নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একজন হোম টিউটর একজন ভালো দর্জি। তিনি সিলেবাসের মধ্যে ভালো রকম কাঁচি চালিয়ে কিছু শর্ট সাজেশন দিয়ে ছাত্র/ছাত্রীদের পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো করাতে খুব দক্ষ। একজন হোম টিউটর নির্দিষ্ট সময় ধরে (এক ঘন্টা থেকে শুরু করে আড়াই ঘন্টা পর্যন্ত) বক্তব্য রাখেন তার পূর্ব প্রস্তুতি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সিলেবাসের নির্দিষ্ট বিষয়ের নির্দিষ্ট অধ্যায়ের জন্য।
তার প্রধান এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রায় একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে, মাসে নির্দিষ্ট কিছু দিন (চন্দ্রবিন্দু বান্ডের হিসেবে সপ্তাহে তিনদিন) তার ছাত্র/ছাত্রী কে নির্দিষ্ট বিষয়ের নির্দিষ্ট সিলেবাস অনুযায়ী নির্দিষ্ট অধ্যায়ের পাঠদান করানো এবং মাস শেষে তার বেতন/সম্মানী নিয়ে নিজের জীবন চালানো। এর এক বিন্দু বেশি বা এক বিন্দু কম তার অভিপ্রায়ের মধ্যে পড়বে না।
শহর অনুযায়ী এই সময় এবং বেতনের তারতম্য থাকলেও হোম টিউটরের ভূমিকায় বিশেষ কোন অদল-বদল থাকে না। বরং সাদৃশ্য বেশি দেখা যায়। কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময় বিশেষ করে অনার্স/ডিগ্রী পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীরা এই ভূমিকা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পালন করেন। কারণ, পড়াশোনার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ খুবই কম; মানে পার্ট টাইম জব নামক বস্তু সব শহরে সমানভাবে বাংলাদেশে বিদ্যমান নয়।
একজন হোম টিউটর জেনে বুঝেই এই দায়িত্ব নেন যে, তিনি আপনার সন্তানকে মানুষ তৈয়ার করতে আসেন নি, তিনি এসেছেন কিছু বিষয় সম্পর্কে জানাতে। অনেকক্ষেত্রে খোদ হোম টিউটর নিজের পড়াশোনা পর্যন্ত সাক্রিফাইস করেন আপনার সন্তানকে ভালো পাঠদান করানোর জন্য। এদের ‘CGPA’ অধিকাংশ ক্ষেত্রে খারাপ হয়ে থাকে।
এখন যে দর্জি আপনি নিয়োগ দিলেন তার কাজ নয় তো আপনার সন্তানকে জীবন ও দর্শন সম্পর্কে জ্ঞাত করা। তার কাজ হচ্ছে, যেটুকু আপনার রেজাল্ট দরকার সেটুকু যেভাবেই হোক আপনার সন্তানের মাধ্যমে তা আদায় করে দেওয়া। তার দায়িত্ব নয় গরুর রচনা আপনার সন্তান কেন পড়ছে? সেটা তাকে জানানো। তার দায়িত্ব হচ্ছে গরুর রচনা যেহেতু পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে থাকে তাই সেটা মুখস্ত করতে হবে এবং পরীক্ষায় অন্তত সে গরুর রচনা সুন্দরভাবে লিখে আসতে হবে।
প্রত্যেকটা হোম টিউটর (আমিও একসময় এই দায়িত্ব পালন করেছি) একেকটা মেশিন; যার কাজ হচ্ছে ক্রমাগত ‘A+’ দিয়ে আপনার শহর ভরে তোলা এবং এভাবেই হোম টিউটর ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের পোর্টফলিও বাড়ানো।
কারণ আপনি যেমন কাজের লোক হিসেবে একজন কে মাত্র এক থেকে তিন মাসের জন্য নিয়োগ দিয়েছেন পরবর্তীতে তিনি সেখানে সুযোগ পাবেন কিনা সে বিষয়ে কোনরুপ নিশ্চয়তা ছাড়াই, তিনিও ভাবছেন পরবর্তী মাসে নতুন আরেকটি টিউশনি দেখতে হবে। আর নতুন টিউশনি পাওয়ার একমাত্র শর্ত হচ্ছে অতীতের পোর্টফলিও। তাই ছাত্রছাত্রী যেমনই হোক তাকে ‘A+’ পাওয়ানো।
আর এই 'A+’ পাওয়ার চক্রে পিষ্ট হয়ে জীবনের স্বাদ ও সাধ্য ভুলে একজন হোম টিউটর এবং তার ছাত্র/ছাত্রীরা ভয়ানক এক ইঁদুর দৌড়ে লিপ্ত। সেমিস্টারের পর সেমিস্টার যায় কিন্তু ‘A+’ পাওয়ার আকাঙ্খা দুই পক্ষের মধ্যে জারি থাকে।
এখন তো বিভিন্ন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক/শিক্ষিকাদের মধ্যেও এই হাল লক্ষ্য করবেন। অনেকদিন আগের সিনেমা ‘দ্বারুচিনি দ্বীপ’ এ মোশাররফ করিম সাহেবের মত অবস্থা। পড়াশোনা তো ঠিক আছে, কিন্তু আজ মাস শেষ, “তোমার মা কই?” ঐ সামান্য বেতনের জন্য আটকে আছে স্বপ্নের প্রমোদভ্রমণ। অনেকদিন আগে কি সুন্দর হোম টিউটরের সংজ্ঞা দিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ স্যার।
আজকাল হঠাৎ দেখি কিছু হোম টিউটর দাবী করেন, “আমি একজন শিক্ষক, আমি আমার যথার্থ সম্মান পাচ্ছি না!”
প্রিয়, জুনিয়র হোম টিউটর, আপনি ভুল জায়গায় ভুল কিছু প্রত্যাশা করছেন। ‘স্কুল এন্ড কলেজ’ টিচারদের হাহাকার দেখে মনে হয় তারা এসবের কিছুই জানতো না। না, না, এরা ‘Zen Z’, তাই সব দোষ এই প্রজন্মের। কিন্তু একটা বেয়াদব প্রজন্মের জন্ম হলো কীভাবে? আদব শেখানোর জন্য কি আমরা অদৌ ছিলাম? আসুন, আমরা সবাই নিজেদের বুকে হাত রেখে সাহস নিয়ে বলি, “আমরা আদব-কায়দা নিয়ে অনেক জ্ঞান ঝেড়েছি!”
টিউশনি করানোর সময় অন্তত আমি একটি বিষয় মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে শুরু করতাম যে, “১০ বছর পর আমার ছাত্র/ছাত্রী আমাকে খুব ঘৃণা করবে।” কারণ আমি ও কে জীবন সংক্রান্ত কিছুই শেখাতে পারলাম না। একদিকে আমি নিজেই খুব বেশি জানি না, অন্যদিকে যেটুকু জানি সেটুকুও জানাতে অক্ষম থেকে গেছি। আবার আমি ছাড়া বাকিরা এসে খুব উদ্ধার করেছেন সেটাও জানা আছে।
কারণ পুরো সিস্টেম এমনভাবে সাজানো যা থেকে ভিন্ন কিছু চিন্তা করা অন্যায়। এক ছাত্রী কে বলেছিলাম, “এত রাত জাগো কেন? বয়ফ্রেন্ড-টয়ফ্রেন্ড আছে নাকি?” সে বললো, “না ওসব নাই। আসলে আমি সারারাত সিনেমা দেখি!” আমি বললাম, “ওকে, আচ্ছা, বলো তো, এন্টারটেইনমেন্ট... এন্টারটেইনমেন্ট... এন্টারটেইনমেন্ট... কোন সিনেমার ডায়ালগ?” এক সেকেন্ডও সময় লাগেনি, উত্তরে বললো, “স্যার, দ্য ডার্টি পিকচার!”
ভারতীয় উপমহাদেশে অনেক গুরুর জন্ম। ইসলাম এসেছে অনেক পীরের অবদানে। এ যে বাংলাদেশ, তা কিন্তু ঐ পীরের দেশ। তাঁরা যে ইসলাম এই উপমহাদেশে এনেছিলেন তাঁর ইতিহাস অজানা কারণে আস্তে আস্তে প্রায় সমস্তই ডুবে গেছে। গুরু ছিলেন তাঁরা! প্রকৃত শিক্ষক ছিলেন তাঁরা! তাঁরা শান্তির দূত ছিলেন।
সর্বোচ্চ চিন্তায় আমার আলিয়া মাদ্রাসায় পাঠদানের সময় বড়সড় বেত নিয়ে আসতেন আমার কিছু প্রিয় শিক্ষক। আজ বড় হয়ে তাঁদের সাথে দেখা হলে মনে হয়, “যেটুকু ‘মানুষ’ এখনো নিজের মধ্যে বেঁচে আছে সেটা এই সব শিক্ষদের জন্য।”
শান্তির ইসলাম ছিলো। তাঁদের শিষ্য ছিলো একজন অন্যজনের চেয়েও ভালো। শুনেছি, তাঁদের সাথে কথা বললেই মানুষ মুগ্ধ হয়ে যেত। পড়েছি, “ইসলাম এত কড়া নয়, বরই শান্তির!” কিন্তু এখন চারপাশে একটার পর একটা তাঁদের মাজার দেখি এবং তার চারপাশে এত মানুষের ভীড়।
এই ভন্ড গুরু/পীরের পাল্লায় পড়ে ‘PK’ সিনেমা উপহার দিলেন আমির খান। আসলেই সব ‘রং নম্বর’ হয়ে গেছে। এখনও যে দুই একজন ভারতীয় উপমহাদেশে বেঁচে আছেন গুরুকূলে, আমি তাঁদেরকে খুব মন দিয়ে শুনি। বুঝার চেষ্টা করি। মনে একরকম শান্তি পাই। বাঁচার জন্য কিছু উদ্দেশ্যের চিন্তা এবং তার খোরাক পাই।
কিন্তু সজ্ঞানে/অজ্ঞানে একজন হোম টিউটর যখন গুরুর সম্মান চেয়ে বসেন তখন ‘মহানগর’ সিরিজের মোশাররফ করিমের একটি ভাইরাল দৃশ্যের মত ‘হা’ করে দেখি আর ভাবি, এসব শুকনো চিন্তায় কিচ্ছু হবে না। এসব যুক্তির মধ্যে নাই কোনো যুক্তি।
আমরা একটার পর একটা গুরু হারিয়েছি কিন্তু একজনকেও জন্ম দিতে পারি নাই। এই পরিবেশ/এই সিস্টেম তা হতে দেই নাই। আর যদি গুরুর সম্মান প্রত্যেকটা হোম টিউটর কে পেতেই হয় তাহলে নিজ শিক্ষক কে দিয়ে আপনি শুরু করুন। পিছে-পৃষ্ঠে গালিগালাজ করার সংস্কৃতি আর ভাল্লাগে না!
ছবি: Bing Enterprise
Also Read It On: ‘গুরু’ মাফ করে দিও!
©somewhere in net ltd.
১| ২৬ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৬
রাজীব নুর বলেছেন: যারা চাকরি পায় না, তারা বাধ্য হয়ে টিউশনি করে।