়ে উঠতো মাছের উৎস। স্থানীয়রা দোয়াইড় পেতে চিংড়ি, বেলে ও খল্লা মাছ ধরতো। দোয়াইড়গুলো পূর্ণ হয়ে থাকতো মাছে। বিলের পাশ্ববর্তী বাড়িগুলোকে মনে হতো ভেসে থাকা ছোট ছোট দ্বীপ। প্রতি বাড়িতেই অনিবার্যভাবেই থাকতো ডিঙ্গি বা কোষা নৌকা। কেউ কেউ বানাতো তালের ডোঙ্গা ও অস্থায়ী কলার গাছের ভেলা। এছাড়া ছাড়া যাতায়াতের আর কোন পথ ছিল না। পুরো বর্ষায় এখানকার মানুষ মাছ ধরে আর আড্ডা দিয়েই অলস সময় পার করতো। বন্যা লেগেই থাকতো। তাতে কর্মহীন সময় আরো বেড়ে যেতো। এ কর্মহীন সময়ের কারণেই তারা বাড়তি আয়ের জন্য ছড়িয়ে যায় সারা দেশে। মূলত এ কারণেই আজ দেশের প্রায় প্রতিটি উপজেলাতেই বিক্রমপুরের ব্যবসায়ীদের পাওয়া যায়। কয়েক দশক আগেও বিলের বিপুল জলরাশিতে ঢেউ উঠতো। মাঝ বিলে দশ হাতি লগিও ঠাই পেতো না, বৈঠাই ভরসা হতো। এই বিল দিয়ে পচিশ/ত্রিশ বছর আগেও লঞ্চ চলতো। বালাশুর থেকে সৈয়দপুর হয়ে ঢাকাগামী লঞ্চ চলতো বর্ষাকালে। শ্রীনগর বাজার থেকে সারা বছরই লঞ্চে ঢাকা যাওয়া যেতো। আরো বিভিন্ন পথেও লঞ্চ চলতো। বছর বছর পলি পড়ায় এখন বিলের গভীরতা অনেক কম। ঢেউ দেখা যায় না। সড়ক পথ হওয়াতে এখন লঞ্চও চলে না।

কিভাবে আসবেন আড়িয়াল বিলে?
আড়িয়াল বিল এখন পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় স্থান। শীতকালে পায়ে হেঁটে পর্যটকরা উপভোগ করে বিলের সৌন্দর্যতা। লকলক করে লাউ কুমড়ার ডগা। দিগন্তপ্রসারী স্বপ্ন দেখে যেনো। বর্ষাকালই পর্যটকদের বেশি টানে আড়িয়াল বিল। তখন পানির রাজ্য। প্রতিদিন শতশত পর্যটক শ্রীনগর বাজার থেকে ট্রলার রিজার্ভ করে ঢুকে যায় বিলে। কেউ সারাদিন বা আধাবেলা কাটিয়ে আসে। ডাঙ্গার জান খোলা থাকলে ট্রলার নিয়ে ঢুকে যায় ডাঙায়। ডাঙার পাড়ে বসে খাওয়া-দাওয়া, জম্পেস আড্ডা বা সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম করে সময় কাটায় অনেকে। শ্রীনগর বাজার থেকে এজন্য একেকটি ট্রলার ভাড়া নেয় কমবেশি ১৫০০/- টাকা দিয়ে। আলমপুর বাজার থেকেও ট্রলার নিয়ে অনেকে বিলে ঢুকে। পর্যটকরা মুগ্ধতা নিয়েই ফিরে যায়। ঢাকার গুলিস্তান থেকে মাওয়া বা দোহারগামী বাসে নামতে হবে শ্রীনগর। ঢাকা থেকে শ্রীনগরের দূরত্ব ২৯ কিলোমিটার। ঢাকা বাড়ৈখালী সড়কেও যানবাহন চলাচল করে। আলমপুর পার হলেও সড়কের দুপাশে বিস্তীর্ণ আড়িয়াল বিল চোখে পড়ে। ঢাকা নবাবগঞ্জ সড়কেও বিলে আসা যায় এজন্য খাসসুর হাই স্কুলের কাছে নেমেও বাড়ৈখালী দিয়ে বিলে ঢুকতে হবে। শ্রীনগর পার হয়ে রাঢ়ীখাল থেকেও বিস্তীর্ণ বিল দেখা যায়। শ্রীনগর বাজার থেকে গাদিঘাট বাজার পার হয়ে সড়কে দাঁড়ালেও বিশাল বিল দেখা যায়।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:১৯

রাজীব নুর বলেছেন: আমার বাড়ি মুন্সিগঞ্জ।
শ্রী নগর থানা।
আড়িয়াল বিলের মাছ অতি সুস্বাদু।
চমৎকার লিখেছেন আমাদের আড়িয়াল বিল নিয়ে।

২| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৮:০৩

জগতারন বলেছেন:
তথ্য বহুল ও পরিশ্রমী পোষ্ট।
পোষ্ট দাতার প্রতি সুভেচ্ছা ও অভিন্দন জ্ঞাপন করিতেছই।

৩| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:২৩

মুজিব রহমান বলেছেন: ধন্যবাদ৷৷ শ্রীনগর কোন গ্রামে আপনার বাড়ি? আমার বাড়ি ভাগ্যকুল৷

৪| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:২৫

মুজিব রহমান বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকেও৷

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.