![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আজ ১লা মে, আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশেও দিবসটি গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে এবং ভবিষ্যতেও হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু যে কারণে দিবসটি পালন করা হয় তার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য পূরণ হয় না কোনদিন। বেশির ভাগ মানুষই দিবসটি পালনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্য সম্পর্কে অবগত নয়, আবার যারা অবগত তারাও এটি এড়িয়ে যাই সচেতনভাবেই। দিবসটির আসল লক্ষ্য পূরণের পরিবর্তে আমরা দিবসটিকে গ্রহণ করেছি নিছক একটি ছুটির দিন হিসাবে এবং ঘোরাফেরা করে আনন্দের সাথে কাটিয়ে দিই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এই দিবসটি। আর আমাদের শ্রমিক নেতারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্রমিকদের স্বার্থ পূরণের পরিবর্তে নিজেদের পকেট ভারী করার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে এই দিবসটিকে। এই দিবসটি পালনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট যদিও অনেকেরই জানা আছে তবুও বর্তমান প্রেক্ষাপটে দিবসটির তাৎপর্য ব্যাখ্যার প্রয়োজনে এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটা সংক্ষেপে তুলে ধরছি।
১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে দৈনিক আট ঘন্টার কাজের দাবীতে শ্রমিকরা হে মার্কেটে জমায়েত হয়েছিল। তাদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের পর পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলীবর্ষণ শুরু করে। ফলে প্রায় ১০-১২জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়। ১৮৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের শতবার্র্ষিকীতে প্যারিসে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাভিনে। ১৮৯১ সালের আরেকটি সম্মেলনে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। এর পরপরই ১৮৯৪ সালের মে দিবসের দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। পরে, ১৯০৪ সালে আমস্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই উপলক্ষ্যে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে দৈনিক আটঘন্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবী আদায়ের জন্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিশ্বজুড়ে পয়লা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজনের জন্য সকল শ্রমজীবি মানুষ এবং শ্রমিক সংঘসমূহের (ট্রেড ইউনিয়ন) প্রতি আহবান জানানো হয়। তখন থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠন সমূহ রাজপথে সংগঠিতভাবে মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে দিবসটি পালন করে থাকে। বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে ১লা মে জাতীয় ছুটির দিন। আরো অনেক দেশে এটি বেসরকারি ভাবে পালিত হয়।
দিবসটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে বোঝা যায়, এটি ছুটির নামে আনন্দ উদযাপনের কোন দিবস নয়। বরং এই দিবসটিতে এক শোকাবহ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং সেই দিনের শোককে শক্তিতে রুপান্তরিত করে বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবি মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে জেগে ওঠার জন্য দিনটি পালিত হয়। অথচ আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই বাস্তব সত্যটিকে এড়িয়ে নিছক ছুটির দিন এবং ঘোরাফেরার উপলক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করি যা এই দিনের তাৎপর্যর সাথে এক নির্মম রসিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এমনও অনেক ঘটনা ঘটে থাকে যে, শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার এই দিনে ছুটিতে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে রিক্সায় ঘুরতে বেরিয়ে ঐ রিক্সাশ্রমিকের সাথে সামান্য কথা কাটাকাটির জের ধরে তাকে লাগিয়ে দিলাম একটা চড়। একজন সচেতন মানুষ হিসাবে এই দিবসটি আমাদের কাছে কি দাবি করে তা আমাদের বুঝতে হবে। শুধু শ্রমিকদের নয়, এই দিবসটির চেতনা বাস্তবায়ন করতে আমাদেরও অনেক কিছু শেখার আছে, বোঝার আছে, করার আছে। আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে যদি আমাদের যথোপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে পারি তবেই দিবসটি পালন স্বার্থক হবে।
প্রথমত দেশ গঠনে শ্রমিকদের অবদান এবং তাদের অধিকার সম্পর্কে আমাদেরকে সচেতন হবে এবং নিজ নিজ পরিসরে শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে গণসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে যাতে করে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে কোন ক্ষেত্রে বঞ্চিত না হয়। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে শ্রমিকরা ভিন্নগ্রহের কোন প্রাণী নয়, তারা আমাদেরই কাছের মানুষ, কারো পিতা, কারো মাতা, কারো চাচা ইত্যাদি ইত্যাদি। তারা আমাদের সমাজেরই মানুষ, আমাদের মাঝেই তাদের বেড়ে ওঠা। আমাদের কোন বিপদে আপদে তারাই প্রথম এগিয়ে আসে। আমাদের সুবিশাল অট্টালিকা যেমন তাদের হাতেই গড়ে ওঠে আবার সেই অট্টালিকায় যখন আগুন লাগে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আগুন নেভাতেও তারাই এগিয়ে আসে সবার আগে, আমরা যাদের তোষামোদ করি সমাজের সেই বাবুসাহেবরা তখন নিজ গৃহে বসেই আরামে সিগারেট টানতে থাকে। আমাদের বিপদে আপদে ঐ বাবুসাহেবদেরকে কখনও নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসতে দেখি না, তবুও তাদের কোন অনুষ্ঠানে আমরা হাজির হই মূল্যবান ডিনার সেট নিয়ে। আর ক্ষুধার যাতনায় অতিষ্ঠ হয়ে একজন শ্রমিক যখন দুইশত টাকা ধার নেওয়ার জন্য আমাদের দুয়ারে আসে আমরা তাদের তাড়িয়ে দিই কুকুরের মত দূর দূর করে। এই যদি হয় আমাদের মানবতা তাহলে আমরা কি শিখলাম ? তাই অন্তত এই দিবসে আমরা শপথ নিতে পারি- আমাদেরই আপনজন এই খেটে খাওয়া শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় আমরা নিজ নিজ পরিসরে গণসচেতনতা গড়ে তোলার পাশাপাশি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনেও তাদের অধিকার রক্ষায় সবসময় সচেতন থাকব। যথাসময়ে তাদের ন্যায্য মজুরি প্রদান করতে কখনও কার্পণ্যবোধ করবনা এবং তাদের বিপদ আপদে আমরা সবসময় আমাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেব, কেউ যেন তাদের উপর কোন প্রকার জুলুম করতে না পারে সেদিকে সর্বোচ্ছ দৃষ্টি রাখব। আমাদের সুখ দুঃখে আমরা তাদেরকেও পাশে রাখব।
আর ছাত্রভাইদের উদ্দেশ্যে বলি- শ্রমিকদেরকে অবহেলা করার প্রবণতাটা আমাদের মধ্যেও অতিমাত্রায় বিদ্যমান। আমরা অনেকেই স্কুল-কলেজ, ভার্সিটিতে পড়ি বলে তাদেরকে অনেক সময় মানুষ বলেই মনে করি না। সামান্য ভাড়া নিয়ে কিংবা অন্য কোন কারণে কথা কাটাকাটির জের ধরে কথায় কথায় তাদেরকে চড় থাপ্পড় লাগিয়ে দিতে সামান্যতম দ্বিধাবোধও করি না। আমরা মনে করি যে আমরা ছাত্র, আমাদের মর্যাদা অনেক উপরে, আমাদের তুলনায় তারা কিছুই না, আইন আদালত, পুলিশ প্রশাসনও আমাদের পক্ষেই থাকবে, বাস্তবে থাকেও তাই। কিন্তু খেটে খাওয়া এই শ্রমিকদের উপর জুলুম চালিয়ে দুনিয়ার আদালতে আমরা নিস্তার পেলেও আল্লাহর আদালতে আমরা নিস্তার পাবনা, সেখানে ঠিকই ধরা খাব। শ্রমিকদের সাথে আমাদের বেশিরভাগ সময়ই কথা কাটাকাটি হয় মূলত: ভাড়া নিয়ে। তারা হয়তো দু টাকা বেশিই চায়। আমরা গার্লফ্রেন্ড কিংবা বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে দামি দামি রেস্টুরেন্টে গিয়ে দু-চার-পাঁচশো টাকা অতিরিক্ত খরচ করতে আমাদের কখনই গায়ে বাজে না, সেখানে আসার সময় আবার ওয়েটারকে পঞ্চাশটা টাকা বখশিষও দিয়ে আসি। অথচ, পরিবহন শ্রমিকরা পাঁচ টাকা বেশি চাইলেই আমাদের গায়ে বাজে। টাকা যদি কমও থাকে আমরা তাদেরকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতে পারি না, দু গালে দুটা চড় লাগিয়েই তাদেরকে তাড়াতে হয়। অথচ, তারা অনেক সময়ই হয় আমাদের বাবার সমতুল্য, না হয় বড় ভাইয়ের। আমাদের বোঝা উচিত এই চপেটাঘাত পরোক্ষভাবে আমাদের বড় ভাই-বাবার প্রতিই চপেটাঘাতের সমতুল্য, আল্লহ তায়ালা আমার ভাই বাবাকেও তো এই পেশায় আনতে পারতেন, ভবিষ্যতে যে আমি কিংবা আমার ভাই-বাপ কেউ যে এই পেশায় কিংবা এর সমতুল্য অন্য কোন পেশায় আসবে না তারও কোন নিশ্চয়তা কি আমরা কেউ দিতে পারি। সৃষ্টিকর্তা চাইলে যেকোন সময় যে কাউকে যেকোন অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে যার উদাহরণ আমরা ভুরি ভুরি আমাদের সমাজে দেখতে পাই। তাই সমাজের এইসব খেটে খাওয়া মানুষগুলোর প্রতি কোন প্রকার অবহেলা না করে মে দিবসের চেতনা থেকে শিক্ষা নিয়ে তাদের অধিকার রক্ষায় তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।
আমরা কি একটিবারও চিন্তা করে দেখেছি- আমরা যে আজ স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়তেছি আমাদের পেছনে সরকার যে লক্ষ লক্ষ টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে এই টাকাগুলো আসে কোথেকে? এই টাকাগুলোও তো আসে আমাদের সেই গরীব-শ্রমজীবি সাধারণ মানুষের মেহনতের টাকা থেকে, তাদের দেওয়া ট্যাক্স থেকেই সরকার আামাদের পড়ালেখার খরচ চালায়। তাদের দেওয়া ট্যাক্সের টাকায় আমরা বড় বড় সার্টিফিকেট বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করে স্বাচ্ছন্দে জীবন যাপন করি, এর ঋণ কি আমরা কখনও শোধ করার চেষ্টা করি? উল্টো তাদেরকেই আমরা দু চার টাকার ভাড়ার জন্য মার-ধর করি। আমাদের বিবেক কি আমাদেরকে একটুও বাধা দেয়না?
আসুন তাই আমরা আজকের এই মে দিবসটিকে নিছক ছুটির দিন হিসাবে পালন না করে এই দিবসটি থেকে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় তাদের পাশে দাঁড়ানোর শপথ নিই। এটিই হচ্ছে মহান মে দিবসের শিক্ষা। ধন্যবাদ সবাইকে, সবাই ভালো থাকবেন। আমার জন্য দোয়া করবেন।
©somewhere in net ltd.