![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
“Ask yourself often, why do I have to think like other people think?”
গত সপ্তাহে ‘আহলে হাদিস’ তথা বাংলাদেশী সালাফি মতাদর্শী সংগঠন জেএমবি সবার উদ্দেশ্যে কিছু বার্তা ও তাদের কিছু স্বীকারোক্তি প্রদান করেছে। এই স্বীকারোক্তিগুলোর কারণে অনেক হত্যা মামলার জট সহজে খুলে যাবে। জেএমবি তাদের নতুন বার্তায় তাদের সংগঠনের নামের ইতিহাস ও ভারতীয় উপমহাদেশে জিহাদের ইতিহাসের কথা উল্লেখ করে। এছাড়া বিএনপি জামাতকে জোটকে ত্বগুত ও মুরতাদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। পাঠক লক্ষ্য করুন, আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসআইএ-এর ম্যাগাজিন দাবিক পত্রিকার ১২তম সংখ্যায় আইএসআইএস বাংলা ভাইকে সাজা দেওয়ার কারণে একই ভাবে বিএনপি-জামাত সরকারকে মুরতাদ ঘোষণা করেছে। সেই সংখ্যায় ৭১-এর আল-বদর কমান্ডার রাজাকার নিজামীকে ‘হেড অব মুরতাদ’ ঘোষণা করা হয়েছে।
বাংলাদেশে আইএস-এর নামে যে হামলাগুলো করা হচ্ছে তা মূলত জেএমবি করছে এবং স্বীকারোক্তি দিচ্ছে আইএস। আইএস একটি সালাফি সুন্নি সংগঠন। ফলে আদর্শিকভাবে জেএমবির সাথে তার মিল রয়েছে। সালাফি সংগঠন আইএস-এর সাথে বাংলাদেশের দুইটি দল খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে ১. জেএমবি ২. হিজবুত তাহরীর।
জেএমবি’র ইতিহাস:
জেএমবি বলছে, জেএমবি নামটি কোন নতুন নয়। ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে মুসলিমদের দ্বারা একটি জামায়াহ তৈরি হয়। যার নাম হয় “জামা’ আতে মুজাহিদীন”। এর নেতৃত্বে ছিলেন সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ এবং তার সেনাপতি ছিলেন ইসমাঈল শহীদ। তাদের নেতৃত্বে এই ভূখণ্ডে কিছু ইসলামিক হুকুম প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ১৮৩১ সালে বালাকোটের যুদ্ধে নেতৃস্থানীয় মুজাহিদীনসহ অন্যরা নিহত হলে ইসলামী শাসনের পতন ঘটে। অনেকে জেল, ফাঁসি ও সাজার সম্মুখীন হয়। ফলে জামা আতে মুজাহিদীন-এর কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে।
তারা বলছে, এই অঞ্চল ব্রিটিশরা ছেড়ে গেলেও তাদের কুফরি আইন কানুন সবই রেখে যায়। ফলে আল্লাহ আইন প্রতিষ্ঠা করতে পাকিস্তান, আফগানিস্তানে মুজাহিদীনরা জেগে উঠে। ঠিক একই টাইপ কথাগুলো দেখতে পাবেন দাবিক ম্যাগাজিনের ১৫ সংখ্যায়ও। পাকিস্তান আফগানিস্তানের পর বাংলাদেশে “আল-কায়েদাতুল জিহাদ(আল-কায়দা)” এর আদলে সহীহ আক্কীদাহ-মানহাজের ভিত্তিতে ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বর মাসে শাইখ আব্দুর রহমান ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে ফজর-এর নেতৃত্বে একটি জিহাদি তানজীম প্রতিষ্ঠিত হয়। যার সেনাপতি ছিলেন শাইখ নাসরুল্লাহ মাদানী। যার নামকরণ করা হয় পূর্বের ব্রিটিশ উৎখাতের যে জিহাদি তানজীম ছিল তার নামানুসারে-জামা’আতুল মাজুহিদীন সংক্ষেপে জেএমবি।
কর্মসূচি হল-
১. দাওয়াত, (আহ্বান/উদ্বুদ্ধকরণ)
২. ই’দাদ (প্রতিক্ষণ/প্রস্তুতি-গ্রহণ)
৩. ক্বিতাল (সশস্ত্র যুদ্ধ)
নিচে জেএমবির আক্রমণের লিস্ট উল্লেখ করা হল। তারা স্পষ্ট করে বলছে, তাদের উল্লেখিত হামলার বাহিরে তারা কোন হামলা করেনি। যদি কোন হামলায় ত্বগুত বাহিনী (পুলিশ বাহিনী) তাদের নাম জড়িত করে তাহলে সেটার দায় তারা নেবে না। তারা স্পষ্ট করে বলছে, অনৈসলামিক কর্মক্ষেত্র, ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানগুলো হামলাই তাদের মূল লক্ষ্য। যেমন-২০০০-২০০৫ সাল পর্যন্ত শতাধিক এনজিও উপর আক্রমণ করা হয়। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, আইএস এর গুরু ওহাব ও তাইমিয়া এমন মাজার বিরোধী তেমনি জেএমবি আইএস-এর মতন প্রচণ্ড মাত্রায় মাজার বিরোধী। ইবনে তাইমিয়া সারা জীবন যুদ্ধই করেছেন সুফিবাদীদের বিরুদ্ধে। তিনি আদেশ দিয়ে যান, ক্ষমতা থাকলে এসব বেদাত জিনিস ভেঙ্গে ফেল আর না পারলে মন থেকে ঘৃণা কর। জেএমবির হামলাগুলোর মধ্যেও অসংখ্য মাজার কিংবা পীরও রয়েছেন। জেএমবি একটি শব্দ খুন ব্যবহার করে তাহলো-ত্বগুত। ত্বগুত শব্দের অর্থ সম্ভবত-যে আল্লাহ ছাড়া অন্যকে স্বীকার করবে কিংবা অন্যের আইন ফলো করে।
হামলার দায়-স্বীকার:
১. ২০০২ সালের ডিসেম্বর মাসে ৪টি সিনেমা হলে অশ্লীল সিনেমা প্রদর্শনের জন্যে বোমা হামলা।
২. ২০০২ সালে সাতক্ষীরায় ইটাগাছায় ত্বগুতের পুলিশের টহল বাহিনীর উপর হামলা, ২ জন নিহত।
৩. ২০০২ সালে সাতক্ষীরায় অশ্লীলতা বন্ধের লক্ষ্যে সিনেমা হল ও সার্কাসে বোমা হামলা।
৪. ২০০৩-২০০৫ সাল পর্যন্ত ৫০টির বেশি যাত্রা পালায় বোমা হামলা। কারণ যাত্রা পালা অশ্লীল।
৫. ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হুমায়ুন আজাদের উপর হামলা। (এখানে বলে রাখা ভাল, ২০১০ সালে এসে অধ্যাপক আজাদ হত্যায় একটি নতুন তথ্য পাওয়া যায়। কারাগারে আটক জেএমবি প্রধান মাওলানা সাইদুর রহমান পুলিশকে জানায় সাঈদীর উস্কানিতেই তার দলের সদস্যরা অধ্যাপক আজাদের উপর হামলা চালায়।)
৬. হুমায়ুন আজাদের মতন একই অপরাধে ২০০৪ সালের শেষের দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইউনুসকে হত্যা করা হয়।
৭. ২০০৩ সালের শুরুর দিকে জয়পুরহাটের কালাইখানা পীরের আস্তানায় ৫ জন খাদেমকে শিরোচ্ছেদ।
৮. ২০০৩ সালে টাঙ্গাইলের তকতার চলা এলাকায় ফাইলা পাগলার মাজারে টাই বোমা ও গ্রেনেড হামলা।
৯. ২০০৪ সালে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার থানায় হোমিও ডাক্তার মনিরুজ্জামানকে “মেয়ে তুমি মানুষ ছিলে কবে” বইয়ের জন্যে হত্যা করা হয়।
১০. ২০০৪ সালে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী জেলার বাগমারা খান, নওগাঁ জেলার রাণী নগর, আত্রাইসহ আশেপাশের এলাকায় লেলিন-কার্ল-মার্কসবাদী অর্থাৎ সর্বহারাবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযান। তাদের বিরুদ্ধে জেএমবি ৩৫০ টির বেশি অভিযান পরিচালনা করে।
১১. ২০০৪ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর ধর্মান্তরিত গণী গোমেজ ওরফে জোসেম মণ্ডলকে ইসলামিক আইনে হত্যা করা হয়। অপরাধ-ধর্ম ত্যাগ ও অন্যদের ধর্মান্তরিতকরণ।
১২. ২০০৫ সালের ১৪ই এপ্রিল ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান হৃদয় রায়কে খ্রিস্টান ধর্মে অন্যদের ধর্মান্তরিতকরণের অপরাধে হত্যা করা হয়।
১৩. ২০০৫ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে কনসার্টে সাউন্ড ব্লাট এর মাধ্যমে অনুষ্ঠান পণ্ড করা হয়।
১৪. ২০০৫ সালের ১৭ই অগাস্ট সারাদেশে সিরিজ সাউন্ড ব্লাস্ট এর মাধ্যমে ইসলামিক আইন বাস্তবায়নের আহ্বান ও দাওয়াত পত্র প্রচার।
১৫. ২০০৫ সালের অক্টোবরে লক্ষ্মীপুর জেলার আদালতে হামলা। (আত্মঘাতি হামলা)
১৫. একই মাসে চট্টগ্রাম কোর্টে হামলা। (আত্মঘাতি হামলা)
১৬. ২০০৫ সালের নভেম্বর মাসে ঝালকাঠিতে তাদের ভাষায় মুরতাদ বিচারকের গাড়িতে হামলা। ২ জন বিচারক হত্যা। (আত্মঘাতি হামলা)
১৭. ২০০৫ সালের নভেম্বরে গাজীপুরে আদালতে হামলা। তাদের ভাষায় ত্বগুতের আদালত। (আত্মঘাতি হামলা)
১৮. নভেম্বরে নেত্রকোনা উদীচী অফিসে পাশে পুলিশের উদ্দেশ্যে হামলা। তাদের ভাসায় ত্বগুতের বাহিনী। (আত্মঘাতি হামলা)
১৯. ২০০৬ সালের অক্টোরব থেকে ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টঙ্গী, উত্তরা, গাবতলি, গুলিস্তান এলাকায় পুলিশের টহল বাহিনীর উপর গ্রেনেড হামলা করা হয়।
২০. ২০০৭ সালের ২৯ শে মার্চ বাংলা ভাই ও তার সঙ্গীদের ফাঁসি কার্যকরের পনের দিনের মাথায় তৎকালীন রাষ্ট্র-পক্ষের পিপি হায়দারকে গুলি করে হত্যা।
২১. ২০০৮ সালে “জামা’আতুল মুজাহিদীন” পরিচিত দাওয়াহ-এর ১৭ই অগাস্টের দাওয়াহর কারণ ও যৌক্তিকতার সিডি প্রকাশ।
২২. ২০০৯ সালের মে মাসে পুলিশের টহল বাহিনীর উপর গ্রেনেড হামলা।
২৩. ২০১৩ সালের ২১ শে ডিসেম্বর গোপীবাগের লুতফর রহমান ফারুকিসহ ৫ জন মুরিদকে হত্যা। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যারা খুন করেছে তাদের ব্রিগেডের নাম-ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ ব্রিগেড। (আগেই উল্লেখ করেছি ১৩ শতকে জন্ম নেওয়া সালাফিদের একজন গুরু সেই তাইমিয়া)
২৪. ২০১৪ সালের ২৩ ষে ফেব্রুয়ারিতে জেএমবির “শাইখ নাসরুল্লাহ ব্রিগেড” মুজাহিদদের মোমেনশাহী কোর্টে নেওয়ার সময় প্রিজনভ্যানে হামলা। বাংলাদেশে এই প্রথম পুলিশের উপর হামলা করে কারাবন্দীদের মুক্ত করার ঘটনা ঘটে।
২৫. ২০১৪ সালের ২৭ শে অগাস্ট চ্যানেল আই-এর উপস্থাপক ইসলামিক চিন্তাবিদ নুরুল ইসলাম ফারুকীকে হত্যা করে জেএমবির “আতাউর রহমান সানী ব্রিগেড”। ফারুকীর অপরাধ তিনি মাজার-পন্থী। আর সালাফিরা মাজার বিরোধী তা পূর্বেই উল্লেখ করেছি।
২৬. ২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর পি.ডি.বি. এর সাবেক চ্যায়ারম্যান পীর খিজির খানকে “হাফেজ মাহমুদ ব্রিগেড” হত্যা করে।
২৭. ২০১৬ সালের ২৫শে এপ্রিল বেলা ১১.৩০ ঘটিকায় সার্জেট ইন্সট্রাক্টর রুস্তম হাওলাদাকে হত্যা করা হয়। তাদের ভাষায় তার অপরাধ; মানব রচিত আইনে ইমানদারদের (জিহাদিদের) ফাঁসিসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়ায় সহায়তা করা।
২৮. ২০১৬ সালের ৭ই মে রাজশাহী জেলার তানোর খানাতে “আব্দুল আউয়াল ব্রেগেড” শহিদুল্লাহকে হত্যা করে।
তাদের নতুন বার্তায় নবী কিংবা ইসলাম নিয়ে কেউ কটূক্তি করলে তাদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান জানানো হলেও দেখা যাচ্ছে নাস্তিক লেখক ছাড়া তারা কোন ব্লগারের উপর হামলা করেনি। সুতরাং ব্লগারদের উপর যে হামলাগুলো হয়ে আসছে তা আইএস কিংবা জেএমবি করেনি করেছে আনসার বাংলা। যারা ভারতীয় আল-কায়দার শাখা হিসেবে নিজেদের পরিচয় নিচ্ছে। বাংলাদেশে প্রথম জঙ্গি হামলা করে জঙ্গি সংগঠন হুজি। হুজির মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামীলীগ। এছাড়া তারা আহমদিয়াদের মসজিদেও হামলা চালায়। যেমনটি-পাকিস্তানের তস্কর-ই-তৈয়বার মূল লক্ষ্য হচ্ছে আহমদিয়া সম্প্রদায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সশস্ত্র হামলা চালায় দুইটি সংগঠন এক. হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি), ২. জামা’ আতে মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। এছাড়া জেএমবির নামের সাথে মিল রেখে তাদের কিছু শাখা গ্রুপও ছিল। যদিও সবগুলোই নিয়ন্ত্রিত হতো জামা’আতে মুজাহিদীন-এর প্রধানের নির্দেশে। বাংলা ভাইয়ের ফাঁসি হওয়ার সাথে সাথে জেএমবি ধ্বংস হয়ে গেছে কিংবা স্থবির হয়ে গেছে এমটি ভাবা হলেও বাস্তবতা বলছে তারা তাদের কার্যক্রম আগের মতনই চালিয়ে যাচ্ছে। হুজির মতন সংগঠন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লেও জেএমবির কার্যক্রমে এতো বছরেও নিষ্ক্রিয়তা আসেনি। বরং বলা যায় সালাফি সুন্নি সংগঠন আইএসআইএস-এর সাথে কাঁধ মিলিয়ে বাংলাদেশে আরো শক্তিশালী জিহাদী দল হিসেবে আর্বিভূত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
©somewhere in net ltd.