নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আলহামদুলিল্লাহ। যা চাইনি তার চেয়ে বেশি দিয়েছেন প্রিয়তম রব। যা পাইনি তার জন্য আফসোস নেই। সিজদাবনত শুকরিয়া। প্রত্যাশার একটি ঘর এখনও ফাঁকা কি না জানা নেই, তাঁর কাছে নি:শর্ত ক্ষমা আশা করেছিলাম। তিনি দয়া করে যদি দিতেন, শুন্য সেই ঘরটিও পূর্নতা পেত!

নতুন নকিব

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দল-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না- বিদ্রোহী রন-ক্লান্ত। আমি সেই দিন হব শান্ত।

নতুন নকিব › বিস্তারিত পোস্টঃ

নামাজে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে সিজদায় যেতে হাতের পূর্বে প্রথমে মাটিতে হাঁটু রাখতে হবে

১৫ ই জুন, ২০২১ সকাল ১০:০৭

গুঠিয়া বাইতুল আমান জামে মসজিদ, বরিশাল এর ভিতরের একটি দৃশ্য, ছবিটি অন্তর্জাল থেকে নেয়া

নামাজে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে সিজদায় যেতে হাতের পূর্বে প্রথমে মাটিতে হাঁটু রাখতে হবে

নামাজে সিজদায় যেতে হাতের পূর্বে মাটিতে হাঁটু রাখার ব্যাপারটি সহজ এবং বিষয়টি যৌক্তিকও বটে। কারণ, একজন ব্যক্তি দাঁড়ানো অবস্থা থেকে সরাসরি যখন সিজদায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে মাটির দিকে ঝুঁকে যেতে থাকেন তখন সরাসরি প্রথমে তার হাঁটু মাটিতে স্থাপন করা হলে শরীরের উর্ধ্বাংশের ওজনের চাপ সামলানো তার পক্ষে সহজ এবং সহনীয় হয়। পক্ষান্তরে সরাসরি যদি তাকে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে মাটির কাছাকাছি গিয়ে প্রথমেই হাতের তালু মাটিতে স্থাপন করতে হয় তাহলে সেটা তার জন্য অপেক্ষাকৃত কঠিন এবং কষ্টদায়ক হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ, এর ফলে তার হাতের উপরে শরীরের প্রায় পুরে ভরটা এসে পড়ে যা নিঃসন্দেহে কষ্টদায়ক। অন্য দিকে হাঁটু অথবা পা হাতের চেয়ে ওজন বহনে অধিক শক্তিশালী হওয়ায় এইক্ষেত্রে হাঁটু আগে মাটিতে রাখা হলে একজন মুসল্লির পক্ষে কষ্টদায়ক বিষয়টি এড়িয়ে চলা সম্ভব।

ইসলাম প্রত্যেক কাজে শৃঙ্খলা এবং নিয়মানুবর্তিতা শেখায়ঃ

ইসলাম প্রতিটি কাজে শৃঙ্খলা, সৌন্দর্য্য, পরিচ্ছন্নতা এবং ধারাবাহিকতা রক্ষার নির্দেশ দেয়। নামাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো বিষয়টিতেই রয়েছে শৃঙ্খলাবোধ, পরিচ্ছন্নতাপ্রিয়তা এবং ধারাবাহিকতা ও নিয়মতান্ত্রিকতা রক্ষার অসাধারণ সৌন্দর্য্যের প্রতিফলন। দাঁড়ানো অবস্থা থেকে সিজদায় যেতেও এর ব্যতিক্রম নয়। এই ক্ষেত্রে প্রথমে মাটিতে রাখতে হয় উভয় হাঁটু, তারপরে হাত, তারপরে নাক, তারপরে কপাল। আবার সিজদা শেষ করে সোজা হয়ে বসা কিংবা দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে রক্ষা করতে হবে এর ঠিক বিপরীত ধারাবাহিকতা। অর্থাৎ, প্রথমে মাটি থেকে কপাল উঠবে, তারপরে নাক, তারপরে হাত এবং সর্বশেষে উঠবে উভয় হাঁটু। একটিবার প্রাকটিস করে দেখুন, কতই না নিপূন সুন্দর ধারাবাহিকতারক্ষার পদ্ধতি! এই পদ্ধতিতে সিজদায় গেলে কাউকে ধুপধাপ করে পড়তে হয় না এবং পর্যায়ক্রমিক সুন্দর এই পদ্ধতি ফলো করার ফলে কারও শারীরিক ছোটখাট কোনো সমস্যা, যেমন, হঠাৎ করে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে একইসাথে মাটিতে হাত স্থাপন করতে গেলে পিঠের কোনো মাংসপেশি বা নার্ভ সিস্টেমে টান লেগে ব্যথা বা কষ্ট পাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে না।

আচ্ছা, হাদিসের আলোকে বিষয়টি বিশ্লেষন করে দেখলে কি পাই আমরা? চলুন, এই বিষয়ক কিছু হাদিস দেখি, যেগুলোতে নামাজে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে সিজদায় যেতে হাতের পূর্বে মাটিতে হাঁটু রাখার দলিল রয়েছে।

নামাজে সিজদায় যেতে হাতের পূর্বে মাটিতে হাঁটু রাখার পক্ষে হাদিসের দলিলঃ

১. হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বলেন -

رَأَيْتُ النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم- إِذَا سَجَدَ وَضَعَ رُكْبَتَيْهِ قَبْلَ يَدَيْهِ وَإِذَا نَهَضَ رَفَعَ يَدَيْهِ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِ. رواه الأربعة وابن خزيمة وابن حبان وابن السكن وحسنه الترمذي.

অর্থ- আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি তিনি যখন সিজদায় যেতেন তখন হাত রাখার আগে হাঁটু রাখতেন। আর যখন সিজদা থেকে উঠতেন তখন হাঁটুর পূর্বে হাত উঠাতেন। -আবূ দাউদ শরীফ, হাদীস নং ৮৩৮; তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং ২৬৮; নাসায়ী শরীফ, হাদীস নং ১০৮৯; ইবনে মাজাহ শরীফ, হাদীস নং ৮৮২; ইবনে খুযায়মা, হাদীস নং ৬২৬; ইবনে হিব্বান, হাদীস নং ১৯০৯ ও ইবনুস সাকান (দ. আছারুস সুনান,পৃ. ১৪৮)

তিরমিযী বলেছেন এটি হাসান গারীব। হাদীসটির সনদ এরকম- ইয়াযীদ ইবনে হারূন বর্ণনা করেছেন শারীক থেকে, তিনি আসিম থেকে, তিনি তার পিতা কুলায়ব থেকে এবং তিনি হযরত ওয়াইল রা. থেকে।

২. হযরত আনাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বলেন,

عن أنس رض قال: رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم انحط بالتكبير فسبقت ركبتاه يديه. رواه الدارقطني والحاكم والبيهقي وقال الحاكم: هو على شرطهما ولا أعلم له علة. وقال البيهقي : تفرد به العلاء بن إسماعيل وهو مجهول.

অর্থ- আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখলাম, তিনি তাকবীর দিয়ে সিজদায় গেলেন এবং হাত রাখার আগে হাঁটু রাখলেন। -দারাকুতনী, হাদীস ১৩০৪, হাকেম, হাদীস ৮২২ ও বায়হাকী, হাদীস ২৬৩২

৩. হযরত সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বলেন,

كنا نضع اليدين قبل الركبتين فأمرنا أن نضع الركبتين قبل اليدين. أخرجه ابن خزيمة في صحيحه (٦٢٨) وفيه إبراهيم بن إسماعيل بن سلمة بن كهيل عن أبيه وهما ضعيفان.

অর্থ: আমরা হাঁটুর পূর্বে হাত রাখতাম। পরে আমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হল, হাতের পূর্বে হাঁটু রাখবে। -সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস নং ৬২৮। এর সনদ দুর্বল

৪. আসওয়াদ র. বলেন,

أن عمر كان يقع على ركبتيه . أخرجه ابن أبي شيبة (٢٧١٩)

অর্থ: হযরত উমর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু আগে হাঁটু রেখেই সিজদায় যেতেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ২৭১৯

তাহাবী র. আলকামা ও আসওয়াদ র. দুজনের সূত্র্রেই হযরত উমর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু এর এই আমল উল্লেখ করেছেন। সেখানে একথাও আছে, তিনি হাত রাখার পূর্বে হাঁটু রাখতেন। এর সনদ সহীহ।

৫. নাফে র. হযরত ইবনে উমর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু থেকে বর্ণনা করেন,

كان يضع ركبتيه إذا سجد قبل يديه ويرفع يديه إذا رفع قبل ركبتيه.

أخرجه ابن أبي شيبة (٢٧٢٠)

অর্থ: তিনি যখন সিজদায় যেতেন, তখন হাত রাখার পূর্বে হাঁটু রাখতেন। আর যখন সিজদা থেকে উঠতেন তখন হাঁটুর পূর্বে হাত ওঠাতেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ২৭২০। এর সনদ হাসান

৬. ইবরাহীম নাখায়ী রহ. বলেছেন,

حُفِظَ عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُودٍ، رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: " أَنَّ رُكْبَتَيْهِ، كَانَتَا تَقَعَانِ إِلَى الْأَرْضِ قَبْلَ يَدَيْهِ "

অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু থেকে (এই আমল) সংরক্ষিত আছে যে, তাঁর হাতের পূর্বে হাঁটু জমিনে লাগতো। -১৫২৯

এর সনদে হাজ্জাজ ইবনে আরতাত আছেন। তার বিশ্বস্ততা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে।

তবে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু এর শিষ্যগণের তদনুরূপ আমল প্রমাণ করে যে, তিনিও তাই করতেন। ইবনে আবী শায়বা তার মুসান্নাফ গ্রন্থে আবু ইসহাক থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন,

كَانَ أَصْحَابُ عَبْدِ اللهِ إذَا انْحَطُّوا لِلسُّجُودِ وَقَعَتْ رُكَبُهُمْ قَبْلَ أَيْدِيهِمْ

অর্থাৎ আব্দুল্লাহ (ইবনে মাসউদ) রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু এর শিষ্যগণ যখন সিজদা করতেন, তখন তাদের হাতের পূর্বে হাঁটু পড়ত। (২৭১১

সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমের আমলঃ

ইমাম তিরমিযী র. হযরত ওয়াইল রা. এর হাদীসটি উল্লেখপূর্বক বলেন,

والعمل عليه عند أكثر أهل العلم يرون أن يضع الرجل ركبتيه قبل يديه وإذا نهض رفع يديه قبل ركبتيه.

অর্থাৎ এ হাদীস অনুসারে অধিকাংশ আলেমের আমল। তারা মনে করেন হাত রাখার পূর্বে হাঁটু রাখবে। এবং হাঁটুর পূর্বে হাত ওঠাবে।

ইবনে হিব্বানও এটাকে মুস্তাহাব বলেছেন। তিনি হাদীসটির উপর এই অনুচ্ছেদ-শিরোনাম দিয়েছেন,

باب ذكر ما يستحب للمصلي وضع الركبتين على الأرض عند السجود قبل الكفين

অর্থাৎ অনুচ্ছেদ-মুসল্লির জন্য সেজদার সময় যমীনে হাত রাখার আগে হাঁটু রাখা মুস্তাহাব হওয়ার আলোচনা সম্পর্কে। এমনিভাবে তার উস্তাদ ইবনে খুযায়মা র.ও এই হাদীস অনুসারে আমল করাকে সুন্নত বলেছেন। তিনি এই হাদীসকে রহিতকারী (ناسخ) এবং হাত আগে রাখার হাদীসকে রহিত (منسوخ) আখ্যা দিয়েছেন।

ইবনুল মুনযির র. ‘আলআওসাত’ গ্রন্থে লিখেছেন,

وقد تكلم في حديث ابن عمر ، قيل إن الذي يصح من حديث ابن عمر موقوف وحديث وائل بن حجر ثابت وبه نقول (٣/٣٢٧)

অর্থাৎ ইবনে উমরের হাদীসটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, সহীহ কথা হলো এটি ইবনে উমরের নিজস্ব আমল। আর ওয়াইল ইবনে হুজর রা. এর হাদীসটি প্রমাণিত। আমাদের মতও অনুরূপ।

শাইখ ইবনে বাযের ফতওয়াঃ

সৌদি আরবের পধান মুফতী শায়খ আব্দুল আযীয ইবনে বায রহ. বলেছেন,

والأفضل أن يقدم ركبتيه قبل يديه عند انحطاطه للسجود هذا هو الأفضل ،

অর্থাৎ সেজদায় যাওয়ার সময় হাত রাখার পূর্বে হাঁটু রাখাই উত্তম। (মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে বায)

শাইখ ইবনে উছাইমিনের ফতওয়াঃ

আরবের আরেকজন খ্যাতনামা আলেম শায়খ মুহাম্মদ ইবনে সালেহ ইবনে উছায়মীন রহ.ও একই কথা বলেছেন। তার ফতোয়াটি উদ্ধৃত হয়েছে তৎপণীত ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম গ্রন্থে। (নং ২৪১) এটির বাংলা অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে।

হযরত ওয়াইল রাদি. বর্ণিত হাদিসটির মানঃ

আমাদের জানামতে বহু শীর্ষ মুহাদ্দিস হযরত ওয়াইল রা. বর্ণিত হাদীসটির অনুকূলে মতামত ব্যক্ত করেছেন। অনেকেই এটিকে সহীহ বলেছেন, কেউ হাসান বলেছেন, কেউবা অন্য কোনও পশংসনীয় বিশেষণ ব্যবহার করেছেন। যথা, ১. ইবনে খুযায়মা, ২. ইবনে হিব্বান, ৩, হাকেম আবু আব্দুল্লাহ, ৪. ইবনুস সাকান, ৫. হাফেয যাহাবী, ৬. ইবনুল মুলাক্কিন, আল বাদরুল মুনীর এর রচয়িতা। এ ছয়জন হাদীসটিকে সহীহ আখ্যায়িত করেছেন।

৭. ইমাম তিরমিযী। ৮. মুহিয়ুস সুন্নাহ বাগাবী, (শারহুস সুন্নাহ, নং ৬৪২) ৯. আবু বকর আল হাযেমী, তার আল ইতিবার গ্রন্থে, ১০. ইবনে সাইয়্যেদুন্নাস, তার তিরমিযীর ভাষ্যে। এ তিনজন হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।

১১. ইমাম ইবনুল মুনযির। তিনি এ হাদীসকে ছাবিত বা প্রমাণিত বলেছেন।

১২. আবু সুলায়মান খাত্তাবী, ১৩. ইবনুল জাওযী, ১৪. আমীর ইয়ামানী। এ তিনজন আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত হাদীসের তুলনায় এ হাদীসকে মজবুত আখ্যা দিয়েছেন।

আবু সুলায়মান খাত্তাবী বলেছেন, حديث وائل أثبت من هذا ওয়াইল রা. বর্ণিত হাদীসটি এটির (আবু হুরায়রা বর্ণিত হাদীসের) চেয়ে মজবুত।

আমীর ইয়ামানীর বক্তব্য সরাসরি এমন না হলেও তার আলোচনা থেকে তাই বোঝা যায়। (দ. সুবুলুস সালাম, সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ)

১৫. ইমাম নববী ও ১৬.যুরকানী এ দুজনের দৃষ্টিতে এটির সনদ জায়্যিদ বা উৎকৃষ্ট। কারণ তারা আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত হাদীসটির সনদকে জায়্যিদ বা উৎকৃষ্ট বলেছেন। আবার ইমাম নববী রহ. বলেছেন, দুটি মতের একটিকে অপরটির উপর প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে না। তার এ বক্তব্য উদ্ধৃত করে যুরকানী তার আলোচনা শেষ করেছেন। (দ. শারহুল মাওয়াহিব) বোঝা গেল, উভয় হাদীস তাদের দৃষ্টিতে সমমানের ছিল।

১৭. আরেকজন শীর্ষ মুহাদ্দিস হাফেজ জিয়া আলমাকদিসী। তিনি তার আল মুখতারা নামক হাদীসগ্রন্থে শরীক বর্ণিত একাধিক হাদীস সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, إسناده حسن এর সনদ হাসান। আর একটি হাদীস সম্পর্কে বলেছেন, إسناده صحيح এর সনদ সহীহ। (দ. নং ১০৫৭, এটি ইয়াযীদ ইবনে হারুন শরীক থেকে বর্ণনা করেছেন।)

সেই সঙ্গে ইমাম তিরমিযী খাত্তাবী, বাগাবী, আমীর ইয়ামানী ও শাওকানী প্রমুখ যে বলেছেন, ‘এ হাদীস অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমের মত’ সে হিসাবে বলা চলে, সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমের মতে এ হাদীসটি সহীহ বা হাসান মান সম্পন্ন।

আলবানী সাহেবের বক্তব্য ও পর্যালোচনাঃ

কিন্তু এতসব আলেমের মতামতকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে আলবানী সাহেব মিশকাত শরীফ ও সহীহ ইবনে খুযায়মার টিকায় দাবি করেছেন, এটি জয়ীফ বা দুর্বল। আর আসলু সিফাতিস সালাহ গ্রন্থে হযরত আবু হুরায়রা রা. ও ইবনে উমর রা. বর্ণিত হাদীস দুটির আলোচনা শেষে তিনি বলেছেন,

وقد عارضها أحاديث لا يصح شيء منها ونحن نسوقها للتنبيه عليها ولئلا يغتر به من لا علم له

অর্থাৎ এ হাদীসদুটির বিপরীতে কিছু হাদীস রয়েছে। যার কোনটিই সহীহ নয়। আমরা সেগুলো উল্লেখ করছি সতর্ক করার জন্য এবং যাতে এলেম সম্পর্কে বেখবর ব্যক্তিরা এর ধোঁকায় না পড়ে সে জন্য।

মস্ত বড় দাবি! এ দাবির অনিবার্য ফল হলো ইমাম তিরমিযীসহ পূর্বোল্লিখিত শীর্ষ মুহাদ্দিসগণ সকলে ধোঁকার শিকার হয়েছেন। যেমন, ধোঁকায় পড়েছেন ইমাম আবু হানীফা, শাফেয়ী, আহমদ ও ইসহাক রহ. সহ সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেম ও ফকীহ। এমন দাবি করা একজন আলেমের পক্ষে শোভনীয় কি না সে প্রশ্নে না গিয়ে আমরা এ দাবির পক্ষে পেশকৃত যুক্তি ও তার পর্যালোচনা তুলে ধরছি।

পূর্বোক্ত গ্রন্থে ওয়াইল রা. বর্ণিত হাদীসটি প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন,

وهذا سند ضعيف ، وقد اختلفوا فيه ؛ فقد حسنه الترمذي ، وقال الحاكم : " احتج مسلم بشريك " . ووافقه الذهبي . وليس كما قالا ؛ فإن شريكاً لم يحتج به مسلم ، وإنما روى له في المتابعات ؛ كما صرح به غير واحد من المحققين ، ومنهم الذهبي نفسه في " الميزان "

অর্থাৎ এটি জয়ীফ সনদ। এ ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। তিরমিযী এটিকে হাসান বলেছেন। আর হাকেম বলেছেন, শরীক (বর্ণিত হাদীস) দ্বারা মুসলিম রহ. প্রমাণ পেশ করেছেন। যাহাবীও তার (হাকেমের) সঙ্গে সহমত ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু তাদের কথা ঠিক নয়। মুসলিম রহ. শরীকের হাদীস প্রমাণস্বরূপ পেশ করেননি। সমর্থক বর্ণনারূপে পেশ করেছেন মাত্র। একাধিক মুহাক্কিক (তাত্ত্বিক) আলেম একথা স্পষ্ট করে বলেছেন। তন্মধ্যে যাহাবী নিজেও আল মীযান গ্রন্থে। (আসলু সিফাতিস সালাহ, ২/৭১৫)
এ ব্যাপারে অধমের আরজ হলো :

হাকেমের ন্যায় ইবনুল জাওযীও বলেছেন, ইমাম মুসলিম শরীকের বর্ণনাকে প্রমাণস্বরূপ পেশ করেছেন। এজন্য মুগলতায়ী রহ. ইকমাল গ্রন্থে বলেছেন, فينظر এটা অনুসন্ধানের দাবি রাখে। আমাদের জানামতে মুসলিম শরীফে ১০৩৯-১০২ ও ২২৫৬-২ নম্বরে উদ্ধৃত শরীক কর্তৃক বর্ণিত হাদীসদুটি প্রমাণস্বরূপ উদ্ধৃত হয়েছে।

তাছাড়া এ হাদীসটিকে তো আরো অনেকে সহীহ বা হাসান মনে করেছেন বা বলেছেন। যেমনটা আমরা উপরে উল্লেখ করলাম। আলবানী সাহেব এখানে এত কার্পণ্য করলেন কেন? নিজের পক্ষের দলিল হলে তো কে কোথায় কি বলেছেন খুঁড়ে খুঁড়ে তা বের করে আনেন। কিন্তু এখানে প্রকাশ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মন্তব্যগুলো তিনি এড়িয়ে গেলেন কেন? তার মতের পক্ষে নয় তাই?

এরপর তিনি লিখেছেন,

وكثيراً ما يقع الحاكم - ويتبعه الذهبي في " تلخيصه " - في هذا الوهم ؛ فيصححان كل حديث يرويه شريك على شرط مسلم

অর্থাৎ অনেক স্থানেই হাকেম ও তার অনুসরণে যাহাবী তার তালখীসুল মুসতাদরাক গ্রন্থে এ ভুলের শিকার হয়েছেন। শরীক কর্তৃক বর্ণিত (মুসতাদরাকে উদ্ধৃত) সব হাদীসকেই তারা মুসলিমের শর্ত মোতাবেক সহীহ আখ্যা দিয়েছেন। (প্রাগুক্ত)

কিন্তু আমাদের ধারণা যদি সত্য হয় এবং পেছনে উল্লেখকৃত নম্বর দুটির হাদীস দুটি যদি প্রমাণস্বরূপ উদ্ধৃত হয়ে থাকে, তবে বলতে হবে, হাকেমের এক্ষেত্রে কোনও ভুল হয় নি। আর যদি তার ভুল হয়েই থাকে তাতেই বা সমস্যা কী? তিনি ছাড়াও তো অনেকেই এই হাদীসকে সহীহ মনে করতেন। তাছাড়া হাকেমের এ ধরনের ভুল তো শরীক ছাড়া অন্য অনেকের বর্ণনার ক্ষেত্রেও ঘটেছে। কিন্তু আলবানী সাহেব সেকথা বলছেন না কেন? সেটা কি তার পক্ষের দলিল ইবনে উমর রা. এর হাদীসটি সম্পর্কে হাকেমের সহীহ বলাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য? কারণ আমাদের জানামতে ঐ হাদীসটিকে হাকেম ছাড়া অন্য কেউ সহীহ বলেন নি।

এরপর তিনি লিখেছেন,

وأما الدارقطني ؛ فقال :" تفرد به يزيد عن شَرِيك ، ولم يحدث به عن عاصم بن كُلَيب غير شريك ، وشريك : ليس بالقوي فيما يتفرد به " . وهذا هو الحق ؛ فقد اتفقوا كلهم على أن الحديث مما تفرد به شريك دون أصحاب عاصم ، وممن صرح بذلك غير الدارقطني : الترمذي ، والبيهقي ، بل قال يزيد بن هارون :" إن شريكاً لم يرو عن عاصم غير هذا الحديث " .

অর্থাৎ ‘দারাকুতনী রহ. বলেছেন, ‘এ হাদীসটি শরীক থেকে শুধু ইয়াযীদ (ইবনে হারুনই) বর্ণনা করেছেন। আর আসেম ইবনে কুলায়ব থেকে শরীক ছাড়া অন্য কেউ এটি বর্ণনা করেননি। আর নিঃসঙ্গ বর্ণনার ক্ষেত্রে শরীক মজবুত নন।’

এটিই সত্য কথা। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এ হাদীসটি আসেমের শাগরেদদের মধ্যে শরীকই একাকী বর্ণনা করেছেন। দারাকুতনী ছাড়া তিরমিযী ও বায়হাকী সুস্পষ্ট করে এ কথা বলেছেন। বরং ইয়াযীদ ইবনে হারুন এ কথাও বলেছেন যে, এ হাদীসটি ছাড়া শরীক আসেম থেকে অন্য কোন হাদীস বর্ণনা করেন নি।’ (প্রাগুক্ত, ২/৭১৫)

এখানে কয়েকটি বিষয় পণিধানযোগ্য:

ক. ইয়াযীদ ইবনে হারুন শরীক থেকে একা বর্ণনা করেছেন, একথা ঠিক নয়। সহীহ ইবনে খুযায়মায় সাহল ইবনে হারুনও শরীক থেকে বর্ণনা করেছেন। (দ. হাদীস নং ৬২৯)

খ. ‘আসেম ইবনে কুলায়ব থেকে শরীক একা বর্ণনা করেছেন’ তিরমিযী প্রমুখের এ কথার উদ্দেশ্য হলো, অবিচ্ছিন্ন সূত্র্রে কেবল তিনিই বর্ণনা করেছেন। তার বর্ণনার সমর্থক আরো যে দুটি বর্ণনা রয়েছে তার একটি মুরসাল, অপরটি মুনকাতি। মুহাদ্দিসগণের সিদ্ধান্ত হলো, মুরসাল ও মুনকাতি বর্ণনাও সমর্থকরূপে পেশ করা যায়। এ দুটি বর্ণনা আরো পরে আসছে। তাছাড়া শরীকের বর্ণনার সত্যতার সাক্ষী (শাহেদ) হিসাবে আছে হযরত আনাস রা. বর্ণিত হাদীসটি। সুত্ররাং শরীককে নিঃসঙ্গ বলাটা মোটেও ঠিক নয়।

গ. ইয়াযীদ যে বলেছেন, ‘এ হাদীসটি ছাড়া শরীক অন্য কোন হাদীস আসেম থেকে বর্ণনা করেন নি’ কথাটি আদৌ সঠিক নয়। আলবানী সাহেবের মতো বিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করা মানুষের পক্ষে এমন কথা উদ্ধৃত করা বড়ই আশ্চর্যের বলে মনে হয়। আসেম থেকে শরীক যে আরো অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন, সেগুলো এখানে উল্লেখ করতে গেলে এ পুস্তকের কলেবর বৃদ্ধি পাবে, তাই তিনটি হাদীস সম্পর্কে শুধু হাদীসগ্রন্থের নাম ও হাদীস নম্বর উল্লেখ করা হলো।

১. আবু দাউদ (৭২৮), তাবারানী কৃত মুজামে কাবীর, (৯৬)।

২. মুসনাদে আহমদ (১৮৮৪৭), আবু দাউদ (৭২৯), তাবারানী কৃত মুজামে কাবীর (৮৬১)।

৩. মুসনাদে আহমদ(১৮৮৬৮, ১৮৮৬৯), তাবারানী কৃত মুজামে কাবীর (১০২)।

এরপর আলবানী সাহেব লিখেছেন,

وشريك سيئ الحفظ عند جمهور علماء الحديث ، وبعضهم صرح بأنه كان قد اختلط ؛ فلذلك لا يحتج به إذا تفرد ، ولا سيما إذا خالف غيره من الثقات الحفاظ

অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ হাদীসবিদের দৃষ্টিতে শরীক ছিলেন দুর্বল স্মৃতির অধিকারী। তাদের কেউ কেউ তো স্পষ্ট বলেছেন, তার স্মৃতি-বিভাট ঘটেছিল। তাই তিনি যখন এককভাবে কোন হাদীস বর্ণনা করেন সেটা প্রমাণস্বরূপ পেশ করা যাবে না। বিশেষত যদি তিনি বিশ্বস্ত ও হাফেযে হাদীসগণের বর্ণনার বিপরীত বর্ণনা করে থাকেন। (প্রাগুক্ত, ২/৭১৬)

এ হলো আলবানী সাহেবের দাবি। মুহাদ্দিসগণের বক্তব্য ও কর্মপন্থার সঙ্গে এ দাবির কোন মিল নেই। আলবানীভক্তরা হয়তো চোখ বুঁজেই তার দাবিকে শতভাগ সত্য মনে করবেন। কিন্তু পেছনে একবার তাকিয়ে দেখুন, কত বিরাট সংখ্যক শীর্ষ হাদীসবিদ শরীকের হাদীসটিকে হয় সহীহ না হয় হাসান আখ্যা দিয়েছেন। আমি মনে করি আলবানী সাহেবের দাবির অসারতা প্রমাণের জন্য উক্ত সংখ্যাই যথেষ্ট। তদুপরি শরীক সম্পর্কে রিজালশাস্ত্রের পণ্ডিতগণের বক্তব্য এখানে তুলে ধরা হলো।

ইমাম আহমদ ও ইবনে মাঈন বলেছেন, صدوق ثقة তিনি সত্যনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত। ইবনে মাঈন আরো বলেছেন, ثقة ثقة তিনি বিশ্বস্ত বিশ্বস্ত। নাসাঈ বলেছেন, ليس به بأس তার মধ্যে অসুবিধার কিছু নেই। আবু দাউদ বলেছেন, ثقة يخطئ على الأعمش তিনি বিশ্বস্ত, তবে আমাশের হাদীসে ভুল করতেন। উল্লেখ্য, আলোচ্য হাদীসটি আমাশ থেকে বর্ণিত নয়। আবু ইসহাক আল হারবী তার তারীখ গ্রন্থে বলেছেন, তিনি বিশ্বস্ত ছিলেন। ইবনে শাহীন তার ছিকাত গ্রন্থে বলেছেন, ثقة ثقة তিনি বিশ্বস্ত বিশ্বস্ত। আহমদ আল ইজলী বলেছেন, كوفي ثقة وكان حسن الحديث তিনি কুফার অধিবাসী, বিশ্বস্ত ও উত্তম হাদীস বর্ণনাকারী ছিলেন। আবু হাতেম রাযীকে জিজ্ঞেস করা হলো, আবুল আহওয়াস (বুখারী ও মুসলিমের রাবী) ও শরীক এ দুজনের মধ্যে ভাল কে ? তিনি বললেন, আমার দৃষ্টিতে শরীকই ভালো। شريك صدوق قد كان له أغاليط শরীক সাদুক বা সত্যনিষ্ঠ, অবশ্য তার কিছু কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতিও রয়েছে। আলী ইবনুল মাদীনী বলেছেন, তিনি ইসরাঈল (বুখারী-মুসলিমের রাবী) এর চেয়ে বেশি জ্ঞান রাখতেন। আর তার তুলনায় ইসরাঈলের ভুল হতো কম। ইবনে সাদ বলেছেন, كان ثقة مأمونا كثير الحديث وكان يغلط كثيرا তিনি বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন ছিলেন। বহু হাদীসের অধিকারী। তিনি অনেক ভুল করতেন। ইয়াকুব ইবনে শায়বা বলেন, ثقة صدوق صحيح الكتاب رديئ الحفظ مضطربه তিনি বিশ্বস্ত ও সত্যনিষ্ঠ, তার কিতাব ছিল সহীহ বা বিশুদ্ধ, তার স্মৃতিশক্তি ছিল খারাপ, তাতে স্থিরতা ছিল না। (তারীখে বাগদাদ)

যারা বলেছেন, তিনি অনেক ভুল করতেন তাঁর সেসব ভুলের পরিমাণ কি ছিল, ইবনে আদী’র কথায় তারও তথ্য মেলে। তিনি বলেছেন, الغالب على حديثه الصحة والاستواء তার বর্ণনায় সঠিক ও বিশুদ্ধের সংখ্যাই বেশি।
এসব ভুল তার কোন কোন উস্তাদ থেকে বর্ণনার ক্ষেত্রে ঘটেছে? আবু দাউদ বলেছেন আমাশের নাম। এছাড়া কুফার অন্যান্য মুহাদ্দিস থেকে বর্ণনার ক্ষেত্রে আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেছেন, شريك أعلم بحديث الكوفيين من سفيان الثوري অর্থাৎ শরীক কুফাবাসীদের হাদীস সুফিয়ান ছাওরীর চেয়েও বেশি ভাল জানতেন।

বোঝা গেল, ভুলগুলো তিনি কুফার বাইরের উস্তাদগণ থেকে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে করতেন। উল্লেখ্য যে, শরীক এ হাদীসটি কুফাবাসী মুহাদ্দিস আসেম থেকে বর্ণনা করেছেন। সুত্ররাং এতে সন্দেহ থাকা উচিৎ নয়।

আরো একটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে। তা হলো, এ ভুলগুলো তার জীবনে কখন ঘটেছিল। শুরু থেকেই তিনি স্মৃতিদুর্বল ছিলেন, না পরবর্তীকালে এ সমস্যা দেখা দিয়েছিল। সালিহ ইবনে মুহাম্মদ বলেছেন, صدوق لما ولى القضاء تغير حفظه তিনি সাদুক ছিলেন। বিচারকের দায়িত্ব পাওয়ার পরেই তার স্মৃতিতে পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল। ইবনে হিব্বান তো আরো স্পষ্ট করে বলেছেন,

ولى القضاء بواسط سنة خمسين ومائة ثم ولى الكوفة ومات بها سنة سبع وسبعين ومائة وكان في آخر عمره يخطئ فيما روى وتغير عليه حفظه فسماع المتقدمين الذين سمعوا منه بواسط ليس فيه تخليط مثل يزيد بن هارون وإسحاق الأزرق وسماع المتأخرين عنه بالكوفة فيه أوهام كثيرة.

অর্থাৎ তিনি ১৫০ হি. সনে ওয়াসিতের বিচারক নিযুক্ত হয়েছিলেন। এরপর কুফার বিচারক হয়েছিলেন, এবং সেখানেই তিনি ১৭৭ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। শেষ বয়সে তিনি যেসব হাদীস বর্ণনা করতেন তাতে ভুল করতেন। তখন তার স্মৃতিও বদলে যায়। তাই কুফার কাজী হওয়ার পূর্বেই ওয়াসিতে যারা তার কাছ থেকে হাদীস শুনেছেন, তাতে কোন বিভাট ছিল না। যেমন, ইয়াযীদ ইবনে হারুন ও ইসহাক আল আযরাক। আর যারা এরপরে কুফায় শুনেছেন, সেখানে ভুল ছিল অনেক।

হাফেয ইবনে হাজারও তাকরীব গ্রন্থে বলেছেন, صدوق يخطئ كثيرا تغير حفظه بعد ما ولى قضاء الكوفة অর্থাৎ সাদূক, ভুল করতেন বেশি, কুফার কাজী নিযুক্ত হওয়ার পর তার স্মৃতিতে পরিবর্তন ঘটে। যাহাবীর মতেও তিনি বিশ্বস্ত ছিলেন। তিনি তাকে من تكلم فيه وهو موثق (যারা সমালোচিত অথচ বিশ্বস্ত) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। আল মুগনী গ্রন্থে যাহাবী বলেছেন, صدوق সাদুক।

আধুনিক কালের দুজন গবেষক ইবনে হিব্বানের এমতটিই পছন্দ করেছেন। একজন হলেন, আলাউদ্দীন আলী রেজা ‘আল ইগতিবাত বিমান রুমিয়া মিনার রুওয়াতি বিল ইখতিলাত’ গ্রন্থের (কৃত সিবতু ইবনিল আজমী) টীকায়, অপরজন হলেন ড. রিফয়াত ফাওযী আলাঈ কৃত আল মুখতালিতীন গ্রন্থের টীকায়।

অবাক হওয়ার বিষয় হলো, আলবানী সাহেব নিজেও অন্যত এই শরীক কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীস সম্পর্কে বলেছেন, إسناده حسن এর সনদ হাসান। কিন্তু এটা ছিল আমীন জোরে বলার হাদীস। তার পক্ষের, তাই। (দ. আসলু সিফাতিস সালাহ, জোরে আমীন বলার আলোচনা) একই গ্রন্থে অন্যত শরীকের একটি হাদীস সম্পর্কে বলেছেন, إسناده جيد এর সনদ উৎকৃষ্ট। (দ. ঊতীতু মিযমারান মিন মাযামীরি আলি দাউদ- হাদীসটির আলোচনা।) এ যেন তার মর্জি, যখন যাকে ইচ্ছা বিশ্বস্ত আখ্যা দেবেন, আবার সময়মতো দুর্বল সাব্যস্ত করবেন।

উল্লেখ্য যে, এ হাদীসটি ইয়াযীদ ইবনে হারুনই- যিনি ওয়াসিত নিবাসী ছিলেন- শরীক থেকে বর্ণনা করেছেন। ইবনে হিব্বানের ভাষ্যমতে শরীকের স্মৃতিতে পরিবর্তন আসার আগেই তিনি তার কাছ থেকে হাদীস শুনেছেন। অথচ এ হাদীসকেই আলবানী সাহেব জয়ীফ বা দুর্বল বলে উড়িয়ে দিতে চাচ্ছেন। শরীক সম্পর্কে এ আলোচনা ভাল করে পড়–ন আর ভাবুন, লা-মাযহাবী বন্ধুদের ভাষায় যুগশেষ্ঠ প্রকৃত মুহাদ্দিস সাহেব যা বলেছেন, তার সঙ্গে হাদীসবিদগণের বক্তব্যের মিল কতটুকু।

আরেকটি কথা হলো, আলবানী সাহেব যে বলেছেন, ‘বিশেষত যদি বিশ্বস্ত ও হাফেযে হাদীসগণের বর্ণনার বিপরীত বর্ণনা করে থাকেন’। এ কথাটি তিনি এখানে কেন জুড়ে দিয়েছেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। শরীক এখানে কোন হাফেযে হাদীসের বিপরীত বর্ণনা করেন নি।

আলবানী সাহেব আরো লিখেছেন,

فقد روى جمع منهم عن عاصم بإسناده هذا عن وائل صفة صلاته صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، وليس فيها ما ذكره شريك .

অর্থাৎ তাদের অনেকে আসিম থেকে একই সনদে ওয়াইল রা. থেকে রাসূল সা. নামাযের বিবরণমূলক হাদীস বর্ণনা করেছেন। কিন্তু শরীক যা উল্লেখ করেছেন সেখানে তা নেই। (প্রাগুক্ত, ২/৭১৬)

ভাল কথা, কিন্তু এ আপত্র্তি শুধু এখানে কেন? বুকে হাত বাঁধার হাদীস মুআম্মাল ইবনে ইসমাঈল সুফিয়ান থেকে বর্ণনা করেছেন। সেখানে অনেক গবেষক বলেছিলেন, মুআম্মাল এমনিতেই জয়ীফ, আবার সুফিয়ানের শাগরেদদের মধ্যে এই বর্ণনার ক্ষেত্রে নিঃসঙ্গ। কিন্তু সেখানে আপনি তা কর্ণপাত করেন নি। কারণ সেটি ছিল পক্ষের হাদীস। আবার হাঁটুর আগে হাত রাখা সংক্রান্ত ইবনে উমর রা. এর হাদীসটি দারাওয়ার্দী একাই উবাইদুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেছেন। উবায়দুল্লাহ থেকে দারাওয়ার্দীর বর্ণনার ক্ষেত্রে ইমাম আহমদ ও নাসাঈ প্রমুখের আপত্র্তি থাকা সত্ত্বেও আপনি সেটিকে সহীহ আখ্যা দিয়েছেন। শুধু কি তাই? আপনি সেখানে এই নীতিও আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে, وليس من شرط الحديث الصحيح أن لا ينفرد بعض رواته والا لما سلم لنا كثير من الأحاديث الصحيحة অর্থাৎ হাদীস সহীহ হওয়ার ক্ষেত্রে এমন শর্ত নেই যে, এর কোন বর্ণনাকারী এককভাবে বর্ণনা করতে পারবে না। এমনটি হলে অনেক সহীহ হাদীসই রক্ষা পাবে না। (প্রাগুক্ত, ২/৭২১)

এসব কথা কি এখানে দিব্যি ভুলে গেছেন?

তিনি আরো লিখেছেন,

على أنه قد رواه غيره عن عاصم عن أبيه عن النبي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مرسلاً ؛ لم يذكر وائلاً .أخرجه أبو داود ، والطحاوي ، والبيهقي عن شَقيق أبي ليث قال : ثني عاصم به .لكن شقيق : مجهول لا يعرف - كما قال الذهبي وغيره - .

অর্থাৎ অধিকন্তু শরীক ব্যতীত অন্য বর্ণনাকারী আসিমের সূত্র্রে তদীয় পিতা থেকে, তিনি নবী সা. থেকে এটি বর্ণনা করেছেন মুরসাল (সূত্রবিচ্ছিন্ন) রূপে, ওয়াইল রা. এর উল্লেখ ছাড়া। আবু দাউদ, তাহাবী ও বায়হাকী এটি উদ্ধৃত করেছেন শাকীক আবু লায়ছের সূত্র্রে। তিনি বলেছেন, আসিম আমার নিকট এভাবেই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তবে শাকীক মাজহুল বা অজ্ঞাত, যেমনটি বলেছেন যাহাবীসহ কেউ কেউ। (প্রাগুক্ত, ২/৭১৬)

আমাদের বক্তব্য হলো, শাকীক অজ্ঞাত, সুত্ররাং তার বর্ণনাকে শরীকের বর্ণনার বিপরীতে দাঁড় করিয়ে শরীকের বর্ণনাকে নাকচ করার সুযোগ কোথায়? কথাটি তো এভাবেও বলা যেত যে, এ মুরসাল বর্ণনাটিও শরীকের বর্ণনার সমর্থন যোগায়। কারণ সমর্থনের জন্য রাবীর অজ্ঞাত হওয়া বা সূত্র বিচ্ছিন্নতা কোনটিই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। মুহাদ্দিসগণের সিদ্ধান্ত এমনই।

শেষকথা তিনি লিখেছেন,

وله طريق أخرى معلولة عند أبي داود ، والبيهقي أيضاً عن عبد الجبار بن وائل عن أبيه مرفوعاً بمعناه وهذا منقطع بين عبد الجبار وأبيه ، فإنه لم يسمع منه

অর্থাৎ এর আরেকটি সনদ আছে। সেটিও মা’লুল বা দোষযুক্ত। আবু দাউদ ও বায়হাকী এটি উদ্ধৃত করেছেন আব্দুল জব্বার ইবনে ওয়াইল থেকে, তিনি তার পিতার সূত্র্রে নবী সা. থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। এ বর্ণনাটি সূত্রবিচ্ছিন্ন। কারণ আব্দুল জব্বার তার পিতা থেকে হাদীস শোনেন নি। (প্রাগুক্ত)

লক্ষ করুন, এ বর্ণনাটির সকল রাবী বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য। দোষ শুধু এতটুকু, সাহাবী ওয়াইল রা. এর ছেলে আব্দুল জব্বার পিতার কাছ থেকে হাদীস শোনেন নি। তার পরও তিনি পিতা থেকে এটি বর্ণনা করেছেন। বোঝা গেল, মাঝখানে অন্য কেউ আছেন, যার কাছ থেকে তিনি হাদীসটি শুনেছেন। ব্যাস, শুধু এই দোষের কারণে এটি শরীকের বর্ণনার সমর্থকরূপেও উল্লেখিত হওয়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে!

আলবানী সাহেবের এ বক্তব্য বড়ই আশ্চর্যের। কারণ প্রথমত, সূত্রবিচ্ছিন্ন বর্ণনাকে শর্তসাপেক্ষে পূর্ববর্তী ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণের অধিকাংশই প্রামাণ্য বলে গ্রহণ করেছেন। (দ. আবু দাউদ কৃত রিসালা আবী দাউদ ইলা আহলি মাক্কাহ ও ইবনে আব্দুল বার কৃত আত তামহীদের ভূমিকা।)

ইমাম বুখারী ও তার যুগের ও পরবর্তী যুগের অধিকাংশ মুহাদ্দিস অবশ্য এ ব্যাপারে কড়াকড়ি করেছেন। আর সেটাও শুধু এই সাবধানতার জন্য যে, পাছে না জানি কোন ভেজাল লোক মাঝখানে ঢুকে থাকে। আর জানা কথা যে, সাহাবীগণের ছেলেদের যুগে ভেজাল লোকের সংখ্যা খুবই কম ছিল। তাছাড়া আব্দুল জব্বার পিতার কাছ থেকে হাদীস শোনার সুযোগ না পেলেও পিতার হাদীসগুলো তিনি তার বড় ভাই আলকামা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য থেকে শুনেছেন। এসব ভেবেই হয়তো দারাকুতনী আব্দুল জব্বারের একটি হাদীস যা তিনি পিতার সূত্র্রে বর্ণনা করেছেন, সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন। (দ. আসসুনান, ১/৩৩৫)

দ্বিতীয়ত, যদি ধরেও নিই, সূত্র বিচ্ছিন্নতার কারণে এটি জয়ীফ বা দুর্বল, তথাপি অন্য আরেকটি হাদীসের সমর্থক হওয়ার ক্ষেত্রে তো কোন সমস্যা নেই। মুহাদ্দিসগণের সিদ্ধান্ত হলো জয়ীফ হাদীসও সমর্থকরূপে পেশ করা যায়। আলবানী সাহেবের মতো মানুষের কাছে এটা অজানা থাকার কথা নয়। কারণ তিনি নিজেই ইরওয়া গ্রন্থে ২৩১৭ নং হাদীসটি প্রসঙ্গে বলেছেন, وله شاهد مرفوع এর সমর্থক একটি মারফূ হাদীস আছে। অতঃপর তিনি আব্দুল জব্বার কর্তৃক তদীয় পিতার সূত্র্রে বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। শুধু তাই নয়, ‘আছছামারুল মুসতাতাব ফী ফিকহিস সুন্নাতি ওয়াল কিতাব’ গ্রন্থে আব্দুল জব্বারের এমন একটি সনদ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন,

وإسناده حسن إلا أن فيه انقطاعا لأن عبد الجبار ثبت عنه في (صحيح مسلم ) أنه قال : كنت غلاما لا أعقل صلاة أبي

অর্থাৎ এ হাদীসটির সনদ হাসান। তবে এতে সূত্রবিচ্ছিন্নতা রয়েছে। কেননা (সহীহ মুসলিমে) আব্দুল জব্বারের বাচনিক বিধৃত হয়েছে যে, আমি ছোট ছিলাম, বাবার নামায বুঝতাম না। (দ. পৃ. ১৫৪)

এখানে তিনি সনদের বিচ্ছিন্নতার কথা স্বীকার করা সত্ত্বেও কত পরিষ্কারভাবে হাদীসটিকে ‘হাসান’ বলে উল্লেখ করলেন। আর হাতের পূর্বে হাঁটু রাখার হাদীসটিকে প্রথমেই মা’লুল (দোষযুক্ত দুর্বল) বলে নাকচ করে দিলেন।

আলবানী সাহেবের একটি বড় ভুলও এখানে ধরা পড়েছে। তিনি আব্দুল জব্বারের এই শেষোক্ত বক্তব্যটিকে সহীহ মুসলিমের বলে উল্লেখ করেছেন। অথচ এটি মুসলিম শরীফে নেই। আছে আবু দাউদ (৭২৩) ইবনে খুযায়মা (৯০৫), তাহাবী (১৫৩৪), ইবনে হিব্বান (১৮৬২), ও তাবারানীর আল মুজামুল কাবীর (৬১) গ্রন্থে।

‘আমি ছোট ছিলাম’ আব্দুল জব্বারের এ উক্তির সনদ সহীহ। যেমনটি বলেছেন শোয়াইব আরনাউত ও আলবানী সাহেব। ইমাম বুখারীসহ অনেকে যে বলেছেন, ‘আব্দুল জব্বার মার্তৃগর্ভে থাকাকালে তার পিতার ইন্তেকাল হয়’ সেটা এই উক্তি দ্বারা নাকচ হয়ে যায়। একারণে তাহযীবুল কামালে মিযযী ও জামিউত তাহসীলে আলাঈ রহ. জোর দিয়ে বলেছেন, বুখারী প্রমুখের বক্তব্য সঠিক নয়। আসলে ইমাম বুখারী মুহাম্মদ ইবনে হুজর এর কথার উপর ভিত্তি করেই ঐ বক্তব্য দিয়েছেন। (দ. আততারীখুল কাবীর) অথচ মুহাম্মদ ইবনে হুজর ছিলেন জয়ীফ বা দুর্বল। দুর্বল রাবীর কথায় বিশ্বস্ত রাবীর মতামতকে উপেক্ষা করার এও একটি নজীর। ইমাম বুখারী নিজেও তার ‘তারীখে’ ফিতর ইবনে খালীফার বরাত দিয়ে আবু ইসহাক থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আব্দুল জব্বার বলেছেন, আমি পিতাকে বলতে শুনেছি। কিন্তু বুখারী ও ইবনে হিব্বান এ কথাটিও নাকচ করে দিয়েছেন।

সারকথা, হযরত ওয়াইল রা. বর্ণিত হাদীসটি সর্ববিচারে প্রমাণযোগ্য। এর বিরুদ্ধে আলবানী সাহেব ও তার সহমত পোষণকারীগণ যাই বলুন না কেন, তা ধোপে টেকে না। সুত্ররাং সিজদায় যাওয়ার সময় আগে হাঁটু ও পরে হাত রাখা সুন্নত হওয়ার ব্যাপারে কোনও সন্দেহই থাকল না।

হযরত আনাস রাদি. বর্ণিত হাদিসঃ

এ হাদীস সম্পর্কে আলবানী সাহেব বলেছেন,

قال الدارقطني والبيهقي : " تفرد به العلاء بن إسماعيل " . قلت : وهو مجهول ؛ كما قال ابن القيم (১/৮১) ، وكذلك قال البيهقي - على ما في " التلخيص "

অর্থাৎ দারাকুতনী ও বায়হাকী বলেছেন, এ হাদীসটি বর্ণনার ব্যাপারে আলা ইবনে ইসমাঈল নিঃসঙ্গ। আমি (আলবানী সাহেব) বলব, তিনি ছিলেন মাজহূল বা অজ্ঞাত। যেমনটি বলেছেন ইবনুল কায়্যিম। এবং বায়হাকীও তাই বলেছেন। তালখীস গ্রন্থ থেকে সেটা জানা গেছে।

বায়হাকীও মাজহূল বলেছেন- একথাটি আলবানী সাহেবের বোঝার ভুল। আত তালখীসুল হাবীর গ্রন্থের উপস্থাপনা থেকে এ ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছে। ঐ মন্তব্য আসলে ইবনে হাজার আসকালানীর, বায়হাকীর নয়। তবু তো শোকর, আলবানী সাহেব সেই গ্রন্থের বরাতেই কথাটি উল্লেখ করেছেন, যে গ্রন্থে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ রয়েছে। কিন্তু মুবারকপুরী সাহেব তুহফাতুল আহওয়াযী গ্রন্থে এবং শামসুল হক আযীমাবাদী সাহেব ‘আওনুল মাবুদ’ গ্রন্থে তালখীস গ্রন্থের বরাত ছাড়াই বলে দিয়েছেন, বায়হাকী তাকে মাজহূল বলেছেন!!

অবশ্য আলবানী সাহেবের ব্যাপারে একটু বেশি আশ্চর্য এজন্য লাগে যে, বায়হাকী’র গ্রন্থাবলি তার সামনে। তিনি সেগুলো ঘাঁটাঘাঁটিও করেছেন বিস্তর। বায়হাকীর কোন গ্রন্থে তিনি ঐ মন্তব্য অবশ্যই দেখতে পাননি। তারপরও কেন এত শৈথিল্য?

আমাদের জানামতে পূর্ববর্তী মুহাদ্দিসগণের কেউই আলা ইবনে ইসমাঈলকে মাজহূল বলেন নি। বরং হাকেম তার আল মুসতাদরাক গ্রন্থে আলা’র এ হাদীসকে বুখারী ও মুসলিমের শর্ত মোতাবেক সহীহ আখ্যা দিয়ে জানান দিয়েছেন, আলা তার নিকট পরিচিত্র্র। এদিকে আলা থেকে হাদীস বর্ণনাকারী তিনজন মুহাদ্দিসের নাম পাওয়া গেছে। ১. আব্বাস ইবনে মুহাম্মদ আদ দূরী, (হাকেম, দারাকুতনী, বায়হাকী) ২. মুহাম্মদ ইবনে আইয়্যূব (দ. ইবনে মানদাহ কৃত ফাতহুল বাব ফিল কুনা ওয়াল আলকাব, নং ১৯৪৭, ৩. ইবনে আবূ খায়ছামা। এই তৃতীয়জন তার আত তারীখুল কাবীরে (নং ৮১) বলেছেন,

حدثنا العلاء بن إسماعيل الكوفي أبو الحسن منزله بفيد نا حفص بن غياث فذكر حديث الباب

অর্থাৎ আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন আলা ইবনে ইসমাঈল আলকূফী আবুল হাসান। তার নিবাস ছিল ফায়দ (মক্কা ও কুফার মধ্যবর্তী একটি প্রসিদ্ধ এলাকা।) তিনি বলেছেন, হাফস ইবনে গিয়াস আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন, ...। অতঃপর তিনি এ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন।

লক্ষ্য করার বিষয় হলো প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে আবু খায়ছামা শুধু তার সূত্র্রে এ হাদীসটি বর্ণনাই করেন নি। সেই সঙ্গে আলা কোথায় বসবাস করতেন তাও উল্লেখ করেছেন। এতে বোঝা যায়, তিনি তাকে ভালোভাবেই চিনতেন জানতেন। সুত্ররাং এমন ব্যক্তি অজ্ঞাত হয় কীভাবে? দারাকুতনী ও বায়হাকী তার হাদীস উদ্ধৃত করেছেন, কিন্তু তাকে মাজহূল বা অজ্ঞাত বলেন নি।

এরপর আলবানী সাহেব লিখেছেন,

وأما قول الحاكم والذهبي : إنه " حديث صحيح على شرط الشيخين " فمنكر من القول ، لم يسبقهما ، ولم يتابعهما عليه أحد .

অর্থাৎ হাকেম ও যাহাবী যে বলেছেন, এটি বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে সহীহ, এটা অশোভন কথা। তাদের পূর্বেও কেউ এমন কথা বলেন নি। তাদের পরেও কেউ এটা সমর্থন করেন নি। (আসলু সিফাতিস সালাহ, ২/৭১৭)

অথচ আলবানী সাহেবের বিভিন্ন গ্রন্থে এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে তিনি হাকেমের সহীহ বলাকে লুফে নিয়েছেন। সেখানেও হাকেমের আগে পরে কেউ উক্ত হাদীসকে সহীহ বলেন নি। ইবনে উমর রা.এর হাদীসটির কথাই ধরুন, যেটাকে আলবানী সাহেব তার মতের স্বপক্ষে দলিল হিসাবে পেশ করেছেন। সে হাদীসকেও হাকেম ছাড়া কেউ সহীহ বলেন নি। সামনে এ সম্পর্কে আলোচনা আসছে। অথচ আলবানী সাহেব হাকেমের উদ্ধৃতি থেকে জোর দিয়ে বলেছেন, হাদীসটি সহীহ। তাহলে এখানে তিনি হাকেমের উপর এত ক্ষিপ্ত হলেন কেন? এ হাদীসটি তার মতের বিপক্ষে গেছে তাই?

এরপর তিনি লিখেছেন,

وقال الحافظ في ترجمة العلاء هذا من " اللسان " : " وقد خالفه عمر بن حفص بن غياث ، وهو من أثبت الناس في أبيه ؛ فرواه عن أبيه عن الأعمش عن إبراهيم عن علقمة وغيره عن عمر موقوفاً عليه . وهذا هو المحفوظ " .

অর্থাৎ হাফেজ (ইবনে হাজার) লিসানুল মীযান গ্রন্থে এই আলা’র জীবনীতে বলেছেন, হাফস ইবনে গিয়াসের ছেলে উমর- যিনি তার পিতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য- তার (আলা’র) থেকে ব্যতিক্রম বর্ণনা করেছেন। তিনি তার পিতার সূত্র্রে আ’মাশ থেকে, তিনি ইবরাহীম নাখায়ীর সূত্র্রে আলকামা প্রমুখ থেকে উমর রা.এর নিজস্ব আমলরূপে এটি বর্ণনা করেছেন। আর এটাই হলো সঠিক বর্ণনা। (প্রাগুক্ত, ২/৭১৭)

আমরা বলব, এ দুটি বর্ণনা ভিন্ন ভিন্ন দুটি হাদীস। এর একটিকে অপরটির মোকাবেলায় দাঁড় করানো উচিৎ নয়।

পরিশেষে তিনি বলেছেন,

على أن حديث أنس لو صح ؛ ليس فيه التصريح أنه صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كان يضع ركبتيه قبل يديه ، وإنما فيه سَبْقُ الركبتين اليدين فقط ، وقد يمكن أن يكون هذا السبق في حركتهما لا في وضعهما - كما قال ابن حزم رحمه الله - .

অর্থাৎ অধিকন্তু আনাস রা. বর্ণিত হাদীসটি যদি সহীহও হয়, তথাপি এতে স্পষ্ট বলা হয় নি যে, নবী সা. হাত রাখার পূর্বে হাঁটু রাখতেন। সেখানে এতটুকু বলা হয়েছে, তাঁর হাঁটু আগে যেত। এমনও তো হতে পারে, মাটিতে রাখার সময় নয়, নড়াচড়ার সময় হাঁটু আগে যেত। যেমনটি বলেছেন ইবনে হাযম রহ.। (প্রাগুক্ত)

এ বড়ই আশ্চর্যের কথা। নড়াচড়ার সময় হাঁটু আগে যাবে কি করে? যারা বলেন, হাঁটুর পূর্বে হাত রাখবে তারা তো হাত মাটিতে রাখার পর হাঁটু হেলিয়ে থাকেন। সুত্ররাং সেটা আগে যাওয়ার সুরত কী? হাঁটু তো আর কাপড়ের আচল নয় যে, এমনিতেই নড়াচড়া করবে।

তাছাড়া শুধু ইবনে হাযমের উপর নির্ভর করলেন কেন? দারাকুতনী, হাকেম ও বায়হাকী প্রমুখকে একটু জিজ্ঞেস করুন, তারা হাদীসটির কি অর্থ বুঝেছেন এবং কোন বিষয়ের প্রমাণস্বরূপ সেটি উদ্ধৃত করেছেন?

হাঁটুর পূর্বে হাত রাখার দলিল : একটি পর্যালোচনাঃ

এক্ষেত্রে দুটি হাদীস এসেছে। হাদীসদুটি পর্যালোচনাসহ এখানে তুলে ধরা হলো।

প্রথম হাদীস

প্রথম হাদীসটি আবু হুরায়রা রা.এর সূত্র্রে বর্ণিত। এটি দুভাবে বর্ণিত হয়েছে।

ক. আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন,

يعمد أحدكم فيبرك في صلاته برك الجمل

অর্থাৎ তোমাদের কেউ কেউ কি এমন করে যে, নামাযে উটের মতো করে বসে? )তিরমিযী, ২৬৯; নাসাঈ, ১০৯০(

এ হাদীসে উটের মতো করে বসা যে অপছন্দনীয় সেটাই প্রকাশ করা হয়েছে। আলেমগণের এক জামাত্র বলেছেন, উটের সামনের পা দুটিই হলো হাত। তাই যেহেতু উট প্রথমে হাত গুটিয়ে বসে, তাই এটা অপছন্দ করার অর্থ হলো আগে হাত ও পরে হাঁটু রাখা পছন্দনীয় নয়। এ হিসেবে হাদীসটি আগে হাঁটু পরে হাত রেখে সেজদা করার পক্ষেই দলিল হয়। আল্লামা আবু বকর জাসসাস রাযী, সারাখসী, ইবনুল কাইয়্যিম, আমীর ইয়ামানী, হাসান ইবনে আহমদ সানআনী (ফাতহুল গাফফার পণেতা) ও শায়খ সালিহ উছায়মীন প্রমুখ এ মতই অবলম্বন করেছেন। আবার মুবারকপুরী ও আলবানী সাহেবসহ অনেকে বলেছেন, উটের সামনের প্রায়েই যেহেতু তার হাঁটু, সে হিসাবে উট প্রথমে হাঁটু রাখে, তাই হাদীসে এটাকে অপছন্দ করে আগে হাত রেখে পরে হাঁটু রাখতে উৎসাহিত করা হয়েছে।

কিন্তু এই বিতর্কের পূর্বে আমাদেরকে দেখতে হবে, হাদীসটি আসলে সঠিক ও প্রমাণিত কি না। হাদীসটির দুজন রাবী নিয়ে কথা আছে। একজন হলেন মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে হাসান। তার সম্পর্কে নাসাঈ বিশ্বস্ত হওয়ার দাবি করলেও ইমাম বুখারী রহ. তার আত তারীখুল কাবীরে এ হাদীসটি উল্লেখপূর্বক মন্তব্য করেছেন, لا يتابع عليه ولا أدري سمع من أبي الزناد أم لا অর্থাৎ তার হাদীসটির সমর্থন পাওয়া যায় না। আমি জানি না তিনি আবুয যিনাদ থেকে (হাদীসটি) শুনেছেন কি না। (নং ৪১৮)

অপর রাবী হলেন আব্দুল্লাহ ইবনে নাফি আস সাইগ। তার বিশ্বস্ততা নিয়ে মুহাদ্দিসগণের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। ইবনে মাঈন ও ইজলী প্রমুখ তাকে বিশ্বস্ত বলেছেন। কিন্তু ইমাম আহমদ বলেছেন, لم يكن في الحديث بذاك অর্থাৎ তিনি হাদীসের ক্ষেত্রে তেমন মজবুত ছিলেন না। ইমাম বুখারী রহ. বলেছেন, يعرف حفظه وينكر وكتابه أصح অর্থাৎ তার স্মৃতি কখনো ঠিক থাকে, কখনো আপত্র্তিকর ঠেকে, তবে তার কিতাব অধিক শুদ্ধ। আবু হাতেম রাযী বলেছেন, هو لين في حفظه وكتابه أصح অর্থাৎ তিনি স্মৃতির ক্ষেত্রে দুর্বল ছিলেন, তার কিতাব অধিক শুদ্ধ ছিল। (দ. তাহযীবুল কামাল ও আলজারহু ওয়াত তাদীল) আবু যুরআ রাযী এক বর্ণনায় তো বলেছেন, لا بأس به অর্থাৎ তার মধ্যে তেমন সমস্যা নেই। কিন্তু বারযায়ীর বর্ণনায় তিনি বলেছেন, هو عندي منكر الحديث অর্থাৎ তিনি আমার দৃষ্টিতে আপত্র্তিকর হাদীস বর্ণনাকারী। বারযায়ী আরো বলেন,

ذكرت أصحاب مالك يعني لأبي زرعة فذكرت عبد الله بن نافع الصائغ فكلح وجهه

অর্থাৎ আমি মালেক রহ.এর শিষ্যদের কথা উল্লেখ করলাম অর্থাৎ আবু যুরআর নিকট, আমি আব্দুল্লাহ ইবনে নাফি আস সাইগ এর কথা বলতেই তিনি মুখ কালো করে ফেললেন।

ইবনে হিব্বান বলেছেন, كان صحيح الكتاب وإذا حدث من حفظه ربما أخطأ অর্থাৎ তার কিতাব সঠিক, যখন তিনি মুখস্থ হাদীস বর্ণনা করেন, তখন মাঝেমধ্যেই ভুল করেন। দারাকুতনী বলেছেন, فقيه يعتبر به অর্থাৎ তিনি ফকীহ, অন্যের সমর্থনকল্পে তাকে গ্রহণ করা যায়। ইবন মানজুয়াহ তার রিজালু সাহীহ মুসলিম গ্রন্থে বলেছেন, في حفظه شيئ তার স্মৃতিশক্তিতে সমস্যা ছিল। এসব মন্তব্য বিবেচনায় নিয়েই ইবনে হাজার আসকালানী তার তাকরীব গ্রন্থে লিখেছেন, ثقة صحيح الكتاب في حفظه لين অর্থাৎ তিনি বিশ্বস্ত, তার কিতাবও সঠিক, তবে তার স্মৃতিতে দুর্বলতা ছিল।

এখন এ হাদীসটিকে সহীহ আখ্যা দেওয়ার একটাই পথ। আর তা হলো একথা প্রমাণ করা যে, তিনি এ হাদীসটি তার কিতাব থেকেই বর্ণনা করেছেন। কিতাব থেকে বর্ণনা করলেও সহীহ তখন হতো যদি তার উস্তাদ সমালোচনার উর্ধ্বে হতেন। কিন্তু পেছনে আমরা দেখলাম, তিনিও সমালোচনা মুক্ত নন। বিশেষ করে ইমাম বুখারী তার নির্ণয়ন নিয়েও দ্বিধা প্রকাশ করেছেন। এবং তাকে তার আয যুআফা (দুর্বল রাবীদের জীবনচরিত) গ্রন্থে উল্লেখ করে তার দুর্বল হওয়ারই ইঙ্গিত দিয়েছেন। এ কথার উদ্ধৃতি একটু পরেই আসছে।

এসব কারণে এই হাদীসকে সহীহ বলা তো দূরের কথা, হাসান বলাও মুশকিল। তাই তো ইমাম তিরমিযী ও আবু বকর হাযেমী এই হাদীসকে গরীব বলে এর দুর্বলতার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। বুখারী ও দারাকুতনীও এটি মা’লুল বা দুর্বল সাব্যস্ত করেছেন। মুহাদ্দিস হামযা কিনানী (মৃত্যু ৩৫৭ হিজরী) বলেছেন, هو منكر অর্থাৎ এটি আপত্র্তিকর বর্ণনা। ইবনে রজব হাম্বলী তার বুখারী শরীফের ভাষ্যগ্রন্থ ফাতহুল বারীতে বলেছেন, لا يثبت এটি প্রমাণিত নয়।

শুধু তারাই নন, স্বয়ং আলবানী সাহেবও সাহীহা গ্রন্থে (৩১৯৬) আব্দুল্লাহ ইবনে নাফি’ সম্পর্কে বলেছেন,

وفيه ضعف من قبل حفظه قال الحافظ في التقريب : ثقة صحيح الكتاب في حفظه لين

অর্থাৎ স্মৃতিশক্তির দিক থেকে তার মধ্যে কিছু দুর্বলতা রয়েছে। হাফেজ তাকরীবে বলেছেন, তিনি বিশ্বস্ত, তার লিখিত কপি সঠিক কিন্তু তার স্মৃতিতে কিছু দুর্বলতা আছে। এর চেয়েও আশ্চর্য হলো, জয়ীফা গ্রন্থে (৬৬১৬) তিনি তার হাদীস সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে,

قلت: وهذا إسناد ضعيف، عبد اللة بن نافع - هو: الصائغ، وهو -: ثقة صحيح الكتاب، في حفظه لين - كما في " التقريب " -، ولا أدري هذا مما حدث به من كتابه أم من حفظه.

অর্থাৎ আমি বলব, এই সনদটি দুর্বল। আব্দুল্লাহ ইবনে নাফি’ আসসাইগ বিশ্বস্ত, তার লিখিত কপিও সঠিক। কিন্তু তার স্মৃতিতে কিছু দুর্বলতা রয়েছে, যেমনটি তাকরীব গ্রন্থে বলা হয়েছে। আমার জানা নেই, এই হাদীসটি তিনি লিখিত কপি থেকে বর্ণনা করেছেন না স্মৃতি থেকে।

এমনিভাবে জয়ীফে আবু দাউদে আলবানী সাহেব তার হাদীসকে দুর্বল আখ্যা দিয়ে বলেছেন, وهو ضعيف من قبل حفظه অর্থাৎ তিনি স্মৃতির দুর্বলতার কারণে দুর্বল। (নং ৭৮) উক্ত গ্রন্থেই ২২১ নং হাদীস সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেছেন, إسناده ضعيف ابن نافع لين الحفظ অর্থাৎ এর সনদ দুর্বল। ইবনে নাফি স্মৃতি-দুর্বল ছিলেন।

তাহলে আলবানী সাহেবের নীতি অনুসারেও উল্লিখিত হাদীসটি যঈফই প্রমাণিত হয়। আর বড় বড় মুহাদ্দিসগণ তো এটিকে দুর্বল আখ্যা দিয়েছেনই।

খ. হাদীসটি ভিন্ন আরেকটি সূত্র্রে একটু ভিন্ন শব্দে এভাবে উদ্ধৃত হয়েছে, আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূল সা. বলেছেন,

إذا سجد أحدكم فلا يبرك كما يبرك البعير وليضع يديه قبل ركبتيه

অর্থাৎ তোমাদের কেউ যখন সেজদা করে তখন উটের মতো করে যেন না বসে। সে যেন তার হাঁটুদ্বয়ের পূর্বে হস্তদ্বয় রাখে। (আবু দাউদ, হাদীস ৮৪০; নাসাঈ, হাদীস ১০৯১; দারিমী, হাদীস ১৩৬০; মুসনাদে আহমদ, হাদীস ৮৯৫৫; দারাকুতনী, ১/৩৪৫; বায়হাকী, হাদীস ২৬৩৩)

এ হাদীসটির সনদেও দুজন সমালোচিত্র্র্র রাবী রয়েছেন। একজন তো হলেন পূর্ববর্তী সনদটিতে উল্লিখিত সেই মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে হাসান। অপরজন হচ্ছেন তারই শিষ্য আব্দুল আযীয ইবনে মুহাম্মদ আদ দারাওয়ার্দী। দারাওয়ার্দীর স্মৃতিদুর্বলতা নিয়ে অনেক মুহাদ্দিসই সমালোচনা করেছেন। ইমাম আহমদ বলেছেন, যখন তিনি স্মৃতি থেকে হাদীস বর্ণনা করেন, তখন ভুল করে ফেলেন, তখন আর তিনি বিশ্বস্ত থাকেন না। আর যখন লেখা কপি থেকে বর্ণনা করেন তখন ঠিক মতোই বর্ণনা করেন। অন্যত তিনি বলেছেন, স্মৃতি থেকে বর্ণনা করার সময় তিনি অনেক বাতিল হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, অনেক সময় তিনি অন্যদের লেখা কপি থেকে বর্ণনা করতেন এবং ভুলের শিকার হতেন। আবু যুরআ রাযী বলেছেন, তিনি দুর্বল স্মৃতিসম্পন্ন। স্মৃতি থেকে কিছু হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং ভুলের শিকার হয়েছেন। নাসাঈ এক বর্ণনায় বলেছেন, তিনি মজবুত বর্ণনাকারী নন। আবু হাতেম রাযী বলেছেন, তার দ্বারা প্রমাণ পেশ করা যায় না। এসব কারণে বুখারী ও মুসলিম তার একক কোন বর্ণনা গ্রহণ করেন নি। সুত্ররাং তার একক বর্ণনাকে সহীহ আখ্যা দেওয়া কঠিন।

আরেকটি কথা, দারাওয়ার্দীর এই বর্ণনায় হাঁটুর পূর্বে হাত রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু হাত কোথায় রাখবে তা স্পষ্ট করে বলা হয় নি। কিন্তু এই আব্দুল আযীয দারাওয়ার্দীর অপর একটি বর্ণনা বায়হাকীতে উদ্ধৃত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, وليضع يديه على ركبتيه অর্থাৎ সে যেন তার উভয় হাত দু’হাঁটুর উপর রাখে। (নং ২৬৩৪)

এটি উদ্ধৃত করার পর বায়হাকী রহ. লিখেছেন,

فَإِنْ كَانَ مَحْفُوظًا كَانَ دَلِيلاً عَلَى أَنَّهُ يَضَعُ يَدَيْهِ عَلَى رُكْبَتَيْهِ عِنْدَ الإِهْوَاءِ إِلَى السُّجُودِ

অর্থাৎ এ বর্ণনাটি সঠিক হলে এটি সেজদায় যাওয়ার সময় উভয় হাত হাঁটুর উপর রাখার দলিল হবে।

এ হিসাবে হাদীসটির মর্ম দাঁড়াবে, তোমাদের কেউ যেন উটের মতো করে সেজদায় না যায়। বরং তার হাঁটু জমিতে রাখার পূর্বেই যেন উভয় হাত দু’হাটুর উপর রাখে। ইমাম কাশ্মিরী রহ.ও হাদীসটির এমর্ম সমর্থন করেছেন। নীমাবী রহ. কৃত আছারুস সুনান গ্রন্থের টীকায় তিনি লিখেছেন,

إنما يريد جعل اليدين على الركبتين حتى يصير شيئا واحدا ولم أر في لفظ ذكر الأرض فالمراد وضع اليدين على موضعهما وهما الركبتان فإنه لا موضع لهما في حين الانحطاط وبين السجدتين والقعدة إلا الركبتان

অর্থাৎ হাদীসটির মর্ম হলো, উভয় হাত হাঁটুর উপর রাখা, যাতে সবটা এক জিনিস হয়ে যায়। এর কোন বর্ণনাতেই আমি জমিনে রাখার উল্লেখ পাই নি। সুত্ররাং এর মর্ম হবে, উভয় হাত যথাস্থানে রাখা। আর সেই স্থান হলো হাঁটু। কেননা সেজদায় যাওয়ার সময়, দুই সেজদার মাঝে ও বৈঠককালে হাত রাখার স্থানই হলো হাঁটু। (পৃ. ১১৬)

দ্বিতীয় হাদীস :

১. আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন,

ان رسول الله صلى الله عليه وسلم كان إذا سجد يضع يديه قبل ركبتيه

অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সা. যখন সেজদা করতেন, তখন হাঁটু রাখার পূর্বে হাত রাখতেন। (দারাকুতনী, ১/৩৪৪)

এ হাদীস ভিন্ন শব্দে এভাবেও উদ্ধৃত হয়েছে-

عن نافع عن ابن عمر : أنه كان يضع يديه قبل ركبتيه وقال : كان رسول الله صلى الله عليه و سلم يفعل ذلك
নাফি বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. হাঁটু রাখার পূর্বে হাত রাখতেন এবং বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সা. এমনটি করতেন। সহীহ ইবনে খুযায়মা (৬২৭), মুসতাদরাকে হাকেম (৯৩০) ও বায়হাকী (২৬৩৮)। হাকেম বলেছেন, এটি ইমাম মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহীহ।

পর্যালোচনা

একাধিক হাদীসগ্রন্থে উদ্ধৃত হলেও এ হাদীসটির সনদ বা সূত্র মাত্র একটিই। আব্দুল আযীয ইবনে মুহাম্মদ দারাওয়ার্দী এটি বর্ণনা করেছেন উবায়দুল্লাহ ইবনে উমর আলউমারী থেকে, তিনি নাফি’ থেকে, তিনি হযরত ইবনে উমর রা. থেকে। আব্দুল আযীয দারাওয়ার্দী ছাড়া অন্য কেউ এটি বর্ণনা করেন নি। দারাওয়ার্দীর স্মৃতিদুর্বলতা সম্পর্কে পেছনের হাদীসে আলোচনা করা হয়েছে। স্মৃতিদুর্বলতার পাশাপাশি এ হাদীসে আরেকটি বড় সমস্যা হলো, উবায়দুল্লাহ আল উমারী থেকে তাঁর বর্ণনার ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণের আপত্র্তি রয়েছে। ইমাম আহমদ বলেছেন, ما حدث عن عبيد الله بن عمر فهو عن عبد الله بن عمر অর্থাৎ তিনি উবায়দুল্লাহ ইবনে উমর থেকে যত হাদীস বর্ণনা করেছেন, তা সবই আসলে (তারই ভাই) আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (আল উমারী) থেকে। (দ. আলজারহু ওয়াত তা’দীল লি ইবনি আবী হাতিম, নং ১৮৩৩)

যদি তাই হয়, তবে আব্দুল আযীয দারাওয়ার্দী যত হাদীস উবায়দুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেছেন তার সবই জয়ীফ বা দুর্বল। কেননা আব্দুল্লাহ আল উমারী মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে দুর্বল ছিলেন।

ইমাম নাসাঈ দারাওয়ার্দী সম্পর্কে বলেছেন, ليس به بأس وحديثه عن عبيد الله منكر অর্থাৎ তার মধ্যে সমস্যার কিছু নেই, তবে উবায়দুল্লাহ থেকে তার বর্ণনা আপত্র্তিকর। (দ. তাহযীবুল কামাল)

সুত্ররাং এ হাদীসটি সহীহ হতে পারে না। তাই তো ইমাম মুসলিম রহ. দারাওয়ার্দীর একক বর্ণনা যেমন গ্রহণ করেন নি, তেমনি উবায়দুল্লাহ থেকেও তাঁর কোন বর্ণনা গ্রহণ করেন নি। আর ইমাম বুখারী তো আরো কড়াকড়ি করেছেন। তাই বলা যায়, এটি ইমাম মুসলিমের শর্ত মোতাবেক হয় নি। যদিও হাকেম সে দাবি করেছেন। যারা বলেন, দারাওয়ার্দী যখন মুসলিম শরীফের রাবী, তাই তার একক বর্ণনায় কোন সমস্যা নেই, বা উবায়দুল্লাহ থেকে দারাওয়ার্দীর বর্ণনা সহীহ হতে কোন বাধা নেই, তাদের বক্তব্য যেমন সুক্ষ্ম চিন্তাপসূত্র নয়, তেমনি মুহাদ্দিসগণের সিদ্ধান্তের সঙ্গেও এর কোন মিল নেই।

ইমাম দারাকুতনীও দারাওয়ার্দীর একক বর্ণনার কারণে এই হাদীসকে মালুল বা দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। (দ. তানকীহ লি ইবনে আবদিল হাদী, ৮১৫) আর বায়হাকী এটি উদ্ধৃত করার পর বলেছেন, ما أراه إلا وهما অর্থাৎ আমি এটাকে (দারাওয়ার্দীর) ভুলই মনে করি।
বায়হাকী রহ. আরো বলেছেন,

وَالْمَشْهُورُ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ فِى هَذَا: إِذَا سَجَدَ أَحَدُكُمْ فَلْيَضَعْ يَدَيْهِ ، فَإِذَا رَفَعَ فَلْيَرْفَعْهُمَا فَإِنَّ الْيَدَيْنِ تَسْجُدَانِ كَمَا يَسْجُدُ الْوَجْهُ. وَالْمَقْصُودُ مِنْهُ وَضْعُ الْيَدَيْنِ فِى السُّجُودِ لاَ التَّقْدِيمُ فِيهِمَا وَاللَّهُ تَعَالَى أَعْلَمُ.

অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে এ ক্ষেত্রে যে হাদীসটি প্রসিদ্ধ সেটি হলো, যখন তোমাদের কেউ সেজদা করে সে যেন হাত রাখে এবং যখন উঠে তখন যেন হাত তুলে নেয়। কেননা হাতও চেহারার মতো সেজদা করে। এ হাদীসের উদ্দেশ্য হলো সেজদার সময় হাত রাখা, পূর্বে রাখা নয়। (নং ২৬৩৯)

হাফেজ ইবনুল কায়্যিম রহ.ও তার ‘তাহযীবে সুনানে আবু দাউদ’ গ্রন্থে বায়হাকীর এ বক্তব্যের সঙ্গে সহমত ব্যক্ত করেছেন। সর্বোপরি ইবনে উমর রা.এর এ হাদীসটি ইমাম বুখারী রহ. মাওকূফ তথা ইবনে উমর রা. এর আমলরূপে উদ্ধৃত করেছেন। মারফূ রূপে নয়। (দ, বুখারী শরীফ, অনুচ্ছেদ নং ১২৮)

উল্লেখ্য যে, এই মাওকুফ বর্ণনাটিও দারাওয়ার্দী সেই উবায়দুল্লাহ’র সূত্র্রেই বর্ণনা করেছেন। সুত্ররাং ইমাম বুখারী সূত্র ব্যতীত এটি উল্লেখ করলেও এতে পূর্বোক্ত সমস্যাগুলো থেকেই যাচ্ছে। তদুপরি ইবনে উমর রা. সম্পর্কে বিপরীত আমল উদ্ধৃত হয়েছে মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বায়। সেখানে বলা হয়েছে, ইবনে আবু লায়লা বর্ণনা করেছেন নাফে রহ. থেকে, তিনি ইবনে উমর রা. সম্পর্কে বলেছেন,

أَنَّهُ كَانَ يَضَعُ رُكْبَتَيْهِ إذَا سَجَدَ قَبْلَ يَدَيْهِ ، وَيَرْفَعُ يَدَيْهِ إذَا رَفَعَ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِ.

অর্থাৎ তিনি সেজদার সময় হাত রাখার পূর্বে হাঁটু রাখতেন এবং ওঠার সময় হাঁটু তোলার পূর্বে হাত তুলতেন। (নং ২৭২০)

এর সনদে ইবনে আবু লায়লা রয়েছেন। তার বিশ্বস্ততা নিয়ে দ্বিমত আছে। তিনি মধ্যম স্তরের রাবী, যেমনটি বলেছেন হাফেজ যাহাবী রহ.। অনেকে তাকে দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু ইবনে উমর রা.এর পূর্বোক্ত আমলটিও যেহেতু সহীহ সনদে নেই, তাই দুটিই সমমানের হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

এ কারণেই ইমাম ইবনুল মুনযির রহ. তার আল আওসাত গ্রন্থে ইবনে উমর রা. এর মাওকুফ বর্ণনাটি দুর্বল হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন,

وقد تكلم في حديث ابن عمر ، قيل : إن الذي يصح من حديث ابن عمر موقوف ، وحديث وائل بن حجر ثابت وبه نقول

অর্থাৎ ইবনে উমর রা. এর (মারফূ) হাদীসটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বলা হয়, ইবনে উমর রা. এর হাদীসটি মওকুফ হওয়াই সঠিক। আর ওয়াইল ইবনে হুজর রা.এর হাদীসটি প্রমাণিত। আমাদের মতও অনুরূপ। (৩/৩২৭)

আলবানী সাহেবের দাবি : একটু পর্যালোচনাঃ

হযরত আবু হুরায়রা ও ইবনে উমর রা. এর হাঁটুর পূর্বে হাত রাখা সংক্রান্ত হাদীস দুটি সম্পর্কে আলবানী সাহেব বেশ কিছু দাবি উত্থাপন করেছেন। সেগুলোর কারণে অনেকে ধোঁকায় পড়ে যেতে পারেন। তাই সেসব দাবি সম্পর্কে একটু পর্যালোচনা করা হলো।

১. আবু হুরায়রা বর্ণিত হাদীসটি সম্পর্কে তিনি তামামুল মিন্নাহ গ্রন্থে বলেছেন, إسناده جيد كما قال النووي والزرقاني অর্থাৎ এর সনদ জাইয়্যিদ বা উৎকৃষ্ট, যেমনটি বলেছেন নববী ও যুরকানী। আর সাহীহা গ্রন্থে লিখেছেন, لقد صحح هذا الحديث جمع من الحفاظ منهم عبد الحق الأشبيلي والشيخ النووي অর্থাৎ এক জামাত্র হাফেযে হাদীস এ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন আব্দুল হক ইশবিলী ও শায়খ নববী।

অথচ ইমাম নববী এটাকে সহীহ বলেন নি। জাইয়্যেদ বলেছেন। জাইয়্যেদ আর সহীহ এক কথা নয়।

ইরওয়াউল গালীল ও আসলু সিফাতিস সালাহ গ্রন্থদ্বয়ে তিনি বলেছেন,

وهذا سند صحيح . رجاله كلهم ثقات رجال مسلم ؛ غير محمد بن عبد الله بن الحسن ، وهو المعروف بالنفس الزكية العَلَوي ، وهو ثقة - كما قال النسائي وغيره ، وتبعهم الحافظ في " التقريب " - . ولذلك قال النووي في " المجموع " (৩/৪২১) ، والزُّرْقاني في " شرح المواهب " (৭/৩২০) : " إسناده جيد " . ونقل ذلك المُناوي عن بعضهم ، وصححه السيوطي في " الجامع الصغير " . وصححه عبد الحق في " الأحكام الكبرى " (৫৪/১) . وقال في " كتاب التهجد " (১/৫৬): " إنه أحسن إسناداً من الذي قبله " . يعني : حديث وائل المعارض له .

অর্থাৎ এ সনদটি সহীহ। এর বর্ণনাকারী সকলে বিশ্বস্ত ও মুসলিমের রাবী। শুধু ব্যতিক্রম হলেন মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে হাসান, যিনি আন নাফসুয যাকিয়্যা উপাধিতে খ্যাত, তিনি মুসলিমের রাবী না হলেও বিশ্বস্ত। ইমাম নাসাঈ প্রমুখ তাকে বিশ্বস্ত বলেছেন। তাদের অনুসরণে হাফেজ ইবনে হাজারও তাকরীব গ্রন্থে তাই উল্লেখ করেছেন। এ কারণেই নববী আল মাজমূ গ্রন্থে ও যুরকানী শারহুল মাওয়াহিব গ্রন্থে (৭/৩২০) বলেছেন, এর সনদ জাইয়্যেদ। একই কথা মুনাবীও উল্লেখ করেছেন কারো কারো বরাতে। জামে সগীরে সুয়ূতী এটিকে সহীহ আখ্যা দিয়েছেন। আব্দুল হকও আল আহকামুল কুবরা গ্রন্থে (১/৫৪) এটিকে সহীহ বলেছেন। আর কিতাবুত তাহাজ্জুদ গ্রন্থে (১/৫৬) তিনি বলেছেন, পূর্বের হাদীসটির (অর্থাৎ এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হযরত ওয়াইল রা.এর হাদীসটির) তুলনায় এর সনদ উত্তম।

এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয় :

বুখারী ও মুসলিমের রাবীদের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় হলো, তাদের কেউ যদি স্মৃতিদুর্বল হয়, তাহলে তাঁরা তার হাদীস গড়ে গ্রহণ না করে বেছে বেছে সেসব হাদীসই গ্রহণ করেছেন যেগুলোর সমর্থন অন্যান্য সূত্র্রে পাওয়া গেছে। এ ধরনের রাবীদের যে কোন হাদীস নিয়েও বলা যাবে না, ইনি বুখারী ও মুসলিমের রাবী, তাই তার হাদীসটি সহীহ।

এ কথা যে আলবানী সাহেব জানতেন না তা নয়। কিন্তু নিজের দলিল পেশ করার সময় এসব কথা তার মনে থাকে না।

দেখুন, সুওয়ায়দ ইবনে সাঈদ মুসলিম শরীফের রাবী। সহীহা গ্রন্থে তার একটি হাদীস সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেছেন,

قلت : والإسناد الأول ضعيف فإن سويد بن سعيد مع كونه من شيوخ مسلم فقد ضعف

অর্থাৎ প্রথম সনদটি জয়ীফ বা দুর্বল। কারণ সুওয়ায়দ ইবনে সাঈদ যদিও মুসলিম রহ.এর উস্তাদ, কিন্তু তাকে জয়ীফ আখ্যায়িত করা হয়েছে।

যদিও এ গ্রন্থের ৫০০ নং হাদীসে তিনি উল্টো কথা বলেছেন,

ومثل طريق سويد بن سعيد في الحديث فإنه ثقة من شيوخ مسلم ولكنه اختلط

অর্থাৎ হাদীসে সুওয়ায়দ ইবনে সাঈদের সনদটি যেমন। তিনি তো বিশ্বস্ত ও মুসলিমের উস্তাদ, তবে তার স্মৃতিবিভাট দেখা দিয়েছিল।

আবার জয়ীফা গ্রন্থে ৫২৫৫ নং হাদীসটি সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেছেন,

ورجاله ثقات رجال الشيخين ؛ غير سويد ؛ فإنه - مع كونه من شيوخ مسلم - فقد ضعفوه. ومن هنا يظهر لك تساهل البوصيري في "الزوائد" (২৭৯/ ২) ؛ حيث قال :"هذا إسناد حسن ؛ سويد مختلف فيه ، ولعله تبع المنذري في تحسينه ،

অর্থাৎ এর রাবীগণ সকলে বিশ্বস্ত ও বুখারী-মুসলিমের রাবী। অবশ্য সুওয়ায়দ ব্যতিক্রম। কেননা তিনি মুসলিমের উস্তাদ হলেও মুহাদ্দিসগণ তাকে জয়ীফ বলেছেন। এখান থেকেই যাওয়াইদ গ্রন্থে বূসীরীর শৈথিল্য ধরা পড়ে। কারণ তিনি বলেছেন, ‘এ সনদটি হাসান, সুওয়ায়দ বিতর্কিত’। হাসান বলার ক্ষেত্রে তিনি হয়ত মুনযিরির অনুসরণ করেছেন।

এতদসত্ত্বেও ইরওয়া গ্রন্থে তিনি সুওয়ায়দ বর্ণিত একটি হাদীসকে সহীহ আখ্যা দিয়েছেন। হাদীসটি ইবনে মাজায় উদ্ধৃত হয়েছে (নং ৪৪৩)। ইরওয়ায় এটি ৮৪ নম্বরে উল্লেখ করা হয়েছে। হাফেজ ইবনে হাজার আন নুকাত গ্রন্থে সুওয়ায়দের কারণে হাদীসটিকে জয়ীফ বলেছেন।

দেখা যাচ্ছে, আলবানী সাহেব একই রাবী ও তার হাদীস সম্পর্কে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। এ নিয়ে আমরা আলোচনায় যাচ্ছি না। কারণ তার লেখায় এমন স্ববিরোধিতা বিস্তর। এ নিয়ে তানাকুযাতুল আলবানী (আলবানীর স্ববিরোধী বক্তব্য) নামে আরবী ভাষায় স্বতন্ত্র বৃহৎ গ্রন্থ রচিত্র্র্র হয়েছে।

আমরা যে বিষয়ে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি তা হলো, সুওয়ায়দ মুসলিম শরীফের রাবী। ইমাম মুসলিম তার সেই সময়কার হাদীস নিয়েছেন যখন তার স্মৃতিশক্তি ভাল ছিল। অথবা বেছে বেছে তার সেসব বর্ণনা নিয়েছেন, যেগুলোর ব্যাপারে তার আস্থা অর্জিত হয়েছিল। সুত্ররাং এ ধরনের রাবীর যে কোন হাদীস নিয়েই বলা যাবে না, ইনি মুসলিম শরীফের রাবী, তাই হাদীসটি সহীহ।

এবারে আমাদের আলোচ্য হাদীসগুলোতে আসা যাক। এর একজন রাবী মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে হাসান। তার হাদীসের সঠিকতা নিয়ে ইমাম বুখারীর আপত্র্তি রয়েছে। বুখারী মুসলিমের কেউই তার হাদীস গ্রহণ করেন নি। ইবনে সাদ বলেছেন, وكان قليل الحديث অর্থাৎ তার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু এতদসত্ত্বেও বুখারী বলেছেন, لا يتابع عليه অর্থাৎ তার এ হাদীসটির সমর্থন পাওয়া যায় না। তাহলে এ ধরনের রাবীর স্মৃতি যে দুর্বল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তাছাড়া এ রাবীর ব্যক্তি পরিচয় নিয়েও ঝামেলা আছে। ইবনে রজব হাম্বলী তার বুখারী শরীফের ভাষ্য ফাতহুল বারীতে লিখেছেন,

ومحمد راويه ، ذكره البخاري في الضعفاء ، وقال : يقال : ابن حسن فكأنه توقف في كونه محمد بن عبد الله بن حسين بن حسن الذي خرج بالمدينة على المنصور ، ثم قتله المنصور بها .

অর্থাৎ ইমাম বুখারী তার জুয়াফা (দুর্বল রাবীদের জীবনচরিত) গ্রন্থে বলেছেন, বলা হয় ইনি ইবনে হাসান। তিনি যেন এ নিয়ে দ্বিধান্বিত যে, ইনিই সেই মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে হাসান কি না। যিনি খলীফা মনসূরের বিরুদ্ধে মদীনায় বিদোহ ঘোষণা করেছিলেন। পরে মনসূর তাকে সেখানেই হত্যা করেছিল। (ফাতহুল বারী, ৭/২১৮)

আরেকজন রাবী হলেন দারাওয়ার্দী। তার সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণের মন্তব্য পেছনে সবিস্তারে তুলে ধরা হয়েছে। আলবানী সাহেবেরও সেগুলো জানা। একারণে দারাওয়ার্দীর হাদীসকে তিনি কখনো বলেছেন সহীহ, কখনো হাসান কখনো জয়ীফ। কখনো তাকে বিশ্বস্ত বলেছেন, কখনো সাদূক বা সত্যনিষ্ঠ (মধ্যম মান বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত পরিভাষা), কখনো তার হাদীসকে জয়ীফ বলে মুহাদ্দিসগণের মন্তব্যগুলো এমনভাবে উল্লেখ করেছেন, যাতে প্রতীয়মান হয় যে, দারাওয়ার্দী তার নিকটও জয়ীফ। এখানে কিছু দৃষ্টান্ত উল্লেখ না করে পারছি না।

১. ইরওয়া গ্রন্থে ২৩২২ নং হাদীসের আলোচনায় নুআয়ম ইবনে হাযযালের বর্ণনাটি সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেছেন,

أخرجه أبو داود وابن أبي شيبة وأحمد إسناده حسن ورجاله رجال مسلم

অর্থাৎ আবু দাউদ, ইবনে আবী শায়বা ও আহমদ এটি উদ্ধৃত করেছেন। এর সনদ হাসান। এর রাবীগণ মুসলিমের রাবী।

উল্লেখ্য, এর সনদে দারাওয়ার্দী আছেন। কিন্তু সকলে মুসলিমের রাবী হওয়া সত্ত্বেও কেন সনদটি হাসান হলো তা তিনি ব্যাখ্যা করেন নি।

২. সহীহা গ্রন্থে ২২১৮ নং হাদীসের আলোচনায় এই দারাওয়ার্দী সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন,

و هو ثقة عند ابن حبان و غيره ، فيه ضعف يسير من قبل حفظه ، فحديثه لا ينزل عن مرتبة الحسن ، و قد احتج به مسلم .

অর্থাৎ তিনি ইবনে হিব্বান প্রমুখের নিকট বিশ্বস্ত, স্মৃতিশক্তির দিক থেকে তার মধ্যে কিছুটা দুর্বলতা রয়েছে। তাই তার হাদীস হাসান মানের চেয়ে নিম্নের হবে না। মুসলিম রহ. তাকে (তার হাদীসকে) প্রমাণস্বরূপ উদ্ধৃত করেছেন।

৩. ‘তাসহীহু হাদীসি ইফতারিস সাইম’ গ্রন্থে দারাওয়ার্দির একটি হাদীসকে মুনকার (আপত্র্তিকর) ও শায (দলবিচ্ছিন্ন) আখ্যা দিয়ে আলবানী সাহেব মন্তব্য করেছেন,

لأنه مختلف فيه وقد وصفه أبو زرعة وغيره بأنه سيئ الحفظ فلا جرم أن البخاري لم يحتج به.

অর্থাৎ কেননা তিনি বিতর্কিত, আবু যুরআ প্রমুখ তাকে স্মৃতি-দুর্বলতার শিকার আখ্যা দিয়েছেন। এ কারণেই বুখারী রহ. তার হাদীস দিয়ে প্রমাণ পেশ করেন নি।

৪. ইরওয়া গ্রন্থে ৫৬৪ নং হাদীসের আলোচনায় তিনি মন্তব্য করেছেন,

لكن الظاهر أن الدراوردي كان يضطرب في إسناده وهو صدوق احتج به مسلم إلا أنه كان يحدث من كتب غيره فيخطئ

অর্থাৎ এটাই স্পষ্ট যে, দারাওয়ার্দী এ হাদীসটির সনদ একেক বার একেক রকম বলেছেন। তিনি সাদূক। ইমাম মুসলিম তাকে প্রমাণ হিসাবে পেশ করেছেন। তবে তিনি (দারাওয়ার্দী) অন্যের কিতাব থেকে হাদীস বর্ণনা করতে যেয়ে ভুল করতেন।

৫. ইরওয়া গ্রন্থেই ২৪২১ নং হাদীসটিকে আলবানী সাহেব জয়ীফ আখ্যা দিয়েছেন। হাদীসটি দারাওয়ার্দী বর্ণিত এবং অন্যান্য রাবীগণও মুসলিমের মানোত্তীর্ণ। যেমনটি বলেছেন হাকেম, আর সমর্থন করেছেন যাহাবী ও শেষে আলবানী সাহেব নিজেও। এ হাদীসটির সকল রাবী বিশ্বস্ত হওয়া সত্ত্বেও আলবানী সাহেব এটিকে জয়ীফ বলেছেন শুধু এ কারণে যে, সুফিয়ান ছাওরী, ইবনে ইসহাক ও ইবনে জুরায়জ হাদীসটি মুরসাল (সূত্রবিচ্ছিন্ন)রূপে বর্ণনা করেছেন। এরপর আলবানী সাহেব মন্তব্য লিখেছেন,

وإنَّ وَصْلَه وَهمٌ من الدراوردي فإنه وإن كان ثقة في نفسه ففي حفظه شيئ قال الحافظ صدوق يخطئ كان يحدث من كتب غيره فيخطئ وقال النسائي : حديثه عن عبيد الله العمري منكر وقال الذهبي في الميزان : صدوق غيره أقوى وقال أحمد : إذا حدث من حفظه يهم ليس هو بشيء وإذا حدث من كتابه فنعم ، وإذا حدث من حفظه جاء بالبواطيل وأما ابن المديني فقال : ثقة ثبت وقال أبو حاتم : لا يحتج به.

এ হাদীসটি অবিচ্ছিন্ন সূত্র্রে বর্ণনা করা দারাওয়ার্দীর একটি ভুল। তিনি মূলত বিশ্বস্ত হলেও তার স্মৃতিশক্তিতে সমস্যা ছিল। হাফেজ (ইবনে হাজার) বলেছেন, তিনি সাদূক বা সত্যনিষ্ঠ, তবে ভুল করতেন। অন্যদের কিতাব থেকে তিনি হাদীস বর্ণনার সময় ভুল করতেন। নাসাঈ বলেছেন, উবায়দুল্লাহ থেকে তার বর্ণনা আপত্র্তিকর। যাহাবী মীযান গ্রন্থে বলেছেন, তিনি সাদূক, তবে অন্যরা তার চেয়ে মজবুত। ইমাম আহমদ বলেছেন, তিনি যখন স্মৃতি থেকে বর্ণনা করতেন তখন ভুল করতেন, আর যখন কিতাব থেকে বর্ণনা করতেন, তখন ঠিক ঠিক বর্ণনা করতেন। তিনি আরো বলেছেন, যখন তিনি স্মৃতি থেকে বর্ণনা করতেন তখন বাতিল হাদীস বর্ণনা করতেন। ইবনুল মাদীনী অবশ্য বলেছেন, তিনি বিশ্বস্ত ও সুদৃঢ় ছিলেন। আবু হাতেম রাযী বলেছেন, তার (হাদীস) দ্বারা প্রমাণ পেশ করা যাবে না।

এ হলো আলবানী সাহেবের বক্তব্য। মুহাদ্দিসগণের এসব মন্তব্যের কারণেই তো আমরা বলেছি, দারাওয়ার্দীর আলোচ্য হাদীসকে (সিজদায় যাওয়ার সময় হাঁটুর পূর্বে হাত রাখা) সহীহ বলা মুশকিল। ইমাম তিরমিযী ও হাযেমী এ হাদীসকে গরীব বলে এর দুর্বলতার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। হামযা আল কিনানী বলেছেন, মুনকার বা আপত্র্তিকর। ইবনে রজব বলেছেন, لا يثبت এটি প্রমাণিত নয়। এছাড়া বুখারী ও দারাকুতনীও এটিকে মালূল বা দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। আলবানী সাহেবও দারাওয়ার্দীকে কখনো বিশ্বস্ত (ছিকাহ), কখনো সাদূক বলেছেন। তার হাদীসকে কখনো সহীহ, কখনো হাসান এবং কখনো জয়ীফ আখ্যা দিয়েছেন। সুত্ররাং এ হাদীসকে এত জোর দিয়ে সহীহ বলা অন্যায় পক্ষপাত বৈ নয়।

খ. নববী ও যুরকানী এর সনদকে উৎকৃষ্ট বলেছেন ঠিক আছে, কিন্তু তারা তো শরীকের বর্ণনাকেও জাইয়্যেদ বা উৎকৃষ্ট মনে করতেন। সেটা গ্রহণ করা হলো না কেন?

তাছাড়া ইমাম নববী তার রওযাতুত তালিবীন গ্রন্থে স্পষ্ট লিখেছেন,

فالسنة أن يكون أول ما يقع على الأرض من الساجد ركبتيه ثم يديه ثم أنفه وجبهته

অর্থাৎ সুন্নত হলো সিজদাকারীর হাঁটু সর্বপ্রথম মাটিতে লাগবে, তারপর হাত, তারপর নাক ও কপাল। (১/২৫৮)

ইমাম নববীর একথা কি আপনি মানেন?

গ. আলবানী সাহেব বলেছেন, মুনাবীও কারো কারো বরাতে একথা উল্লেখ করেছেন। এখানে আলবানী সাহেব রীতিমতো সত্য গোপন করেছেন। মুনাবী তার ফায়যুল কাদীর গ্রন্থে লিখেছেন,

رمز المؤلف لصحته اغترارا بقول بعضهم سنده جيد وكأنه لم يطلع على قول ابن القيم وقع فيه وهم من بعض الرواة الخ

অর্থাৎ গ্রন্থকার (সুয়ূতী) এটি সহীহ হওয়ার সংকেত ব্যবহার করেছেন। কেউ কেউ যে বলেছেন, এর সনদ জাইয়্যেদ বা উৎকৃষ্ট, তিনি হয়তো সে কারণে ধোঁকার শিকার হয়েছেন। তিনি মনে হয় ইবনুল কায়্যিমের বক্তব্য সম্বন্ধে অবগত ছিলেন না যে, এ হাদীসে জনৈক রাবীর তরফ থেকে বিচ্যুতি ঘটেছে। (১/৩৭৩)

একইভাবে আত তায়সীর গ্রন্থে মুনাবী বলেছেন,

رمز المؤلف لصحته وليس كما قال

অর্থাৎ গ্রন্থকার (সুয়ূতী) এটি সহীহ হওয়ার সংকেত ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তিনি যেমনটি বলেছেন ব্যাপারটি তেমন নয়। (১/১০৪)

লক্ষ করুন, মুনাবী কি বলেছেন, আর আলবানী সাহেবের উদ্ধৃতি থেকে কি বোঝা যায়।।

ঘ. জামে সগীরে সুয়ূতীও এটিকে সহীহ বলেছেন একথা ঠিক আছে। কিন্তু পাঠক একটু পূর্বে এই কিতাবের ভাষ্যকার মুনাবীর মন্তব্য অবহিত হয়েছেন। আসলে সহীহ বলার ক্ষেত্রে সুয়ূতী ছিলেন শিথিল মনোভাবাপন্ন। এই কিতাবটি সম্পর্কে ভূমিকায় তিনি বলেছিলেন, এতে কোন জাল হাদীস আনবেন না। কিন্তু তারপরও এতে অনেক অনেক জাল হাদীস এসে গেছে। সুত্ররাং জামে সাগীরে সহীহ বলার কথা বলে লাভ নেই।

ঙ. আলবানী সাহেব লিখেছেন, আব্দুল হক (আল ইশবিলী) তার আল আহকামুল কুবরা গ্রন্থে (১/৫৪) এটিকে সহীহ আখ্যা দিয়েছেন।

এ বরাতটি ভুল বলে মনে হয়। আহকামুল কুবরা গ্রন্থে এ কথা নেই। সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠায়ও নেই, অন্য কোথাও নেই। অনেক অনুসন্ধান করেও আমরা এর হদিস পাই নি। হ্যাঁ, কিতাবুত তাহাজ্জুদে তিনি যে أحسن إسنادا বলেছেন, সেটি পাওয়া গেছে।

এরপর আলবানী সাহেব লিখেছেন,

وقد أعله بعضهم بثلاث علل :الأولى : تفرد الدراوردي به عن محمد بن عبد الله . والثانية : تفرد محمد هذا عن أبي الزناد . والثالثة : قول البخاري : " لا أدري أسمع محمد بن عبد الله بن حسن من أبي الزناد أم لا " .

অর্থাৎ কেউ কেউ এ হাদীসটির তিনটি ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথম, মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ থেকে দারাওয়ার্দী একাকী এটি বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয়, মুহাম্মদও একাকী আবুয যিনাদ থেকে বর্ণনা করেছেন। তৃতীয়, ইমাম বুখারীর বক্তব্য, জানি না আবুয যিনাদ থেকে তিনি (মুহাম্মদ) শুনেছেন কি না।

প্রথমত, এখানে আলবানী সাহেব ‘কেউ কেউ ... উল্লেখ করেছেন’ বলে ব্যাপারটিকে হালকা করেছেন। বড় বড়দের নাম উল্লেখ করলে পাঠক সেদিকেই ঝুঁকে পড়েন কি না সেজন্যই কারো নাম উল্লেখ না করে শুধু কেউ কেউ বলেই চালিয়ে দিয়েছেন।

দ্বিতীয়ত, ইমাম বুখারীর কথা তিনি অর্ধেক নকল করেছেন। কারণ এ অর্ধেকের জবাব দেওয়া সহজ। বাকি অর্ধেকের জবাব দেওয়া অত সহজ নয়। সে অর্ধেকে বুখারী রহ. বলেছেন, لا يتابع عليه এ হাদীসটির ক্ষেত্রে তার কোন সমর্থন পাওয়া যায় না। তাছাড়া এই মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ কে- তা নিয়েও ইমাম বুখারী দ্বিধা প্রকাশ করেছেন। পেছনে ইবনে রজব হাম্বলীর বরাতে এ কথা তুলে ধরা হয়েছে।

এরপর আলবানী সাহেব বলেন,

وهذه العلل ليست بشيء :أما الأولى والثانية ؛ فلأن الدراوردي وشيخه محمداً هذا ثقتان - كما تقدم - ؛ فلا يضر تفردهما بهذا الحديث ، وليس من شرط الحديث الصحيح أن لا ينفرد بعض رواته به ، وإلا ؛ لما سلم لنا كثير من الأحاديث الصحيحة ،

অর্থাৎ এগুলো কোন ত্রুটি নয়। প্রথম ও দ্বিতীয় অভিযোগের উত্তরে বলা যায়, দারাওয়ার্দী ও তার উস্তাদ এই মুহাম্মদ দুজনই যখন বিশ্বস্ত, তখন এই হাদীস বর্ণনায় তাদের নিঃসঙ্গতা কোন অসুবিধা সৃষ্টি করবে না। সহীহ হাদীসের জন্য এমন কোন শর্ত নেই যে, তার কোন বর্ণনাকারী নিঃসঙ্গ হতে পারবে না। অন্যথায় অনেক সহীহ হাদীসই নিখাদ থাকবে না।

সেই ঘুরে ফিরে একই কথা। তাদের বিশ্বস্ততাই তো প্রশ্নবিদ্ধ। স্বয়ং আপনার কাছেও। সুত্ররাং বারবার একই কথা বলে পাঠককে ধোঁকা দেওয়ার কি অর্থ? আমরা কি ইমাম বুখারী, তিরমিযী, হামযা কিনানী, আবু বকর হাযিমী ও ইবনে রজব হাম্বলী প্রমুখের কথা মানব, না আপনার কথা? এমনিভাবে ইমাম আহমদ, আবু যুরআ রাযী, আবু হাতেম রাযী সহ যারা দারাওয়ার্দীর স্মৃতিশক্তি নিয়ে আপত্র্তি তুলেছেন তাদের কথা গ্রহণ করব, না আপনার কথা? দারাওয়ার্দীর স্মৃতিদুর্বলতার কথা তো আপনিও মেনে নিয়েছেন। তাহলে তার বিশ্বস্ততা প্রশ্নাতীত থাকে কীভাবে?

আর আপনি যে বলেছেন, ‘সহীহ হাদীসের জন্য এমন কোন শর্ত নেই যে, তার কোন বর্ণনাকারী নিঃসঙ্গ হতে পারবে না’ এটি আংশিক সত্য। কারণ কোন রাবীর স্মৃতি যদি দুর্বল হয় তবে তার হাদীস ত্রুটি মুক্ত হলে হাসান স্তরের হবে। একাধিক সনদ ও সূত্র্রে বর্ণিত হলেই কেবল সেটি সহীহ’র মানে উত্তীর্ণ হতে পারবে।

এত গেল যদি তার বর্ণনা অন্য কোন হাদীসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়। যদি সাংঘর্ষিক হয়, তবে তো হাসান হওয়াও মুশকিল।

আলবানী সাহেব নিজেও একথা বলেছেন। ‘আছ ছামারুল মুসতাতাব ফী ফিকহিস সুন্নাতি ওয়াল কিতাব’ গ্রন্থে মসজিদে পবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সংক্রান্ত একটি হাদীসের আলোচনায় দারাওয়ার্দীর দুটি ভুল চিহ্নিত করে মন্তব্য করেছেন,

وهو وإن كان ثقة ففيه شيء فلا يحتج به أيضا إذا خالف الثقات

অর্থাৎ তিনি বিশ্বস্ত হলেও তার মধ্যে কিছু সমস্যা ছিল। সুত্ররাং তিনি অন্যান্য বিশ্বস্ত রাবীদের বিপরীত বর্ণনা করলে সেটা দিয়ে প্রমাণ পেশ করা যাবে না।

আলোচ্য বিষয়ে দারাওয়ার্দীর বর্ণনাটি যেমন শরীকের বর্ণনার বিপরীত, তেমনি হযরত উমর ও আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.এর মতো পবীন সাহাবীগণের আমলেরও বিপরীত। সুত্ররাং এটা কি করে প্রামাণ্য হবে?

চ. আলবানী সাহেব জয়ীফাগ্রন্থে (৯২৯) হাঁটুর পূর্বে হাত রাখার প্রমাণ পেশ করতে গিয়ে বলেছেন,

لما ثبت في أحاديث كثيرة من النهي عن بروك كبروك الجمل

অর্থাৎ কেননা বহু হাদীসে উটের মতো করে বসতে নিষেধ করা হয়েছে।

আমাদের বক্তব্য হলো এটা অতিশয়োক্তি মাত্র। আমাদের অনুসন্ধানমতে হযরত আবু হুরায়রা রা.এর হাদীসটি ছাড়া এ মর্মে দ্বিতীয় কোন হাদীস নেই। আলবানী-ভক্তদের কাছে অনুরোধ, তারা যেন আরেকটি হাদীস বের করে দেখান। অন্যথায় এর দ্বারা মানুষ পত্রারিত হতে পারে।

জ. আরেকটি কথা আলবানী সাহেব ও তার ভক্তরা উদ্ধৃত করে থাকেন হাফেজ ইবনে হাজার রহ. এর বুলূগুল মারাম থেকে। তিনি আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত হাদীসটি উল্লেখপূর্বক সেখানে (২৯২, ২৯৩) লিখেছেন,

وَهُوَ أَقْوَى مِنْ حَدِيثِ وَائِلٍ فَإِنْ لِلْأَوَّلِ شَاهِدًا مِنْ حَدِيثِ : اِبْنِ عُمَرَ - رضي الله عنه - صَحَّحَهُ اِبْنُ خُزَيْمَةَ , وَذَكَرَهُ اَلْبُخَارِيُّ مُعَلَّقًا مَوْقُوفًا .

অর্থাৎ এ হাদীসটি ওয়াইল ইবনে হুজর রা. বর্ণিত হাদীসের তুলনায় অধিক শক্তিশালী। কেননা এর সমর্থক ও সাক্ষী রয়েছে ইবনে উমর রা.এর হাদীসটি। ইবনে খুযায়মা এটিকে সহীহ বলেছেন এবং ইমাম বুখারী তালীক (সূত্র্রের উল্লেখ ছাড়া)রূপে ও মাওকুফ (ইবনে উমরের নিজস্ব আমল) রূপে এটি উদ্ধৃত করেছেন।

এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয় ;

১. ইবনে হাজার রহ. এর চেয়ে অনেক বড় বড় মুহাদ্দিস ওয়াইল রা. বর্ণিত হাদীসটিকে সহীহ বা হাসান বলেছেন এবং তাদের অনেকেই এটিকে আবু হুরায়রা বর্ণিত হাদীসের উপর অগ্রগণ্য সাব্যস্ত করেছেন। পেছনে সে কথা বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।

২. ইবনে হাজার আসকালানীর কথাটি আপনারা পুরোপুরি মানেন না। কারণ তার বক্তব্য থেকে পরিস্কার বোঝা যায়, হযরত ওয়াইল রা. এর হাদীসটিও শক্তিশালী। কিন্তু আপনারা সেটিকে জয়ীফ বলেছেন। একইভাবে ইবনে সাইয়্যেদুন্নাস রহ. ও আব্দুল হক ইশবেলীর কথাও আপনারা মানছেন না। ইবনে সাইয়্যেদুন্নাস তো স্পষ্টভাবে হযরত ওয়াইল রা. বর্ণিত হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। আর আব্দুল হক ইশবিলীর কথা থেকেও তাই বুঝে আসে। কারণ তিনি যখন আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত হাদীসটিকে অধিক হাসান বলছেন, তাতেই তো বোঝা যায় ওয়াইল রা. এর হাদীসটিও তার দৃষ্টিতে হাসান। অথচ আপনারা বলছেন জয়ীফ!!

৩. ইবনে হাজার রহ. যে সমর্থক ও সাক্ষী বর্ণনার কারণে আবু হুরায়রা রা.এর হাদীসটিকে অধিক শক্তিশালী আখ্যা দিয়েছেন, সেই হাদীসটি দুর্বল হওয়ার কারণে তার দাবিও সঠিক বলে বিবেচিত্র্র্র হচ্ছে না। পূর্বেই বলেছি, মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে উবায়দুল্লাহ উমারী থেকে দারাওয়ার্দীর বর্ণনা মুনকার আপত্র্তিকর ও জয়ীফ। আর ইবনে উমর রা. এর হাদীসটি একমাত্র ঐ সূত্র্রেই বর্ণিত। খোদ আলবানী সাহেব এই সূত্র্রে বর্ণিত অন্য একটি হাদীসকে জয়ীফ সাব্যস্ত করে বলেছেন,

وأنا أرى أن التردد المذكور إنما هو من شيخ إسحاق وهو عبد العزيز بن محمد الدراوردي ، فإنه وإن كان ثقة ومن رجال مسلم ، ففي حفظه شيء أشار إليه الحافظ بقوله فيه في " التقريب " : " صدوق كان يحدث من كتب غيره فيخطئ ، قال النسائي : حديثه عن عبيد الله العمري منكر " .
قلت : وهذا من روايته عن عبيد الله كما ترى فهو منكر مرفوعا ، والمحفوظ موقوف على ابن عمر ، كذلك رواه جمع من الثقات عن نافع .(الضعيفة ৭১৭)

অর্থাৎ আমি মনে করি এই দোদুল্যমানতা ইসহাকের উস্তাদ দারাওয়ার্দী থেকে ঘটেছে। কেননা তিনি যদিও বিশ্বস্ত ও মুসলিম শরীফের রাবী, তথাপি তার স্মৃতিশক্তিতে কিছু সমস্যা ছিল। হাফেজ (ইবনে হাজার) এদিকেই ইঙ্গিত করেছেন তার এই মন্তব্যে- তিনি সাদূক, তবে ভুল করতেন। অন্যদের কিতাব থেকে তিনি হাদীস বর্ণনা করতেন আর ভুলের শিকার হতেন। আর ইমাম নাসাঈ বলেছেন, উবায়দুল্লাহ থেকে তার বর্ণনা আপত্র্তিকর। আমি (আলবানী সাহেব) বলব, এ বর্ণনাটি তিনি উবায়দুল্লাহ থেকেই করেছেন। যেমনটা আপনি দেখতে পাচ্ছেন। সুত্ররাং এটি মারফূরূপে আপত্র্তিকর। সঠিক হবে এটি ইবনে উমর রা.এর নিজস্ব বক্তব্য। (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নয়।) একাধিক বিশ্বস্ত রাবী নাফে’র সূত্র্রে ইবনে উমর রা.এর বক্তব্য হিসেবেই এটি বর্ণনা করেছেন। (যয়ীফা, ৭১৭)

সুত্ররাং একথা বুঝতে আর বাকি নেই যে, উবায়দুল্লাহ থেকে দারাওয়ার্দীর বর্ণনা স্বয়ং আলবানীর কাছেও আপত্র্তিকর। আর এটি আপত্র্তিকর ও জয়ীফ হলে এর উপর ভিত্তি করে যে হাদীসকে অধিক শক্তিশালী বলা হলো সেটাও আর সঠিকতা পাবে না।

৪. হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত হাদীসটির যেমন বলা হয় সমর্থক ও সাক্ষী হিসাবে ইবনে উমর রা.এর বর্ণনা রয়েছে, যদিও সেটি দুর্বল। তেমনি শরীকের বর্ণনাটিরও তো সাক্ষী ও সমর্থক বর্ণনা রয়েছে হযরত আনাস রা.এর হাদীসটি। আমীর আল ইয়ামানী রহ. বুলূগুল মারাম গ্রন্থের ভাষ্য সুবুলুস সালামে কতই না সুন্দর বলেছেন-

وقول المصنف إن لحديث أبي هريرة شاهدا يقوى به معارض بأن لحديث وائل أيضا شاهدا قد قدمناه وقال الحاكم إنه على شرطهما وغايته وإن لم يتم كلام الحاكم فهو مثل شاهد أبي هريرة الذي تفرد به شريك فقد اتفق حديث وائل وحديث أبي هريرة في القوة وعلى تحقيق ابن القيم فحديث أبي هريرة عائد إلى حديث وائل وإنما وقع فيه قلب ولا ينكر ذلك فقد وقع القلب في ألفاظ الحديث

অর্থাৎ গ্রন্থকার যে বলেছেন, আবু হুরায়রা রা.এর হাদীসের সমর্থক ও সাক্ষী বর্ণনা রয়েছে, যেটির দ্বারা এটি শক্তিশালী হয়। এর বিপরীতে বলা যায় ওয়াইল রা.এর হাদীসেরও সমর্থক ও সাক্ষী রয়েছে, যেমনটি আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। হাকেম রহ. বলেছেন, সেটি বুখারী ও মুসলিম উভয়ের শর্ত মোতাবেক (সহীহ)। হাকেমের মন্তব্য যদি পুরোপুরি সঠিক না-ও হয়, তবুও এতটুকু তো নিশ্চিত্র্র্র যে, আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত হাদীসটির সমর্থক ও সাক্ষীর মতো এটি ঐ হাদীসের সমর্থক ও সাক্ষী, যেটি এককভাবে শরীক বর্ণনা করেছেন।

আর ইবনুল কায়্যিমের গবেষণা অনুযায়ী তো আবু হুরায়রা রা.এর হাদীসটি ওয়াইল রা.এর হাদীসের সমার্থক হয়ে যায়। আবু হুরায়রা রা.এর হাদীস (বর্ণনাকারীর কারণে) ওলটপালট হয়ে গেছে। এটা অস্বীকার করার জো নেই। কেননা হাদীসের একাধিক শব্দে ও বাক্যে ওলটপালট সংঘটিত হয়েছে। (সুবুলুস সালাম, ১/২৮১)

আরেকটি কথা, পেছনে তিরমিযী, খাত্তাবী ও ইমাম মুহিয়্যুস সুন্নাহ বাগাবী’র বরাতে উল্লেখ করেছি যে, আগে হাঁটু রাখা সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমগণের মত। একই কথা উল্লেখ করেছেন আমীর ইয়ামানী, শাওকানী ও আযীমাবাদী প্রমুখ। এ সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে সাহাবী, তাবেঈ, তাবে-তাবেঈ, তিন মুজতাহিদ ইমাম ও মুহাদ্দিস-ফকীহ সকলে আছেন। আলবানী সাহেব নিজের পক্ষের একটি দলিল পেশ করতে গিয়ে একটি হাদীস সম্পর্কে কত সুন্দর বলেছেন,

ممن صححه الترمذي وابن العربي والضياء وابن القيم ويمكن أن يضم إليهم الإمام أحمد وإسحاق ، فإنهما أخذا بالحديث وعملا به باعتراف العراقي نفسه وذلك دليل إن شاء الله تعالى على أن الحديث ثابت عندهما وهو المطلوب (تصحيح حديث إفطار الصائم قبل سفره بعد الفجر)

অর্থাৎ তিরমিযী, ইবনুল আরাবী, আয যিয়া ও ইবনুল কায়্যিম এ হাদীসকে সহীহ বলেছেন। তাদের সঙ্গে ইমাম আহমদ ও ইসহাককেও যুক্ত করা যেতে পারে। কারণ তারা দুজনই এ হাদীসটি গ্রহণ করেছেন এবং এতদনুসারে আমল করেছেন। যেমনটি স্বয়ং ইরাকী রহ. স্বীকার করে নিয়েছেন। এতে ইনশাআল্লাহু তায়ালা এ কথার দলিল রয়েছে যে, হাদীসটি তাদের দুজনের কাছেই প্রমাণিত। আর এটাই বলা এখানে উদ্দেশ্য। (তাসহীহু হাদীসে ইফতার ...,পৃ. ২২)

পাঠক, লক্ষ করুন, এ বক্তব্য কি আমাদের এ মাসআলায় খাটে না? এখানে যে সংখ্যাগরিষ্ঠরা ওয়াইল রা. এর হাদীসটি গ্রহণ করলেন এবং তদনুযায়ী আমল করলেন, এতে কি প্রমাণিত হয় না- হাদীসটি তাদের নিকট প্রমাণিত? বিশেষ করে এই সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে যখন উল্লিখিত দুজন মনীষী ইমাম আহমদ ও ইসহাকও রয়েছেন? তাহলে আলবানী সাহেব, ড. আসাদুল্লাহ গালিব (তার ছালাতুর রাসূল ছাঃ গ্রন্থে) ও মুযাফফর বিন মুহসিন (তার জাল হাদীসের কবলে রাসূলুল্লাহ ছাঃ এর ছালাত গ্রন্থে) কেন এ হাদীসকে দুর্বল আখ্যা দিচ্ছেন?

একটি উদ্ধৃতি প্রসঙ্গেঃ

লা-মাযহাবী বন্ধুরা কাযী আবু ইয়ালা রহ. এর তাবাকাতুল হানাবেলা গ্রন্থ থেকে ইমাম আহমদের একটি উক্তি সম্ভবত হানাফীদেরকে কটাক্ষ করেই উদ্ধৃত করে থাকেন। উক্তিটি হলো, তুমি যদি (বাগদাদের) একশত মসজিদেও ছালাত আদায় কর, তবুও তুমি কোন মসজিদে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও সাহাবায়ে কেরামের ছালাত দেখতে পাবে না।

এ উক্তিটি তারা যেভাবে উপস্থাপন করেন, তাতে অনুমিত হয় যে, ইমাম আহমদ হানাফীদের উদ্দেশ্যেই উক্তিটি করেছিলেন। তারা ইমাম আহমদের মূল আলোচ্য বিষয় থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধু তাঁর এ উক্তিটি উদ্ধৃত করেছেন। মূলত তিনি কোন এক মসজিদে নামায আদায়কালে লক্ষ করেছিলেন, অনেক মুসল্লি ইমামের পূর্বেই রুকু ও সেজদা করে। ফলে তাদের নামায ত্রুটিযুক্ত হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গেই তিনি ঐ উক্তিটি করেছিলেন। কিন্তু এ কথা বলাও এখানে আমার উদ্দেশ্য নয়। তাদের উদ্ধৃতি খুঁজতে গিয়ে সেই জায়গায়ই- আল হামদু লিল্লাহ- ইমাম আহমদের নিম্নোক্ত বক্তব্যটি পেয়ে গেছি, যাতে তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন,

خصلةٌ ، قد غلب عليها الناس في صلاتهم ـ إلا من شاء الله ـ من غير علة ، وقد يفعلها شبابهم وأهل القوّة والجلد منهم : ينحطّ أحدهم من قيامه للسّجود ، ويضع يديه على الأرض قبل ركبتيه ، وإذا نهض من سجوده ، أو بعدما يفرغ من التّشهّد : يرفع ركبتيه من الأرض قبل يديه ، وهذا خطأ ، وخلاف ما جاء عن الفقهاء ، وإنّما ينبغي له إذا انحطّ من قيامه للسّجود : أن يضع ركبتيه على الأرض ، ثم يديه ، ثم جبهته ، وإذا نهض : رفع رأسه ، ثم يديه ، ثم ركبتيه ، بذلك جاء الأثر عن النّبيّ - صلى الله عليه وسلم فأمروا بذلك ، وانهوا عنه من رأيتم يفعل خلاف ذلك ، وأمروه أن ينهض - إذا نهض - على صدور قدميه ،

অর্থাৎ কোন রকম ওযর ছাড়া একটি অভ্যাস নামাযে মানুষের উপর- কিছু ব্যতিক্রম লোক ছাড়া- প্রভাব বিস্তার করেছে। তাদের যুবক শ্রেণী ও শক্তিমান ও বলবানরাও এটি করে থাকে। তারা যখন দাঁড়ানো অবস্থা থেকে সেজদায় যায়, তখন মাটিতে হাত রাখে হাঁটু রাখার পূর্বে। আর যখন সেজদা থেকে উঠে কিংবা তাশাহহুদ শেষ করে ওঠে, তখন হাত ওঠানোর পূর্বে মাটি থেকে হাঁটু উত্তোলন করে। এটা একটি ভুল পদ্ধতি। ফকীহগণের কাছ থেকে যা পাওয়া গেছে এটা তার বিপরীত। তার জন্য উচিৎ হলো, সেজদায় যাওয়ার সময় আগে মাটিতে হাঁটু রাখা, পরে হাত, পরে চেহারা। আর যখন উঠবে, তখন প্রথমে মাথা, পরে হাত, পরে হাঁটু উঠাবে। নবী সা. থেকে এভাবেই হাদীস এসেছে। তাই তোমরা এভাবেই করার নির্দেশ দাও এবং যাদেরকে এর ব্যতিক্রম করতে দেখ তাদেরকে ঐ কাজ থেকে নিষেধ কর। তাদেরকে বল, যেন পায়ের উপর ভর দিয়েই উঠে পড়ে। (তাবাকাতুল হানাবিলা, ১/৩৬৩)

এখন দেখুন, এরা কি বলে, আর ইমাম আহমদ কি বলেন? মানুষ কোনটা মানবে? ইমাম আহমদের কথা, না এদের মতো মানুষের কথা, যাদের বক্তব্য স্ববিরোধিতা ও ভুলে ভরা?

ইমাম আহমদের মতো ইসহাক রহ.ও এ মাসআলায় একই মত অবলম্বন করেছেন।

ইমাম ইবনুল মুনযিরও (মৃত্যু ৩১৯ হিজরী) তার আল ইকনা’ গ্রন্থে তার নিজের মত এভাবে ব্যক্ত করেছেন,

ثم خر ساجدا تكبر مع انحطاطك وأنت تهوي للسجود ولتقع ركبتاك على الأرض قبل يديك ويداك قبل وجهك.

অর্থাৎ অতঃপর তুমি সেজদা করো, এবং সেজদায় যাওয়ার সময় তাকবীর বল। মাটিতে হাত পড়ার পূর্বে যেন তোমার হাঁটু পড়ে এবং চেহারা পড়ার পূর্বে যেন হাত পড়ে। (১/৯৪)

অসম দুঃসাহসিকতাঃ

পূর্বেই বলেছি, সংখ্যাগরিষ্ঠ ফকীহ ও মুহাদ্দিস হাতের পূর্বে হাঁটু দিয়েই সেজদায় যাওয়ার পক্ষে। ইমাম দারিমী অবশ্য বলেছেন, আগে হাত দিক বা হাঁটু, উভয়টিই ভাল কাজ। ইমাম মালেক রহ. থেকেও এমন একটি বর্ণনা রয়েছে যে, বিষয়টি মুসল্লির এখতিয়ারাধীন। ইমাম ইবনে তায়মিয়াও এ মতটি অবলম্বন করেছেন। তবে ইমাম মালেকের প্রসিদ্ধ মত হলো, হাত আগে দেবে, পরে হাঁটু। এমনটি করা তার নিকট মুস্তাহাব। মালেকী মাযহাবের কিতাবসমূহে নামাযে মুস্তাহাব আমলের তালিকায় এটি উল্লেখ করা হয়েছে। (দ. আহমাদ আদ দারদের, আশ শারহুল কাবীর, ১/২৫০) এসব থেকে স্পষ্ট যে, উম্মতের কেউই এটাকে ফরজ বলেন নি। হিজরী পঞ্চম শতকে সর্বপ্রথম ইবনে হাযম জাহিরী (মৃত্যু ৪৫৬) আগে হাত দিয়ে সেজদায় যাওয়াকে ফরজ বলে উম্মত থেকে বিচ্ছিন্ন মত পোষণ করেছেন। দীর্ঘ শতাব্দী পর আলবানী সাহেব (মৃত্যু ১৪২০ হিজরী) সেই বিচ্ছিন্ন মতটিকে বেছে নিয়ে অসম দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন (দ. আসলু সিফাতিস সালাহ)। তার ভক্তরা অবশ্য সকলে এ বিষয়ে তার সঙ্গে একমত হতে পারে নি। ড. আসাদুল্লাহ গালিব তার ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) গ্রন্থে নামাযের সুন্নত আমলগুলোর মধ্যে এটিকেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। (দ. পৃ. ৫২)

আমরা অনুমোদিত পন্থায় আমল করার পক্ষেঃ

তো, এত এত সহিহ হাদিস দলিল হিসেবে বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও, অনুমোদিত এবং সহজে পালনীয় নিয়ম ছেড়ে নামাজে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে সিজদায় যেতে হাতের পূর্বে মাটিতে হাঁটু রাখার ক্ষেত্রে অধিকতর কঠিন এবং যুক্তিগ্রাহ্য নয় এমন পদ্ধতির পেছনে আমাদের কেন ছুটতে হবে? আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা এবং তাঁর প্রিয় রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো আমাদের জন্য দ্বীনের প্রতিটি আমলকে সহজ করে দিয়েছেন। আমরা কেন এগুলোকে কঠিন থেকে কঠিনতর এবং জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছি? আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা দ্বীনের প্রতিটি আমলকে সহিহভাবে, শরিয়াহ অনুমোদিত সহজ পদ্ধতিতে পালন করার তাওফিক দান করুন।

এই লেখার উদ্দেশ্য এবং তথ্য গ্রহণের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশঃ

বিভ্রান্তির অপনোদন এবং সঠিক পথ ও পন্থা অবহিত হয়ে সেই অনুসারে প্রতিটি আমল সুন্দরভাবে সুসম্পন্ন করা অতিব গুরুত্বপূর্ণ। ইদানিংকালে আমাদের কিছু ভাইদের এসব আমলের ক্ষেত্রে অতি বাড়াবাড়ি সমাজে বিভক্তি সৃষ্টির পথ তৈরি করছে। তারা নিজেরা যে আমল ভালোবাসেন অথবা সঠিক মনে করেন, সেটির অনুসরণ তারা করতেই পারেন, তাতে আমাদের কোনো আপত্তিও নেই; কিন্তু অন্যদেরকেও একই পথে চলতে বাধ্য করার নীতিবিরুদ্ধ তাদের যে অপচেষ্টা সেটা খুবই দৃষ্টিকটু এবং নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। তাদের মত করে আমল যারা করেন না, কুরআনুল কারিম, হাদিসে নববী কিংবা শরিয়তে সে আমলের যত দলিলই থাকুক, তারা অবলীলায় সেটিকে বিদআত কিংবা ভুল আমল আখ্যা দিয়ে দিবেন এটাই হচ্ছে তাদের অনুসৃত একমাত্র নীতি এবং থিউরি। তাদের এই ভ্রান্ত নীতিই তাদেরকে উগ্রতার পথে ধাবিত করাচ্ছে। অথচ ইসলামে উগ্রতা এবং উগ্রবাদের কোন স্থান নেই। ইসলাম বরাবরই সাধারণ অবস্থায় পারস্পারিক সম্প্রীতি, সদ্ভাব, সহনশীলতা, নমনীয়তা এবং কোমল আচরণে বিশ্বাসী। নামাজের প্রতিষ্ঠিত দলিলভিত্তিক নিয়ম এবং মাসআলা মাসায়েলের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অনাকাঙ্খিত অপপ্রচারের ফলে সৃষ্ট দ্বিধা, সংশয় ও হীনমন্যতার বেড়াজাল থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার লক্ষ্যে আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং জ্ঞানের পরিধিকে প্রসারিত করে নেয়ার বিকল্প নেই। সেই লক্ষ্যেই এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।

এই লেখাটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে অধিকাংশ তথ্য উপাত্ত গ্রহণ করা হয়েছে সুলেখক মাওলানা আব্দুল মতিন প্রণিত দলিলসহ নামাজের মাসায়েল গ্রন্থ থেকে। নামাজের অধিকাংশ মাসআলা মাসায়েলের দলিল ভিত্তিক নির্ভরযোগ্য বইটি বাংলা ভাষাভাষী সকল মহলে ইতোমধ্যেই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। প্রত্যেকেরই উচিত বইটি নিজের সংগ্রহে রাখা। প্রাজ্ঞ এবং বিজ্ঞ লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞতা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা তাঁর সকল দ্বীনি খেদমতকে কবুল করুন। তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি করুন। ইহকালে পরকালে তাকে এসব কাজের উত্তম প্রতিদান প্রদান করুন।

মন্তব্য ১২ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই জুন, ২০২১ সকাল ১১:০৯

নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন:

নতুন নকিব ভাই আসসালামু আলা্ইকুম
আশা ও বিশ্বাস করি আপনি মহান আল্লাহর
কৃপায় কুশলে আছেন। আপনি শুরু থেকেই
ইসলাম ধর্মের নানান প্রসঙ্গ নিয়ে লেখা প্রকাশ
করেন আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আপনাকে এজন্য
উত্তম বিনিময় দান করবেন। আমিন
আপনার এ ধরনের লেখা পড়ে ইমানদার মুসলমান
প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে ইনসাআল্লাহ।

ইদানিং বিভিন কারনে আমার মনে একটি প্রশ্ন জাগ্রত
হয়ছে তা হলো এ্ই লেখাগুলো কি মৌলক মানে আপনার
নিজের লেখা ? আপনি কি আরবী টাইপ করতে জানেন?
নাকি কোথাও থেকে কপি করে পেস্ট করেন?
কপি পেস্ট হলেও আমার বলার কিছু নাই কারণ ভালো
কিছু কোথাও থেকে সংগ্রহ করে তা কারো জানার জন্য
প্রকাশ করা দোষণীয় নয়। ইদানিং ব্লগ কর্তৃপক্ষ কপি পেস্টের
বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন। শাস্তি হিসেবে কয়েকজনকে
নির্বাসিত করেছেন এটা ভালো উদ্যোগ । তবে এটা সবার বেলা
প্রযোজ্য হলে সমতা বজায় থাকে ! আশা করি বুঝতে পেরেছেন।
আবারো আপনার সু-স্বাস্থ্য কামনা করে আপনার এ ধরনের লেখার
অব্যহত থাকুক সে প্রত্যাশা করছি।

১৫ ই জুন, ২০২১ বিকাল ৩:০৫

নতুন নকিব বলেছেন:



জ্বি, ওয়া আলাইকুমুস সালাম প্রিয় নূরু ভাই। আপনার আশা ও বিশ্বাস অনুসারে আল্লাহ তাআ'লার অশেষ রহমতে কুশলেই আছি।

আপনি শুরু থেকেই ইসলাম ধর্মের নানান প্রসঙ্গ নিয়ে লেখা প্রকাশ করেন আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আপনাকে এজন্য উত্তম বিনিময় দান করবেন। আমিন

আপনার এ ধরনের লেখা পড়ে ইমানদার মুসলমান প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে ইনসাআল্লাহ।


-অতি সামান্য যা কিছু লিখে থাকি, তা যদি ইমানদার মুসলমানগণসহ কারও সামান্য উপকারে আসে, তাহলেই শ্রম স্বার্থক মনে করবো। আপনার আন্তরিক দোআ আল্লাহ তাআ'লা কবুল করুন। আপনাকেও তিনি সুস্বাস্থ্যে দীর্ঘায়ু করুন। আপনার ঈমান ও আমলে বারাকাহ দান করুন।

আপনার শেষের পয়েন্টটি গুরুত্বপূর্ণ। কপি পেস্ট বন্ধ হওয়া একান্ত প্রয়োজন। ব্লগের পরিচ্ছন্নতা রক্ষা এবং এর ফলে সৃষ্ট যে কোনো অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি এড়ানোর জন্যই এটা প্রয়োজন। ব্লগ কর্তৃপক্ষের সাম্প্রতিক এ পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তাদেরকে সাধুবাদ জানাই।

বাদবাকি আপনি জানতে চেয়েছেন যে, আমি আরবি লিখতে পারি কি না। আলহামদুলিল্লাহ, পারি। আর সর্বোপরি কথা হচ্ছে, মৌলিক লেখা কাকে বলা যায় সেটা কিন্তু একটা প্রশ্ন। একটি লেখার সাথে রেফারেন্স হিসেবে যদি কোন লেখা থেকে কিছু কোট করা হয় লেখকের আবশ্যিক দায়িত্ব হয়ে যায় সেই লেখকের কাছ থেকে সম্ভব হলে অনুমতি গ্রহন করে নেয়া। নিতান্ত অপারগতায় সূত্র উল্লেখপূর্বক তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ন্যূনতম সৌজন্যতা। সেটাও যখন না করা হয় তখন তাদেরকে কোন অভিধায় ভূষিত করবেন? এটা স্রেফ চৌর্যবৃত্তির আওতায় পড়ে বলে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান বলে।

প্রসঙ্গত একটি কথা বলা বিধেয় মনে করছি যে, ইসলামী জ্ঞান বিষয়ক লেখার পেছনে লেখকের অন্তরে পাঠকবৃন্দের পক্ষ থেকে সাওয়াবপ্রাপ্তির একটা উদ্দেশ্য নিহিত থাকে। পক্ষান্তরে অন্যান্য লেখা যথা- কবিতা, গল্প, ফিচার ইত্যাদি প্রকাশের পেছনে মূল লেখক বা কপি পেস্ট রাইটার কারোরই সাওয়াবপ্রাপ্তির এই উদ্দেশ্যটি থাকে না। এসবের পেছনে বরং পার্থিব কোনো উপকারের বিষয় থেকে থাকে কিংবা তাদের হয়তো নিজেদের লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা কিংবা সুনাম সুখ্যাতি ইত্যাদি অর্জন করার বাসনা থেকে থাকে। যেসবের কারণে সাধারণ লেখা এবং ইসলামী জ্ঞান বিষয়ক লেখার উদ্দেশ্যের ভেতরেই একটা পার্থক্য স্পষ্টভাবে বিদ্যমান। এই ক্ষেত্রে মূল লেখকের অনুমতি সাপেক্ষে কিংবা একান্ত অপারগতায় সঠিকভাবে সূত্র উল্লেখ করে শুধুমাত্র দ্বীনের জ্ঞানের প্রচারের উদ্দেশ্যে এবং সাওয়াবপ্রাপ্তির প্রত্যাশায় ইসলামী জ্ঞান বিষয়ক কোনো লেখার রেফারেন্স বা বিশেষ প্রয়োজনে অনুমতি সাপেক্ষে অংশ বিশেষ প্রকাশের অবকাশ রয়েছে বলে মনে করি। তবে, শর্ত হচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় মূল লেখককে অবশ্যই সাথে রাখা উচিত, তিনিও যাতে উক্ত লেখা পাঠ করে উপকার গ্রহনকারী প্রত্যেক ব্যক্তির নিকট থেকে দোআর অংশীদার হতে পারেন।

জাজাকুমুল্লাহু খাইরান।

২| ১৫ ই জুন, ২০২১ সকাল ১১:৩৩

নজসু বলেছেন:




আস সালামু আলাইকুম প্রিয় ভাই।
আশা করি ভালো আছেন।
মাশায়াল্লাহ অনেক সুন্দর একটি ব্লগ শেয়ার করলেন।
ভালো লেগেছে। লাইক দিলাম।

৩| ১৫ ই জুন, ২০২১ সকাল ১১:৩৬

মরুভূমির জলদস্যু বলেছেন: ইদানিং বিভিন কারনে আমার মনে একটি প্রশ্ন জাগ্রত
হয়ছে তা হলো এ্ই লেখাগুলো কি মৌলক মানে আপনার
নিজের লেখা ? আপনি কি আরবী টাইপ করতে জানেন?
নাকি কোথাও থেকে কপি করে পেস্ট করেন?


ইদানিং ব্লগ কর্তৃপক্ষ কপি পেস্টের
বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন। শাস্তি হিসেবে কয়েকজনকে
নির্বাসিত করেছেন এটা ভালো উদ্যোগ । তবে এটা সবার বেলা
প্রযোজ্য হলে সমতা বজায় থাকে !


আমারও এই কথাই!!

৪| ১৫ ই জুন, ২০২১ সকাল ১১:৪১

আমি সাজিদ বলেছেন: ধরুন, যে মানুষটির অস্টিও আথ্রাইটিস আছে, সে তো আগে হাত দিয়ে পরে হাঁটু বসাবে, তার কি নামায কবুল হব্র না?

৫| ১৫ ই জুন, ২০২১ সকাল ১১:৪২

মহাজাগতিক চিন্তা বলেছেন: সুপ্রিয় কবি ও লেখক, আপনার এজাতীয় পোষ্ট মানুষের অজ্ঞতা নিরসনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আল্লাহ আপনাকে হায়াতে তাইয়েবাহ দান করুন-আমিন।

৬| ১৫ ই জুন, ২০২১ সকাল ১১:৪৬

মহাজাগতিক চিন্তা বলেছেন: @ আমি সাজিদ, অপারগতার ক্ষেত্রে ইসলামে ভিন্ন হিসাব।

৭| ১৫ ই জুন, ২০২১ দুপুর ১২:০৯

ফুয়াদের বাপ বলেছেন: মাশাআল্লাহ, অনেক হাঁটু আগে না হাত আগে এই নিয়ে খুটিনাটি সকল তথ্য নিয়ে সুবিস্তৃত আলোচনা।

৮| ১৫ ই জুন, ২০২১ বিকাল ৩:০২

লোনার বলেছেন: আপনার বিশাল লেখাটা স্ক্যান করতে দেখলাম শাইখ ইবনে বায, শাইখ ইবনে উসাইমিনের পরে হঠাৎ করে
শাইখ আলবানীকে সম্বোধন করলেন "আলবানী সাহেব" বলে। একটা নামের ব্যাপারেই সুবিচার করতে পারলেন না - আপনার কাছে দ্বীন কতটুকু নিরাপদ, সেটা বিশ্লেষণের দাবী রাখে। আপনি যাকে "আলবানী সাহেব" বলে পাশের বাড়ীর "রহিম সাহেব" বা "সোহেল সাহেবের" জায়গায় নামাতে চেয়েছেন, তাকে স্বয়ং বিন বায শতবর্ষে জন্ম নেয়া একজন "মুজাদ্দিদদ" বলে আখ্যায়িত করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি যে ২০৮ খানি কিতাব লিখে রেখে গেছেন, আমার মত নগণ্য মানুষ আরেকবার জীবন পেলেও, সেগুলো পড়ে শেষ করতে পারবে বলে মনে হয় না! মুসলিম হয়েও যদি একজন যুগশ্রেষ্ঠ আলেমের প্রতি, দ্বিমত থাকলেও, সম্মান দেখাতে না পারেন - তাহলে কাফির, মুশরিক, নাস্তিকদের দোষ কোথায়?

৯| ১৫ ই জুন, ২০২১ বিকাল ৩:৫২

জটিল ভাই বলেছেন:
প্রয়োজনীয় পোস্ট :)

১০| ১৫ ই জুন, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:৩৬

নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন:

লেখক বলেছেনঃ বাদবাকি আপনি জানতে চেয়েছেন যে, আমি আরবি লিখতে পারি কি না। আলহামদুলিল্লাহ, পারি। আর সর্বোপরি কথা হচ্ছে, মৌলিক লেখা কাকে বলা যায় সেটা কিন্তু একটা প্রশ্ন। একটি লেখার সাথে রেফারেন্স হিসেবে যদি কোন লেখা থেকে কিছু কোট করা হয় লেখকের আবশ্যিক দায়িত্ব হয়ে যায় সেই লেখকের কাছ থেকে সম্ভব হলে অনুমতি গ্রহন করে নেয়া। নিতান্ত অপারগতায় সূত্র উল্লেখপূর্বক তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ন্যূনতম সৌজন্যতা। সেটাও যখন না করা হয় তখন তাদেরকে কোন অভিধায় ভূষিত করবেন? এটা স্রেফ চৌর্যবৃত্তির আওতায় পড়ে বলে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান বলে।

আলহামদুল্লিাহ, আপনি আরবী টাইপও জানেন। তা হলে এটা আপনার মৌলিক লেখা আরবী টাইপসহ। যেহেতু লেখার শেষে কোন সূত্র যোগ করেন নি। আল্লাহ আপনা ক উত্তম বিনিময় দান করুন। আমিন

নামাজে মাঝে মাঝে আমার হাত আগে জমিন স্পর্শ করতো
আজ আপনার লেখাটি পড়ে খুব সতর্ক হয়েছি আশা করি
আগামীতে আর এমন ভুল হবেনা।

১১| ৩০ শে জুন, ২০২১ রাত ১০:৩২

খায়রুল আহসান বলেছেন: প্রথম দুটো অনুচ্ছেদে যা বলেছেন, সেটা সঠিক। আমার বাবাও আমাকে নামায শেখানোর সময় এ নিয়মগুলোই শিখিয়েছিলেন। আল্লাহ রাব্বুল 'আ-লামীন তাকে জান্নাত নসীব করুন!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.