নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি মেহেদি হাসান, মি. বিকেল নামে পরিচিত। আমি একজন লেখক, অভিনেতা, সমাজকর্মী, রেডিও জকি, ওয়েব ও অ্যাপ ডেভেলপার, সম্পাদক, উপস্থাপক, রক্তদাতা, এবং নাট্য পরিচালক। মাইক্রোসফটে ডেভেলপার হিসেবে কর্মরত এবং গল্প বলা আমার প্রধান পরিচয়।

মি. বিকেল

আমি মোঃ মেহেদি হাসান, কলম নাম মি. বিকেল।

মি. বিকেল › বিস্তারিত পোস্টঃ

কেন ইরানকে হালকাভাবে নেওয়া ছিল ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় ভুল?

১৮ ই জুন, ২০২৫ রাত ১:০২



ইসরায়েল ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার মত করে একটু বেশিই হালকা ভাবে নিয়েছে মুসলিম বিশ্বের শক্তিশালী দেশ ইরানকে। ইরানকে আক্রমণ করতে হলে ইরানের ৩টি শক্তিশালী প্রক্সি কে আগে মোকাবিলা করতে হবে যথাক্রমে হামাস, হুতি ও হিজবুল্লাহ। এছাড়াও ইরানের আছে ভৌগোলিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাটেজিক অবস্থান। এখন পর্যন্ত ইসরায়েল হামাস কে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করতে পারে নাই। অন্যদিকে হিজবুল্লাহ কিছুটা কমজোর হলেও সাম্প্রতিক সময়ে হুতি গোষ্ঠী তাদের শক্তি আরো বাড়িয়েছে। এই তিনটে প্রক্সি ইরান কতৃক ব্যাপক সমর্থন ও শক্তিশালী হতিয়ার পর্যন্ত পেয়ে থাকে।

ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এখানে অনেক জটিল সুতরাং অতি-সরলীকরণ একটি ন্যারেটিভের দিকে আমি এগিয়ে যাবো। কিছুদিন আগেই সিরিয়াতে সরকার পরিবর্তন বা সোজা বাংলায় পুতুল সরকারের নিয়োগ দিয়ে এখানের শিয়া শাসকদের বিদায় দিয়েছে ইসরায়েল ও তাদের বড় ভাই যুক্তরাষ্ট্র। আমরা কমবেশি সবাই জানি যে, ভবিষ্যতে মুসলিম বিশ্বের হর্তাকর্তা হওয়া নিয়ে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বে মুসলিমরা বিভক্ত। মানে সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলের ইরানে হামলায় সৌদি আরবের ভূমিকা সেটাই পুনরায় প্রমাণ করলো।

শুধুমাত্র একজন মুসলিম হিসেবে নয়, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে ইরান কে যতটুকু পর্যবেক্ষণ করেছি তাতে মনে হয়েছে সুন্নি দেশগুলোর চেয়ে অন্তত ১০ গুণ বুকের পাটা নিয়ে শক্রুর সাথে মোকাবিলায় রীতিমতো এ পর্যন্ত টক্করে টক্কর দিচ্ছে শিয়া অধ্যুষিত দেশ ইরান; তাও শূন্য পারমাণবিক শক্তি নিয়ে। ইরানকে ঘিরে মধ্যপ্রাচ্যের ১১টি দেশে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, যেখানে প্রায় ৭০,০০০ সেনা মোতায়েন করা হয়েছে সাম্প্রতিক উত্তেজনার প্রেক্ষিতে (জুন ২০২৫)। অবশ্য ইরানের এই পারমাণবিক শক্তি বা বোমা তৈরিতে বাধা দিতেই ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে।

ইসরায়েলের স্টকপাইল পত্রিকার হিসাবে, দেশটির হাতে আনুমানিক ৮০ থেকে ৪০০টি পারমাণবিক বিস্ফোরকমুখ (ওয়ারহেড) রয়েছে। তবে ইরানের কিন্তু একটিও থাকা যাবে না। এমনটাই আজীবন মনে করে এসেছেন মাননীয় বড় ভাই যুক্তরাষ্ট্র। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হবার পর যুক্তরাষ্ট্র মনে করেছিলো, ট্রাফিক সিগন্যাল রেড হলেও আমি আমার ইচ্ছামতো রাস্তা পার হবো এবং এতে আমাকে বাধা দেবার কেউ নাই। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব মাত্র একটি বা দুটি শক্তির উপর নির্ভরশীল নয়। এখানে নতুন নতুন খেলোয়াড়দের সংখ্যা বাড়ছে। চীন, ভারত ও পাকিস্তান কেও গুণতে হচ্ছে বিশ্ব মোড়লদের। একমাত্র কারণ হলো, পারমানবিক শক্তির উপস্থিতির ভয় সহ বানিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার আকাঙ্খা।

দূর্ভাগ্যবশত পাকিস্তান পারমানবিক শক্তি অর্জন করলেও ইরান সেটা করতে পারে নাই বা করতে দেয়া হয় নাই। মুসলিম বিশ্বের একমাত্র পারমাণবিক শক্তি সম্পূর্ণ দেশ হলো কিন্তু এই পাকিস্তান। আবার ইরান ও ইসরায়েল একে অপরের এতবড় শক্র মোটেই ছিলো না। আপনি জেনে অবাক হবেন, এই দুই দেশ একসময় বন্ধু ছিলো।

১৯৪৮ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ইরান ও ইসরায়েল বন্ধু দেশ ছিলো। সে সময়ে ইরানের শাসক ছিলেন শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি। আরব শক্রুদের মোকাবিলা করতে যুক্তরাষ্ট্রের মত করে ইরানও অস্ত্র-শস্ত্র পাঠাতো ইসরায়েলে। বিনিময়ে ইসরায়েল ইরানকে কৃষি ও প্রযুক্তি খাতে সাহায্য করতো। এমনকি ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ১৯৫৭ সালে ইরানের গোয়েন্দা সংস্থা ‘সাভাক’ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। মানে সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের গোয়েন্দা সংস্থার যে ব্যর্থতা তার সাথে কিছুটা হলেও মিল পাওয়া যায় এন্ড্রয়েড স্মার্টফোনে পেগাসাস ভাইরাসের উপস্থিতির মত।

এখন তারগুলো যুক্ত করতে হবে:
১. ইরানের ৩টি প্রক্সি (হামাস, হুতি ও হিজবুল্লাহ)
২. ইরানকে পারমানবিক শক্তি অর্জনে বাধা প্রদান ও পাকিস্তানের হাতে পারমাণবিক শক্তি
৩. ভৌগোলিক ভাবে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান
৪. ইরানের গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা
৫. ইরান শিয়া অধ্যুষিত অঞ্চল বা দেশ ও ধর্মীয় বিবাদ
৬. বিশ্বে ইউনি পোলার বা একাধিক শক্তির উপস্থিতি
৭. সিরিয়ায় ক্ষমতা পাল্টানো বা, পুতুল শাসক
৮. অঞ্চলভিত্তিক দাদা গিরি
৯. ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় গণহত্যা এবং ১০. বন্ধু যখন শক্রু

দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরায়েল। অঞ্চলভিত্তিক আধিপত্য দেখাতে ও ধর্মীয় কারণে হামাস, হুতি ও হিজবুল্লাহ রেজিস্ট্যান্ট ফ্রন্ট হিসেবে সামনে দেখা যায়। এতে করে এই ৩টি মিলিট্যান্ট গ্রুপ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়। তাদের বড় বড় নেতাকে টার্গেট কিলিং করে ইসরায়েল। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে ইসরায়েল সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে হামলা চালিয়ে কুদস ফোর্সের কমান্ডারসহ ৭ কর্মকর্তাকে হত্যা করে। ইরান পাল্টা ৩০০+ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হামলা করে। খুব সম্ভবত প্রথমবারের মত আমরা দেখতে পাইছিলাম ইসরায়েলের শক্তিশালী অভেদ্য আইরন ডোম ভেদ করতে।

যদিও ইসরাইল এবং ইরানের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ ২০২৪ সালে শুরু হয়েছিল, কিন্তু ২০২৫ সালের জুন মাসে হঠাৎ ইসরায়েল ইরানকে আক্রমণ করে। নিউইয়র্ক টাইমসের লাইভ আপডেট অনুসারে, ইসরাইল তেহরানে রাতারাতি বিমান হামলা চালিয়েছে, যার লক্ষ্য ছিল প্রধান গ্যাস ডিপো, তেল শোধনাগার, এবং নিউক্লিয়ার সংক্রান্ত স্থাপনা। ইসরাইল প্রায় ১৫০ টি হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে দক্ষিণ পার্স গ্যাস ফিল্ড এবং নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের স্থাপনা লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল। ইরানের প্রত্যাঘাত ছিল তীব্র, যেখানে তারা ইসরাইলে প্রায় ২০০ টি মিসাইল এবং বহু সংখ্যক ড্রোন চালিয়েছে, যা গত শুক্রবার রাত থেকে শুরু হয়েছে।

পাল্টাপাল্টি এই হামলায় একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের সূচনা হয়ে গেছে; নিঃসন্দেহে। সর্বশেষ (যখন লিখছি) পাওয়া তথ্য মতে, এই পর্যন্ত ইরানে প্রায় ৭০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে আছে শীর্ষ সুরক্ষা কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানী পর্যন্ত। আহতদের সংখ্যা অজানা। অন্যদিকে ইসরায়েলে এই পর্যন্ত নিহত হয়েছে ১৩ জন এবং আহত হয়েছে ৪০০+ জন। বড় বড় প্রোফাইলের মানুষদের টার্গেট কিলিং করেছে ইসরায়েল। আর এখানেই ইরানের গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা নজরে পড়ে। কিছুটা পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করার মত ছিলো বিষয়টি। কারণ ১৫ জুন ওমানে মার্কিন-ইরানি নিউক্লিয়ার বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা ছিলো। মানে নিউক্লিয়ার শক্তি নিয়ে সমঝোতা হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু তার আগেই ইরানের উপর হামলা চালায় ইসরায়েল।

এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দখলদার ইসরায়েল থেকে মুক্তির জন্য ইরানের পারমাণবিক শক্তির দরকার। আমরা যদি উত্তর কোরিয়ার দিকে দেখি তাহলে খুঁজে পাই, পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পর উত্তির কোরিয়া কে কেউ আক্রমণ করে নাই। আবার এই উত্তর কোরিয়া কিন্তু ইরানকে সাহায্য করেছে পারমাণবিক শক্তি অর্জনে। একাধিক সূত্র মতে ইরান ইতোমধ্যেই ৬০%+ ইউরেনিয়াম ইনরিচমেন্ট করতে পেরেছে। নিউক্লিয়ার শক্তি অর্জনে ৯০% পর্যন্ত পিউরিটি প্রয়োজন। সোজা বাংলায়, যে স্কেলে ইরান পারমানবিক শক্তির বিকাশ ঘটাইছে তাও একাধিক ‘স্যাংশন (Sanctions)’ খেয়ে সেখান থেকে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই একটি নিউক্লিয়ার বোমা এবং এক মাসে অন্তত ৭টি নিউক্লিয়ার বোমা তৈরি করতে সক্ষম।

রিপোর্ট অনুযায়ী, এতদিনে ইরানের কাছে পারমানবিক বোমা উপস্থিতি থাকার কথা। আর তার প্রথম পারমাণবিক বোমা ইসরায়েলে গিয়ে হামলা করতে পারে। অন্যদিকে পাকিস্তান তার পারমাণবিক শক্তি দিয়ে ইরানকে সাহায্য করার কথা আলোচনায় এসেছে। বিশাল ঋণে হাবুডুবু খাওয়া এই সুন্নি দেশ অদৌ কতটুকু মাঠে সাহায্য করতে পারবে সেটা হয়তো সময় বলে দেবে। তবে কোথাও না কোথাও আমরা শিয়া-সুন্নি বিবাদের বিষয়টি এখানে একধরণের মীমাংসার দিকে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। অন্যান্য সুন্নি দেশের অন্তত মৌখিকভাবে অবস্থান ইরানের প্রতি। বিবৃতিতেও ইরান কে সমর্থন। তবে কি শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব বা ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি থেকে বেড়িয়ে আসা কি অদৌ সম্ভব? এত সহজ বোধহয় নয়। কারণ এই বিবাদে বহু মানুষের প্রাণ গেছে, তবে এই যুদ্ধের মধ্যেও এক ধরণের ‘আলো’ দেখা যায়।

ইরানের ভৌগোলিক শক্তি: নিছক মানচিত্র নয়, এক প্রাকৃতিক দুর্গ
ইরানকে বুঝতে হলে শুধু তার সামরিক বা পারমাণবিক শক্তি দেখলে চলবে না; তাকাতে হবে তার মানচিত্রের দিকে। ইরানের ভৌগোলিক অবস্থান নিছক একটি ঠিকানা নয়, এটি তার সবচেয়ে বড় কৌশলগত অস্ত্র। দেশটি যেন এশিয়া মহাদেশের হৃৎপিণ্ড—মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া আর দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রহরী। এই অবস্থানই তাকে পূর্ব-পশ্চিমে (চীন থেকে ভূমধ্যসাগর) এবং উত্তর-দক্ষিণে (রাশিয়া থেকে পারস্য উপসাগর) এক অপ্রতিরোধ্য প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা দিয়েছে। এই সুবিধার কারণেই ইরান তার ‘প্রতিরোধ অক্ষ' (Axis of Resistance)’ বা রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্টকে এত সহজে কার্যকর করতে পারে, যেখানে প্রতিবেশীদের ভূমি ব্যবহার করে শত্রুকে ক্রমাগত ব্যস্ত রাখা যায়।

এর সাথে যুক্ত হয়েছে হরমুজ প্রণালী—বিশ্ব অর্থনীতির শ্বাসরোধ করার চাবিকাঠি। বিশ্বের মোট তেলের প্রায় ৩০ শতাংশই এই সরু জলপথ দিয়ে যায়। ইরান যদি এই প্রণালী বন্ধ করে দেয়, তবে গোটা বিশ্বের অর্থনীতিতে যে সুনামি আসবে, তা সামাল দেওয়া প্রায় অসম্ভব। এই ক্ষমতাই তাকে আলোচনার টেবিলে এক বাড়তি দর কষাকষির সুযোগ দেয়। দেশটির হাতে থাকা বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম তেল এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ যেন এই আগুনের জ্বালানি। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এই অর্থ দিয়েই হিজবুল্লাহ, হামাস বা হুতিদের মতো গোষ্ঠীগুলোকে পুনরায় সংগঠিত করা হয়।

ইসরায়েলের জন্য ইরানের ভূগোল এক জীবন্ত দুঃস্বপ্ন। যদিও দুই দেশের মধ্যে সরাসরি কোনো সীমান্ত নেই, ইরান তার প্রতিবেশীদের ব্যবহার করে ইসরায়েলকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার এক দারুণ কৌশল সাজিয়েছে। পশ্চিমে ইরাক ও সিরিয়ার করিডোর ব্যবহার করে লেবাননের হিজবুল্লাহর কাছে অস্ত্র পৌঁছে দেওয়া হয়, যা ইসরায়েলের উত্তর সীমান্তে প্রতিনিয়ত কাঁটার মতো বিঁধছে। দক্ষিণে গাজায় হামাসকে সমর্থন দিয়ে তৈরি করা হয়েছে আরেক ফ্রন্ট।

সবচেয়ে বড় কথা, ইরানের প্রায় ১৬.৫ লক্ষ বর্গকিলোমিটারের বিশাল ভূখণ্ড এবং এর পার্বত্য প্রকৃতি একে এক দুর্ভেদ্য প্রাকৃতিক দুর্গে পরিণত করেছে। বাইরে থেকে সরাসরি আক্রমণ করে এই দেশকে দখল করা প্রায় অসম্ভব। এর সাথে যখন ১,০০০ থেকে ২,০০০ কিলোমিটার পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি যুক্ত হয়, তখন ভৌগোলিক দূরত্বটাই মুছে যায়। এই ক্ষেপণাস্ত্র আর ড্রোনগুলোই ইরানের অদৃশ্য অস্ত্র, যা দিয়ে ইসরায়েলের যেকোনো প্রান্তে আঘাত হানা সম্ভব।

সমর্থনের জাল: ইরানের পেছনে কারা?
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে ইরান একা নয়; তার পেছনে রয়েছে এক বহুস্তরীয় সুরক্ষা বলয়। এই সমর্থনের প্রথম এবং সবচেয়ে শক্তিশালী স্তরটি হলো রাশিয়া ও চীন। সোভিয়েত পতনের পর থেকে চলা আমেরিকার একচ্ছত্র দাদাগিরির বিরুদ্ধে এই দুই দেশ ইরানের পাশে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া সরাসরি ইসরায়েলি হামলাকে ‘আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি’ বলে জাতিসংঘে ইরানের পক্ষে ভেটো দেওয়ার হুমকি দেয়। অন্যদিকে, চীন ইরানের ‘শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির অধিকার’-কে সমর্থন করে এবং ইসরায়েলকে ‘আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারী’ হিসেবে দেখে। চীনের সাথে ইরানের ৪০০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য চুক্তি এবং রাশিয়ার ড্রোন প্রযুক্তিতে সহায়তা—এই দুটিই প্রমাণ করে যে, তাদের সমর্থন কেবল কথার কথা নয়।

মুসলিম বিশ্বের চিত্রটি আরও জটিল। পাকিস্তান, ইরাক ও ওমানের মতো দেশগুলো ইরানের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’-কে সরাসরি সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু সৌদি আরব বা তুরস্কের মতো সুন্নি শক্তিগুলোর অবস্থান কিছুটা ভিন্ন। তারা ইসরায়েলি হামলার নিন্দা করলেও ইরানের সাথে তাদের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের কারণে সমর্থনটি কেবলই কূটনৈতিক এবং সীমিত।

তবে ইরানের সবচেয়ে কার্যকর সমর্থক হলো তার সশস্ত্র মিত্র গোষ্ঠীগুলো, যারা মাঠের আসল খেলোয়াড়:
১. হিজবুল্লাহ: লেবাননে ইসরায়েলের উত্তর সীমান্তে দেড় লক্ষেরও বেশি রকেট তাক করে বসে আছে।
২. হুতিরা: ইয়েমেন থেকে লোহিত সাগরে ইসরায়েলি জাহাজে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে।
৩. হামাস ও প্যালেস্টাইনিয়ান ইসলামিক জিহাদ: গাজা থেকে গেরিলা হামলা চালিয়ে ইসরায়েলকে সার্বক্ষণিক চাপে রাখছে।

এই প্রক্সি দলগুলোর মাধ্যমে ইরান সরাসরি যুদ্ধে না জড়িয়েও ইসরায়েলকে ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত করে চলেছে।

নিষেধাজ্ঞার শেকল ভেঙে যেভাবে ‘দানব’ হলো ইরানের সামরিক শক্তি
১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ইরানকে পঙ্গু করার বদলে এক স্বনির্ভর সামরিক দানবে পরিণত করেছে। ইরান-ইরাক যুদ্ধ (১৯৮০-৮৮) ছিল দেশটির জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা, যা তাকে শিখিয়েছে প্রয়োজনে কীভাবে শত্রুর অস্ত্র কপি করে নিজের অস্ত্র বানাতে হয়। রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং বা উল্টো প্রকৌশলের মাধ্যমে সোভিয়েত স্কাড ক্ষেপণাস্ত্র থেকে শুরু করে আজকের ফাত্তাহ হাইপারসনিক মিসাইল—সবই এই নীতির ফসল। আজ ইরান তার সামরিক সরঞ্জামের ৮৫ শতাংশই নিজে তৈরি করে।

একনজরে ইরানের সামরিক শক্তি:
১. মানবসম্পদ: নিয়মিত ও বিপ্লবী গার্ড কর্পস (IRGC) মিলিয়ে প্রায় ১২ লক্ষ সক্রিয় সৈন্য এবং সাড়ে তিন লক্ষ রিজার্ভ সৈন্যর এক বিশাল বাহিনী।
২. স্থল শক্তি: প্রায় ২,০০০ ট্যাঙ্ক এবং ৬৫,০০০-এর বেশি সাঁজোয়া যান।
৩. আকাশের ঘাতক (ড্রোন ও বিমান): ১৮৬টি যুদ্ধবিমান থাকলেও ইরানের আসল শক্তি তার ড্রোন বাহিনী। শাহেদ-১৩৬ এর মতো ২,৫০০ কিমি পাল্লার ড্রোনগুলো শত্রুর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বোকা বানিয়ে আঘাত হানতে সক্ষম।
৪. ক্ষেপণাস্ত্রের ভাণ্ডার: ৩,০০০-এর বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের এক বিশাল সংগ্রহ রয়েছে ইরানের, যার মধ্যে ফাত্তাহ-১ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রটি ইসরায়েলের আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য এক দুঃস্বপ্ন।
৫. পারমাণবিক সক্ষমতা: আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক বোমা না থাকলেও, ৬০% বিশুদ্ধতায় সমৃদ্ধ করা প্রায় ৪০৯ কেজি ইউরেনিয়াম ইরানের হাতে রয়েছে। এই মজুদ দিয়ে মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই প্রায় ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করা সম্ভব।

ইসরায়েলি হামলা প্রতিরোধ: সাফল্য, ব্যর্থতা ও বাস্তবতা
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলায় ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা একটি মিশ্র চিত্র দেখিয়েছে। তেহরানের দিকে ছুটে আসা ৮০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র এবং ৭টি ড্রোন ভূপাতিত করার দাবি করেছে ইরান। এমনকি ইসরায়েলের ৩টি এফ-৩৫ স্টেলথ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে পাইলটদের আটক করার মতো অসমর্থিত দাবিও করা হয়েছে। ইরানের খোর্দাদ ও বাভর-৩৭৩-এর মতো বিমান-বিধ্বংসী ব্যবস্থাগুলো কিছু সাধারণ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে পারলেও, ইসরায়েলের স্যাচুরেশন অ্যাটাক (একসাথে শতাধিক অস্ত্র দিয়ে হামলা) এবং উচ্চগতির ক্ষেপণাস্ত্রের সামনে ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অনেকটাই ভেঙে পড়ে।

তেহরানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, শারান তেল ডিপো এবং পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রে সরাসরি আঘাত হানা ক্ষেপণাস্ত্রগুলো প্রতিহত করা যায়নি। এর ফলে, ইরানের ৯ জন পরমাণু বিজ্ঞানীসহ বহু শীর্ষ কর্মকর্তা নিহত হন। এই ব্যর্থতার পেছনে প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি গোয়েন্দা তথ্যের অভাবকেও দায়ী করা হচ্ছে। ইরান হয়তো ২০-৩০% হামলা প্রতিহত করতে পেরেছে, কিন্তু কৌশলগত স্থাপনা ও বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি রোধ করতে পারেনি।

নেতৃত্বের রহস্য: কেন থামছে না ইরান?
ইসরায়েলি হামলায় জেনারেল হোসেইন সালামির মতো শীর্ষ সামরিক নেতা এবং মোহাম্মদ মেহেদি তেহরানচির মতো পরমাণু বিজ্ঞানীরা নিহত হয়েছেন। এত বড় ক্ষতি সত্ত্বেও ইরানের কার্যক্রম থেমে নেই। এর কারণ হলো, ইরানে নেতৃত্ব কোনো ব্যক্তিনির্ভর নয়; এটি একটি প্রতিষ্ঠান ও আদর্শ-নির্ভর ব্যবস্থা। বিপ্লবী গার্ড কর্পস (IRGC) এবং রাষ্ট্রের কাঠামো এমনভাবে তৈরি যে, একজন নেতা নিহত হলে তার জায়গা নেওয়ার জন্য আগে থেকেই একাধিক বিকল্প প্রস্তুত থাকে। অনেক সময় বিজ্ঞানীরা ছদ্মনাম ব্যবহার করেন এবং তাদের পরিচয় গোপন রাখা হয়।

ফিনিক্স পাখির মতো ইরান বারবার ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে উঠেছে। প্রতিটি আঘাত তাকে আরও শক্তিশালী এবং স্বনির্ভর হতে শিখিয়েছে। তাই শীর্ষ নেতাদের হত্যা করে ইরানকে থামিয়ে দেওয়া যাবে—এই ধারণাটি একটি কৌশলগত ভুল।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৮ ই জুন, ২০২৫ রাত ১:৩১

জ্যাক স্মিথ বলেছেন: জ্বী বুঝলাম, ভয়ঙ্কর এক সিংহের কবেলে পরেছে ইসরায়েল, ইসরায়েলের অবস্থা এখন ছেড়ে মা কেঁদে বাচি অবস্থা।

ইরান আক্রমণ করে ইসরায়েল কঠিন এক বিপদে পড়েছে। এখন কথা হলো ইসরায়াল কবে আত্নসমর্পন করতে যাচ্ছে?

বিশ্বের মানচিত্রে কি তাহলে এখন ইসরায়েলের অস্তিত্ব থাকবে?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.