নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি মেহেদি হাসান, মি. বিকেল নামে পরিচিত। আমি একজন লেখক, অভিনেতা, সমাজকর্মী, রেডিও জকি, ওয়েব ও অ্যাপ ডেভেলপার, সম্পাদক, উপস্থাপক, রক্তদাতা, এবং নাট্য পরিচালক। মাইক্রোসফটে ডেভেলপার হিসেবে কর্মরত এবং গল্প বলা আমার প্রধান পরিচয়।

মি. বিকেল

আমি মোঃ মেহেদি হাসান, কলম নাম মি. বিকেল।

মি. বিকেল › বিস্তারিত পোস্টঃ

সেকেন্ড হ্যান্ড পণ্যের অদৃশ্য ফাঁদ: আপনি কি অন্যের আবেগও কিনে ফেলছেন?

৩১ শে জুলাই, ২০২৫ রাত ১২:২৪



মানুষ আমাদের লক্ষ্য করে। আপনার পোশাক-আশাক, আপনার স্মার্টফোন, আপনার ল্যাপটপ, আপনার জুতো, আপনার হাতঘড়ি, আপনার সানগ্লাস/গ্লাস, আধুনিক গ্যাজেট, আপনার বই-খাতা ও কলম, আপনার ব্যাগ থেকে শুরু করে আপনার ব্যবহৃত পারফিউম পর্যন্ত। মানুষ শুধু আমাদের লক্ষ্যই করে না, আমাদের দ্বারা ব্যবহৃত সমস্ত পণ্যের মাধ্যমে আমাদের ব্যক্তিত্ব, সামাজিক অবস্থান, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক মর্যাদা পর্যন্ত নির্ধারণ করতে পারে।

ব্যবহৃত বা পুরনো পণ্য মানে পুরনো মানুষ হিসেবে আপনাকে বিবেচনা করা হতে পারে। মানে, “Used Products = Used Person” -এর দর্শন হিসেবে। আপনার হাতে সেকেন্ড হ্যান্ড পণ্য দেখে নির্ধারণ করা যেতে পারে যে, আপনি আর্থিক সংকটে ভুগছেন। পরীক্ষা কেন্দ্রে বা ক্লাসে পুরনো পার্কার কলম দেখে আপনাকে সহজেই কেউ বলে দিতে পারে আপনি অনেক পুরনো চিন্তা-চেতনার মানুষ। কারণ পার্কার ভেক্টর কলমগুলো আমাদের দাদুর সময়ে ব্যবহৃত হত। সেসময়ে এসবের দামও ছিলো অনেক। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেসময়ের সরকারি চাকুরীর এক মাসের পুরো বেতন প্রায়। মানে ১৫-২০ টাকার মত।

ক্লাসমেট বা সহকর্মী আপনার পার্কার কলম নিয়ে হাসাহাসি করতে পারেন। বিশেষ করে যখন আপনি কার্তুজ পকেটে নিয়ে সারাক্ষণ ঘুরছেন। একদিন আপনার এক ক্লাসমেট/সহকর্মী হয়তো আপনাকে জিজ্ঞেসা করেই বসলেন, “আপনি এখনো এই পার্কার কলম কেন ব্যবহার করেন?” প্রত্যুত্তরে কলমটি আপনি তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “আমার এই কলমটি আমার দাদুর। আমার দাদু যখন প্রথম একটি সরকারি চাকুরী পেয়েছিলো তখন তার প্রথম মাসের বেতন দিয়ে এই কলম ক্রয় করেছিলেন। অবশ্য দাদু আজ বেঁচে নেই। তিনি তার মৃত্যুর আগে তাকে যেন আমি স্বরণ করি এজন্য এই কলম আমাকে উপহার দেন। আমাদের বংশের উপাধি ‘হাসান’। কলমের উপরের অংশে আপনি ‘হাসান’ শব্দটা খুঁজে পাবেন।”

প্রশ্ন এটা নয় যে, কলমটি সত্যিই আপনার দাদুর কিনা? প্রশ্ন হলো, এতে করে আপনার ক্লাসমেট বা সহকর্মী আর হাসাহাসি করবেন কিনা? আপনাকে আর হেয় করবেন কিনা?

আমার মতে, এই গল্প শোনার পর কেউই আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি বা আপনাকে হেয় করবেন না। অথচ, এই পার্কার কলম মূলত সেকেন্ড হ্যান্ড বা ব্যবহৃত কলম। সুতরাং পূর্বের দর্শন অনুযায়ী আপনাকে আর্থিক সংকটে থাকা/সামাজিক অবস্থানে নিচুস্তরে থাকা একজন মানুষ হিসেবে নির্ণয় করা উচিত। কিন্তু যখনই আপনি ঐ পণ্যের পেছনের গল্প ও ঐতিহ্য তুলে ধরলেন তখনই আপনাকে সবাই একটু বেশিই মূল্যায়ন করা শুরু করলো। আর এই মূল্যায়ন আপনি সাধারণ এবং আধুনিক একটি কলম ব্যবহার করেও পেতেন না।

হঠাৎ করে যে মন্তব্যগুলো আপনি পেতে শুরু করলেন,

– “ওহ্‌! রেট্রো ভাইব!”
– “এটা তো Antique লেভেল!”
– “দাদুর স্মৃতি আছে—priceless!”

পণ্য সেকেন্ড হ্যান্ড কিন্তু পণ্যের ব্যাকস্টোরি তার ‘Perceived Value’ অনেক বেশি বাড়িয়ে দেয়। গল্পটা না বলা পর্যন্ত আপনি একটি সস্তা ও পুরাতন সেকেন্ডে হ্যান্ড কলম ব্যবহার করছিলেন। কিন্তু গল্পটা প্রকাশ পেতেই তার মূল্য সামাজিকভাবে বেড়ে গেল। আপনাকে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করা শুরু হলো। এই বর্ধিত মূল্যের পেছনে আছে একটি গল্প, একটি আবেগ ও একটি ঐতিহ্য। একটি সামান্য কলম হয়ে উঠলো তিন প্রজন্মের সাক্ষী। মানে সাংস্কৃতিক একটা দিকও আমরা খুঁজে পাই।

আর উপরোক্ত এই তিনটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে গ্যাফমানের ‘Spoiled Identity’ তত্ত্ব ঠিক এভাবেই সেকেন্ড হ্যান্ড বা পুরাতন পণ্যের ব্যবহারে কাজ করে। সেকেন্ড হ্যান্ড পণ্য নির্ধারণ করে আপনার সামাজিক অবস্থান। গ্যাফমানের দৃষ্টিকোণ থেকে, ‘এন্টিক (Antique)’ বস্তু এবং ‘সেকেন্ড হ্যান্ড (ব্যবহৃত)’ বস্তুর মধ্যে পার্থক্য হলো, ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক মর্যাদা। এন্টিক বস্তু সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মর্যাদা প্রতিফলিত করে, যা ব্যক্তির আত্মপ্রতিষ্ঠা বাড়ায়। অন্যদিকে, সেকেন্ড হ্যান্ড বস্তু সামাজিক মর্যাদা কমায়, যা ব্যক্তির আত্মপ্রতিষ্ঠা ক্ষতিগ্রস্ত করে।

এন্টিক বস্তুর ক্ষেত্রে পুরাতন পণ্যের বয়স অন্তত ১০০ বছর হতে হবে। আর ভিন্টেজ পর্যায়ের বস্তুর ক্ষেত্রে এই সীমা ২০-৯৯ বছর। যেমন, ‘নোকিয়া ১১০০’ মডেলের ফোনটি বর্তমান সময়ে এসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিন্টেজ পণ্যে পরিণত হয়েছে।

প্রশ্ন হলো, কেন আমাদের সেকেন্ড হ্যান্ড পণ্য ব্যবহার করা উচিত নয়? এতে কি কি অসুবিধা রয়েছে?

অবশ্য আমাদের যাদের একেবারেই সামর্থ্য নাই তাদের কথা আলাদা। সেকেন্ড হ্যান্ড পণ্য কখনো কখনো খুবই ভয়ংকর একটি চয়েস হতে পারে। দাম কম, বেশি সুযোগ-সুবিধা - আর এই লোভে পড়েই সেকেন্ড হ্যান্ড পণ্য ক্রয়ের জমজমাট বাজার আজ কিন্তু উন্মুক্ত। কিন্তু সেকেন্ড হ্যান্ড পণ্য ক্রয়ের সাথে সাথে আমরা অতিরিক্ত অনেক কিছু ক্রয় করে থাকি,

১. সেকেন্ড হ্যান্ড পণ্যের সাথে জুড়ে থাকা স্মৃতি।
২. সেকেন্ড হ্যান্ড পণ্যের সাথে জুড়ে থাকা ব্যক্তিত্ব।
এবং ৩. সেকেন্ড হ্যান্ড পণ্যের সাথে জুড়ে থাকা ভাগ্য।

এখান থেকেই পুরো বিষয়টি বেশ ইন্টারেস্টিং ও কৌতুহলোদ্দীপক হতে শুরু করে। ব্যবহৃত জিনিসের সঙ্গে তার পূর্ব-মালিকের স্মৃতি ও অনুভূতি জড়িয়ে থাকে—এই ধারণাটি কেবল কুসংস্কার নয়, এর পেছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও রয়েছে।

২০২০ সালে নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় একটি চমকপ্রদ তথ্য উঠে আসে। গবেষকরা বলেন, যখন আমরা কোনো ব্যবহৃত বস্তু স্পর্শ করি, তখন তাতে লেগে থাকা মাইক্রো-রেসিডিউ (যেমন ঘাম, তেল, বা শরীরের ক্ষুদ্র কণা) আমাদের মস্তিষ্কের ‘মিরর নিউরন’কে (Mirror-Neuron) সক্রিয় করে তোলে। এই মিরর নিউরন অন্যের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা অনুকরণ করতে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা যায়, এর মাধ্যমে পূর্ব-মালিকের মানসিক অবস্থা বা মুড প্রায় ১৩% পর্যন্ত নতুন মালিকের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে। অর্থাৎ, আগের ব্যবহারকারী যদি বিষণ্ণ বা অসুখী থাকেন, তার সেই অনুভূতি আমাদের মনেও ছাপ ফেলতে পারে। এটাকে বলা হয়, ‘এপিসোডিক কন্ট্যামিনেশন (Episodic Contamination)’।

আমাদের মন অনেক সময় পারিপার্শ্বিক ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়, যাকে প্লেসিবো ইফেক্ট বলে। ২০২৩ সালে ইয়েল ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণা এই ধারণাকে আরও স্পষ্ট করে। অংশগ্রহণকারীদের নতুন মগে চা পান করতে দেওয়া হলে তাদের মানসিক স্কোরে কোনো পরিবর্তন আসেনি। কিন্তু যখন তাদের পুরনো বা ব্যবহৃত মগে চা দেওয়া হয়, তখন তাদের মধ্যে দুঃখ-স্কোর প্রায় ১২% বৃদ্ধি পায়। এর কারণ হলো, ব্যবহৃত মগের সঙ্গে তাদের মনে পূর্ব-ব্যবহারকারীর অজানা গল্প বা স্মৃতি জড়িয়ে গিয়েছিল, যা তাদের মনের ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল।

আবার একটি পণ্যের দাম কেবল তার আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করে না, বরং আমাদের সামাজিক মর্যাদারও একটি সংকেত দেয়।

অর্থনীতিবিদ থরস্টেইন ভেবলেন বলেছিলেন, কিছু বিলাসবহুল পণ্যের ক্ষেত্রে দাম বাড়লে তার চাহিদাও বাড়ে, কারণ সেটি তখন স্ট্যাটাসের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সেকেন্ড-হ্যান্ড পণ্যের ক্ষেত্রে এই তত্ত্ব উল্টোভাবে কাজ করে। এখানে দাম যত কমে, পণ্যের সামাজিক মর্যাদাও ততটাই কমে যায়। তবে জিনিসটি যখন ১০০ বছরের বেশি পুরনো হয়ে ‘অ্যান্টিক’-এর মর্যাদা পায়, তখন আবার ভেবলেনের তত্ত্ব ফিরে আসে। অ্যান্টিকের দাম যত বাড়ে, তার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ও স্ট্যাটাসও ততটাই বৃদ্ধি পায়। এটাকে বলা হয়, ‘রিভার্স ভেবলেন কার্ভ (Reverse Veblen Curve)’।

১৯৭৩ সালে অর্থনীতিবিদ মাইকেল স্পেন্স ‘সিগন্যালিং থিওরি (Signalling Theory)’ নামক একটি তত্ত্বের অবতারণা করেন। তিনি বলেন, একটি পণ্যের দাম সমাজে একটি নির্দিষ্ট সংকেত পাঠায়। যেমন, একটি ব্যবহৃত আইফোন ৬ হাতে দেখলে মানুষ ধরে নিতে পারে আপনার আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। কিন্তু যদি বলা হয় এটি আইফোন ৬-এর ১০০ বছরের পুরনো একটি প্রোটোটাইপ, তখন সেটি আর সাধারণ ব্যবহৃত ফোন থাকে না, বরং একটি ‘কালেক্টর আইটেম’ হিসেবে বিবেচিত হয়, যা আপনার সংগ্রাহক সত্তার পরিচায়ক।

আমরা যা ব্যবহার করি, তা আমাদের পরিচয়ের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। নতুন ও পুরনো জিনিস আমাদের আত্মপরিচয়কে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রভাবিত করে।

মনোবিজ্ঞানী ই. টোরি হিগিন্স ১৯৮৭ সালে ‘সেলফ-ডিসক্রেপেন্সি থিওরি (Self-Discrepancy Theory)’ নামক একটি তত্ত্ব দেন। তার মতে, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে একটি ‘প্রকৃত সত্তা (Actual Self)’ এবং একটি ‘সম্ভাব্য সত্তা (Possible Self)’ রয়েছে। ‘প্রকৃত সত্তা’ হলো আমরা বর্তমানে যা, আর ‘সম্ভাব্য সত্তা’ হলো আমরা ভবিষ্যতে যা হতে চাই। নতুন কোনো জিনিস কিনলে তা আমাদের ‘সম্ভাব্য সত্তা’-র কাছাকাছি যেতে সাহায্য করে, মনে হয় আমরা নিজেদের উন্নত করছি। কিন্তু ব্যবহৃত জিনিস আমাদের পুরনো পরিচয়ের ফ্রেমে আটকে রাখে এবং আত্ম-উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে।

সমাজতত্ত্ববিদ পিয়ের বর্দিউ একটি ধারণাটি প্রবর্তন করেন। তার মতে, সমাজে টিকে থাকতে গেলে শুধু অর্থনৈতিক পুঁজিই যথেষ্ট নয়, সাংস্কৃতিক পুঁজিও প্রয়োজন। অ্যান্টিক বা দুর্লভ পুরনো জিনিস ব্যবহার করা ‘উচ্চ সাংস্কৃতিক পুঁজি’র (High Cultural Capital) পরিচায়ক, যা সমাজে আমাদের রুচি ও মর্যাদা বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে, সাধারণ সেকেন্ড-হ্যান্ড জিনিস ব্যবহার করা ‘নিম্ন সাংস্কৃতিক পুঁজি’র (Low Cultural Capital) লক্ষণ, যা সামাজিকভাবে আমাদের পিছিয়ে দেয়।

এই তিনটি তত্ত্ব এক সুতোয় গাঁথলে বোঝা যায়, কেন একেবারে নতুন অথবা অনেক বছরের পুরনো জিনিসের প্রতি আমাদের আকর্ষণ কাজ করে, কিন্তু অল্প-দিনের পুরনো জিনিস আমাদের মন থেকে এতটা সাড়া পায় না। নতুন জিনিস আমাদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়, আর অ্যান্টিক আমাদের ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের অনুভূতি দেয়। কিন্তু অল্প ব্যবহৃত জিনিস কেবল অন্যের ফেলে যাওয়া স্মৃতি আর সামাজিক দীনতার সংকেতই বহন করে।

ছবি: Gemini

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ৩১ শে জুলাই, ২০২৫ সকাল ৯:১০

রাজীব নুর বলেছেন: কথা সত্য্য।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.