নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি মেহেদি হাসান, মি. বিকেল নামে পরিচিত। আমি একজন লেখক, অভিনেতা, সমাজকর্মী, রেডিও জকি, ওয়েব ও অ্যাপ ডেভেলপার, সম্পাদক, উপস্থাপক, রক্তদাতা, এবং নাট্য পরিচালক। মাইক্রোসফটে ডেভেলপার হিসেবে কর্মরত এবং গল্প বলা আমার প্রধান পরিচয়।

মি. বিকেল

আমি মোঃ মেহেদি হাসান, কলম নাম মি. বিকেল।

মি. বিকেল › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইরান কি আরব বিশ্বের ঐক্যের নতুন দিশা?

২৫ শে জুন, ২০২৫ রাত ১১:১৯



সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাপ্রবাহে ইরান এক নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার পর যখন মনে হচ্ছিল এক ভয়াবহ যুদ্ধ আসন্ন, তখনই ইরান তার সামরিক শক্তি এবং ভূ-রাজনৈতিক দৃঢ়তা প্রদর্শন করে বিশ্বকে চমকে দিয়েছে। এই ঘটনাপ্রবাহে ইরান দেখিয়ে দিয়েছে যে, তার ক্ষেপণাস্ত্রের সামনে ইসরায়েলের আয়রন ডোম বা ট্রাম্পের হুমকি কোনোটিই কার্যকর নয়।

অনেকেই অবাক হয়ে ভাবছেন, কীভাবে এমনটা সম্ভব হলো? আমেরিকা তো সুপার-পাওয়ার, আর ইসরায়েলকে হারানো তো প্রায় অসম্ভব! কিন্তু ভূ-রাজনীতিতে কেবল সৈন্য, ট্যাংক আর বিমান গুনে শক্তি মাপা যায় না। হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার হুমকির পর কাতার, সৌদি আরব এমনকি ট্রাম্পও বুঝতে পেরেছেন যে, ইরানকে হালকাভাবে নেওয়াটা কতটা বোকামি ছিল।

মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের বাড়তি প্রভাব
যদি এই সংঘাত এখানেই থেমে যায়, তবে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব আরও বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশ্বে এমন আর কোনো দেশ নেই, যা এত সাহস নিয়ে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে পারে, তাও কোনো পরিণতির পরোয়া না করে। ইরানের এই সাহসিকতার পুরস্কার তারা অবশ্যই পাবে এবং অন্যান্য দেশও এখন ইরানের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে চাইবে। ইরান নিজেও এমনটিই চেয়েছিল।

প্রতিটি জাতি তার ইতিহাস নিজেই তৈরি করে, কিন্তু সেই ইতিহাস সর্বদা তার ইচ্ছামতো হয় না। যাদের যুদ্ধ করার সাহস ও ক্ষমতা বেশি, তাদের ইতিহাস ততটাই রোমাঞ্চকর হয়। আর যুদ্ধ ও সংঘাতের কথা উঠলে আরব বিশ্বের প্রসঙ্গ আসাটা স্বাভাবিক।

আরব সুপারস্টেটের স্বপ্ন
আফ্রিকা, এশিয়া এবং ইউরোপের সংযোগস্থলে অবস্থিত এই অঞ্চলটি সব সময়ই যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এখানকার ভূগোলের দিকে বিশ্বের সমস্ত ক্ষমতাধর দেশগুলোর নজর ছিল। আর যখন থেকে এখানে তেল ও গ্যাসের খনিজ সম্পদ আবিষ্কৃত হয়েছে, তখন থেকে তো বিশ্বের আগ্রহ আরও বেড়ে গেছে। বিংশ শতাব্দীতে আরবের মানুষ চেষ্টা করেছিল বিদেশি শাসন থেকে নিজেদের মুক্ত করে একটি একক জাতি রাষ্ট্র গঠন করতে – অর্থাৎ, সমস্ত আরব দেশকে নিয়ে একটি ‘আরব সুপারস্টেট’।

অনেকেই এই ধারণাটিকে পছন্দ করেছিলেন এবং স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন একটি দেশের, যা মরক্কোর সমুদ্র থেকে শুরু হয়ে মিশর হয়ে নীলনদ ধরে সৌদি আরবের সোনালী মরুভূমি পেরিয়ে ইরাকের উর্বর ভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। আজকের হিসাব অনুযায়ী, এই আরব সুপারস্টেটের জনসংখ্যা প্রায় ৪৪ কোটি হতো এবং এর জিডিপি প্রায় ৩.৬ ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি হতো, যা বিশ্বের ষষ্ঠ শক্তিশালী অর্থনীতি হিসেবে গণ্য হতো।

বিংশ শতাব্দীতে যখন আরব সুপারস্টেট গঠনের কথা শুরু হয়েছিল, তখন সবার ধারণা ছিল যে, তাদের সংস্কৃতি কমবেশি একই রকম, ভাষা একই রকম এবং বেশিরভাগ মানুষই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এই ভিত্তির উপর নির্ভর করে আরবের মানুষ সুপারস্টেট গঠনের পথে এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। উল্টো আজ দেখা যায়, আরব বিশ্ব আগের চেয়েও বেশি বিভক্ত। ২২টি আলাদা আলাদা দেশ তৈরি হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, ঠিক কোথায় ভুল হয়েছিল? কেন আজও আরব সুপারস্টেট গঠিত হতে পারেনি?

বিভক্তির কারণ: ইতিহাস ও ভূগোল
প্রথম দেখায় আরব বিশ্বকে অনেকগুলো দেশে বিভক্ত দেখা যায় - আঁকাবাঁকা সীমান্ত, কোথাও মরুভূমি তো কোথাও পাহাড়, কোথাও শিয়া তো কোথাও সুন্নি, কোথাও কুর্দি তো কোথাও ওয়াহাবি। পুরো আরব বিশ্ব যেন টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে আছে। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ এবং রোমাঞ্চকর ইতিহাস। এই অঞ্চলে যত রক্তপাত হয়েছে, সম্ভবত বিশ্বের অন্য কোথাও ততটা হয়নি।

ইসলামের শুরুর দিকে যখন সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু হয়, সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে উমাইয়া খেলাফত একটি বিশাল অঞ্চলের উপর রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে, যা পর্তুগাল থেকে আজকের পাকিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তারা দ্রুত বাইজেন্টাইন (রোমান) শাসনের অনেক অংশও দখল করে নেয়, যার ফলে ইহুদি ও খ্রিস্টান জনসংখ্যাও এই খেলাফতের অংশ হয়ে যায়।

পরবর্তীতে আব্বাসীয় খেলাফত যখন উমাইয়াদের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করে, তখন তারা সহনশীলতার নীতি বজায় রাখে। সেই সময় ইসলামী আইন অনুযায়ী অমুসলিমদের কাছ থেকে ‘জাজিয়া’ নামক একটি বিশেষ কর নেওয়া হতো এবং এর বিনিময়ে তাদের সুরক্ষা ও কিছু অন্যান্য সুবিধা দেওয়া হতো। এই ব্যবস্থায় মানুষ তাদের ধর্ম, প্রথা, রীতিনীতি অনেকটাই স্বাধীনভাবে পালন করতে পারত।

উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগ মিলে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করেছিল, যেখানে জ্ঞান, সভ্যতা ও চিন্তাভাবনার অনেক উন্নতি হয়েছিল। বাগদাদ, দামেস্ক ও কায়রোর মতো শহরগুলো সেই সময়ের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল, যেখানে দর্শন, ধর্মীয় চিন্তা, সভ্যতা, বিজ্ঞান ও আইন-কানুনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের উন্নতি হয়েছিল। এই সময়টিকেই আজও ‘ইসলামের স্বর্ণযুগ’ হিসেবে স্মরণ করা হয়।

সেই সময়ে যখন ইসলামী সভ্যতা তার শীর্ষে ছিল, তখন গ্রিক থেকে অনেককিছু আরবি ভাষায় অনুবাদ করে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে এই অনুবাদগুলো ইউরোপে পৌঁছায় এবং ইউরোপীয় রেনেসাঁ কে দারুণভাবে উৎসাহিত করে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যে, এই যুগটি যাকে আমরা আরবের স্বর্ণযুগ বলি, এটি একটি মিশ্র সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র তৈরি করেছিল, যা পরবর্তীকালের অনেক আঞ্চলিক নেতাকে বারবার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

সাম্রাজ্যবাদ ও নতুন আদর্শের উত্থান
অনেক শতাব্দী ধরে জাতীয় আকাঙ্ক্ষা দমন করা হয়েছিল। ১৬শ শতাব্দী থেকে অটোমান সাম্রাজ্য আরব ভূমিতে শাসন করেছিল এবং আরব সমাজ তুর্কি শাসনের অধীনে চলে আসে। এই তুর্কি শাসকদের আচরণ সময়ের সাথে সাথে আরব জনগণের সাথে পরিবর্তিত হয়েছে – কখনো অত্যাচারী হিসেবে আচরণ করেছে তো কখনো তাদের স্বাধীনতা দিয়েছে। ১৮শ শতাব্দীর শেষ নাগাদ অটোমান সাম্রাজ্যের ক্ষমতা দুর্বল হতে শুরু করে। আর তখনই ব্রিটিশ ও ফরাসি হস্তক্ষেপ আরব বিশ্বে বাড়তে থাকে। লেবানন, মেসোপটেমিয়া ও শামি অঞ্চলে খ্রিস্টান মিশনারি স্কুল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নতি হয়, যা ইউরোপীয় চিন্তা যেমন সেকুলারিজম ও জাতীয়তাবাদ আরব সমাজে প্রবেশ করতে শুরু করে।

এই সময়ে আরব মুসলিম সমাজেও পরিবর্তন আসছিল। অটোমান সাম্রাজ্যের দুর্বলতার কারণে মানুষের মনে এই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে যে, তাদের নিজস্ব পরিচয় কী এবং তারা কি একটি জাতিতে পরিণত হতে পারে? এই চিন্তা ধীরে ধীরে ইসলামী আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়, যেখানে মানুষ ইসলামী ভ্রাতৃত্বকে ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদী চিন্তার সাথে মেলানোর চেষ্টা করে। শীঘ্রই এই ধারণাগুলো লেভেন্ট এবং আরবের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। যখন বলকানের স্লাভ জাতিগুলো অটোমান সাম্রাজ্যকে সরিয়ে নিজেদের স্বাধীনতা অর্জন করে, তখন আরব সমাজে এই বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে, তারাও নিজেদের স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে।

এই আশায় আরব উপজাতিরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ ও ফরাসিদের সাথে মিলে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে। কিন্তু তাদের আশা ভেঙে যায় যখন প্যারিস ও লন্ডন মিলে আরব ভূমিগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। এর ফলে পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়, বিশেষ করে যখন ব্রিটেন ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতি স্থাপনে সাহায্য করা শুরু করে।

ব্যর্থ ঐক্যের প্রচেষ্টা
এমন পরিস্থিতিতে একটি নতুন চিন্তার প্রয়োজন ছিল, যা একদিকে আরবদের সকলকে একত্রিত করে রাখবে এবং অন্যদিকে আঞ্চলিক পরিচয়কেও স্থান দেবে, যাতে ইংরেজ ও ফরাসি শক্তির মোকাবেলা করা যায়। এই পরিস্থিতিতে আরব তাদের সোনালী অতীতকে স্মরণ করে এবং আরবদের একত্রিত করার কথা ভাবতে শুরু করে। তাদের স্বপ্ন ছিল একটি আরবের, যা মরক্কো থেকে ইরাক পর্যন্ত বিস্তৃত হবে এবং তার ভূগোল, মানবিক ক্ষমতা ও প্রাকৃতিক সম্পদকে একত্রিত করে একটি শক্তিশালী শক্তিতে পরিণত হবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ব্রিটিশ ও ফরাসি শক্তিগুলো পিছু হটে, তখন আরব বিশ্বের সামনে একটি খালি ক্যানভাস ছিল, যেখানে আরব ইউনিয়নের স্বপ্নকে সত্যি করা যেত। প্রথম পরিকল্পনা ছিল উর্বর ক্রিসেন্ট ইউনিয়ন, যেখানে ইরাক ও জর্ডানের পাশাপাশি সিরিয়া ও ফিলিস্তিনকেও অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। দেখতে এই পরিকল্পনাটি সঠিক মনে হয়েছিল, কারণ উর্বর ক্রিসেন্ট অর্থাৎ দজলা ও ফুরাত নদীর তীরবর্তী অঞ্চল শতাব্দী ধরে সংযুক্ত ভূমির একটি রূপ দিত। কিন্তু আসল বাধা ছিল রাজনৈতিক। ফিলিস্তিনে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার কারণে এই পুরো পরিকল্পনাটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

প্রায় এক দশক পর আরব ঐক্যের চিন্তাটি আবার পুনরুজ্জীবিত করেন জামাল আবদেল নাসের, যিনি ইউনাইটেড আরব রিপাবলিক গঠন করেন। ১৯৫৬ সালের সুয়েজ খাল সংকটে যখন মিশর ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েলকে পিছু হটতে বাধ্য করে, তখন পুরো আরব বিশ্ব মিশরের দিকে তাকায় এবং ঐক্যের চেষ্টা জোরদার হয়।

যেমন, সিরিয়ার বাথ পার্টি নিজেদের মিশরীয় শাসনের অধীনে নিয়ে আসে। উভয় দেশের জনগণের সম্মতিতে মিশর ও সিরিয়া ১৯৫৮ সালে একত্রিত হয়ে একটি দেশ গঠন করে। অল্প সময়ের মধ্যেই উত্তর ইয়েমেনের রাজতন্ত্রও এই শিবিরে যোগ দিতে পছন্দ করে, যাতে তারা মিশরের শক্তির ওপর ভর করে সৌদি আরবের প্রভাবকে মোকাবেলা করতে পারে।

বেশি দেরি হয়নি যখন এই জোট, যা পরবর্তীতে ইউনাইটেড আরব স্টেটস নামে পরিচিতি লাভ করে, একটি আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত হতে দেখা যায়। এর জবাবে ইরাক ও জর্ডান মিলে তাদের আলাদা জোট গঠন করে, যা আরব ফেডারেশন নামে পরিচিত ছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল হাশেমি রাজতন্ত্রগুলোকে নাসেরের চিন্তাভাবনা (নাসেরিজম) থেকে রক্ষা করা। কিন্তু মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই এই জোট ভেঙে যায়, যখন বাগদাদে নাসেরের সমর্থক সামরিক কর্মকর্তারা অভ্যুত্থান ঘটায়। এরপর ইরাক ও জর্ডান খোলাখুলি ভাবতে শুরু করে যে, তারা মিশর-নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড আরব স্টেটস-এর সাথে যোগ দিলে ভালো হবে।

কিন্তু আসলে এই দুটি শিবিরই, ইউনাইটেড আরব রিপাবলিক ও ইউনাইটেড আরব স্টেটস, ছিল পরিস্থিতির চাপে করা বিয়ে, যেখানে তাৎক্ষণিক সুবিধা দেখা হয়েছিল। যখন সিরিয়ার বাথ পার্টি তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর ভূমিকা নিয়ে অসন্তুষ্ট হয়, তখন তারা ১৯৬১ সালের অভ্যুত্থানে মিশর থেকে নিজেদের ক্ষমতা ফিরিয়ে নেয়। এর কিছুদিন পরেই উত্তর ইয়েমেনও একই পথ অনুসরণ করে এবং একটি দীর্ঘ গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এরপর একটি আরব সুপারস্টেট গঠনের চিন্তা ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে যায়, যতক্ষণ না ১৯৭০-এর দশকে মুয়াম্মার গাদ্দাফি আরব প্রজাতন্ত্রগুলোর একটি নতুন জোট গঠনের প্রস্তাব দেন।

এতে লিবিয়া, মিশর ও সিরিয়া অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই জোট ১৯৭২ সালে গঠিতও হয়, তবে কেবল নামমাত্র। লিবিয়ার গাদ্দাফি ও মিশরের প্রেসিডেন্ট সাদাতের মধ্যে গভীর মতবিরোধ ছিল, যার কারণে এটি পুরোপুরি একত্রিত হতে পারেনি। ১৯৭৩ সালে সিরিয়া ও মিশর লিবিয়াকে না জানিয়ে ইসরায়েল আক্রমণ করলে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক আরও খারাপ হয়ে যায়। তাই ১৯৭৭ সালে যখন এই জোট ভেঙে যায়, তখন কেউ অবাক হয়নি।

এই ব্যর্থতার পর আরেকটি প্রচেষ্টা আসে সাদ্দাম হোসেনের পক্ষ থেকে। সাদ্দাম হোসেনও পুরনো উর্বর ক্রিসেন্ট ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেন এবং চান যে বাথ পার্টির শাসনাধীন সিরিয়া ও ইরাককে মিশরের সাথে একত্রিত করে একটি নতুন আরব রিপাবলিক ইউনিয়ন গঠন করা হোক। সাদ্দামের উদ্দেশ্য ছিল জর্ডানকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখা এবং ফিলিস্তিনকে ইসরায়েল ও জর্ডানের বিরুদ্ধে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা। কিন্তু এবার সিরিয়া ও ইরাকের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব এই পরিকল্পনাটিকে আবারও ব্যর্থ করে দেয়।

অন্যদিকে, গাদ্দাফি আরেকটি চেষ্টা করেন। এবার তিউনিসিয়ার সাথে এটিকে ‘আরব ইসলামিক রিপাবলিক’ বলা হয়। গাদ্দাফির এই ছোট উদ্দেশ্য ছিল ধীরে ধীরে আরব দেশগুলোকে একত্রিত করার সূচনা করা। কিন্তু এই চুক্তি শুরু থেকেই অস্পষ্ট ও জটিল ছিল। এই বিভ্রান্তির কারণে তিউনিসিয়া দ্রুতই তাদের প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসতে শুরু করে এবং এইভাবে এই আরব ইসলামিক রিপাবলিক শুধু কাগজে-কলমেই থেকে যায়।

বিভক্তির মূল কারণ: ভূগোল, অর্থনীতি ও রাজনীতি
প্রায় ৫০ বছরের আরব ঐক্যের প্রচেষ্টার ফলাফল ছিল কেবল ব্যর্থতা। কিন্তু তা সত্ত্বেও, অতীত গৌরব ও সম্মানের অনুভূতি আজও আরব বিশ্বের মধ্যে একটি শক্তিশালী আবেগ হিসেবে টিকে আছে, যা বারবার প্রকাশ পায়। যখনই পুরো আরব অঞ্চলকে একত্রিত করার কথা হয় - অর্থাৎ যখন একটি একক জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনাকে বাস্তবতার সাথে সংঘর্ষ করতে হয়, তখন চিন্তা প্রায়শই দুর্বল হয়ে পড়ে। পুরো আরব অঞ্চলকে একটি পতাকার নিচে আনার আকাঙ্ক্ষার ব্যর্থতার অভিযোগ সংস্কৃতি বা কোনো নেতা বা ব্যক্তিত্বের উপর চাপানো সহজ। কিন্তু বাস্তবে, এটি মূলত ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার ফল।

আরব বিশ্বের একটি বড় অংশ মরুভূমি এবং খুব কম জমিই আছে যা চাষাবাদের যোগ্য। শুধুমাত্র উত্তর লিবিয়া, উর্বর ক্রিসেন্ট, বার্বার উপকূল এবং নীল নদ উপত্যকার মতো কয়েকটি জায়গা এই পরিস্থিতি থেকে ব্যতিক্রম। এগুলি ছাড়া, জনবসতিপূর্ণ শহর বা শহরতলীগুলো একে অপরের থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। তাদের মধ্যে দূরত্ব অনেক বেশি। এর অর্থ হলো, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সংযুক্ত হওয়া এবং একটি একক চিন্তায় একীভূত হওয়া খুব কঠিন।

ভূগোল যেন আরবের বন্ধু কখনো ছিলই না। এর উপরে রক্তক্ষয়ী ইতিহাসও এই অঞ্চলের অনেক ক্ষতি করেছে। ইউরোপীয়রা যখন আরব অঞ্চল দখল করে, তখন ভূমিগুলোকে এমন আঁকাবাঁকা অংশে বিভক্ত করে দেয় যে, একটি একক আরব পরিচয় তৈরি করাই কঠিন হয়ে পড়ে। তারা এখান থেকে তেল ও অন্যান্য সম্পদ আহরণ করে, কিন্তু স্থানীয় আরব জনগণ এর খুব কমই সুবিধা পেয়েছে। আজও আরব দেশগুলোর মধ্যে নিজেদের মধ্যে ব্যবসা কম হয় এবং বাইরের বিশ্বের সাথে তাদের ব্যবসা বেশি হয়।

এছাড়াও, রাজনৈতিক ক্ষমতা ও সম্পদের বণ্টনও সমান নয়। কিছু দেশ ধনী, কিছু খুব দরিদ্র। কারো কারো সেনাবাহিনী আছে তো কারো কারো কেবল ঋণ। এই বৈষম্যের কারণে আরব অঞ্চল একটি শক্তিশালী ঐক্যের রূপ নিতে পারেনি। এর ফলস্বরূপ, প্রতিটি দেশ নিজেদের সুবিধার জন্য আলাদা আলাদা পথে চলতে শুরু করে এবং বাইরের শক্তিগুলোর কাছ থেকে সাহায্য নেওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। স্নায়ুযুদ্ধ এই পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তোলে।

১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর মিশর আমেরিকার তত্ত্বাবধানে ইসরায়েলের সাথে আলাদাভাবে শান্তিচুক্তি করে। এর ফলে মিশরের ঝোঁক ওয়াশিংটনের দিকে আরও বেড়ে যায়। এতে পুরো আরব ঐক্যে ধাক্কা লাগে এবং একত্রিত হওয়ার স্বপ্ন অনেক দূরে চলে যায়।

ইরানের উত্থান এবং নতুন সম্ভাবনা
যখনই আরবকে একত্রিত করার চিন্তা দুর্বল হয়েছে, তার শূন্যস্থান পূরণ করতে এসেছে রাজনৈতিক ইসলাম। এবং যেহেতু আরব ঐক্যের মূলে ইসলাম রয়েছে, তাই সবাই নিজেকে সবচেয়ে বড় ইসলামী প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে এবং অন্যের উপর কর্তৃত্ব করতে চেয়েছে। ধর্মের উপর জোর বাড়ার সাথে সাথে সাম্প্রদায়িকতাও বাড়তে থাকে।

তবে ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব হয়। এর ফলে পুরো অঞ্চলের রাজনীতি বদলে যায়। ইরান নিজেদের সাথে হিজবুল্লাহর মতো দলগুলোকে যুক্ত করে, যারা ইসরায়েলের বিরোধিতা করত এবং লেবাননের জনগণের সমর্থনও পেতে শুরু করেছিল। এর কয়েক বছর পর, ২০০৩ সালে যখন আমেরিকা সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করে, তখন ইরানের ক্ষমতা আরও বেড়ে যায় এবং ইরান ইরাকের নতুন শিয়া সরকারের উপর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পায়।

তবে সৌদি আরবও পিছিয়ে ছিল না। ১৯৮০-এর দশক থেকে সৌদি আরব পুরো মুসলিম অঞ্চলে সালাফি ও ওয়াহাবি মাদ্রাসা ও প্রতিষ্ঠান ছড়িয়ে দিতে শুরু করে, কারণ তাদের কাছে তেলের অর্থের প্রাচুর্য ছিল। তাই পরের ৩০ বছরে তারা ৭৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি খরচ করে। এটিকে সম্ভবত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় প্রচার বলা যেতে পারে।

এর প্রভাবও ছিল। আলজেরিয়া থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত সুন্নি চিন্তাভাবনা ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এর ফলে অনেক জায়গায় নিজেদের মধ্যে এবং অন্যান্য দেশের সাথে বিরোধও দেখা দেয়, যার ফলে মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় এবং আরব দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক উত্তেজনা বেড়ে যায়।

বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ
এতকিছুর পরও একত্রিত আরব বিশ্বের স্বপ্ন আজও বেঁচে আছে। এটি এমন একটি স্বপ্ন, যা আরব সংস্কৃতির চিন্তায় বারবার ফিরে আসছিল, কিন্তু বাস্তবে এখনও পূরণ হয়নি। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো দেখে মনে হচ্ছে, ইরান এখন আরব ঐক্যের পতাকা হাতে নিয়েছে। কিন্তু আরব সুপারস্টেট গঠনের লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথ সহজ নয়।

এখন পর্যন্ত যতগুলো চেষ্টা হয়েছে, তা ব্যর্থ হলেও আরব সুপারস্টেটের ধারণা আজও বিভিন্ন আন্দোলনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। জাতীয়তাবাদী চিন্তার আরবরা হোক, ইসলামী আন্দোলনের অনুসারীরা হোক, এমনকি আইসিস-এর মতো কট্টর গোষ্ঠীও, যারা একটি নতুন খেলাফত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল, তারাও পুরনো আরব বিজয়গুলোর কথা বলেই এগিয়ে গিয়েছিল।

এটিও সত্যি যে, নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডার জন্যও আরবকে একত্রিত করার কথা বলা হয়। কিন্তু তারপরও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে অবশ্যই প্রভাব ফেলে। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, ইরান বিশ্বে সমস্ত ইসলাম ধর্মাবলম্বী দেশকে একত্রিত করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে।

বিশেষ করে গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধের সময়ও আরব দেশগুলিকে একত্রিত করার তাদের প্রচেষ্টা খুব স্পষ্টভাবে দেখা গেছে। ইসরায়েল এবং আমেরিকার সাথে নির্ভয়ে জড়িয়ে পড়েছে। ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার জবাবে যখন মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে, তখন অনেক আরব দেশ আমেরিকার বিরুদ্ধে কথা বলেছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, জর্ডান, বাহরাইনের মতো দেশগুলো বলেছে যে, তারা ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণ করবে না। অর্থাৎ কোথাও না কোথাও তাদেরও মনে হচ্ছে যে, ইরানের সাহস আছে।

এছাড়াও, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকি মিশর, সৌদি আরব, জর্ডান, কাতার, ওমানের মতো আরব দেশগুলো সফর করেছেন। সেখানকার নেতাদের সাথে দেখা করেছেন এবং ইরান-সৌদি আরব, ইরান-মিশরের মতো দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নত করার চেষ্টা করেছেন। এর উদ্দেশ্য ছিল, পুরো আরব অঞ্চলে ঐক্যের একটি রাজনৈতিক আবহ তৈরি করা। গাজার পাশে তারা দাঁড়িয়ে আছে। তাই কেউ তাদের শিয়া-পন্থী হওয়ার অভিযোগও করতে পারে না।

এগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে, আরব বিশ্বে ইরান নিজেকে একটি আশা হিসেবে উপস্থাপন করছে। যা শুধু ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েই নয়, বরং আলোচনার মাধ্যমে, নিজেদের সংস্কৃতি দিয়ে, ইসলামী চিন্তা দিয়ে আরব সুপারস্টেট তৈরির দিকে এগিয়ে যেতে চায়।

এখন আপনারা আমাকে বলুন, আরবের বাকি দেশগুলোর কি ইরানের সাথে থাকা উচিত? সবার কি মিলে একটি আরব সুপারস্টেট তৈরি করা উচিত? আপনাদের মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে জুন, ২০২৫ রাত ১২:০৯

সৈয়দ কুতুব বলেছেন: সৌদিসহ সুন্নী ব্লকের মুসলিম দেশগুলো পশ্চিমাদের হাতের পুতুল। ইরান হাত মিলিয়েছে রাশিয়া-চায়না ব্লকের সাথে। কি মনে হয় ঐক্য হবে?

২| ২৬ শে জুন, ২০২৫ ভোর ৪:১৮

সামরিন হক বলেছেন: অর্ধেকটা পড়লাম। অনেক লম্বা লেখা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.