![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে রেহান নিজেকে একটি ভিন্ন বাস্তবতায় খুঁজে পেল। একটি মাটির বাড়ি, দোতালা। নিচতলায় একটি ঘরে মশারী টাঙানো। আর তারমধ্যে রেহান। কাঠের খাট কিন্তু রাজকীয়। বিশেষ করে এর চারপাশে আঁকা বিভিন্ন প্রতীক। গাছপালা, মাছ, পাখি, একদল মানুষ এবং আরও অনেক কিছু। ছুঁয়ে দেখতেই আরো বেশি জীবন্ত লাগছে। ঘরে খুব বেশি আসবাবপত্র নাই। খাটের পাশে একটি কাঠের চেয়ার ও টেবিল। কিছু পুরাতন বই আর তারপাশে হারিকেন জ্বলছে। কেরোসিনের পোড়া গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আর একটু দূরেই মাটির একটি আলমারি; ঝাপসা দেখা যাচ্ছে।
জানালা খুলতেই পাখির কিচিরমিচির। বেশ মিষ্টি শব্দ। চারপাশ টা এখনো অন্ধকার। সকাল হতে হয়তো আরো একটু দেরি। হাতে একটি হাতঘড়ি দেখে টের পেলো, এখন সময় ভোর ৬টা। মানে ফজরের নামাজ টা আজ মিস হয়ে গেছে। রেহান অবাক হয়ে চারপাশে মাটির দেয়াল দেখতে লাগলো। মাটির সোঁদা গন্ধ নাকে ভেসে আসলো।
রেহান ভাবতে লাগলো, “আচ্ছা! মাটি দিয়েও কি এমন সুন্দর ঘর নির্মাণ করা যায়!” কিন্তু সে মোটেই বুঝতে পারছে না এখানে সে কীভাবে পৌঁছালো। সর্বশেষ রেহানের শুধু মনে আছে, স্রষ্টার কাছে তার একটি বিশেষ অনুরোধ, “বর্তমানের এই পৃথিবীর জন্য আমি বড্ড বেশি বেমানান, ইশ! আমি যদি একটু আগে এই পৃথিবীতে জন্ম নিতাম!”
রেহান খাট থেকে উঠে হারিকেনের সুতো টেনে হারিকেন বন্ধ করলো। তারপর আলমারির বিপরীত প্বার্শে একটি আয়না খুঁজে পেল। মাটির সাথে গুছিয়ে লাগানো, কিন্তু খুব স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। আয়নার দিকে তাকাতেই নিজের লম্বা চুল, আর অদ্ভুত সব পোশাক-আশাক দেখে আশ্চর্য হলো। ঢিলেঢালা শার্ট ও প্যান্ট। এক রঙের এবং স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই দীর্ঘ বলে রেহানের মনে হচ্ছে। কিন্তু রঙ ঝলছে গেছে।
হঠাৎ দরজায় কেউ একজন নক করছে, ফিসফিস করে বলছে, “রেহান… রেহান… আপনি কি ভেতরে আছেন?” কাঠের দরজার খিল খুঁজে বের করতেই রেহানের দশা খারাপ। একসময় খিল টেনে দিতেই একটি মেয়ে যেন তার উপড় পড়ে গেল। আবার তাৎক্ষণিক সে নিজেকে সামলিয়ে বললো, “খিল টা পরিবর্তন করলেও তো পারেন! এভাবে উস্টে খেতে হত না!” তারপর মেয়েটা খুব সম্ভবত লজ্জা পেয়ে দৌড়ে পালালো।
খুব ভোরে এমন সুন্দরী মেয়েকে ডেটিং এপ্লিকেশনেও খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে কি সুন্দরী মেয়েরা নিজেদের লুকিয়ে রাখে? উজ্জ্বল তামাটে বর্ণের মেয়েটার উচ্চতা আনুমানিক ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি। প্রথম দেখাতে ফর্সা বলেই মনে হবে। কালো শাড়ি পরেছে। কপালে টিপ, ওটাও শাড়ির সাথে মিল রেখে ‘কালো টিপ’, ছোট্ট। খাঁজকাটা শরীর। ওর শরীরের ভাজ আর খাঁজ শব্দদুটো মাথায় আসতেই কেমন জানি অস্থির লাগছে। আর চেহারার আকৃতির নকশা কেউ সুন্দর করে শিল্পে রুপান্তরিত করেছে, মানে ওর চেহারায় একটা আর্ট আছে।
একইসাথে এত লম্বা, ফর্সা আর চমৎকার দৈহিক গঠনের মেয়ের সাথে কখনো দেখা হয়নি রেহানের। এছাড়া কোথাও একবিন্দু মেক্যাপ লক্ষ্য করেনি সে। কিন্তু ঠোঁটে কালো রঙের লিপিস্টিক ব্যবহার করেছে। পারমানেন্ট নয়, সাদা শার্টে ঠোঁটের চিহ্ন উঠে আছে।
টেবিলে চোখ যেতেই লক্ষ্য করলো একটি ‘ফাইল’। ফাইলের উপরে লেখা ‘আদমশুমারী - ১৯৮১’। ফাইল খুলতেই রেহানের চোখে পড়লো গ্রামের নাম: কালিগঞ্জ, ওয়ার্ড নং: ৩। নিজের নামের পাশে গণনাকারীর দায়িত্ব স্পষ্ট। মানে রেহান অন্তত মেট্রিক পাশ করেছে। প্রতিদিনের কাজ ভাগ করা। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। হঠাৎ পাশের এক চিরকুট পড়ে বুঝলেন আজও ওর কাজ আছে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, সাথে ঐ মেয়েটাও থাকবে, ওর নাম ‘স্বর্ণালী সরকার’। তারমানে মেয়েটাও শিক্ষিত কিন্তু হিন্দু মেয়ে। আর রেহানের সারনেম ‘রেহান আহমেদ’। মুসলিম বাঙালী পরিবারে জন্ম, পিতা-মাতা মৃত। চিরকুটের উল্টো পাশে স্পষ্ট করে লেখা, “সকাল ৯টা, বটতলা, চেয়ারম্যান পাড়া”।
দরজা খুলে বাইরে বের হতেই একটি টিউবওয়েল দেখতে পেল। তারপর জল উঠিয়ে মাটির কাপে ঢকঢক করে জল পান করলো। রেহানের মনে হলো, সে যেন জল নয়, শরবত পান করছে। তারপর গোসল করে গুছিয়ে বের হলো বটতলার দিকে। সাথে আছে একটি পুরনো সাইকেল। খুব সম্ভবত এটা স্বাধীনতারও আগের সময়ের সাইকেল। একটু বেশিই উঁচু। ভাগ্যিস সাইকেল চালানো আগে থেকেই জানতো রেহান। এরপর অনেক খুঁজে বের করলো সেই ‘বটতলা’। মেয়েটা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আর বারবার নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। রেহানকে দেখেই যেন বুকে জল ফিরে এলো। সাইকেল একপাশে দাঁড় করিয়ে রেখে রেহান স্বর্ণালী এর দিকে এগুলো।
স্বর্ণালী: আপনার চুলগুলো এমন অদ্ভুত করে রেখেছেন কেন?
রেহান: মনে করুন, এটা একটি নতুন স্টাইল।
স্বর্ণালী: আপনার হয়তো খেয়াল নেই যে, আজ আমাদের চেয়ারম্যানের বাড়তে যেতে হবে। কাদির মোল্লা কে চেনেন তো? এসব নতুন স্টাইল আজকের কাজের বাধাও হতে পারে।
রেহান: তো, দুই-একজন বাদ পড়লে দেশে জনসংখ্যা অনেক কমে যাবে নাকি?
স্বর্ণালী: খুব সম্ভবত বিষয়টি কম বা বেশি হবার নয়। আপনাকে আজ পুরোটাই ভিন্ন মানুষ বলে মনে হচ্ছে। চলুন, যাওয়া যাক?
রেহান মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো…
একটুবাদেই স্বর্ণালী আর রেহান চেয়ারম্যানের বাড়িতে। কাদির সাহেব বেশ গোস্বা করে আছেন। চেয়ার থেকে ওঠার নাম নাই। স্বর্ণালী সাহস করে বললো, “আমরা আদমশুমারী থেকে…”। কাদির মোল্লা হাত উঁচিয়ে স্বর্ণালীকে থামিয়ে দেয়। আর বলতে শুরু করেন, “জানি… জানি… এই আদমশুমারী তো একটা বাহানা মাত্র। আর এই কাজের নাম করে আপনারা যে সমাজ ব্যবস্থা ধ্বংস করছেন সেটা কি খেয়াল আছে?” স্বর্ণালী জবাব দেয়, “আপনি কি বুঝাতে চাইছেন?” কাদির মোল্লা ক্ষেপে গিয়ে, “বুঝতে পারবেন, সবই বুঝতে পারবেন।”
রেহান চিন্তা করতে শুরু করে, সাধারণ এই আদমশুমারী নিয়ে মোল্লা সাহেবের এত আপত্তি কেন! রেহান এই প্রথমবার মুখ খুললো, “আমার পাশে হিন্দু মেয়েকে দেখে আপনার গায়ে ফোসকা পড়েছে মনে হয়। চেয়ারম্যান শুধু একটি পদ নয়, দায়িত্বও। আপনার মত মানুষই যদি সাহায্য না করেন তাহলে সাধারণ মানুষ কীভাবে সাহস পাবে?” রেহানের কথা শুনে চেয়ারম্যান সাহেব যারপরনাই রেগে গেলেন।
সেদিন অবশ্য আদমশুমারীতে চেয়ারম্যানের নাম উঠানো সম্ভব হলো না। কিন্তু স্বর্ণালী অনেক খুশি। বিশেষ করে চেয়ারম্যানের মুখে রেহানের ওমন জবাব দেবার পর। কোথাও না কোথাও স্বর্ণালীর মনে হলো, বাবা-মা ছাড়া দুটো মানুষ এমন নিঃস্বার্থভাবেও একে অন্যের পাশে দাঁড়াতে পারে। সাইকেলে করে স্বর্ণালীকে রেহান তার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিল। স্বর্ণালী ছোট্ট করে একটি ‘ধন্যবাদ’ জানালো আর বললো, “আপনার দরজার খিলটা মনে হয় নষ্ট হয়ে গেছে। ঠিক করে নেবেন। রেহান সকালের ঘটনা মনে পড়তেই মুচকি হাসতে লাগলো।”
পরদিন ভোরবেলা…
দরজার ওপাশে স্বর্ণালী। একবার কড়া নাড়তেই রেহান দরজা খুলে দিলো। স্বর্ণালী ভেতরে এসে রেহানের এলেমেলো ঘর দেখছিলো। একসময় বললো, “আরো একটু গুছিয়ে রাখলে ভালো করতেন!” রেহানের মুখে মুচকি হাসি। স্বর্ণলীর কাছে যেতেই রেহান স্বর্ণালীর ঠোঁটে একটি চুমু এঁকে দিলো। স্বর্ণালী লজ্জায় আর কিছুই যেন বলতে পারছে না। কিন্তু ওদিকে বেশ কয়েকজন মিলে রেহানের বাড়ি ঘেরাও করেছে। স্বর্ণালী ও রেহান টের পেতেই চেয়ারম্যান সাহেব ঘরে ঢুকেই স্বর্ণালীর উপর হাত তুললো। চেয়ারম্যান কে বাধা দিতে যাবে, ঠিক এই মুহুর্তেই কয়েকজন এসে রেহান কে ঘেরাও করে বেধে ফেললো।
সেদিন বিকালে চেয়ারম্যান সাহেব গ্রামের সবাইকে ডেকে বিচারের ব্যবস্থা করলেন। চেয়ারম্যান সাহেব ওরফে কাদির মোল্লা বললেন, “এই ধরণের ব্যভিচারী সম্পর্ক আমাদের সমাজে স্থান পেতে পারে না। এদের দুজনকেই এখন এই গ্রাম ছাড়তে হবে। আপনারা কে কি বলছেন?”
চেয়ারম্যানের কথায় ছিলো ঐ গ্রামের শেষ কথা। গ্রামবাসী শুধু তার সাথে ‘হ্যাঁ’ মেলালেন। সেদিন বিকেলের এক বাসে স্বর্ণালী আর রেহান পাড়ি জমালো ঢাকার উদ্দেশ্যে। স্বর্ণালীর চোখে জল। অনেক স্মৃতি ছিলো এই গ্রামে। অনেককিছুই ফেলে রেখে যেতে হচ্ছে। নতুন ঠিকানা অজানা।
তারপর থেকে আজ পর্যন্ত, আদমশুমারী থেকে জনশুমারিতে নাম পরিবর্তন হলেও সঠিক জনসংখ্যার হিসেব জানে না এই দেশ…
ছবি: vidIQ
২| ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৮
শেরজা তপন বলেছেন: গল্প ভালো -আর শেষের কথাটা বেশ ভাল লাগলো।
৩| ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:০৮
শায়মা বলেছেন: আহা কি সর্বনাশের গল্প!!
তারপর তাদের অজানা ইতিহাসও জেনে আমাদের জানাও ভাইয়া।
৪| ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১৮
বিজন রয় বলেছেন: আজকাল ব্লগে গল্প খুব কম আসে।
আপনার গল্পটি ভালো হয়েছে।
৫| ০১ লা অক্টোবর, ২০২৫ দুপুর ১:৩৪
রাজীব নুর বলেছেন: পোষ্টে আবার এলাম। কে কি মন্তব্য করেছেন সেটা জানতে।
©somewhere in net ltd.
১|
৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১০
রাজীব নুর বলেছেন: ভালো গল্প।