![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব দক্ষিণ এশিয়ার একটি দীর্ঘস্থায়ী এবং জটিল বিষয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে এই বিরোধ দুটি দেশের মধ্যে একাধিক যুদ্ধ ও সংঘাতের জন্ম দিয়েছে এবং এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ব্যাহত করেছে। এই দ্বন্দ্বের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, কাশ্মীরের ভৌগোলিক বিভাজন, সংঘাতের মূল কারণ, এর ফলে সৃষ্ট শরণার্থী আন্দোলন ও অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি বিস্তারিত গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হলো।
কাশ্মীরের ভৌগোলিক বিভাজন ও নিয়ন্ত্রণ
কাশ্মীর অঞ্চলটি বর্তমানে ভারত, পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে বিভক্ত। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে নিয়ন্ত্রণ রেখা (লাইন অফ কন্ট্রোল বা LOC) রয়েছে, তা এই অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাজনকারী বৈশিষ্ট্য। এই সামরিক নিয়ন্ত্রণ রেখাটি ১৯৪৭ সাল থেকে জম্মু ও কাশ্মীর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে পশ্চিমে ও উত্তরে যথাক্রমে পাকিস্তান-শাসিত আজাদ কাশ্মীর এবং গিলগিত-বালতিস্তান থেকে পৃথক করেছে। নিয়ন্ত্রণ রেখাটি হিমাচল প্রদেশ ও পাঞ্জাব রাজ্যের উত্তরে এবং লাদাখের পশ্চিমে অবস্থিত।
১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে এই রেখাটি তৈরি হয়। এই যুদ্ধের ফলে কাশ্মীর অঞ্চলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে এবং অর্ধেকের কিছু বেশি ভারতের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। কাশ্মীরের কিছু অংশ চীনেরও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যেমন আকসাই চিন এবং ট্রান্স-কারাকোরাম এলাকা, যদিও এই প্রতিবেদনের মূল মনোযোগ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার দ্বন্দ্বের উপর কেন্দ্রীভূত থাকবে।
পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীর দুটি প্রধান অংশে বিভক্ত: আজাদ কাশ্মীর এবং গিলগিত-বালতিস্তান। আজাদ কাশ্মীর একটি স্ব-শাসিত অঞ্চল যা পাকিস্তানের প্রশাসনের অধীনে পরিচালিত হয়। এর রাজধানী ও বৃহত্তম শহর হলো মুজাফফারাবাদ। ২০১৭ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, আজাদ কাশ্মীরের জনসংখ্যা প্রায় ৪০ লক্ষ ৪৫ হাজার। এই অঞ্চলের ৯৯ শতাংশের বেশি মানুষ মুসলিম।
অন্যদিকে, ভারত-শাসিত কাশ্মীর মূলত জম্মু ও কাশ্মীর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল নামে পরিচিত। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, এই অঞ্চলের জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২৫ লক্ষ ৪১ হাজার ৩০২ জন। যদিও এখানে মুসলিমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ (প্রায় ৬৮.৩১ শতাংশ ), তবে হিন্দু (প্রায় ২৮.৪৪ শতাংশ ), বৌদ্ধ ও শিখ সম্প্রদায়ের মানুষও বসবাস করেন। জম্মু ও কাশ্মীর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগর এবং শীতকালীন রাজধানী জম্মু। এই অঞ্চলের আয়তন প্রায় ১,২৫,৫৩৫ বর্গকিলোমিটার।
প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ফলস্বরূপ ১৯৪৭-৪৮ সালে নিয়ন্ত্রণ রেখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই যুদ্ধ কাশ্মীর অঞ্চলের একটি স্থায়ী বিভাজন তৈরি করে, যেখানে পাকিস্তান প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে, যা আজাদ কাশ্মীর, গিলগিত ও বালতিস্তান নামে পরিচিত। ভারত অবশিষ্ট জম্মু ও কাশ্মীরের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। নিয়ন্ত্রণ রেখা, যা পূর্বে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং উভয় দেশ কর্তৃক স্বীকৃত, কার্যত একটি সীমান্ত হিসেবে কাজ করে।
এই রেখাটি কাশ্মীর অঞ্চলের প্রায় ৭৪০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এবং একটি দুর্গম ভূখণ্ড, যা পর্বত, বন ও উপত্যকার মধ্য দিয়ে গেছে। নিয়ন্ত্রণ রেখার উভয় পাশে কাঁটাতারের বেড়া, পর্যবেক্ষণ পোস্ট এবং সৈন্যদের উপস্থিতি দেখা যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনায় এই অঞ্চলের সংবেদনশীলতা বজায় রয়েছে।
কবে থেকে এই অংশগুলো কাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে?
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় কাশ্মীর একটি দেশীয় রাজ্য ছিল, যার শাসক ছিলেন হিন্দু মহারাজা হরি সিং। ‘ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট’ অনুসারে, কাশ্মীরকে ভারত অথবা পাকিস্তানে যোগদানের অথবা স্বাধীন থাকার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। মহারাজা হরি সিং প্রাথমিকভাবে স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলেন। তবে, ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে পাকিস্তান-সমর্থিত পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলার বিদ্রোহী নাগরিক এবং পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পশতুন উপজাতিরা কাশ্মীর রাজ্য আক্রমণ করে।
এই পরিস্থিতিতে মহারাজা হরি সিং ভারতের সাহায্য প্রার্থনা করেন। গভর্নর-জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন এই শর্তে সাহায্য করতে রাজি হন যে, রাজা কাশ্মীরের ভারতভুক্তির পক্ষে স্বাক্ষর করবেন।
১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর, মহারাজা হরি সিং কাশ্মীরের ভারতভুক্তির চুক্তিতে (ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাক্সেসন) স্বাক্ষর করেন এবং ২৭ অক্টোবর তা ভারতের গভর্নর-জেনারেল কর্তৃক অনুমোদিত হয়। এই চুক্তির ফলে জম্মু ও কাশ্মীর স্বাধীন রাজ্য হিসেবে ভারতীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের পর ভারতীয় সেনা কাশ্মীরে প্রবেশ করে অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ভারত বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করে। ফলস্বরূপ, ১৯৪৭ সালেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ শুরু হয়, যা প্রায় দুই বছর ধরে চলেছিল।
জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে ১৯৪৮ সালে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়, তবে পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করে। তখন থেকেই কাশ্মীর কার্যত পাকিস্তান ও ভারত নিয়ন্ত্রিত দুটি অংশে ভাগ হয়ে যায়। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আজাদ কাশ্মীর দিবস পালিত হয় ২৪ অক্টোবর, ১৯৪৭ সালে। এই দিনটি পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের প্রতিষ্ঠার দিন হিসেবে গণ্য করা হয়।
১৯৪৭ সালের ঘটনাক্রম থেকে একটি সুস্পষ্ট কারণ ও ফলাফল সম্পর্ক দেখা যায়। উপজাতীয়দের আক্রমণ মহারাজার ভারতের সাথে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্তকে ত্বরান্বিত করে, যা পরবর্তীতে প্রথম যুদ্ধ এবং কাশ্মীরের বর্তমান বিভাজনের দিকে ধাবিত করে। ভারত কর্তৃক ২৬/২৭ অক্টোবরের তারিখটি অন্তর্ভুক্তির আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে গণ্য হলেও, পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মীর প্রতিষ্ঠার তারিখ ২৪ অক্টোবর তাদের ভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও ব্যাখ্যার পরিচায়ক।
মহারাজা হরি সিংয়ের স্বাধীনতা বজায় রাখার প্রাথমিক আকাঙ্ক্ষা থেকে বোঝা যায় যে, বর্তমান বিভাজন অনিবার্য ছিল না, বরং ১৯৪৭ সালের অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির ফলস্বরূপ তৈরি হয়েছিল।
কাশ্মীরের স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষা
ভারত-শাসিত কাশ্মীরের জনগণের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ স্বাধীনতা অথবা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হতে চায়। ভারত-শাসিত জম্মু ও কাশ্মীরের জনসংখ্যার প্রায় ৬৮.৩১ শতাংশ মুসলিম। এখানকার জনগণের মধ্যে উচ্চ বেকারত্বের হার এবং প্রতিবাদ ও বিদ্রোহীদের দমনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর নীতি বিদ্যমান। ১৯৮৯ সালে ইসলামপন্থীদের নেতৃত্বে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়।
কাশ্মীরের জনগণের একটি অংশ মনে করে যে, ১৯৪৭ সালে কাশ্মীরের ভারতভুক্তি তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছিল এবং তারা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের পক্ষে। তারা চায় হয় পূর্ণ স্বাধীনতা, না হয় পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্তি। এই আকাঙ্ক্ষা বিভিন্ন সময়ে বিক্ষোভ ও বিদ্রোহের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
এমনকি ২০১৯ সালে ৩৭০ ধারা বাতিলের পরও কাশ্মীরিরা বিশ্বাসঘাতকতা অনুভব করছেন এবং তাদের বিশেষ অধিকার হারানোর বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। কেউ কেউ মনে করেন, ৩৭০ ধারা বাতিল করার ফলে কাশ্মীরি মুসলমানরা তাদের নিজেদের ভূখণ্ডে প্রান্তিক হয়ে যেতে পারে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, সংঘাতমুক্ত কাশ্মীর প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ৩৭০ ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতের কাশ্মীরি জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। অনেক কাশ্মীরি মনে করেন, কাশ্মীর যতক্ষণ পর্যন্ত একটি স্বাধীন দেশ না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেখানকার মানুষ তাদের অধিকার ফিরে পাবে না।
কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কতবার সংঘর্ষ হয়েছে?
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে সংঘটিত প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সংঘাতের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিচে দেওয়া হলো:
১. প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ (১৯৪৭–১৯৪৮): কাশ্মীরের রাজা হরি সিংহের ভারতভুক্তির সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে পাকিস্তান-সমর্থিত উপজাতি যোদ্ধারা কাশ্মীর আক্রমণ করে। পাকিস্তানি বাহিনী ও উপজাতিদের অগ্রগতির মুখে রাজা হরি সিংহ ভারতের সাহায্য চান। ভারতীয় সেনা কাশ্মীরে প্রবেশ করে এবং শ্রীনগর রক্ষা করে। জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি হয়। কাশ্মীর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্ত হয় (LoC প্রতিষ্ঠা)।
২. দ্বিতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ (১৯৬৫): পাকিস্তান ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’ নামে ভারতীয় কাশ্মীরে গেরিলা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে। ভারত পাকিস্তানের লাহোর ও সিয়ালকোটে পাল্টা আক্রমণ চালায়। উভয় পক্ষ বিমান হামলা ও ট্যাঙ্ক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় ‘তাশখন্দ চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। কাশ্মীরের স্ট্যাটাস কো অপরিবর্তিত থাকে।
৩. কারগিল যুদ্ধ (১৯৯৯): পাকিস্তান-সমর্থিত বিদ্রোহীরা ভারতীয় কাশ্মীরের কারগিল সেক্টরে অবস্থান নেয় এবং কৌশলগত উচ্চভূমি দখল করে। ভারত ‘অপারেশন বিজয়’ চালিয়ে পাহাড়ি অঞ্চল পুনর্দখল করে। পাকিস্তানি সেনা ও বিদ্রোহীরা পিছু হটে। আন্তর্জাতিক চাপে পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহার করে। ভারতের জয়ে কারগিল পুনরুদ্ধার হয়।
৪. কাশ্মীরে বিদ্রোহ ও সন্ত্রাসবাদ (১৯৮৯–বর্তমান): ১৯৮৭ সালের বিতর্কিত নির্বাচন ও ভারতের শাসনের বিরুদ্ধে কাশ্মীরি জনগণের অসন্তোষ। পাকিস্তান বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে প্রশিক্ষণ ও অর্থায়ন করে। ১৯৯০-এর দশক: হিজবুল মুজাহিদিন ও লস্কর-ই-তৈয়বার মতো গোষ্ঠীর উত্থান। ২০১৬ উরি হামলা: জইশ-ই-মোহাম্মদের হামলায় ১৯ ভারতীয় সেনা নিহত। বর্তমান অবস্থা: নিয়মিত সেনা-বিদ্রোহী সংঘর্ষ ও বেসামরিক হতাহত।
৫. ২০১৯ পুলওয়ামা হামলা ও বালাকোট বিমান হামলা: পুলওয়ামা হামলা (১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯): জইশ-ই-মোহাম্মদের আত্মঘাতী হামলায় ৪০ ভারতীয় সেনা নিহত। ভারতের জবাব (২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯): ভারত পাকিস্তানের বালাকোটে বিমান হামলা চালায়, দাবি করে জঙ্গি শিবির ধ্বংস হয়েছে। পাকিস্তান ভারতীয় মিগ-২১ ভূপাতিত করে ও পাইলট অভিনন্দন বর্তমান কে বন্দি করে (৩ দিন পর মুক্তি)।
৬. ২০২৫ পেহেলগাম হামলা ও অপারেশন সিন্দুর (নতুন সংযুক্তি): পেহেলগাম হামলা (এপ্রিল ২০২৫): কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলায় ২৬ জন নিহত। জইশ-ই-মোহাম্মদ দায় স্বীকার করে। ভারতের প্রতিক্রিয়া: ভারত ‘অপারেশন সিঁন্দুর’ চালিয়ে পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ৯টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করে। পাকিস্তান ৫টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিতের দাবি করে। উভয় দেশে বেসামরিক হতাহত বাড়ছে।
৭. সর্বশেষ সীমান্ত সংঘর্ষ (২০২০–২০২৪): ২০১৯ সালে ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার। পাকিস্তান এই সিদ্ধান্তকে অমর্যাদা হিসেবে দেখে। ২০২০-২০২১: LoC-তে ভারী গোলাবর্ষণে উভয় পক্ষের শতাধিক সেনা ও বেসামরিক নিহত। ২০২৩-২০২৪: রাজৌরি-পুঞ্চ অঞ্চলে সন্ত্রাসী হামলা ও ভারতের ‘অপারেশন ধনুষ’ প্রতিশোধমূলক অভিযান।
৮. ১৯৯৯ আটলান্টিক বিমান ভূপাতন: ১০ আগস্ট ১৯৯৯-এ পাকিস্তান ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি নজরবিহীন প্রশিক্ষণ বিমান (আটলান্টিক) ভূপাতিত করে। ১৬ জন ভারতীয় কর্মী নিহত। এই ঘটনা কাশ্মীর উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে দুই দেশের সম্পর্ককে আরও জটিল করে।
কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত ও পাকিস্তানের সংঘাত ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য, সন্ত্রাসবাদ, ও জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবির জটিল সমন্বয়। প্রতিটি সংঘাত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে হস্তক্ষেপে বাধ্য করলেও স্থায়ী সমাধান আজও অধরাই রয়ে গেছে। এছাড়াও, বিভিন্ন সময়ে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর উভয় দেশের সেনাদের মধ্যে ছোটখাটো সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা লেগেই থাকে।
কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে বারবার সংঘটিত এই সংঘাতগুলো এই অঞ্চলের বিরোধের গভীরতা ও স্থায়ীত্বের প্রমাণ দেয়। অন্তত চারটি বড় যুদ্ধ এবং দীর্ঘমেয়াদী সামরিক সংঘাত (যেমন সিয়াচেন) থেকে বোঝা যায় যে এটি কেবল একটি ঐতিহাসিক বিষয় নয়, বরং উত্তেজনার একটি পুনরাবৃত্তিমূলক উৎস। ১৯৬৫ সালের কচ্ছের মতো সীমান্ত সংঘর্ষ থেকে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নেওয়ার প্রবণতা দুটি পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে সংঘাতের বিপজ্জনক চিত্র তুলে ধরে।
১৯৮৪ সালে শুরু হওয়া সিয়াচেন সংঘাত, যা প্রযুক্তিগতভাবে এখনও বিদ্যমান, দেখায় যে বড় ধরনের যুদ্ধ না হলেও কাশ্মীর ইস্যু দীর্ঘমেয়াদী সামরিক মোতায়েন এবং নতুন করে সংঘাতের সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।
এই সংঘর্ষগুলোর মূল কারণগুলো কী কী?
কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষের মূল কারণ হলো এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক বিরোধ। পাকিস্তান তার জন্মলগ্ন থেকেই কাশ্মীর দখলের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের মূল কারণ ছিল কাশ্মীর সমস্যা। ভারত মনে করে জম্মু ও কাশ্মীর তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা ধর্মনিরপেক্ষতা ও বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ভারতীয় দর্শনের মূল ভিত্তি।
অন্যদিকে, পাকিস্তান দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে কাশ্মীরকে একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা হিসেবে দেখে এবং মনে করে এটি পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত ছিল।
বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত প্রধান যুদ্ধগুলোর নির্দিষ্ট কিছু কারণও ছিল। ১৯৪৭-৪৮ সালের যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল পাকিস্তানের কাশ্মীর দখলের পরিকল্পিত চেষ্টার মাধ্যমে, যার ফলস্বরূপ কাশ্মীরের হিন্দু রাজা ভারতের সাহায্য চেয়েছিলেন। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের কারণ ছিল পাকিস্তানের ধারণা যে কচ্ছ অঞ্চলে সাফল্যের পর তারা কাশ্মীরেও ভারতের প্রতিরোধ ভেঙে ফেলতে পারবে। এর ফলস্বরূপ পাকিস্তান ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’-এর মাধ্যমে অনুপ্রবেশকারী প্রেরণ করে এবং ‘অপারেশন গ্র্যান্ড স্লাম’-এর মাধ্যমে আখনুর দখলের চেষ্টা করে।
১৯৯৯ সালের কারগিল সংঘাত ছিল পাকিস্তান-সমর্থিত বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশের ফল। ১৯৮৪ সালে সিয়াচেন সংঘাতের সূত্রপাত হয় ভারতের ‘অপারেশন মেঘদূত’-এর মাধ্যমে, যার লক্ষ্য ছিল হিমবাহের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
কাশ্মীরের মর্যাদা নিয়ে মৌলিক মতানৈক্য (ভারত এটিকে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখা এবং পাকিস্তানের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তিতে নিজেদের দাবি করা) সমস্ত সংঘাতের মূল কারণ। পাকিস্তানের কৌশল প্রায়শই কাশ্মীরের অভ্যন্তরে বিদ্রোহ উস্কে দেওয়া বা ভারতীয় প্রতিরক্ষার দুর্বল দিকগুলো কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে, যা ১৯৬৫ ও ১৯৯৯ সালের সংঘাতের পূর্বে দেখা গেছে।
ভারতের পদক্ষেপ, যেমন ১৯৮৪ সালে সিয়াচেনে অভিযান, সংঘাতের কারণ হয়েছে, যা ইঙ্গিত করে যে উভয় পক্ষই সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছে যা উত্তেজনা বাড়িয়েছে। ভারতীয়-শাসিত কাশ্মীরের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের স্বাধীনতা বা পাকিস্তানের সাথে যোগদানের আকাঙ্ক্ষা এই সংঘাতকে আরও জটিল করে তোলে, যা এটিকে কেবল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বিষয় হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখে না।
কাশ্মীর নিয়ে কেন ভারতের সঙ্গে পেরে উঠছে না পাকিস্তান?
কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তান ক্রমশ ভারতের সঙ্গে পেরে উঠছে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির ভারসাম্যহীনতা। ২০২৫ সালের গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের রিপোর্ট অনুযায়ী, সামরিক শক্তির নিরিখে বিশ্বে ভারতের অবস্থান চতুর্থ, যেখানে পাকিস্তান রয়েছে দ্বাদশ স্থানে।
ভারতের বার্ষিক প্রতিরক্ষা বাজেট প্রায় ৮৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা পাকিস্তানের প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় অনেক বেশি। জনবলের দিক থেকেও ভারত এগিয়ে, দেশটির সক্রিয় সৈন্য সংখ্যা প্রায় ১৪ লক্ষ ৫৫ হাজার, যেখানে পাকিস্তানের সৈন্য সংখ্যা প্রায় ৯ লক্ষ ৩৫ হাজার ৮০০ জন। রিজার্ভ সেনা এবং প্যারামিলিটারি বাহিনীর ক্ষেত্রেও ভারত পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে।
ভারতের কাছে ৪,২০১টি ট্যাংক রয়েছে, যেখানে পাকিস্তানের রয়েছে ২,৬২৭টি। ভারতের মোট এয়ারক্রাফট ২,২২৯টি, পাকিস্তানের ১,৩৯৯টি। যুদ্ধবিমানের সংখ্যায়ও ভারত এগিয়ে, তাদের ৫১৩টি যুদ্ধবিমান রয়েছে, যেখানে পাকিস্তানের আছে ৩২৮টি। পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যায় উভয় দেশ প্রায় সমানে সমান, ভারতের কাছে ১৮০টি এবং পাকিস্তানের কাছে ১৭০টি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।
এছাড়াও, কাশ্মীর ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সমর্থনও পাকিস্তানের দিকে আগের মতো নেই। ২০১৯ সালে ৩৭০ ধারা বাতিলের পর নিরাপত্তা পরিষদও পাকিস্তানের অভিযোগ আমলে নেয়নি। ভারতের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক মহলে তাদের সমর্থন বাড়ছে। এমনকি মুসলিম দেশগুলোর জোট ওআইসি-তেও কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তান সমর্থন হারাচ্ছে।
পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত জাভিদ হুসাইন মনে করেন, কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের নৈতিক ও আইনি যুক্তিগুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমলে নিচ্ছে না। পাশাপাশি, ভারত ও কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের কৌশলগত লক্ষ্য ও নীতির স্পষ্টতা ও ধারাবাহিকতার অভাব রয়েছে, যা ভারতের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানকে দুর্বল করে দিচ্ছে। অর্থনৈতিক সংকটের কারণেও পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে পেরে উঠছে না।
কাশ্মীরের দ্বন্দ্বের ফলে শরণার্থী আন্দোলন এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো কীভাবে প্রভাবিত হয়েছে?
কাশ্মীর দ্বন্দ্বের ফলে ব্যাপক শরণার্থী আন্দোলন ও অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৪৭-৪৮ সালের যুদ্ধের পর জম্মু ও কাশ্মীর বিভক্ত হওয়ার ফলে উভয় দিকেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। ভারত সরকারের মতে, কিছু শিখ ও মুসলিম পরিবার সহ ৬২,০০০ টির বেশি পরিবার কাশ্মীরি শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত রয়েছে। এদের বেশিরভাগ পরিবার জম্মু, দিল্লি এবং অন্যান্য প্রতিবেশী রাজ্যে পুনর্বাসিত হয়েছে।
অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার একটি বড় উদাহরণ হলো কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ডিসপ্লেসমেন্ট (বাস্তুচ্যুতি)। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার অনুমান অনুযায়ী, রাজনৈতিক উত্তেজনা, দাঙ্গা ও অর্থনৈতিক কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরি পণ্ডিত বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ১৯৮৯ সালে ইসলামপন্থীদের নেতৃত্বে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়, যা সম্ভবত আরও অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার কারণ হয়।
এই বিদ্রোহ ও সংঘাতের ফলে বহু বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। কাশ্মীর মিডিয়া সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৯ থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৯৬ হাজার ৪৩২ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৭ হাজার ৩৮২ জনকে পুলিশ হেফাজতে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়াও, ১ লক্ষ ৭৫ হাজার ৯৩৬ জন বেসামরিক নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং ১ লক্ষ ১০ হাজার ৫৫৯ টি ঘরবাড়ি ও দোকানপাট ধ্বংস করা হয়েছে।
নারী ও শিশুদের ওপর এই সহিংসতার প্রভাব ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক। এই সময়ের মধ্যে ১১ হাজার ২৬৭ জন নারী গণধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন। এর ফলে ২২ হাজার ৯৮২ জন নারী বিধবা হয়েছেন এবং ১ লক্ষ ৭ হাজার ৯৮২ শিশু এতিম হয়েছে। ভারতীয়-শাসিত কাশ্মীরে উচ্চ বেকারত্বের হার এবং প্রতিবাদ ও বিদ্রোহীদের দমনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর নীতি অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা বাড়িয়েছে।
২০১৯ সালে ৩৭০ ধারা বাতিলের পর কাশ্মীরিরা বিশ্বাসঘাতকতা অনুভব করছেন এবং বাইরের লোকেদের জমি কেনার অধিকার দেওয়ায় জনসংখ্যার পরিবর্তন নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, যা ভবিষ্যতে বিদ্রোহের কারণ হতে পারে। কেউ কেউ মনে করেন, ৩৭০ ধারা বাতিল করার ফলে কাশ্মীরি মুসলমানরা তাদের নিজেদের ভূখণ্ডে প্রান্তিক হয়ে যেতে পারে, যা ফিলিস্তিনের পরিস্থিতির সাথে তুলনীয় এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যতের বিশৃঙ্খলার ইঙ্গিত দেয়।
জম্মু ও কাশ্মীরের অস্থিরতায় বহু মানুষের মৃত্যু অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা ও জীবনযাত্রার ব্যাপক ডিসরাপশন (বিঘ্ন)-এর দিকে ইঙ্গিত করে। ৩৭০ ধারা বাতিলের ফলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা অত্যাচারিত রিফিউজি (শরণার্থী) এবং ১৯৫৩ সালে কাশ্মীরে আসা শ্রমিক পরিবার ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ায় একটি দীর্ঘস্থায়ী শরণার্থী সমস্যার সমাধান হয়েছে, যদিও এটি সরাসরি সংঘাত-প্ররোচিত বিদ্রোহ ছিলো না।
কাশ্মীর সংঘাতের কারণে সীমান্ত পেরিয়ে শরণার্থী চলাচল (যদিও এই গবেষণায় বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়নি) এবং উল্লেখযোগ্য অভ্যন্তরীণ সংঘাত উভয়ই ঘটেছে। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বিতাড়ন এবং চলমান সহিংসতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অন্যান্য সম্প্রদায়ের সম্ভাব্য বিতাড়ন এই অঞ্চলের একটি বড় মানবিক সংকট।
৩৭০ ধারা বাতিল, যদিও ভারতের সাথে কাশ্মীরকে আরও সম্পূর্ণরূপে একীভূত করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, স্থানীয় মুসলিম জনসংখ্যার মধ্যে ভবিষ্যতের জনমিতিক পরিবর্তন এবং সম্ভাব্য বিতাড়নের আশঙ্কা জাগিয়েছে, যা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জনসংখ্যা স্থানান্তরের উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাবের উদাহরণ। ১৯৮০-এর দশকের শেষভাগ থেকে চলমান সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন অভ্যন্তরীণ সংঘাত একটি প্রধান কারণ এবং একটি ভয় ও অস্থিরতার পরিবেশ তৈরি করেছে।
বর্তমানে কাশ্মীরের পরিস্থিতি কেমন এবং সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো কী কী?
বর্তমানে কাশ্মীর পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত এবং সংবেদনশীল। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে স্নায়ুযুদ্ধ আজও অব্যাহত রয়েছে। ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে ভারত সরকার জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে এবং রাজ্যটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করে। এই সিদ্ধান্তের ফলে অঞ্চলটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। যদিও কিছু বিশ্লেষক মনে করেন ৩৭০ ধারা বাতিলের ফলে কাশ্মীরে উন্নয়ন ও একতা বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে অনেক কাশ্মীরি এই সিদ্ধান্তকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখছেন এবং স্বাধীনতার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় অন্তত ২৬ জন পর্যটকের নিহত হওয়ার ঘটনা। এই হামলায় একজন সংযুক্ত আরব আমিরাতের এবং একজন নেপালের নাগরিকও নিহত হন। এই হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে এবং পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা বাতিলসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।
জবাবে পাকিস্তানও ভারতীয় নাগরিকদের ভিসা বাতিল, দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য স্থগিত এবং ভারতীয় উড়োজাহাজের জন্য তাদের আকাশসীমা বন্ধসহ বেশ কয়েকটি পাল্টা পদক্ষেপ নিয়েছে। এমনকি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত সিন্ধু নদের পানি চুক্তিও হুমকির মুখে পড়েছে।
পাকিস্তান এই চুক্তি স্থগিতের চেষ্টাকে ‘যুদ্ধ’ হিসেবে গণ্য করবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ উভয় পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
২০১৯ সালে ৩৭০ ধারা বাতিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় ছিল, যা কাশ্মীরের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোয় বড় পরিবর্তন এনেছে এবং জনসংখ্যার একটি অংশের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। ২০২৫ সালের পেহেলগামের সন্ত্রাসী হামলা প্রমাণ করে যে, নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতির দাবি সত্ত্বেও অঞ্চলটি এখনও সহিংসতার ঝুঁকিতে রয়েছে এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চাপা উত্তেজনা সহজেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে জাতিসংঘ, এই পরমাণু শক্তিধর অঞ্চলে উত্তেজনা বৃদ্ধি রোধে বারবার আহ্বান জানাচ্ছে। ৩৭০ ধারা বাতিলের পর ভারতীয় সরকার এবং কিছু বিশ্লেষক শান্তি ও উন্নয়নের কথা বললেও, অনেক কাশ্মীরি এবং অন্যান্য পর্যবেক্ষক মনে করেন এটি বিচ্ছিন্নতা এবং অধিকার হরণের দিকে ধাবিত করেছে।
কাশ্মীর দ্বন্দ্বের অর্থনৈতিক প্রভাব
কাশ্মীর দ্বন্দ্বের অর্থনৈতিক প্রভাব ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। এই সংঘাতের কারণে কাশ্মীর অঞ্চলের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়েছে। পর্যটন, যা একসময় কাশ্মীরের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি ছিল, তা বহুলাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সাম্প্রতিক পেহেলগামের সন্ত্রাসী হামলার পর পর্যটন শিল্পে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে এবং বহু হোটেল ও অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। শুধু কাশ্মীর নয়, ভারত ও পাকিস্তানের অর্থনীতিতেও এই সংঘাতের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। প্রতিরক্ষা খাতে বিপুল পরিমাণ ব্যয় উভয় দেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করছে।
যুদ্ধের কারণে শেয়ারবাজারে ধস নামে এবং বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারান। সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উভয় দেশই অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এছাড়া, সিন্ধু নদীর জলবন্টন চুক্তি স্থগিতের হুমকি পাকিস্তানের কৃষি অর্থনীতির উপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিও এই সংঘাতের কারণে মন্থর হতে পারে।
কাশ্মীর দ্বন্দ্বের আন্তর্জাতিক ভূমিকা
কাশ্মীর দ্বন্দ্বের সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে জাতিসংঘ, শুরু থেকেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার চেষ্টা করেছে। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর কাশ্মীর নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে, ভারত বিষয়টি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে নিয়ে যায়। সেখানে রেজ্যুলিউশন ৩৯ (১৯৪৮) পাশ হয় এবং দুই দেশের মধ্যে সমস্যা সমাধানের জন্য ‘জাতিসংঘের ভারত-পাকিস্তান কমিশন (ইউএনসিআইপি)’ গঠন করা হয়। দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ থামলে, যুদ্ধবিরতি রেখা পর্যবেক্ষণের জন্য ‘জাতিসংঘের ভারত পাকিস্তান সামরিক পর্যবেক্ষক দল (ইউএনএমওজিআইপি)’ তৈরি করা হয়, যা আজও সক্রিয় রয়েছে।
জাতিসংঘ বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা, সৈন্য প্রত্যাহার এবং গণভোটের আয়োজনের জন্য একাধিক প্রস্তাব দিয়েছে। তবে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ঐকমত্যের অভাবে এসব প্রস্তাব কার্যকর করা যায়নি। পাকিস্তান কাশ্মীর ইস্যুকে আন্তর্জাতিক স্তরে উত্থাপন করতে চায় এবং ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘের রেজোলিউশন বাস্তবায়নের পক্ষে, যেখানে কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে স্বাধীন গণভোটের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে, ভারত দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করতে আগ্রহী এবং তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের পক্ষ অবলম্বন করে, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। ২০১৯ সালে লাদাখকে ভারতের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে আনার বিষয়ে চীন বিরোধিতা করেছে, কারণ তারা এটিকে তাদের আঞ্চলিক সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন হিসেবে দেখে। মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীও কাশ্মীরের বিষয়ে ভারতের পদক্ষেপের সমালোচনা করেছিলেন।
২০১৯ সালে ৩৭০ ধারা বাতিলের পর চীন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীর নিয়ে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছিল, যেখানে রাশিয়া এটিকে ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক বিষয় বলে উল্লেখ করে। যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, কাশ্মীর ইস্যুতে তাদের কোনো অবস্থান নেই এবং তারা নিরপেক্ষ আছে।
কিছু বিশ্লেষক মনে করেন দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য সংঘাতমুক্ত কাশ্মীর প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ৩৭০ ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতের কাশ্মীরি জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। তবে, বর্তমানে কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক সমর্থন হারাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে, এমনকি মুসলিম দেশগুলোর মধ্যেও।
জাতিসংঘ কাশ্মীর সংঘাতের শুরু থেকেই মধ্যস্থতা ও শান্তিরক্ষার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ঐকমত্যের অভাবের কারণে এর কার্যকারিতা সীমিত। কাশ্মীর সংঘাত বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সাথে জড়িয়ে গেছে, যেখানে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ পক্ষ নিয়েছে, যা এই অঞ্চলের কৌশলগত গুরুত্বকে প্রতিফলিত করে।
পাকিস্তান বরাবরই আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ও জাতিসংঘের প্রস্তাব বাস্তবায়নের পক্ষে, বিশেষ করে গণভোটের বিষয়ে, যেখানে ভারত দ্বিপাক্ষিক আলোচনার উপর জোর দিয়েছে। ২০১৯ সালে ৩৭০ ধারা বাতিলের পর আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হয়েছে, যেখানে পাকিস্তান সম্ভবত কিছু আন্তর্জাতিক সমর্থন হারিয়েছে এবং জাতিসংঘ আগের তুলনায় কম সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।
উপসংহার
কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব একটি দীর্ঘস্থায়ী এবং জটিল সমস্যা, যার শিকড় ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় প্রোথিত। এই বিরোধের মূল কারণ হলো কাশ্মীরের ভৌগোলিক বিভাজন, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, দুটি দেশের ভিন্ন ভিন্ন জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং কাশ্মীরি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা। এই দ্বন্দ্বের ফলে বহুবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে এবং ব্যাপক শরণার্থী আন্দোলন ও অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এই সংঘাতের অর্থনৈতিক প্রভাবও অত্যন্ত নেতিবাচক, যা অঞ্চলের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতাকে ব্যাহত করে।
বর্তমানে কাশ্মীরের পরিস্থিতি সংবেদনশীল, ২০১৯ সালে ৩৭০ ধারা বাতিল এবং সাম্প্রতিক পেহেলগামের সন্ত্রাসী হামলা এই অঞ্চলের উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে জাতিসংঘ, এই বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য বারবার আহ্বান জানালেও, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে গভীর অনাস্থা এবং ভিন্ন ভিন্ন কৌশলগত অবস্থানের কারণে কোনো স্থায়ী সমাধান এখনো পর্যন্ত অধরা রয়ে গেছে।
কাশ্মীর সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ ও স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করা দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।
ছবি: ChatGPT
২| ০৯ ই মে, ২০২৫ সকাল ৮:৩৮
কামাল১৮ বলেছেন: রচনা ভালো হয়েছে।লাইন গুনেই নাম্বার দেয়া যায়।এই সব নিজের ফেসবুকে লিখুন।ব্লগে একটু ছোট করে লিখুন।
৩| ০৯ ই মে, ২০২৫ সকাল ৯:৪৮
রাজীব নুর বলেছেন: পুরোনো কাসুন্দি।
©somewhere in net ltd.
১|
০৮ ই মে, ২০২৫ রাত ১১:১৪
মহাজাগতিক চিন্তা বলেছেন: পোষ্টের জন্য ধন্যবাদ।