![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার।
১.
ভগবানের লীলা বোঝা বড় দায়।
যে ব্রাক্ষ্মন পুত্র, অদ্য পুজোর প্রসাদ চুপিসারে খাইতেছে, কেহই বলিতে পারিবে না যে, সে পুরোহিত হইয়া অচিরেই পুজো শুরু করিবে না।
ভগবান, অশ্বিনী রায় ও মৃনালিনী দেবীর ঘর আলো করিয়া একটি পুত্র সন্তান পাঠাইতে, কোনো এক অজানা খেয়ালে, নিজেই তাহাকে গড়িতে বসিয়াছেন। মেয়েদের গাত্রবর্ণ পিতামাতারা দুধে আলতা কামনা করিলেও, ভগবান ছেলেটিকে সেই রংই দিলেন। সম্মুখে ধাবমান তীক্ষ্ণ নাক, কাকের চাইতেও কালো বর্ণের কেশ, চক্ষু দুইটি ভরা ভালবাসা। জন্মের পরে দেখিয়াই বোঝা গিয়াছিল যে, ছেলে দৈহিক গঠন ও উচ্চতায় বংশের শ্রেষ্ঠ তাহার পিতা যে অশ্বিনী রায়, তাহাকেও ছাড়াইয়া যাইবে।
কার্তিক মাসে জন্মগ্রহন করায়, মৃনালিনী দেবী, স্বামীর পরিবারের রীতি অনুযায়ী, নিজেই পুত্রের নাম রাখিলেন কার্তিক রায়। পিতা মাতা জন্মের পর হইতেই ভগবানের নিকট সহস্র পুজা দানে, এইরকম পুত্র প্রাপ্তির কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিলেন।
সন্তান বড় হইবার সাথে সাথে তাহার - ব্যাবহার, বিবেচনা, মানবতা ও মনের উদারতা দেখিয়া সবার মনে একটিই প্রশ্নেরই উদ্রেগ হয় -
- "ভগবান নিজ হস্তে তৈয়ার করিলেন ঠিকই, কিন্তু কি করিয়া তাহার স্মরন শক্তির জায়গাটি একেবারেই অপূর্ণ রাখিয়া দিলেন?"
ভগবানের লীলা বোঝা বড় দায়।
২.
সর্বপ্রথম কার্তিকের মাতা মৃনালিনী দেবীর মুখে কালো মেঘের ন্যায় কিঞ্চিত ছায়া দৃশ্যমান হইল। কার্তিকের তখন বছর দুয়েক বয়স হইবে। শুধুই মা ডাকিতে শিখিয়াছে। এমতাবস্থায় মৃনালিনী দেবী, কার্তিকের তর্জনীখানি নিজ কপালের টিপের উপর রাখিয়া বলিলেন -
- বাবা, বল "কাজল" ।
প্রায় অর্ধপ্রহর ব্যায় করিবার পরে কার্তিক স্পষ্ট উচ্চারনে বলিল -
- কাজল।
মৃনালিনী দেবীর অন্তরে এই আনন্দ বেশীক্ষন স্থায়ী হইল না, যখন কার্তিক নিজের কপালে তর্জনী রাখিয়া, মাকে ডাকিতে শুরু করিল -
- কাজল।
- বল বাবা, মা।
- কাজল।
অতঃপর, আরো অর্ধ প্রহর ব্যায় করিবার পরে, কার্তিক কাজল ভুলিয়া, তর্জনী কপালে স্পর্শ করিয়া যেন, ইহা তাহার কপালের লিখন বুঝাইবার পরে তাহার মাতাকে ডাকিল -
- মা।
মৃনালিনী দেবী কিঞ্চিত চিন্তিত হইলেও কার্তিকের বাবাকে এ ব্যাপারে কিছুই বলিলেন না।
ঐ ঘটনার হপ্তাহ দুয়েক পরেই, কার্তিককে তাহার পিতা খানিকক্ষন তিনটি খেলনা হইতে দুইটি ঘুষের ন্যায় প্রদান করিয়া, প্রায় ঘণ্টা খানেক সময় ব্যায়ে বাবা ডাকিতে শেখাইলেন। কার্তিক প্রথমবার স্পষ্ট উচ্চারনে বাবা ডাকিলে, পিতা অশ্বিনী রায়ের আঁখি দুটি হইতে জল নির্গমিত হইয়া কপোলে আসিয়া ঠেকিল। তিনি উচ্চ স্বরে চিৎকার করিয়া বলিলেন -
- মৃনালিনী, মৃনালিনী।
মৃনালিনী আসিয়া দেখিলেন, তাহার পুত্র পিতার দাড়িতে হস্তখানি বুলাইয়া বাবা ডাকিতেছে। মৃনালিনীকে দেখিয়া কার্তিক, তর্জনী কপালে স্পর্শ করিয়া ডাকিল -
- বাবা।
অশ্বিনী রায় বলিলেন -
- বাবা, বল মা।
- বাবা।
অতঃপর শেষ খেলনাখানি ঘুষ দেবার পর, খানিকক্ষনের চেষ্টায় কার্তিক আসিয়া মৃনালিনীর থুতনিতে হাত দিয়া, যেন পিতা অশ্বিনী রায়ের দাড়িতে হাত বুলাইতেছে, এমন ভঙ্গিমায় মাতাকে ডাকিল -
- মা।
অশ্বিনী ও মৃনালিনী দেবী ভাবিলেন, বয়সের সহিত সবই ঠিক হইয়া যাইবে।
ভগবানের লীলা বোঝা বড় দায়।
৩.
গঙ্গায় জল বহিয়া চলিল, কার্তিকও বড় হইতে থাকিল। কিন্তু, তাহার স্মরনশক্তির ভাণ্ডার শূণ্যই রহিয়া গেল। অতঃপর, ভগবানের কৃপায় হউক, কিংবা ভগবানের সৃষ্ট কড মাছের যকৃতের তৈল, ভিটামিন সি যুক্ত ফল, থানকুনি পাতার রস সহ যাবতীয় পথ্যই হউক, আর তাহার সহিত পুজোর ঘরের পুজোর সাথে ব্রাক্ষন শিক্ষকের আপ্রান চেষ্টাতেই হউক, কার্তিক -
- মাকে মা, বাবাকে বাবা সহ নিকটাত্নীয় ও বন্ধুবান্ধব, পাড়া প্রতিবেশীর নাম মনে রাখিতে পারিল। অতীব আশ্চর্য্য ও আনন্দের বিষয় এই যে, কার্তিক যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ সহ হিসাব নিকাশও শিখিয়া ফেলিল। পাঠশালা পাশ করিতে না পারিলেও, ইহা কার্তিকের পিতা মাতার মনে কোনরুপ কষ্টের আগমন না ঘটাইয়া, বরঞ্চ আনন্দের বন্যায় ভাসাইল। অশ্বিনী রায়, পৈতৃক ব্যাবসার প্রসার ঘটাইয়া অনেক বড় অবস্থায় আনিয়াছেন। অশ্বিনী ও মৃনালিনী দেবীর একমাত্র সন্তান কার্তিক, শুধু হিসাব রাখিতে পারিলেই যে, তিন পুরুষ বসিয়া খাইতে পারিবে, তাহা হলপ করিয়া বলা যায়।
ধীরে ধীরে কার্তিক বিশ বছরে পা রাখিল। সৌন্দর্য্য বিবেচনায় কার্তিকের সমকক্ষ কন্যার সন্ধান যে মিলিবে না, তাহা সকলেই জানিত। তদুপরি, সার্বিক দিক বিবেচনায়, দক্ষিনে নারায়নপুর গ্রামের মধ্যবিত্ত কিন্তু শিক্ষিত ঈশ্বর চন্দ্র রায়ের কনিষ্ঠা কন্যা, শ্রীমতি বিন্দুবালাকে যোগ্য কন্যা হিসাবে মনোনীত করিল সবাই কষ্টি পাথরে যাচাই বাছাই করিয়া। কার্তিকের স্মরনশক্তির ঘাটতির কথা জানিয়াও, প্রস্তাব দেওয়া মাত্রই ঈশ্বরচন্দ্র খুশী মনে এই বিয়েতে রাজী হইয়া গেলেন। ধুমধামের সহিত শ্রীমতী বিন্দুবালার সহিত কার্তিকের বিবাহ হইয়া গেল, পৌষ মাসের এক শুভলগ্নে।
মাঘ পেরিয়ে ফাল্গুনেই বিন্দুবালা একদিন বাড়ীর আঙ্গিনায় হটাৎ মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া গেল। তাহার এই মাথা ঘোরা, অশ্বিনী রায়ের বংশে বাতি আসার সন্দেশ হইয়া অতি দ্রুত অশ্বিনীর নিকট পৌঁছাইয়া গেল। অশ্বিনী রায়ের বাড়ীর সর্বত্র আনন্দ কোলাহলে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল।
ভগবানের লীলা বোঝা বড় দায়।
৪.
বিন্দুবালার সাত মাসের সময়ে, অশ্বিনী দত্ত তাহার পরিবারের সবচাইতে বৃহৎ অনুষ্ঠানটির আয়োজন করিলেন। বিশাল ধুমধাম করিয়া সাত খাওয়ানোর পরে, রীতি অনুযায়ী, বিন্দুবালা তাহার পিতামাতার সহিত সন্তান প্রসবের উদ্দেশ্যে পিত্রালয়ে গমন করিল।
মাস দুয়েক পরে কার্তিককে তাহার পিতামাতা পাঠাইলেন শ্বশুড়ালয়ে। বিন্দুবালার তখন নয় মাস। কার্তিক রওনা করিবার পূর্বেই মৃনালিনী বলিলেন -
- বাবা কার্তিক, অবশ্যই মনে করিয়া তুমি, সন্তানের নাম বিন্দু কি রাখিবে? তাহা জানিয়া আসিবে। পরিবারের রেওয়াজ অনুযায়ী আমি তাহা বিন্দুবালার উপরেই ছাড়িয়া দিয়াছি।
কার্তিক মাথা নাড়িয়া সম্মতি প্রকাশ করিয়া রওনা করিল। মৃনালিনী দেবী - মা দুর্গা, মা দুর্গা বলিবার পূর্বে কার্তিককে তাহার সন্তানের নামখানা জানিয়া আসিতে আরেকবার স্মরন করাইয়া দিলেন সঙ্গত কারণেই।
এদিকে ঈশ্বরচন্দ্র, কন্যা বিন্দুবালার সন্তান প্রসবের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত প্রস্তুতিই সম্পন্ন করিয়াছেন। কোন ফাঁক রাখিবার মানুষ ঈশ্বরচন্দ্র নহেন। একরাত শ্বশুরালয়ে অবস্থান করিবার পরে, নিজ বাড়ীতে গমনের উদ্দেশ্যে কার্তিক প্রস্তুতি গ্রহন করিল। কার্তিক শ্বশুরালয়ে মহা আদর আপ্যায়নের সহিত, তাহার অনাগত সন্তানের কথা ভাবিয়া আনন্দ ধারায় ডুবিয়া থাকিল। তাই, তাহার মায়ের প্রশ্নখানি বিন্দুবালাকে জিজ্ঞেস করিতে ভুলিয়া গেল। পক্ষান্তরে, ফিরিবার সময় তাহার শ্বাশুড়ি তাহাকে চায়ের সহিত পিয়াজু ভক্ষন করিতে দিলে, পিয়াজুর স্বাদ কার্তিকের ঠোঁট কোনভাবেই ভুলিতে পারিল না। তাই, আসিবার সময় শ্বশুর শ্বাশুড়িকে প্রনাম করিয়া, কার্তিক শ্বাশুড়ি মাতাকে জিজ্ঞাসা করিল -
- মাতা, চায়ের সহিত খাইতে দিয়াছিলেন যাহা, তাহার নাম কি হয়?
- ইহাকে পিয়াজু বলে।
শ্বাশুড়ি কার্তিকের স্মরনশক্তি সম্মন্ধে অবগত থাকায়, সন্ধি বিচ্ছেদ করিয়া দিলেন -
- পিঁয়াজ + উ। বাবা, পিঁয়াজের নাম মনে রাখিলেই চলিবে। তারপরে ব্যাথা পাইবার ভঙ্গিতে উ বলিতে হইবে।
ভগবানের লীলা বোঝা বড় দায়।
৫.
কার্তিক বাড়ী ফিরিবার পথে, সারাটি রাস্তা বিরবির করিয়া পিঁয়াজ বলিতে লাগিল। বাড়ীর নিকটে একটি ছোট্ট খাল, গজ চল্লিশেক লম্বা হইবে হয়তোবা। সেই খালের মাঝামাঝি হাঁটু পানিতে আসিয়া, হটাৎ কার্তিক পিঁয়াজের নাম ভুলিয়া বসিল। হতভম্ব হইয়া সে উক্ত স্থানেই দন্ডায়মান থাকিল। বাড়ী নিকটে হওয়াতে, পরিচিত পাঁচ ছয় জন মানুষ আসিয়া উপযাচক হইয়াই কার্তিককে বলিলেন -
- বাবা কার্তিক, তুমি কি কিছু হারাইয়াছ?
কার্তিক জ্বী বলাপূর্বক মস্তক নাড়িয়া সায় দিল।
অতঃপর, তাহারা জিজ্ঞাসা করিল -
- কোথায়?
- এই স্থানেই বটে।
তৎক্ষনাত সবাই হাঁটু পানিতে, দুই হস্ত ডুবাইয়া, কার্তিকের হারানো শব্দটিকে খুঁজিতে লাগিল। কার্তিকও দাড়াইয়া না থাকিয়া খুঁজিতে শুরু করিল। তাহা কি আর পাওয়া যায়?
হটাৎই একজন শরীর হইতে দূষিত বায়ু ত্যাগ করিয়া বসিল। তাহার পিছনেই পানিতে হাত ডুবাইয়া মুখমন্ডল খুবই সন্নিকটে রাখিয়া যে ব্যাক্তি হারানো শব্দ খুঁজিতেছিলেন, তিনি বলিয়া বসিলেন -
- কোন রাবন পুত্র, লজ্জা শরমের মাথার সহিত পিঁয়াজ ভক্ষন করিয়া, এই কর্ম সাধন করিল?
তৎক্ষনাত, কার্তিক পানির নীচ হইতে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত তুলিয়া বলিল -
- পাইয়াছি, পাইয়াছি।
ধনী ব্যাবসায়ী পুত্রের এই হাঁটু পানিতে কিছু হারাইলে, তাহা স্বর্ণের আংটি জাতীয়ই কিছু হইবে বৈকি। তাহাদের মত হত দরিদ্র লোকরা হারাইবে কাঁঠাল। যাহা মুষ্ঠিবদ্ধ না হইলেও খুঁজিয়া পাইতে সহজ। তাই, বাকী সকলেই মা দুর্গা, মা দুর্গা বলিতে বলিতে নিজের কর্মে মনোনিবেশ করিতে চলিয়া গেল।
ভগবানের লীলা বোঝা বড় দায়।
৬.
কার্তিক তাহার হারানো শব্দ পুনরুদ্ধারের পরে, আর কোনভাবেই তাহা হারাইতে রাজী নহে। তাই, মুষ্ঠিবদ্ধ অবস্থাতেই কার্তিক, বাড়ীর পানে দৌড়াইয়া চলিল।
বাসার বাহিরে কার্তিককে বরণ করিতে তাহার পিতা অশ্বিনী রায় দাড়াইয়া ছিলেন। কার্তিককে দেখিয়া তিনি, উচ্চ রক্ত চাপের রোগী হওয়া সত্বেও, অধিক উত্তেজনায় চিৎকার করিয়া দৌড়াইয়া আসিলেন। কার্তিক কাছে আসিবা মাত্রই অশ্বিনী রায় কার্তিককে জিজ্ঞাসা করিলেন -
- কার্তিক, কি নাম রাখিয়াছে আমার নাতির?
- বাবা, পিঁয়াজ।
"পিঁয়াজ" শব্দটি মুখ হইতে বাহির হইবার পরেই, কার্তিক আর ব্যাথা পাইবার ভঙ্গিতে "উ" বলিবার কোন সময়ই পাইল না। তাহার পূর্বেই, পিতামশাই সেই "উ" বলিয়াই, কর্তিত কলাগাছের ন্যায় মাটিতে পড়িয়া গেলেন। তাহার হৃদপিন্ড কোনভাবেই তাহার নাতির নাম "পেঁয়াজ" বলিয়া মানিয়া লইতে না পারিয়া, শরীরে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ করিয়া দিল। কার্তিক তাহার প্রানপ্রিয় পিতার এহেন অবস্থা দেখিয়া, নিজেও জ্ঞান হারাইয়া ভুপাতিত হইল। বলা বাহুল্য, তাহাদের এই কথোপকথনের সাক্ষী কেহই উপস্থিত ছিল না। তাই অশ্বিনী রায়ের মৃত্যুটা সবার নিকট তাহার অধিক উত্তেজনার ফলে, উচ্চ রক্ত চাপ জনিত মৃত্যু বলিয়াই গন্য হইল।
কিছুদিন আগে মৃনালিনী দেবী তাহার স্বামী অশ্বিনী রায়কে জিজ্ঞেস করিয়াছিল -
- আমি কার্তিকের জন্মের সময় মনে মনে ভগবানের নিকট পুত্র সন্তান চাহিলেও, তোমার ইহাতে কোন মত ছিল না। অতঃপর তোমার উপরে চাপ প্রয়োগ করিলে, তুমি বলিলে -
- ভগবান, যাহাই দিবেন তাহাতেই আমি খুশী। তবে যদি বলিতে বল, তাহা হইলে বলিব - কন্যা সন্তান আমার আকাঙ্খা।
সেই তুমি আজ কেন বারংবার আমার নাতি, আমার নাতি করিয়া চলিয়াছ?
উত্তরে অশ্বিনী রায় বলিয়াছিলেন -
- মৃনালিনী, আমার অন্তর আমাকে বলিয়াছে, অশ্বিনী, তুমি নাতি পাইবে। আমি গত তিন রাত্রি নাতিকে দেখিয়াছি।
কার্তিকের জ্ঞান ফিরিবার পরে, তাহার পিতা স্বর্গে গমন করিয়াছে শুনিয়া, পুনরায় জ্ঞান হারাইয়া ফেলিল। কার্তিকের সেই জ্ঞান ফিরিয়া আসিবার পরেই সকলে শ্মশানে রওনা করিল।
শোকের বাড়ীতে কেহই আর কার্তিককে তাহার পিতার এই হটাৎ মৃত্যু সম্মন্ধে কিছুই জিজ্ঞাসা করিল না এবং এই প্রসঙ্গও পুরো বাড়ীতে আর একটিবারের জন্যও উত্থাপিত হইল না।
ভগবানের লীলা বোঝা বড় দায়।
৭.
বিন্দুবালা একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিল। শোকের বাসায় যেন প্রান ফিরিয়া আসিল। মৃনালিনী দেবী স্বামী হারানো অপূরনীয় কষ্টেও যখন দেখিলেন, নাতির নাকে ঠিক তাহার দাদার মত একটা তিল রহিয়াছে, কপালের পাশে সেই একই জন্মদাগ বিদ্যমান, মনে মনে ভাবিলেন -
- তাহার স্বামী, নাতি হয়ে পূনঃজন্ম গ্রহন করিয়াছেন।
কিন্তু মুখে তিনি কিছুই বলিতে পারিলেন না।
বিন্দুবালার মা সকলের উপস্থিতিতে, তাহার একটি ইচ্ছা পোষন করিলেন -
- কার্তিকের বাবা কি করিয়া বারংবার বলিতেন যে, আমার নাতি, আমার নাতি? তিনি তো বরাবরই কন্যা সন্তানের আগমনের অপেক্ষায় থাকিতেন! নিশ্চয়ই ভগবানের কৃপায় তিনি স্বপ্নে নাতি দর্শন করিয়াছেন। কার্তিকের বাবা আশ্বিন মাসে জন্মগ্রহন করায়, তাহার পিতামাতা তাহার নাম অশ্বিনী রায় রাখেন। কার্তিকের ছেলে কার্তিকে জন্মগ্রহন না করিয়া, সেই আশ্বিনেই জন্মগ্রহন করিল। তাই কার্তিকের বাবার মত বড় মনের মানুষ হইতেই, কার্তিকের ছেলের নাম, তহার দাদুর নাম "অশ্বিনী রায়" রাখিবার প্রস্তাব করিতেছি।
উভয় পরিবার, এই প্রস্তাবখানি সাদরে গ্রহন করিল। সবচেয়ে বেশী খুশী হইল মৃনালিনী ও কার্তিক। দুইজনই তাহাদের হারানো পরম ধন, এই দেবশিশুর মধ্যে খুঁজিয়া পাইতে শুরু করিল।
কার্তিক ও মৃনালিনী যাইবার আগের দিন, কার্তিকের শ্বাশুড়ি পেঁয়াজু ভাজিলেন, কিছুটা গোপনীয়তা রক্ষা করিয়া। বেয়াইন বেধবা হওয়ায়, তাহার এখন পেঁয়াজ বর্জনীয় খাদ্য। জামাইয়ের কথা চিন্তা করিয়া তিনি পেয়াজু ভাজিবার পরে, তাহা নিজ ঘরে বিন্দুবালাকে দিয়া পরিবেশন করিলেন।
কার্তিক, এক চিমটি কামড় দিয়া আর পেঁয়াজু মুখে লইল না। এক ফাঁকে কার্তিককে তাহার শ্বাশুড়ি জিজ্ঞাসা করিলেন -
- বাবা কার্তিক, তুমি তো একখানি পেঁয়াজুও খাইলে না বাবা।
- মাতা, আপনি মনে হয় ভুলিয়া গিয়াছেন যে, আমি পেঁয়াজ খাইতে পছন্দ করি না।
- কি বলিতেছ বাবা? তুমি কি তোমার মাতাকে গতবার এইখান হইতে যাইবার পরে পিঁয়াজুর কথা বল নাই?
- কিসের পিয়াজু? কিসের কথা?
শ্বাশুড়ী দমিয়া গেলেন। ভাবিলেন, জামাইয়ের স্মরনশক্তির স্বল্পতার কথা। পরক্ষণেই মনে হইল -
- জিহবার স্বাদের সহিত স্মরনশক্তির কোন সম্পর্ক তো থাকিবার কথা নহে!
ভগবানের লীলা বোঝা বড় দায়।
৮.
পেঁয়াজের ব্যাপারে বিন্দুবালা তাহার মাতার মত অবাক হইলেও, সবচাইতে বেশী খুশী হইয়াছে সে। মৃনালিনী বিধবা বিধায়, পেঁয়াজ খাওয়া বন্ধ করিল। বাসায় কার্তিক ও বিন্দুবালা পেঁয়াজের গন্ধ সহ্য করিতে না পারায়, পেঁয়াজ শব্দটা অশ্বিনী রায়ের আত্নার সহিত এই বাড়ী হইতে হারাইয়া গেল।
ভগবানের লীলা বোঝা বড় দায়। অশ্বিনী রায় পরলোক গমনের সময়, এই বাড়ী হইতে তাহার হন্তাকারক পেঁয়াজকে লইয়া চলিয়া গেলেন। তাহার বিনিময়ে একটি জিনিস প্রদান করিয়া গেলেন সুদে আসলে। এই পরিবার ও অত্র গ্রামের কেহই তাহা বিশ্বাস করিতে পারিতেছিল না। অশ্বিনী বাবুর মৃত্যুর পরে তাহাদের পুরনো বিশ্বস্ত কর্মচারী নির্মল রায়, ব্যাবসায় কার্তিককে সহায়তা করিতে লাগিলেন। কার্তিক তাহার পিতৃদেবের ন্যায় নির্মল কাকাকেও শ্রদ্ধা করে। নব অশ্বিনী রায়ের প্রথম জন্মদিবসের পরের দিন, নির্মল কাকা, কার্তিককে বলিলেন -
- বাবা কার্তিক, বয়স হইয়াছে তো, তাই গত হপ্তাহের বাকীর খাতা হালনাগাদে কোন ভুল হইয়াছে কিনা, তাহা যদি একবার মনে করিয়া দেখিতে পার?
- জ্বী কাকা। বাকীর খাতাখানিতে কার্তিক একবার মাত্র চোখ বুলাইয়া খাতাটি নির্মল কাকাকে ফেরত দিল। অতঃপর কার্তিক বলিল -
- কাকা, যে সমস্ত বাকী আপনি খাতায় লিখিতে ভুলিয়া গিয়াছেন, তাহা আমি বলিতেছি, আপনি লিখুন -
- আশ্বিনের ১২ তারিখে, দক্ষিন পাড়ার হেমন্ত কাকা তৈল ১ টাকা ২০ পয়সা, পশ্চিমের নারুর পিসোমশাই ঘৃত ৩ টাকা ১৫ পয়সা, আশ্বিনের ১৪ তারিখে ......। কার্তিক, মাথা হইতে একের পর এক বাকির বিপরন বাহির করিয়া বলিয়া চলিল, আর নির্মল কাকা, তাহার ঝরনা কলম হইতে কালি নির্গমনে তাহা লিখিয়া চলিলেন।
- "ভগবানের লীলা বোঝা বড় দায়।"
২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৩:০২
বিজু চৌধুরী বলেছেন: একমত। নতুন কিছু নেই। সাধু ভাষায় হাত পাকানোর চেষ্টার সাথে কিছুটা রম্য বিষয়ক লিংখতে চেষ্টা করেছি। অসংখ্য ধন্যবাদ।
২| ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ভোর ৫:০৯
ডঃ এম এ আলী বলেছেন: গল্পটা প্রথম থেকে শেষ অবধি ভাল লেগেছে ।
শুভেচ্ছা রইল ।
২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৩:০২
বিজু চৌধুরী বলেছেন: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১|
২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ভোর ৪:৩৫
চাঁদগাজী বলেছেন:
ভালো লাগছে, তবে এখনো নতুন কিছুর সৃস্টি হয়নি