![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
‘লক্ষ্মীপুরের মত জায়গায় আদার ব্যবসা করে কোটিপতি। তুই যাই বলিস না কেন বেটা একখান জিনিস।বাচ্চাগুলো দেখেছিস কি মেধাবী। তোর ছোট বোনের সঙ্গে তার একটা মেয়ে পড়ে। তাইতো এলাম তোর বোনের আকিকায় তাদের দাওয়াত করতে।তার ছেলে নেই দুটো মেয়ে একটা রুমকির সাথে ফাইভে পড়ে আর একটা ছোট ক্লাস থ্রি শুনেছি সেও মেধাবী ক্লাসে ফার্স্ট।’
নিজের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নাতিকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এসব কথা বলছিলেন বয়োবৃদ্ধ ফজলু মিয়া।
নাতি ফরিদ বললো- আচ্ছা ওসব রাখো। চলো দাওয়াত দিয়ে আরো কয়েক জায়গায় যেতে হবে। আর ওনাকে আমার একটা কবিতার বই দিও।
এরপর দুই দাদু-নাতী আদার আড়তে ঢুকলেন। আড়তের মালিক সোবহান হোসেন তখন সেখানেই ছিলেন। শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে তাকে সপরিবারে দাওয়াত করে ফিরবেন-এমন সময় ফরিদ কিছুটা কটমট করে উঠলো।
ফজলু মিয়া বুঝতে পারলেন। ঝটপট সোবহান হোসেনের হাতে একটা কবিতার বই দিয়ে বললেন, আমার এই নাতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে এবার ও একটা কবিতার বই বের করেছে। সবাইকে উপহার দিচ্ছি। যদিও আপনি আদার বেপারি তারপরও আপনাকে এই বইটা উপহার দিলাম! কিছুটা বিরক্তি ছিল কথায়।
বইটা পেয়ে অনেক খুশি হলেন সোবহান সাহেব অন্য কথায় ভ্রুক্ষেপই করলেন না। বইটা হাতে নিয়ে বললেন- ‘অনন্যা’ বইয়ের নাম আর কবির নাম ফরিদ হোসেন। তুমি লিখেছ- ফরিদকে এ কথা বলে পাতা ওল্টাতে লাগলেন।
কি লিখেছ- পদ্য না গদ্য কবিতা। ছন্দও ঠিকমত মেলেনি। ভাবার্থ অনেকটা ঠিক আছে।তোমাকে আরো বেশি পড়তে হবে। অনেক বেশি পড়বে। আর...
এসব কথায় রীতিমত রেগে গেলেন ফজলু মিয়া। ‘আফনে মিয়া একজন আদার বেপারি আফনে কবিতার কি বোঝেন? হুদা-হুদি কথা কন কিল্লাই?’ রাগলেনতো আর আঞ্চলিকতা পরিহার করতে পারলেন না।
কিছুটা বিব্রত হলেন সোবহান সাহেবও। আসলে এসব আলোচনা সচরাচর করেন না তিনি। বাস্তবেই একজন আদার বেপারির মুখে এসব কথা মানায় না!
তবে ফরিদ কিছুটা চিন্তিত হলো। সে জানে কি লিখেছে; আর নিজের সম্পর্কে সে ভালোই বোঝে! তাই তৎক্ষণাত সে বলে উঠলো- আপনি যা বলেছেন ঠিকই। তবে পেশার সাথে বিষয়টা কেমন যেন বেমানান মনে হচ্ছে।
নাতির কথায় থমকে গেলেন বৃদ্ধ ফজলু মিয়া।বিস্মিত তিনিও!
সোবহান হোসেন হেসে বললেন- সাহিত্য জগতটাতো সবার জন্য উন্মুক্ত আমি সেই জগতের একজন পাঠক। তাই বললাম।
না, এ মন্তব্য যেন-তেন পাঠকের নয়। আপনি গদ্য-পদ্য কবিতা এমনকি ছন্দ ও ভাবার্থ নিয়েও কথা বলেছেন। আমার কবিতার ভেতরে প্রবেশ করে সেখানকার বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন।
সোবহান হোসেন বইয়ের একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন, দেখ-
বিদগ্ধ আখিতে চাইনা ভাসিতে
মন চায় বারে বারে ফিরিয়া আসিতে
মোর প্রিয়া মোরে দিওনা যেতে
তোমায় ছেড়ে মোটে পারিনা থাকিতে।
এই আসিতে-ভাসিতে, যেতে-খেতে কেমন যেন ছন্দপতন হলো না। না ভেবে লিখেছ? একটু ভেবে এভাবে লিখলে হতো না :
ভাসতে চাইনা আখি জলে
তাইতো পারিনা যেতে চলে
তোমায় ছেড়ে প্রিয়া ওরে
কেমনে থাকি বলো।
সবার কথা ভুলে তুমি
আমার সাথে চলো।
ফরিদ রীতিমত বিস্মিত। ফজলু মিয়ার চোখতো কপালেরও উপরে উঠে যেতে চাইছে।
ফরিদ আর না থেমে বললো- চলুন আপনার এখানে একটু বসি। নাতির ভাব দাদু বুঝতে পেরে কোনো আপত্তি ছাড়াই বসে পড়লেন। সোবহান সাহেব আজ যেন মনের মতো অতিথি পেলেন।
আদার আড়তের মধ্যেও তার বসার জায়গাটা নিরিবিলি। বসেই চা-নাস্তা আনতে বললেন কাজের লোককে।
আপনিতো সুন্দর কবিতা বলেন এবং বানানও একটা কবিতা শোনান না। আবদার করে ফেললো ফরিদ।
ফজলু মিয়াও বললেন- হ মিয়া সব কাম বাদ কবিতা শুনান।
সোবহান সাহেব হেসে একনাগারে বলে গেলেন :
ওই দুটি কালো চোখ
কোনো আবেদন রাখে না
ও চোখের দুষ্টু ভাষা মিষ্টি নিবেদন
এ হৃদয়ে তোলপাড় তোলে না।
হরিণীর মতো চোখ তার তেমনি গড়ন।
কালো শাড়ি শ্যামা মেয়ে ঈষৎ চিকন
সত্যি বলছি এমন মেয়ের
জুড়ি মেলে না এখন।
তাকিয়েছো ভালবেসে একথা ভুলতো নয়
বলি সহাস্যে- ও আকর্ষণে
ভগ্ন এ হৃদয় জড়াবার নয়।
বলছি আরো শোন;
ভগ্ন এ হিয়া যেন ভাঙ্গা কাঁচ
বসে আছে আশায় মনেরই খাঁচায়
আসবে কখন সেই পাখিটি।
তারই প্রতীক্ষায় বসে আছি
হয়তো সে আসবে নয়তো আসবে না
তাই বলে এ হৃদয় তাকে নিয়ে ভাববে না?
ফরিদ বললো- দারুণ কবিতা এমন কবিতাতো আগে পড়িনি। এটা কার কবিতা? ভালোই লিখেছেন কবি।
সোবহান সাহেব বললেন- এ কবিতাগুলো এখানে-ওখানে পাবে। পত্রিকার পাতায় কিংবা লিটল ম্যাগগুলোতেও পেতে পারো। আর এখনতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও পাওয়া যায়। তবে বেশি মনোযোগী হবে পাঠকোত্তীর্ণ কবি যেমন; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লী কবি জসীম উদ্দিন, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখের কবিতাগুলোর প্রতি। মন দিয়ে ওগুলো পড়বে। দেখবে তুমিও একদিন পথ পেয়েছ।
ফরিদ কথায় সায় দিয়ে বললো- আজ তবে উঠি। তার বৃদ্ধ দাদুও তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালেন।
বের হবেন এমন সময় একজন নারী এসে পথে দাঁড়ালেন।
সোবহান হোসেন পরিচয় করিয়ে দিলেন- আমার গৃহকর্তী। আর স্ত্রীকে বললেন- ইনি ফজলু মিয়া আমাদের রিতার বান্ধবী রুমকির দাদু। আর ও ফরিদ রুমকির বড় ভাই। ও ঢাবিতে বাংলায় পড়ছে। কবিতাও লিখে ভালো।
ঢাবি শুনতেই সোবহান সাহেবের স্ত্রী বললেন; তাই নাকি আমিও ঢাবিতে পড়েছিলাম। ইংরেজি বিভাগে আর ও তো ঢাকা কলেজে সমাজবিজ্ঞানে।
বৃদ্ধ ফজলু মিয়া ও ফরিদের চক্ষু চড়কগাছ!
ফজলু মিয়া বললেন, বুঝলাম না এত্ত শিক্ষিত্ মানুষ আমগো লক্ষ্মীপুরে আদার ব্যবসা করতাছে?
জবাব না পেয়ে দরজা থেকে পেছনের দিকে ফিরলেন তিনি বললেন, আরেক কাপ চা আনেন মিয়া হবাই সকাল ১০টা বাজে আরো দুইটা কথা কইয়া যামু।
ফরিদ মৃদু হাসলো। সোবহান সাহেব ও তার গৃহকর্তীও মুচকি হাসতে শুরু করলেন।
কোন ভূমিকা ছাড়াই বৃদ্ধ ফজলু মিয়া বললেন, এইবার আসল রহস্য কন। এত্ত শিক্ষিত মানুষ আদার ব্যবসায় ক্যান?
সোবহান সাহেব বললেন, থাক মূল পরিচয় আমি একজন আদার ব্যবসায়ী...
থামিয়ে দিয়ে তাঁর স্ত্রী বললেন, এই ছদ্মবেশী জীবনেরতো একযুগ পেরিয়ে গেলো আর কিবা করবে গোপন করে? বলতে পারো চাচাকে।
হেসে সোবহান সাহেব বললেন, কি আর গোপন রেখেছি। আসলে চাচা আমি একজন নিষিদ্ধ ঘোষিত কবি।
‘নিষিদ্ধ ঘোষিত কবি!!’ একসাথে বলে উঠলো দাদু-নাতি।
ফজলু মিয়া বললেন- বিস্তারিত কনতো মিয়া।
সোবহান হোসেন বললেন, প্রেমিকার রোষানলের শিকার!
এবার ফরিদ বললো- কি বলেন আপনি? আপনার জীবনসঙ্গিনীতো আপনার পাশেই!
প্রেমিকা বলায় বেগম সোবহানেরও মুখে বিরক্তি।
চা এলো আবারো। চায়ে চুমুক দিতে দিতেই সোবহান সাহেব বলে উঠলেন- আসলে অনার্স সেকেন্ড ইয়ার থেকেই একটা পত্রিকার সাহিত্য পাতার সাথে জড়িয়ে যাই। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতেও আনাগোনা শুরু হয়। কবিতা পাঠের এক সংগঠনেও যুক্ত হই। সেখানেই এক বান্ধবীর দেখা মেলে। তার সাথে হওয়া বন্ধুত্ব কখনো ভালোবাসায় রূপ নেয়নি।
তবে তারই এক বান্ধবীকে আমার ভালোলেগে যায়। যে কবিতাটা আপনাদের শোনালাম সেটাই আমার জীবনের কাল।
আমার সে বান্ধবীকে উদ্দেশ্য করে লেখা; কবিতাটা ও ঠিকই বুঝে ফেলে।তারপর সে বিয়ে করে এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীকে। যে কি না উত্তরাধিকার সূত্রে একটা টিভি চ্যানেল ও জাতীয় দৈনিকের মালিক।
তবে তার বিয়ের পর আমিও বিয়ে করে ফেলি। তার সেই বান্ধবীই বর্তমানে আমার জীবনসঙ্গিনী। আর এতেই ক্ষিপ্ত হয় সে।
শুরুর দিকে আমাদের কিছুটা অনটন থাকলেও বছর ঘুরতে না ঘুরতে আমার স্ত্রীর বিসিএস হয়ে যায়। ও ইডেনে ইংরেজির শিক্ষিকা হিসেবে জয়েন করে। অন্যদিকে আমিও অল্পবয়সী কবি সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি পাই। পত্রিকা জগতেই স্থায়ী হওয়ার পথে এগিয়ে যাই।
একদিন এলো সে দুর্যোগ। আমার কিছু প্রেমের কবিতার ক্লিপিংসসহ একটা উকিল নোটিশ পেলাম। আমার সে বান্ধবী পাঠিয়েছিলো। আমি নাকি তার বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে তাকে নিয়ে অশ্লীল কবিতা অনবরত লিখে চলেছি!
যদিও তার নোটিশ চ্যালেঞ্জ করে জিতে যাই। তবে তার স্বামী প্রভাবশালী তাই আর কোথাও আমার কবিতা ছাপা হচ্ছিল না। বিনা কারণে পত্রিকার চাকরিটাও চলে গেলো।
একটা ব্যবসা শুরু করে দেখি সেখানেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। তবে বউ আমার সংসারটা ঠিকই চালাচ্ছিল। সেখানেও বিড়ম্বনা। সেই প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর প্রভাবে মন্ত্রী হওয়া লোকেরা কূটিল চক্রান্তে আমার স্ত্রীকেও চাকুরিচ্যূত করলো।
ফিরে গেলাম গ্রামে। তবে আমাকে কিছুতেই শান্তিতে থাকতে দেয়া হবে না। গ্রামেও টিকতে পারছিলাম না।
ওইসময় ফোন এলো সেই বান্ধবীর। বললো- তুই আমাকে গ্রহণ করিস নি তাই তোর পৃথিবীতে আগুন লাগিয়েছি। সমঝোতায় আয়। ক্ষমা চা আমার কাছে। আর কিছু চাইনা। নত হলেই সব নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে।
তখন আমার স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করলাম-কি করা যায়?
ও বললো- পথতো সব বন্ধ করেছে।কিসের আবার ক্ষমা চাওয়া! চলো দেশের বাইরে যাই।
আমার বুড়ো বাবা-মাকে বললাম তারাও রাজি হলেন। তবে বিদেশও যেতে দেয়া হলো না আমাদের।
এরপর যা করার আব্বাই করলেন। তিনি নিজের বাস্তুভিটাসহ সমস্ত সম্পত্তি গোপনে বেঁচে দিলেন অনেকটা সস্তা দামেই! এরপর আমরা বাবা-মাসহ সপরিবারে চলে এলাম লক্ষ্মীপুরে।
বাবাই আদার ব্যবসা শুরু করলেন।আর আমাকে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী বানিয়েই তিনি দুনিয়া ত্যাগ করেছেন।এখন কেবল মা-ই বেঁচে আছেন।
সোবহান সাহেবের স্ত্রীর চোখ ছলছল।
ফজলু মিয়া ও ফরিদও আবেগে আপ্লুত। উঠি বলে উঠে দাঁড়ালেন ফজলু মিয়া।চোখে তার অশ্রুধারা।
চোখ মুছতে মুছতে নাতি ফরিদকে বললেন, ‘তোর আর কবিতা লেখন লাগবো না...কবিতার কষ্ট জীবনে চইল্যা আইবো।’
এই বলে বেরিয়ে গেলেন তারা। ঘরটা নিঃস্তব্ধ।
[এটা সপ্তম বাংলা ব্লগ দিবস উপলক্ষে প্রতিযোগিতার জন্য পাঠিয়েছি]
০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:২৮
গুরুর শিষ্য বলেছেন: ধন্যবাদ...
©somewhere in net ltd.
১|
০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:২৪
রুদ্র জাহেদ বলেছেন: বাহ!গল্পের প্লটটা দারুণ।সাবলীল...
++++++