নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আয়েশ করে, আলসেমিতে...

অলসদের দিয়ে কী আর হয়। আলসেমি ছাড়া!

মুনির হাসান

অলস লোক। নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার খায়েশ কিন্তু করতে পারি না!

মুনির হাসান › বিস্তারিত পোস্টঃ

পড়,পড়,পড়-৯

২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সকাল ১১:৪৭

পড়,পড়,পড়-৮



গাড়ি যখন শুভপুর ব্রিজের কাছে তখনই আমার ঘোরটা কেটে গেল। বুঝলাম এই সেই ব্রিজ। ১৯৮১ সালের মে মাসের শেষ ক’দিনে এই ব্রিজই হয়ে উঠেছিল ইতিহাসের এক অনন্য স্বাক্ষী। সেই সময়ে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিহত হোন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। চট্টগ্রাম থেকে বিদ্রোহী সেনা সদস্যরা শুভপুর ব্রিজের চট্টগ্রাম প্রান্তে অবস্থান নেয়। আর কুমিল্লা থেকে ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের সৈন্যরা অবস্থান নেয় ব্রিজের অপর প্রান্তে। দুই প্রান্তেই যুদ্ধাবস্থা। পরে যখন চট্টগ্রামের বিদ্রোহীরা বুঝতে পারে ঢাকা থেকে যাদের তাদের দলে যোগ দেওয়ার কথা তারা ভোল পাল্টেছে তখন থেকেই এই ব্রিজের দৃশ্য পাল্টাতে থাকে। এই এক বিরাট কাহিনী। এখন না বললে চলে।

ব্রিজ পার হতে হতে আমার ঘোর পুরোই কেটে গেল এবং মায়ের কথা মনে হতে শুরু করলো।

আমার মা আমার নানার পাঁচ মেয়ের মধ্যে চতুর্থ। আমার নানা, এই বঙ্গদেশের প্রথম মেডিকেল গ্র্যাজুয়েট, ১৯২৭

সালে গান্ধীর রেঙ্গুন সফরের সময় আবদুল বারী চৌধুরীর জাহাজ থেকে ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন, সেই নানা তাঁর এই মেয়ের বিয়ে দিতে রাজী ছিলেন না।

তাঁর ধারণা ছিল, আমার মা শুকনা বলে, সন্তান হওয়ার সময় মারা যাবে। এই ভয়ে তিনি যে কোন প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতেন। পরে আমার দাদী, দি ফিল্ড মার্শাল অব রাউজান হাজি বাড়ি, আমার নানীকে ম্যানেজ করে আমার বাবা-মা’র বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন।

আমার সেই মা, নানী আর নানার কারণে ছোটবেলা থেকেই খালি পড়তেন। আমার বুদ্ধি হওয়ার পর আমি দেখেছি মা সন্ধ্যা থেকেই কিছু না কিছু পড়ছেন। মা ১৯৬২-৬৩ সালে ময়মনসিংহের রাজবাড়িতে মেয়েদের টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড করেন। সেসময় চট্টগ্রাম থেকে ময়মনসিংহ যেতে ক'দিন লাগতো? তার আগে কিছুদিন অপর্ণা চরণ স্কুলে মাস্টারী করেন। বিএড করে আসার পর যোগ দেন ডা. খাস্তগীর বালিকা বিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই অবসর নেওয়া। মা’র পড়ার অভ্যাসই আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। বাসার নানান জায়গায় নানান রকমের বই পড়ে থাকতো। মা’র এই অভ্যাসের সঙ্গে দ্যোতনা ছিল দাদা শিক্ষাবিদ আহমদ চৌধুরীর পড়া আর পড়ানোর অভ্যাস। কাজে, আমাদের বাসার আলাপ আলোচনার সিংহভাগ জুড়ে থাকতো পড়ালেখা সংক্রান্ত নানান বিষয়। যেমন আজকের পত্রিকার কোন লেখাটার কী গুন, আনন্দ মেলার কোন গল্পটা কেমন এই সব।

বাবার একটা বই-এর আলমিরা ছিল। সেই আলমিরাতে কেরি সাহেবের মুন্সী, শরৎ রচনাবলী থেকে শুরু করে কুয়াশাও ছিল। আমার এখনো মনে আছে কুয়াশা-৩ এর প্রচ্ছদে এক মিশরীয় নৃত্যশিল্পীর ছবি ছিল। তাই প্রথমে আমি ভেবেছিলাম এটি বোধহয় বড়দের বই। কিন্তু পড়তে পড়তে দেখা গেল আমিও পড়তে পারি (আমি তখন ফোর বা ফাইফে পড়ি)। সিক্স থেকে আমরা পড়তে শিখে গেলাম কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা। সেই সময় খোঁজ পাই রাইফেল ক্লাবের সামনে থেকে বই ভাড়া নেওয়া যায়। ৫০ পয়সা দিলে একটা বই পড়া যায়।

তো, বই পড়া, কিংবা সিনেমা দেখার জন্য যত টাকা-পয়সা দরকার সব কোথায় পাবো? কোন বাবা-মা ছেলেকে বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখার টাকা দেন? দেন না। খালি আমার মা দেন। মা বলতেন – যেখানেই যাবি মাগরিবের আজানের আগে বাসায় ফিরবি, কোথায় যাচ্ছিস আমাকে বলে যাবি এবং টাকা পয়সা লাগলে নিয়ে যাবি। কাজে সিনেমা দেখার জন্য টাকা পয়সার কোন অভাব হয়নি। এডমিরাল ইয়ামামাটো দেখেছি বন্ধুদের সঙ্গে, বড় মামা আমাদের সবাইকে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন দ্যা ব্রিজ অন দি রিভার কাওয়াই। এই সব সিনেমা দেখতাম আর বাবা-মার কাছে শুনতাম উত্তম-সুচিত্রার সিনেমার কথা। বাবার কাছে শুনেছি তিনি ১৭ বার সাগরিকা দেখেছিলেন। এবং একদিন সব শো’ই দেখেছিলেন। বাবার থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে ১৯৮১ সালে, সার্কের উদ্বোধনের সময় আমি খালার বাসাতে এসে সারাদিনে দেখেছি – মর্নিং-এ জোনাকি সিনেমা হলে শ্যামলী (উত্তম কুমার), ম্যাটিনিতে আনন্দ সিনেমা হলে সোল ভা সাল (দেবানন্দ), সেখান থেকে বাসায় গিয়ে শুনলাম টেলিভিশনে পাশের বাড়ি (কিশোর কুমার – মেরে সামনে ওয়ালি খিড়কি মে) দেখাবে। সেটা শেষ হল সাড়ে আটটার সময়। ফোন করলাম কাকরাইলের সিনেমা হলে। বললাম নাইট শো’র টিকেট আছে কিনা। এবং দেখলাম “সাগরিকা”। এবং দেখা গেল বাপ-ছেলের পছন্দের ডায়ালগ সেইম--চিনি ক’চামচ?-চিনি? লাগবে না। ঔ সুন্দর হাত দিয়ে নেড়ে দেন। তাতেই মিষ্টি হয়ে যাবে।







তো, এই আমার মা, আমার নানার অতি আদরের মেয়ে, গান গাওয়ার শখ। কলেজে পড়ার সময় গাইতেন – কাজলা দিদি আর নদী আপন বেগে পাগল পাড়া, ছেলেরা কাজলা দিদি বলে ক্ষেপাতো (এই ছেলেদের মধ্যে সবচেয়ে দুষ্টুটি ছিলেন মুহম্মদ ইউনুস, রাজা মিয়া সওদাগরের জুয়েলারি শপের অন্যতম জুয়েল), সেই মা এসে পড়েন আমার বাবাদের রক্ষণশীল ফ্যামিলিতে। ৪ দেবর আর দুই ননদ !!! কিছুদিনের মধ্যে মা’র হারমোনিয়াম নষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু মা পড়ার অভ্যাসটা ধরে রাখলেন। আর আমাদের মধ্যে সেটি সঞ্জারিত করেছেন। কোনদিন এমনকি আমাদের কোন বকাও দিতেন না। ১৯৭০ সালে আমার বাবা জার্মানী থেকে একটা টেলিভিশন এনেছিলেন। ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম কেন্দ্র চালু হওয়ার পর থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় নিয়ম করে টেলিভিশন দেখাটা হয় আমাদের হবি। কেও আপত্তি করে না। সেই সময় দেখে ফেলেছি হাওয়াই ফাইফ-ও, টারজান, দি ম্যান ফ্রম ইউএনসিএলই, দি ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্ট সহ সব বিখ্যাত মুভি। প্রতি শনিবার দেখানো হত চমৎকার সব সিনেমা। দি সাউন্ড অব মিউজিক, দি ক্রেনস আর ফ্লাইং, অপুর সংসার, ব্যালাড ফর ও সোলজার- কী নয়। এবং সব কিছু দেখতে পারতাম মা’র প্রশ্রয়ে।গাড়ি যতই চিটাগাং-এর দিকে আসছিল ততই আমার মনে হচ্ছিল আমি যদি বুয়েট থেকে না পড়েই ফেরৎ আসি তাহলে সব দোষ হবে আমার মা’র। সবাই মাকে বলবে – আশকারা দিয়ে দিয়ে ছেলেকে মাথায় তুলেছো। এখন বোঝ?বাবা বলবেন – আমি তো আগেই বলেছি। তুমি ডাক্তারী পড়। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার দরকার নাই।খবর পেয়ে আমার চাচা (ততদিনে পাকশী বদলি হয়েছেন, ইঞ্জিনিয়ার বলে ছোটবেলায় ইনি চাচা ডাকতাম) এসে বোঝানোর চেষ্টা করবেন – তুমি পারবা। আবার ফেরৎ যাও। কিন্তু ঠিকই মা’কে কথা শুনিয়ে যাবেন। সবাই বলবে ছেলে মানুষ করার ব্যাপারে আমার মায়ের যে তত্ত্ব সেটা মোটেই ঠিক নয়। ছেলেদের মাইরের ওপর রাখতে হয়। মাইরের নাম লহ্মীকান্ত! যদি ছোটবেলা থেকে মা আমারে মাইরের ওপর রাখতো তাহলে আজকে আমার এই ভিমরতি হতো না।আমি বুঝলাম, আমার নিজের জীবনের সহজতার জন্য আমি যে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি তা আমাদের বাড়িতে আমার মা’র অবস্থানকে একেবারে শূণ্য করে দেবে। আমার আদরের মা’কে সবাই গঞ্জনা দেবে আমার কারনে। এটি কী আমি পারবো?



মা খুব সকাল বেলায় বাসা থেকে বের হয়ে যান। কিন্তু ঐদিন রূপালীর বাস অনেক আগেই চাটগাঁ পৌছে গেল (তখন ডাকা চট্টগ্রাম ১৭ ঘন্টা লাগতো না!)। আিমযখন বাসায় ঢুকি তখন মা রেডি হয়ে স্কুলে যাচ্ছিলেন। আমি মা’কে জড়িয়ে ধরলাম। মা জানতে চাইল – কীরে? ভার্সিটি বন্ধ?-জী। দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ হয়েছে। আমি তোমাদের সঙ্গে ছুটি কাটাতে এসেছি।



[আগামী পর্বে সমাপ্য]



পাদটীকা : ১৯৫০ এর দশকে বিউটি বোর্ডিং-এর কবিরা অগত্যা নামে একটি মাসিক সাময়িকী প্রকাশ করতেন। সম্পাদক ছিলেন সম্ভবত ফজলে লোহানী। সেখানে একবার কোন এক কবির (সৈয়দ শামসুল হক?) একটি ধারাবাহিক উপন্যাস ছাপা হচ্ছিল। তো, এক পর্ব শেষ হলে যেখানে রাত হয়ে গেছে দেখে নায়িকাকে নায়কের বাসায় রাত কাটাতে হবে। এই জন্য মশারী -টশারী ইত্যাদি খোজাখুজি করছে নায়ক। কিন্তু পরের পর্ব শুরু হল নায়কের বাসায় সকালে নায়ক নায়িকা চা খাচ্ছে এই দুশ্য থেকে। তখন অনেক পাঠক চিঠি লিখে মধ্যবর্তী সময়ে কী হয়েছিল সেটি জানতে চান। তখন পরের পর্বে সম্পাদক উপন্যাসের শুরুতে একটি ঘোষণা দিলেন-



সম্পাদক দায়ী নহেন

এই উপন্যাসের আগের আগের পর্বের শেষ এবং আগের পর্বের শুরু মাঝখানে যা কিছু ঘটুক না কেন, তার জন্য সম্পাদক দায়ী নহেন।





সবার সেকেন্ড ডিফারেন্সিয়াল নেগেটিভ হোক।

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৪:৫৫

মামুন রশিদ বলেছেন: লেখাটা শেষ হলে পুরোটা এক সাথে পড়ব । শুভ কামনা ।

০৩ রা মার্চ, ২০১৪ রাত ৯:৪১

মুনির হাসান বলেছেন: শেষ পর্ব দিয়ে দিয়েছি, মামুন! ধন্যবাদ।

২| ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ২:৪৯

গ্রীনলাভার বলেছেন: ++ স্যার।

৩| ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৩২

ইলুসন বলেছেন: ভালো লাগছে আপনার জীবনে গল্প পড়তে। আগামী গল্পে কী হবে ভেবে মজা পাচ্ছি।

০৩ রা মার্চ, ২০১৪ বিকাল ৩:১৭

মুনির হাসান বলেছেন: গল্প শেষ!!!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.