নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আলহামদুলিল্লাহ। যা চাইনি তার চেয়ে বেশি দিয়েছেন প্রিয়তম রব। যা পাইনি তার জন্য আফসোস নেই। সিজদাবনত শুকরিয়া। প্রত্যাশার একটি ঘর এখনও ফাঁকা কি না জানা নেই, তাঁর কাছে নি:শর্ত ক্ষমা আশা করেছিলাম। তিনি দয়া করে যদি দিতেন, শুন্য সেই ঘরটিও পূর্নতা পেত!

নতুন নকিব

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দল-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না- বিদ্রোহী রন-ক্লান্ত। আমি সেই দিন হব শান্ত।

নতুন নকিব › বিস্তারিত পোস্টঃ

হাদিস সংকলনের ইতিহাস, পর্ব-০৩

২৮ শে এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ১২:৩৪

ছবিঃ অন্তর্জাল।

পূর্বের পর্বগুলোর লিঙ্ক-

হাদিস সংকলনের ইতিহাস, পর্ব-০১

হাদিস সংকলনের ইতিহাস, পর্ব-০২

হাদিস সংকলনের ইতিহাস, পর্ব-০৩

হাদিস সংরক্ষন, সংকলন এবং কিয়ামত পর্যন্ত পরবর্তীতে পৃথিবীতে আগন্তুক মানবগোষ্ঠীর কাছে তা পৌঁছে দেয়ার গুরুত্ব, ফজিলত এবং মর্যাদার বিষয়টি সাহাবায়ে কিরাম রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুম সবচেয়ে বেশি বুঝতেন। এরপরে সম্মানিত তাবেয়ীগণ, তাবে-তাবেয়ীগণ এই কাজের গুরুত্ব অনুধাবন করে এ বিষয়ে যথাযথ মনোসংযোগ ঘটান। এরপরে তাদের থেকে হাদিসের জ্ঞান অর্জনে ঝাপিয়ে পড়েন মুহাদ্দিসীনে কেরাম, ইমামে হাদিসবৃন্দ। হাদিসের পেছনে তারা একেকজন এমনইভাবে ছুটেছেন যে, এই মহৎ কাজে তাদের জীবনই পার করে দিয়েছেন। একটিমাত্র হাদিস সংগ্রহ করার জন্য তারা ছুটে গিয়েছেন শত সহস্র মাইল।

ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহ আলাইহির কথাই যদি বলি। বুখারী শরীফ এর প্রতিটি হাদিস সংগ্রহ ও তার সঠিকত্ব প্রমাণের জন্য ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহ আলাইহিকে যাত্রা করতে হয়েছে শত সহস্র মাইল। এমন ঘটনাও বর্ণিত আছে যে, একটিমাত্র হাদিস সংগ্রহের জন্য তিনি দুই মাসের রাস্তাও পাড়ি দিয়েছেন। বিভিন্ন দেশে ভ্রমনের মাধ্যমে তিনি লক্ষাধিক সহীহ হাদীস সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শুধুমাত্র হাদিস সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি মক্কা, মদিনা, সিরিয়া, হিজাজ, মিশর ও ইরাকসহ আরো অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। এ সকল দেশ ভ্রমণ করতে গিয়ে তাকে অনেক মুহাদ্দিসদের কাছে পরিক্ষার সম্মুখিন হতে হয়েছে। এ সকল পরিক্ষায় তিনি সফলভাবে নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন।

মাত্র ৯ বছর বয়সে ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহ আলাইহি পবিত্র কুরআন হিফজ করেন এবং দশ বছর বয়স থেকে তিনি হাদিস শিক্ষা শুরু করেন। হাদিস শিক্ষা জীবনে ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহ আলাইহির জীবনে সংঘটিত হয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ ও মজার অনেক ঘটনা। দু'একটি উল্লেখ করছি-

সাধারণতঃ ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহ আলাইহির সময়কার নিয়ম ছিল, হাদিসের ক্লাশে সকল ছাত্র হাদিসগুলো উস্তাদের মুখ থেকে শুনে সাথে সাথে নোট করে রাখতেন। কিন্তু ইমাম বুখারী কোন দিনই হাদিসগুলো নোট করে রাখতেন না। এভাবে বেশ কিছু দিন অতিবাহিত হলো। সহপাঠীরা ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহ আলাইহিকে একবার বললেন, ‘আপনি কোন হাদিস নোট করে রাখেন না কেন?’

ইমাম বুখারী উত্তর দিলেন- 'সকলেই আমাকে প্রতিবার এই একই প্রশ্ন করছেন। আচ্ছা, যে সমস্ত হাদিস আপনারা এত দিন যাবত নোট করেছেন, তা আমাকে পড়ে শোনান।'

সকলে তাই করলেন। হাদিসগুলো তাকে পড়ে শোনালেন।

এরপরই ঘটলো আশ্চর্য্যজনক ঘটনা। তাদের নোটকৃত সবগুলো হাদিস তাদেরকে মুখস্ত শুনিয়ে দিলেন ইমাম বুখারী রহ.। শুধু তাই নয়, আরো পনেরো হাজার হাদিস অতিরিক্ত শুনিয়ে দিলেন। সেদিন থেকেই সহপাঠীরা বুঝতে পারলেন যে, ইমাম বুখারী রহ. সাধারণ কোনো ব্যক্তি নন। আল্লাহ পাক প্রদত্ত অসাধারণ মেধা এবং বিরল স্মরণশক্তির এমনই সমাহার ঘটেছিল ইমামুল হাদিসের জীবনে।

হাদিসের বিষয়ে নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ

نضر الله امرء سمع منا شىا

'আল্লাহ তাআ'লা ধন্য করবেন সেই ব্যক্তিকে, যে আমার নিকট হতে কোন কিছু শুনল এবং উহা যেভাবে শুনল সেভাবেই অপরের নিকট পৌঁছে দিল। কেননা, শ্রোতা অপেক্ষা উহা যার নিকট পৌছানো হয়, সে-ই উহার অধিক সংরক্ষণকারী হয়ে থাকে।' (তিরমিযী)

নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরেক হাদিসে ইরশাদ করেছেনঃ

قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عليه وَسَلَّم نَضَر اللهُ عَبْدًا سَمِعَ مقَالتىْ فَحَفَظَهَا اوْوَ عَاهَا وَاَدَّها وَرَدَّهَا فَرُبَّ حَامِلِ فِقْهِ اَلَى مَنْ هُوَ اَفْقَهٌ مِنْهُ- (ابو داؤد)

'আল্লাহ তা’য়ালা সেই লোকের মুখমণ্ডল উজ্জ্বল উদ্ভাসিত করবেন, চিরসবুজ, চিরতাজা করে রাখবেন, যে আমার কথা শুনে মুখস্থ করে রাখবে কিংবা স্মৃতিপটে সংরক্ষিত রাখবে এবং অপর লোকের নিকট তাহা পৌঁছে দিবে। জ্ঞানের বহু ধারকই প্রকৃত জ্ঞানী নয়। তবে জ্ঞানের বহু ধারক উহা এমন ব্যক্তির নিকট পৌঁছায়, যে তার অপেক্ষা অধিক সমঝদার।' (আবূ দাউদ)

হাদিসের সংকলন ও সংরক্ষনে মুসলিম উম্মাহর নজিরবিহীন ত্যাগঃ

মানুষের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ হলো নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবন চরিত। তাঁর জীবন চরিত বিবৃত হয়েছে হাদীসের মধ্যে। ইসলামের দৃষ্টিতে কুরআনের পরই হাদীসের স্থান। কুরআন ইসলামী আইনতন্ত্রের প্রধান উৎস এবং হাদীস দ্বিতীয় উৎস। কুরআনের জীবন্ত ব্যাখ্যা হিসেবে হাদীসে নববী সংরক্ষণ ও সংকলনের ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহ যে কঠোর ত্যাগ স্বীকার করেছেন বিশ্ব ইতিহাসে তার কোন নজির নেই। ইসলামী শরীয়াহ সংরক্ষণের জন্য শুধুমাত্র কুরআন সংরক্ষণ ও সংকলনই যথেষ্ট নয়, বরং হাদীসের ভান্ডারও সংরক্ষিত ও সংকলিত হওয়া দরকার। নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দীর্ঘ তেইশ বছরের নবুওয়তী জিন্দেগীর সকল কথা এবং কর্ম ও অনুমোদন সংক্রান্ত বাণী অবিকল সংরক্ষণ করা, বিশেষত সেই যুগে, যখন কাগজ, প্রেস কিংবা কম্পিউটার ছিল না, এযে কত কঠিন কাজ তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবীগণ এ দুরূহ কাজটি সমাধা করেছেন আশ্চর্যজনক কৃতিত্বের সাথে। তাঁরা নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস অক্ষরে অক্ষরে মুখস্থ রাখেন এবং বিভিন্ন উপকরণে লিখিতভাবে সংরক্ষণ করেন। সাহাবীদের পর তাবেঈগণও অনুরূপভাবে হাদীস সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেন। তাই আল্লাহ তাআ'লার অশেষ রহমতে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন ও মুহাদ্দিসগণের কঠোর পরিশ্রম ও দীর্ঘ সাধনার বদৌলতে হাদীস সংরক্ষিত ও সংকলিত হয়েছে।

হাদীস সংরক্ষণের পদ্ধতিসমূহঃ

হাদীস সংরক্ষণের পদ্ধতিসমূহ দ্বিতীয় পর্বে সামান্য আলোচিত হয়েছে। এই পর্বে এ বিষয়ে আরও কিছু আলোকপাত করার ইচ্ছে। মুসলিম উম্মাহ রাসূলের নবুওয়তী জিন্দেগীর প্রাথমিক পর্যায় হতে আজ অবধি হাদীস সংরক্ষণের ক্ষেত্রে প্রধানত নিম্নোক্ত পন্থা ও পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করে আসছেনঃ

১. হাদীসের শিক্ষা গ্রহণ ও মুখস্থকরণ

২. হাদীসের শিক্ষাদান

৩. হাদীস মোতাবেক আমল

৪. হাদীস লিপিবদ্ধকরণ

১. হাদীসের শিক্ষা গ্রহণ ও মুখস্থকরণঃ

হাদীসের প্রথম ধারক ও বাহক ছিলেন নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সান্নিধ্যপ্রাপ্ত সাহাবায়ে কেরাম। তাঁরা প্রিয় নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুখ নিসৃত বাণীসমূহ যা শুনেছেন এবং কর্ম ও অনুমোদনসমূহ যা প্রত্যক্ষ করেছেন তা সবই সংরক্ষণ করে পরবর্তী উম্মতের কাছে আমানতস্বরূপ রেখে গেছেন। সাহাবীগণ হাদীসের শিক্ষা গ্রহণে সর্বদা নিজেদের নিয়োজিত রাখতেন এবং তা মুখস্থ করতেন। আর অন্যদের কাছে তা যথাযথভাবে পৌঁছানো এবং শিক্ষাদানের লক্ষ্যে প্রাণপণ চেষ্টা চালাতেন। নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছ থেকে সরাসরি অথবা অন্য সাহাবীদের মাধ্যমে হাদীস বর্ণনা করেছেন এমন সাহাবীদের সংখ্যা ইমাম আবু জুরআ রাজীর মতে এক লাখ চৌদ্দ হাজার। নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তিকালের সময় কেবল মক্কা ও মদীনায় সাহাবীদের সংখ্যা ছিল ইমাম শাফেয়ীর মতে ষাট হাজার। সাহাবায়ে কেরামের অনেকে হাদীসের শিক্ষা গ্রহণ ও মুখস্থকরণের জন্যে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছেন। যেমন- আসহাবে সুফফা, সুফফার অধিবাসীগণ দিন-রাত নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে পড়ে থাকেন। ফলে মসজিদে নববী একটি আবাসিক বিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছিল। হযরত আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বলেন- ‘আমি রাত্রিকে তিন ভাগে ভাগ করে নিই। একভাগে ঘুমাই, একভাগ ইবাদতের মধ্যে অতিবাহিত করি, আর একভাগে রাসূলের হাদীস পাঠ ও মুখস্থ করতে থাকি’। -সুনানে দারমী-১/৮২

আর অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম যারা নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে নিয়মিত উপস্থিত থাকতে পারতেন না তারা অন্যের নিকট নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে কখন কি ঘটছে তা জেনে নেয়ার চেষ্টা করতেন। কেউ কেউ রাসূলের দরবারে হাজির হওয়ার জন্য একে অন্যের সাথে পালা ঠিক করে নিতেন। যেমন হযরত ওমর ফারুক রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু তাঁর এক আনসারী প্রতিবেশীর সাথে পালা ঠিক করে নিয়েছিলেন। একদিন হযরত ওমর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত থাকতেন, আরেকদিন উক্ত আনসারী সাহাবী উপস্থিত থাকতেন। -বোখারী শরীফ

সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে অনেকেই দূর-দূরান্ত থেকে সফর করে রাসূলের দরবারে আসতেন হাদীস শিক্ষার জন্য। অনুরূপভাবে নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তিকালের পরেও অনেক সাহাবায়ে কেরাম একে অপরের নিকট হাদীস শেখার জন্য শত শত মাইল সফরের কষ্ট স্বীকার করতেন। হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু কেবল একটি মাত্র হাদীস শোনার জন্যে মদীনা থেকে একমাসের পথ সুদূর সিরিয়া সফর করেছিলেন। -সহিহ বোখারী, কিতাবুল ইলম

সাহাবায়ে কেরামের হাদীস সংগ্রহ সংক্রান্ত আরও বহু চমকপ্রদ ঘটনা ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

সাহাবায়ে কেরামের অসাধারণ স্মৃতিশক্তিঃ

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবের যে জনসমাজে আত্মপ্রকাশ করেন তাঁদের চরিত্রে অসাধারণ স্মৃতিশক্তি বিদ্যমান ছিল। একথা অস্বীকারের কোন উপায় নেই যে, নবীজীর হাদীস ও জীবনাদর্শ সংরক্ষণ করতে হবে বলেই যেন এ সমাজটিকে পূর্ব থেকে পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করা হয়েছিল। স্মরণশক্তির আতিশয্য তৎকালীন আরব-মানুষকে আজো ইতিহাস প্রসিদ্ধ বানিয়ে রেখেছে।

একটি সুদীর্ঘ কাব্যগ্রন্থ একবার শোনামাত্র মুখস্থ করে নেয়া কিংবা বিভিন্ন কওমের উর্ধ্বতন বংশ পরম্পরা অতি দূর পর্যন্ত কণ্ঠস্থ রাখা। এমনকি পালের এক একটি বকরি, এক একটি ঘোড়া ও উটের বংশ পরম্পরা কণ্ঠস্থ রাখতে পারা কেবল তৎকালীন আরবদেরই বৈশিষ্ট্য ছিল। -দরসে তিরমিযী, মুকাদ্দমা

পূর্ব পরিকল্পিত হওয়ার প্রমাণ এভাবেও দেখানো হয় যে, চৌদ্দশ বছর পূর্বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নামও যখন মানুষ জানতো না, তখন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস ও জীবনাদর্শকে যেভাবে অতিশয় নিখুঁত, সর্বাধিক বিশ্বস্ত ও সর্ব ব্যাপকতাসহ সংরক্ষণ করা হয়েছিল বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের শক্তি ও সামর্থ্যকে আরো সহস্রগুণে বৃদ্ধি করে দেয়া সত্ত্বেও কি কোন মানুষের হাদীস ও জীবন চরিত এত ব্যাপক ও বিশ্বস্তভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব হতো? প্রাচীন গ্রন্থাবলীতে তৎকালীন আরবদের অসাধারণ স্মৃতিশক্তি সম্পর্কে অনেক কিংবদন্তী আছে। প্রসিদ্ধ তাবেয়ী হযরত কাতাদা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু স্পষ্টই বলেন, ‘‘আল্লাহ এই জাতিকে স্মরণশক্তির এমন প্রতিভা দান করেছিলেন যা অন্য কোন জাতিকে কখনো দান করা হয়নি।’’ -যুরকানী ৫/৩৯৫

যেমন- প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু তিনি বিপুল সংখ্যক হাদীসের ‘হাফিয’ ছিলেন। উমাইয়া খলিফা মারওয়ান বিন হাকাম হযরত আবু হুরায়রার রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু স্মৃতিশক্তি পরীক্ষা করার মানসে তাঁকে একবার রাজদরবারে দাওয়াত করলেন। তিনি উপস্থিত হলে খলিফা নিজেই তাঁকে কিছু সংখ্যক হাদীস মুখস্থ শোনানোর অনুরোধ করলেন। আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু তখন কিছু সংখ্যক হাদীস শোনিয়ে দেন। বাৎসারিককাল পরে একদিন ঠিক এ হাদীসসমূহ শোনাবার জন্যে হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুকে অনুরোধ করা হলো। তিনি সেই হাদীসগুলো এমনভাবে মুখস্থ শোনালেন যে, পূর্বের শোনানোর সাথে এর কোন পার্থক্য হয়নি। -কিতাবুল কুনা-ইমাম বুখারী, পৃ: ৩৩

২. হাদীসের শিক্ষা দানঃ

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে হাদীস সংরক্ষণে সাহাবায়ে কেরামের হাদীস শিক্ষাদানের ধারাবাহিকতা বিশেষভাবে ভূমিকা পালন করেছিল। কুরআন-হাদীসের শিক্ষাদানের জন্য সাহাবায়ে কেরাম নিজ নিজ এলাকায় শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশাতেই মদীনা শরীফে নয়টি মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাতে যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামায়াতের সাথে পড়া হতো, তেমনি প্রত্যেকটিতে দ্বীনে ইসলাম শিক্ষাদানেরও ব্যবস্থা ছিল। -উলূমুল হাদীস ওয়া মুসতালাহুহু, পৃ: ১৭

তদুপরি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীগণকে দ্বীনের প্রতিটি কথা শিক্ষা দিতেন এবং তাঁকে দেখে দেখে শিক্ষা গ্রহণের জন্য সাহাবীগণকে আদেশ করতেন। সাহাবী হযরত ইবনে মাসউদ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বলেন, '‘রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নামাযের ‘তাশাহুদ’ শিক্ষা দিতেন যেভাবে কুরআনের কোন সূরা শিক্ষা দিতেন'। -সহীহ মুসলিম

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীগণকে হাতে-কলমে সকল কিছু শিক্ষা দিতেন। প্রয়োজনীয় কোন ছোট-খাট জিনিসের শিক্ষাদান থেকে তিনি পিছিয়ে থাকতেন না। উদাহরণস্বরূপ ইস্তিঞ্জা করার নিয়ম পদ্ধতির কথা বলা যায়। ফলে শত্রুদের কেউ কেউ উপহাস করে একবার প্রসিদ্ধ সাহাবী সালমান ফারসী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুকে বলেছিলেন : ‘তোমাদের নবী তোমাদেরকে সব কিছু শিক্ষা দেন এমনকি পেশাব-পায়খানা করার পদ্ধতিও। -তিরমিযী

হযরত সালমান ফারসী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু তখন বিজ্ঞচিত ভাষায় উত্তর দিয়ে বলেছিলেন, হ্যাঁ, আমাদের নবী আমাদেরকে সকল কিছুরই ‘আদর্শ’ শিক্ষা দিয়ে থাকেন। এ ঘটনা থেকে নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শিক্ষাদান কাজের ব্যাপকতা অনুমান করা যায়। নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শিক্ষাদান ও তত্ত্বাবধান এবং সাহাবায়ে কেরামের একনিষ্ঠতার ফল দাঁড়াল যে, সাহাবীগণের আমলী জীবন ও নবুয়্যাতী শিক্ষা ও আদর্শের শুধু ‘জীবন্ত কপি’ তাই নয় বরং সাহাবীগণ সেই শিক্ষার এমন কপি হওয়ার মর্যাদা লাভ করেন যা নিখুঁত, ত্রুটিমুক্ত ও যাচাইকৃত। বলাবাহুল্য কোন জীবনাদর্শকে সংরক্ষণ করার জন্য এ অপেক্ষা উচ্চতর আর কোন পদ্ধতি চিন্তা করা যায় না। রাসূলের সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকালের পর সাহাবাদের এ উদ্যমী কাফেলা হাদীস শিক্ষাদান কার্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং সমগ্র আরব ভূমিকে হাদীসের জ্ঞানে উদ্ভাসিত করে দেন।

৩. হাদীস মোতাবেক আমলঃ

রাসূলের সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুগে তাঁর হাদীসসমূহ সংরক্ষণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া ছিল সাহাবায়ে কেরাম কর্তৃক হাদীসের বাস্তব অনুসরণ তথা সে অনুযায়ী আমল করে তাঁরা হাদীসে রাসূলকে সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবন্ত রেখেছেন। নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন আক্বীদা ও তত্ত্বমূলক কথা বলতেন, তখন সাহাবায়ে কেরাম তা মুখস্থ করে মন-মগজে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে নিতেন এবং সে অনুসারে স্বীয় আক্বীদা ও বিশ্বাস গড়ে তুলতেন। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যাবতীয় আদেশ-নিষেধ সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের নৈমিত্তিক অভ্যাসে পরিণত না করা পর্যন্ত চর্চা ও অভ্যাস করতে সর্বোতভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বলেন: ‘‘আমাদের কেউ যখন ১০টি আয়াত শিক্ষা লাভ করতো তখন এর অর্থ ভালরূপে হৃদয়ঙ্গম ও তদনুযায়ী আমল করার পূর্বে সে অন্য কিছু শেখার জন্যে অগ্রসর হতো না। -জামিউ বায়ানিল ইলুম

মূলত রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যাবতীয় ইবাদত, মোয়ামালাত, কথাবার্তা, লেবাস-পোশাক, পানাহার, উঠা-বসা, নিদ্রা-জাগরণ এমন কোন বিষয় নেই, যে বিষয়ে সাহাবায়ে কেরাম তাঁর পূর্ণ অনুকরণ ও অনুসরণের চেষ্টা করেননি। সাহাবায়ে কেরামের এরূপ নিরবচ্ছিন্ন অনুসরণের মাধ্যমেই রাসূলের সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি কথা, কাজ ও মৌন সম্মতি কিংবা অনুমোদন এবং যাবতীয় কর্মকাণ্ডের বিবরণসমূহ চিরদিনের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে।

৪. হাদীস লিপিবদ্ধ করণঃ

রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশায় অনেক সাহাবী লিখিতভাবে হাদীস সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন। তবে ইসলাম প্রচারের প্রথম দিকে হাদীস লিপিবদ্ধ করার ব্যাপারে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা ছিল। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বর্ণিত হাদীসে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

‘‘তোমরা আমার হাদীস লিখবে না। আর যে ব্যক্তি আমার পক্ষ থেকে কুরআন ছাড়া অন্য কিছু লিখে থাকে সে যেন তা মুছে ফেলে।’’ -সহীহ মুসলিম, খ. ২য়, পৃ: ৪১৪

হাদীস লিখনে এ নিষেধাজ্ঞা ছিল মদীনায় হিজরতের পূর্বে মক্কায়। এসময় কোনো কোনো সাহাবী রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুখ থেকে যা শুনতেন তা একই জায়গায় লিখে রাখতেন। তাতে কুরআন ও হাদীস সংমিশ্রিত হয়ে যাওয়ার আশংকা ছিল প্রবল। তদুপরি তখনও তাঁরা কুরআনের ভাব-গাম্ভীর্য তথা ভাষা- শৈলী আত্মস্থ করতে সক্ষম হননি। এমতাবস্থায় কুরআনের পাশাপাশি হাদীস লিপিবদ্ধ করা ছিল যুগপৎ কষ্ট কর ও ঝুঁকিপূর্ণ। তাই রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই সময় হাদীস লিপিবদ্ধ করতে নিষেধ করেন। তারপর যাদেরকে তিনি লিখন কার্যে পারদর্শী দেখেছেন কিংবা যারা কুরআন ও হাদীসকে যথার্থ উপায়ে লেখার যোগ্যতা অর্জন করেছেন বলে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন তাঁদেরকে লেখার অনুমতি দিয়ে দেন। সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বলেন, আমি প্রিয় নবীর সব হাদীসই লিখে রাখতাম। একবার আমাকে লোকেরা নিষেধ করে বলেন, নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক কথা মানবীয় ক্রোধ ও অসন্তুষ্টি নিয়েও বলে থাকেন অথচ তুমি কিনা তার সব হাদীসই লিখে ফেলছ? কথাটি নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জানানো হলে নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমর! তুমি নির্দ্বিধায় সব কিছু লিখতে পার। কারণ আল্লাহর শপথ! আমার এমুখ থেকে প্রকৃত সত্য ছাড়া অন্য কিছুই বের হয় না। (আবু দাউদ) মক্কা থেকে মদীনায় পৌঁছার পর নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাদীস সমূহ লিখিতভাবে সংরক্ষণের সরাসরি নির্দেশ দিয়ে বলেন; ‘‘তোমরা ইলমকে লিখনীর মাধ্যমে সংরক্ষণ কর।’’ -মুস্তাদরাক, খ: ১, পৃ: ১০৬

তাছাড়া মদীনার সনদ, সাদাকাতের নেসাব, বিভিন্ন গোত্রের উদ্দেশ্যে প্রেরিত ফরমান ইত্যাদির সবই রাসূলের সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সরাসরি উদ্যোগে লিখিত বিষয় ছিল। নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস লিপিবদ্ধ করার অনুমতি প্রদান করার পর অনেক সাহাবী নিজস্ব নিয়মে ও নিজেদের পছন্দমতে হাদীস লিপিবদ্ধ করে গ্রন্থাকারে সাজিয়ে রাখেন। যদিও এগুলিতে গ্রন্থের রূপ-বৈশিষ্ট্য পরিপূর্ণ বিদ্যমান ছিল না। সাহাবাদের লিখিত সে সব প্রাচীনকালীন লিখিত সম্পদ আজো বিশ্বের বিভিন্ন মিউজিয়ামে বিদ্যমান।

সাহাবায়ে কেরাম সংকলিত কতিপয় হাদীস গ্রন্থঃ

সাহাবায়ে কেরামগণের কেউ কেউ হাদিস সংকলন করেছেন। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-

১. আস সহীফাতুস সাদিকাঃ

সাহাবী যুগে সংকলিত সর্বাধিক সংখ্যক হাদীসের গ্রন্থ। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু এ সংকলন তৈরি করেন।

২. সহীফাতু আলী

এর রচনাকারী ছিলেন স্বয়ং হযরত আলী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু। এটিকে ভাঁজ করে তিনি নিজ তলোয়ারের খাপের মধ্যে সযত্নে রেখে দেন।

৩. কিতাবুস সাদাকাহ:

এ গ্রন্থটি স্বয়ং রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের তত্ত্বাবধানে ওফাতের মাত্র কয়েকদিন পূর্বে লিখিয়ে ছিলেন। এগ্রন্থে যাকাত, সাদাকাত, উশর ইত্যাদি সম্পর্কীয় নির্দেশ ছিল।

৪. সহীফাতু আমর ইবন হাযম :

গ্রন্থটি নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশায় তাঁরই আদেশক্রমে হযরত উবাই ইবন কা’ব রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু লিপিবদ্ধ করেুন। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দশম হিজরীতে হযরত আমর ইবনে হাযমকে রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু নাজরানের শাসনকর্তা হিসেবে প্রেরণ করার সময় এ হাদীস গ্রন্থ তার নিকট প্রদান করেন। এতে পবিত্রতা, নামায, যাকাত, হজ্ব, উমরা, জিহাদ ও গণীমত ইত্যাদি বিষয়ে অনেক হাদীস সন্নিবেশিত ছিল।

৫. সহীফাতু ইবন আব্বাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু

৬. সহীফাতু জাবির ইবন আব্দুল্লাহ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু

৭. সহীফাতু আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু

৮. সুহুফু (অনেক গ্রন্থ) আনস ইবনে মালিক রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু।

৯. মুসনাদু আবী হুরাইরা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু

১০. সহীফাতু সাদ ইবন উবাদা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু উল্লেখযোগ্য।

খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে হাদীস সংকলন :

এমনিভাবে খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগেও হাদীস সংকলন করা হয়েছে। যেমন-

ক. হযরত আবু বকর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু:

হযরত আবু বকর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু নিজে পাঁচ শত হাদীসের একটি সংকলন প্রস্তুত করেছিলেন, তবে শেষ জীবনে তিনি নিজেই তা নষ্ট করে ফেলেন। এর কারণ হিসেবে মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকগণ দু’টি বিষয় উল্লেখ করেছেন-

১. তিনি বিশেষভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েন যে, তাঁর সংকলিত হাদীসে একটি শব্দও যদি রাসূলের সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূল বাণীর বিন্দু মাত্র বিপরীত হয়ে পড়ে তবে রাসূলের সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্কবাণী অনুযায়ী তাঁকে জাহান্নামের ইন্ধন হতে হবে।

২. তাঁর মনে এ ভয়ও জাগ্রত হয় যে, তাঁর সংকলিত হাদীস গ্রন্থকে মুসলিম জনগণ যদি কুরআনের সমতুল্য মর্যাদা দিয়ে বসে বা অন্য সাহাবীগণের বর্ণিত হাদীস অপেক্ষা অধিক মর্যাদা দিতে শুরু করে, তাহলে ইসলামের বিশেষ ক্ষতি হবে।

খ. হযরত ওমর ফারুক রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু:

তিনি অনেক হাদীস সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করে ইসলামী রাজ্যের বিভিন্ন শাসকের নিকট প্রেরণ করেছিলেন এবং সর্বসাধারণ্যে সে সবের ব্যাপক প্রচার করার নির্দেশও দিয়েছিলেন। ইলমে হাদীসের শিক্ষা ব্যাপকতর করার জন্যে তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও প্রতিষ্ঠা করেন। হযরত ওমর ফারুক রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু এর সময়ই বিচ্ছিন্ন থাকা হাদীস সম্পদ সংকলন করার প্রশ্ন প্রথম উত্থাপিত হয়। ওমর ফারুক রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু এবিষয়ে অন্যান্য সাহাবীর সাথে পরামর্শ করেন। মুসলমানরা তাঁর অনুকূলেই পরামর্শ দেন। কিন্তু শেষে তিনি একদিন বললেন-আমি তোমাদের হাদীস লিপিবদ্ধ ও সংকলিত করার কথা বলেছিলাম একথা তোমরা জান। কিন্তু পরে মনে হল তোমাদের পূর্বের আহলে কিতাবরাও এমনিভাবে নবীর কথা সংকলিত করে কিতাব রচনা করেছিল এবং আল্লাহর কিতাব পরিত্যাগ করেছিল। আল্লাহর শপথ, আমি আল্লাহর কিতাবের সাথে কোন কিছুই মিশাবোনা। অত:পর তিনি হাদীস সংকলিত করার সংকল্প ত্যাগ করেন। বস্তুত: সুসংবদ্ধ ও সংকলিত হাদীস গ্রন্থ পেয়ে লোকেরা হয়তো কুরআন থেকে তাকে বেশি গুরুত্ব দিবে এবং কেবল হাদীস অনুযায়ী চলতে শুরু করবে, শুধুমাত্র এভয়েই ওমর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু হাদীস সংকলনের সংকল্প পরিত্যাগ করেন। তিনি এটাকে যে নাজায়েয মনে করতেন না, তা তাঁর পূর্বোল্লিখিত কার্যকলাপ থেকে সহজেই অনুমেয়।

গ. হযরত ওসমান রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু:

হযরত ওসমান রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু খুবই কমসংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেছেন। কেন না তিনি ভুল হওয়ার আশংকায় হাদীস বর্ণনা করা থেকে এক প্রকার বিরত ছিলেন বলা চলে। এ বিষয়ে তাঁর নিজের বক্তব্য হচ্ছে: ‘রাসূলের সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের মধ্যে আমি কম হাদীস জানি, এটি রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস বর্ণনা থেকে আমার বিরত থাকার কারণ নয়। আসল কারণটি হচ্ছে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আমি নিজেই রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, আমি যা বলিনি যদি কেউ তা আমার কথা হিসেবে বর্ণনা করে তবে সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়।’

তাই হযরত উসমানের রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বর্ণনা করা কয়েকটি মাত্র হাদীস পাওয়া যায়।

ঘ. হযরত আলী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু:

যে কয়জন সাহাবী হাদীস লিপিবদ্ধ করেছিলেন হযরত আলী রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তিনি তাঁর লিখিত হাদীস ভাঁজ করে তাঁর তলোয়ারের খাপে রেখে দিয়েছিলেন। -বুখারী, মুসনাদে আহমদ

অবশ্য সাহাবায়ে কেরামের এ সংগ্রহ ও সংকলন ছিল সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত পর্যায়ে। তবে সামগ্রিকভাবে হাদীস সংকলন হয়েছিল পঞ্চম খলিফা খ্যাত হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীযের শাসনামলে।

হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের শাসনামলে হাদীস সংকলন :

প্রখ্যাত তাবেয়ী হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ (জন্ম ৬১ হি:, মৃত্যু ১০১ হিজরি), ৯৯ হিজরী সনে খলিফা নির্বাচিত হন। তাঁর খিলাফতের মেয়াদ ছিল দুই বছর পাঁচ মাস। ঈমান, তাকওয়া ও যোগ্যতার কারণে তিনি ইসলামের পঞ্চম খলিফা হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত। খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেই তিনি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন যে ইসলামী জীবন যাপন ও খিলাফত পরিচালনার জন্যে হাদীস এক অপরিহার্য সম্পদ। সাহাবায়ে কেরামের প্রায় সকলে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। অধিকাংশ তাবেয়ীও দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। যারা বেঁচে আছেন তারাও আর বেশি দিন থাকবেন বলে মনে হয় না। অতএব, অনতিবিলম্বে এই মহান সম্পদ সংগ্রহ ও সংকলন একান্ত দরকার। এটি ভেবেই তিনি ইসলামী রাজ্যেও বিভিন্ন কেন্দ্রে নিম্নোক্ত ফরমান লিখে পাঠান-‘রাসূলের সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসের প্রতি দৃষ্টি দাও। তা সংগ্রহ- সংকলন কর।’’

মদীনার শাসনকর্তা ও বিচারপতি আবু বকর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হাযমকেও তিনি নিম্নোক্তভাবে ফরমান লিখে পাঠান- ‘রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর হাদীস বা তাঁর সুন্নাত অথবা হযরত ওমরের বাণী কিংবা অনুরূপ যা কিছু পাওয়া যায় তার প্রতি দৃষ্টি দাও এবং আমার জন্যে লিখে নাও। কেননা আমি ইলমে হাদীসের ধারক-বাহকদের অন্তর্ধান ও হাদীস সম্পদের বিলুপ্তির আশংকা করছি।’ (বুখারী-কিতাবুল ইলম)

ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ তাবেয়ী ইমাম জুহরীকে বিশেষভাবে হাদীস সংকলনের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের ফরমান জারি করার পর বেশি দিন জীবিত ছিলেন না (মৃত্যু: ১০১ হিজরি) কিন্তু তাঁর ফরমানের ফলে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের যে প্রবাহ শুরু হয়েছিল তা পরের কয়েকশ বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তাবেয়ীগণ বিভিন্ন শহরে উপস্থিত থাকা সাহাবী বা তাবেয়ীদের নিকট থেকে হাদীস সংগ্রহের জন্যে ব্যাপকভাবে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করতেন। হিজরী ২য় শতকের শুরু থেকে কনিষ্ঠ তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীনদের এক বিশাল কাফেলা সাহাবা ও প্রবীণ তাবেয়ীদের লিখিত হাদীসগুলো ব্যাপকভাবে একত্রিত করতে থাকেন। খলিফা ওমর বিন আব্দুল আজিজ রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর সরকারী ফরমান এব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

হিজরী প্রথম শতকে হাদীস সংকলন :

খলিফা ওমর ইবনে আব্দুল আযীযের আদেশক্রমে ইমাম শাবী, ইমাম যুহরী, ইমাম মাকহুল দামেশকী ও কাযী আবু বকর ইবনে হাযম রহমাতুল্লাহি আলাইহিসহ প্রমুখ হাদীস সংকলনে মনোনিবেশ করেন। এ শতকে হাদীস সংকলনের কাজ সামান্য হলেও এরই ফলে যে হাদীস গ্রন্থকারে সংকলনের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছিল তা অনস্বীকার্য।

হিজরী দ্বিতীয় শতকে হাদীস সংকলন :

হিজরী দ্বিতীয় শতকের প্রথম থেকেই হাদীস সংকলনের কাজ শুরু হয়। তবে এ শতকের মাঝামাঝি সময়ে একাজ নিয়মিতভাবে চলতে থাকে। এযুগে সংকলিত গ্রন্থগুলো হলো:

১. কিতাবুল আছার-ইমাম আবু হানিফা,
২.মুয়াত্তা-ইমাম মালেক
৩. আলজামে-সুফিয়ান সাওরী
৪. কিতাবুস সুনান-ইমাম মাকহুল
৫. কিতাবুস সুনান-আবু আমর আওযায়ী।
৬.কিতাবুস সুনান-আবু সাঈদ ইয়াহইয়া ইবনে যাকারিয়া।
৭. কিতাবুল মাগাযী- আবু বক্র ইবনে হাযম।
৮. কিতাবুস সুনান, কিতাবুযযুহ্দ, কিতাবুল মানাকিব-যায়েদ ইবনে কুদামা।
৯. ইমাম শাবী একই বিষয়ের হাদীস একই স্থানে একত্রিত করে একখানি গ্রন্থে রূপ দিয়ে ছিলেন বটে, কিন্তু তা মাত্র কয়েকটি অধ্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল। এর বেশি তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি।

হিজরী তৃতীয় শতকে হাদীস সংকলন :

হিজরী তৃতীয় শতকে মুসলিম জাহানে যাঁরা হাদীস শিক্ষাদান ও গ্রন্থ প্রণয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন তাঁরা হলেন, আলী ইবনুল মাদিনী, ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন, আবু জুযয়া রাযী, আবু হাতেম রাযী, মুহাম্মদ ইবনে জারীর তাবারী, ইবনে খোযায়মা, ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহে, মুহাম্মদ ইবনে সাদ ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল প্রমুখ। এসময় ‘মুসনাদ’ নামক গ্রন্থ সংকলন করা হয়। এ শতকের শেষ দিকে প্রসিদ্ধ ‘সিহাহ সিত্তাহ’ও সংকলন করা হয় এবং একে হাদীস সংকলনের সোনালী যুগ বলা হয়। হাদীসের এ গ্রন্থসমূহ সংকলিত হওয়ার পর হাদীস সংরক্ষণ ও প্রচারের প্রথম ও দ্বিতীয় যুগের ধারা পরিবর্তন হয়ে যায়। অর্থাৎ মুখস্থ করার মাধ্যমে সংরক্ষণ এবং বক্তব্যের মাধ্যমে প্রচারের ধারা পরিবর্তন হয়ে পুস্তক বা গ্রন্থ আকারে সংরক্ষণ ও পুস্তক পাঠের মাধ্যমে প্রচারের ধারা শুরু হয়ে যায় এবং তা দ্রুত গতিতে প্রসিদ্ধি ও জনপ্রিয়তা লাভ করে।

হিজরী ৫ম শতক থেকে বর্তমান কাল :

এ সুদীর্ঘ সময়ে হাদীস সংরক্ষণ, সংকলন ও প্রচারে যে কাজ হয়েছে তার সারসংক্ষেপ হলো:

১. হাদীসের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থসমূহের ভাষ্যগ্রন্থ, টীকা ও অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ গ্রন্থ রচিত হওয়া।

২. হাদীস শাস্ত্রের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা নিয়ে অসংখ্য গ্রন্থ এবং এসব গ্রন্থের ব্যাখ্যা ও সারসংক্ষেপ রচিত হওয়া।

৩. বিশেষজ্ঞ আলেমগণ কর্তৃক তৃতীয় যুগের গ্রন্থাবলী থেকে নিজেদের আগ্রহ বা প্রয়োজনে হাদীস চয়ন করে গ্রন্থ প্রণয়ন করা। এধরনের কয়েকটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হচ্ছে:

ক. মিশকাতুল মাসাবীহ-সংকলক : ওয়ালী উদ্দিন খতীব তাবরীযী।
খ. বিয়াদুস-সালিহীন-ইমাম আবু যাকারিয়া শরফুদ্দিন নববী।
গ. মুলতাকাল আখবার-
ঘ. মাসাবীহুস সুন্নাহ ইত্যাদি।

কম্পিউটার আবিষ্কার হওয়ার পর কম্পিউটার ডিস্কের মাধ্যমে হাদীস সংরক্ষণ ও ওয়েব সাইটের মাধ্যমে হাদীস প্রচারের কাজ শুরু হয়েছে এবং বর্তমানে তা দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

অতএব বিভ্রান্তি নয় চাই হাদিসের সঠিক জ্ঞানঃ

অতএব, রাসূল প্রেমিক জ্ঞান সাধকদের নিরন্তর সাধনা ও অধ্যাবসায়ের বদৌলতে সংকলিত হয়েছে রাসূলের অমূল্য হাদীস ভান্ডার। আধুনিক বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার এ যুগে হাদীস সংরক্ষণ ও প্রচার-প্রসারে ভবিষ্যতে উদ্ভাবিত হবে অসংখ্য অত্যাধুনিক পন্থা। তবে পাশাপাশি চালু রাখতে হবে হাদীসের বাস্তব অনুসরণের সনাতন ধারা। আল্লাহ পাক আমাদের হাদিস সংকলনের সঠিক ইতিহাস জানার মত সামান্যতম জ্ঞানটুকু দান করুন। হাদিসের জ্ঞান আহরণ করে আমাদের জ্ঞানভান্ডারকে সমৃদ্ধ করার এবং এর উপরে আমল করে সৌভাগ্য অর্জনের তাওফিক দান করুন।

ধারাবাহিক হাদিস সংকলনের ইতিহাস ভিত্তিক এই নিবন্ধটি প্রণয়নে কৃতজ্ঞতা: বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট গ্রন্থাবলী, অন্যান্য জার্নাল এবং মরহুম মাওলানা আব্দুর রহিম. রহমাতুল্লাহি আলাইহ প্রণিত এই সংক্রান্ত কিতাবাদি।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ১:১৫

নেওয়াজ আলি বলেছেন: শিক্ষা গ্রহনের জন্য সুদূর চীন দেশে যেতেও বাঁধা নেই। এই হাদিস নিয়ে আধুনিক ও বিজ্ঞান সম্মত মতবাদ বিশদ আলোচনা করবেন।

৩০ শে এপ্রিল, ২০২০ সকাল ১০:০২

নতুন নকিব বলেছেন:



শুকরিয়া। সুন্দর একটি প্রসঙ্গে আলোচনা করতে অনুরোধ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে চীন দেশে যাও কথাটি হাদীস নয়।

আরবীতে বলা- اطلبو العم ولو بالصين 'উতলুবুল ইলমা ওয়ালাও কানা বিচ্ছীন' বাক্যটি ব্যাপকভাবে হাদীস হিসাবে বলা হয়ে থাকে। প্রকৃত পক্ষে এটি মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নয়, পরবর্তী জ্ঞানী কোনো লোকের বাণী। তবে সন্দেহ নেই যে, বক্তব্যটি সঠিক ও বাস্তবসম্মত। ইলমে দ্বীন হাসিলের জন্য যত দূরের সফরই হোক, তাওফীক হলে তা করা উচিত। ইলম অন্বেষণে কখনো মেহনত-মুজাহাদা তথা কষ্ট-ক্লেশকে ভয় পাওয়া উচিত নয়। তদ্রূপ পার্থিব জীবনে প্রয়োজনীয় শিল্প ও বিদ্যা শিক্ষার জন্যও দূর দূরান্তে সফর করা জায়েয; বরং তা একটি পর্যায় পর্যন্ত কাম্যও বটে। এই সকল কিছু স্বস্থানে বিদ্যমান আছে এবং শরীয়তের বিভিন্ন দলীল দ্বারা তা প্রমাণিত। কিন্তু আমাদের আলোচ্য বাক্যটি হাদীস নয়। যদিও তা হাদীস হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, কিন্তু সনদে আবু ‘আতিবা তরীফ ইবনে সুলায়মান নামক একজন রাবী আছে যে হাদীস শাস্ত্রের ইমামগণের দৃষ্টিতে মাতরূক তথা পরিত্যক্ত বা পরিত্যাজ্য। তাকে হাদীস জাল করার অভিযোগেও অভিযুক্ত করা হয়েছে। রিজাল ও রেওয়ায়েত-শাস্ত্রের বিখ্যাত ইমাম আবু জা’ফর উকাইলী লেখেন- আয-যুআফাউল কাবীর, উকাইলী ২/২৩০; কিতাবুল মাজরূহীন, ইবনে হিব্বান ১/৩৮২; মিযানুল ইতিদাল ২/২৫৮; আলমুনতাখাব মিনাল ইলাল লিল-খাল্লাল ইবনে কুদামাহ পৃ. ১২৯-১৩০; আলমাকাসিদুল হাসানাহ, সাখাভী পৃ. ১২১

এই হাদিসকে যারা সহিহ বলতে চান তারা নিম্নোক্ত কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন-

عن انس بن مالك قال قال رسول الله صلي الله عليه و سلم اطلبو العم ولو بالصين فان طلب العلم فريضة علي كل مسلم

অর্থ: হযরত আনাস বিন মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তাআ'লা আনহু হতে বর্নিত, প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, 'ইলম অর্জনের জন্য সদূর চীন দেশ হলেও যাও, কেননা ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজ।' (দলীলঃ আল জামিউছ ছগীর লিস সূয়ুুতি ১ম খন্ড ১৬৮ পৃষ্ঠা-হাদীস শরীফ নং ১১১০, শুয়াবুল ঈমান লি বায়হাকী ২য় খন্ড ২৫৪ পৃষ্ঠা, হাদীস শরীফ নং ১৬৬৩,তারিখে বাগদাদ ৭/৩৬৪ ,কানযুল উম্মাল ১০/১৩৮, ২৮৬৯৭)

প্রকৃতপক্ষে এটি সহিহ হাদিস নয়ঃ
ইবন জাওযি এবং ইবন হিব্বান জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর চীনে যেতে হলেও যাও কথাটিকে জাল বলে প্রমাণ করেছেন। আলবানির সংকলিত ৫০০০ টি দুর্বল হাদিসের সংগ্রহে এটিকে জাল বলে চিহ্নিত করা হয়েছে [সিলসিলাতুল আহাদিস আল যায়িফা, ভলিউম ১, পৃষ্ঠা ৪১৩]। এই জাল হাদিসটি মানুষকে জ্ঞান অর্জনের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে ব্যবহার করা হয়—যার উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে মহৎ ও ভালো। কিন্তু এইরকম ভালো এবং মহৎ একটি উদ্দেশ্যে আল্লাহর রাসূল ﷺ এর নাম ব্যবহার করে ধর্মের নামে মিথ্যা কথা প্রচার করা অবশ্যই একটি বিরাট গুনাহ।

হাদিসে এসেছে- 'যে ব্যক্তি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমার নামে মিথ্যা ছড়ায়, তার পরিণতি জাহান্নাম'। সাহিহ বুখারি

জ্ঞান অর্জন একটি ধর্মীয় দায়িত্ব এবং আল্লাহ তাআ'লা আমাদেরকে কুরআনুল কারিমের বহু জায়গায় জ্ঞান অর্জনের কথা বলেছেন। যেমন-

১। وَقُل رَّبِّ زِدْنِي عِلْمًا

'অ ক্কুর রাব্বি যিদনি ই’লমান'।

'আর বলুন, হে প্রভু, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন।' (২০:১১৪)

২। قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُوْلُوا الْأَلْبَابِ

'বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না; তারা কি সমান হতে পারে? চিন্তা-ভাবনা কেবল তারাই করে, যারা বুদ্ধিমান।' (৩৯:৯)

৩। يَجْعَلُ الرِّجْسَ عَلَى الَّذِينَ لاَ يَعْقِلُونَ

আল্লাহ তাদের অন্তর কলুষিত করে দেন, যারা বিচার-বুদ্ধি ব্যবহার করে না। (১০:১০০)

৪। يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ

'তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস করে এবং যাদেরকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে অনেক সন্মানিত করবেন।' (৫৮:১১)

কুরআনুল কারিমে আরও বহু আয়াত রয়েছে এই বিষয়ে। সুতরাং, এত আয়াত থাকতে আমাদের জাল হাদিস প্রচার করার কোনো প্রয়োজন নেই।

আশা করছি আপনার বোধগম্য আকারে উপস্থাপন করতে পেরেছি। ভালো থাকবেন।

২| ২৮ শে এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৪:৪৮

রাজীব নুর বলেছেন: হাদীসের শিক্ষা আমি বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে পারলাম না।

৩০ শে এপ্রিল, ২০২০ সকাল ১০:০৩

নতুন নকিব বলেছেন:



চেষ্টা করেন ইনশাআল্লাহ পারবেন।

৩| ২৯ শে এপ্রিল, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৫৯

শের শায়রী বলেছেন: দারুন একটা পোষ্ট পড়লাম। অনেক অজানা বিষয় জানা হল। সরাসরি প্রিয়তে নিয়ে নিলাম। পোষ্টে +++ ধন্যবাদ আপনাকে।

৩০ শে এপ্রিল, ২০২০ সকাল ১০:০৭

নতুন নকিব বলেছেন:



আপনার প্রেরণাদায়ক মন্তব্য সত্যিই আনন্দিত করে। লাইকসহ পোস্ট প্রিয়তে নেয়ায় অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা।

আপনি তো মা-শাআল্লাহ খুবই ভালো লিখেন। সময় স্বল্পতার কারণে আপনার চমৎকার সব পোস্ট পড়ার সুযোগ তেমন একটা হয়ে ওঠে না। ইচ্ছে রয়েছে যাব ইনশাআল্লাহ।

নিরন্তর ভালো থাকার দুআ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.