নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নীলকান্ত নীল

নীলকান্ত দা

কবিতার ঘ্রাণ আসে, আসে এক বুক গোলাপের নির্যাস

নীলকান্ত দা › বিস্তারিত পোস্টঃ

জন্মান্তর নাকি অনাত্মা?

১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১০:৫৫

উপনিষৎ এ আত্মার কথা বলা হয়েছে। যেমনঃ আত্মা মানুষের অন্তস্থলে রয়েছে। প্রতিটি জীবের নিজস্ব আত্মা রয়েছে। সেই আত্মা পর-ব্রহ্মেরই অংশবিশেষ বা পরমাত্মা। তাই আত্মাই ব্রহ্ম। আত্মার মৃত্যু নাই, ক্ষয় নাই, আত্মা নিত্য। আত্মা অশরীরী রূপে অনিত্যবস্তুর (দেহ) মধ্যে বর্তমান। আত্মাকে জামা কঠিন। এই শরীর রথ হলে আত্মা হলো রথচালক। আত্মা সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর, আবার বিশাল থেকে বিশালতর। আত্মা সর্বত্র বিচরণ করে। আত্মার কারণেই মানুষ রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ও মিলনসুখ উপলব্ধি করে। অতএব আত্মা জ্ঞানস্বরূপ। তিনি সর্বক্ষণ বর্তমান। আত্মা জাগতিক দুঃখে লিপ্ত হয় না, জন্মহীন, শাশ্বত। দেহের নাশ হলেও আত্মার বিনাশ নাই। আবার বলা হলো মনই আত্মা। আত্মা পরব্রহ্মের সাথে লীন হলে তবেই মুক্তি, নইলে বারবার জন্মগ্রহণ করতেই হবে।

কিন্তু বৌদ্ধদর্শন? বৌদ্ধদর্শনে মন বা চিত্তকে, চিত্ত বা মনই বলা হয়েছে, আত্মা বলা হয় নি। বৌদ্ধদর্শনে আত্মা নেই। বুদ্ধের স্বীকৃত অনাত্মা। বুদ্ধদর্শন বলে জগতের সব কিছুই অনিত্য। এই অনিত্য সংসারে নিত্য বলতে কিছুই নেই। প্রতিটি মুহুর্তেই এই জীবজগত পরিবর্তন হচ্ছে, আমি বা আপনি সকলেই, ধ্রুব স্থিত বলতে কিছুই নেই। সুতরাং নিত্য আত্মাও নেই।
বুদ্ধ বলেছেন - সৃষ্টি-স্থিতি-লয় সব কিছুই কার্য-কারণ সম্বন্ধে হয়। এখানে ঈশ্বরের কোন কারসাজি নেই। যেখানে ঈশ্বরের ভূমিকা নেই সেখানে আত্মা ও জন্মান্তরের কার্য-কারণ কি? বৌদ্ধদর্শন বলছে কেবল তৃষ্ণার কারনেই মানুষের পূনজন্ম হয়। এখানে চিত্তের একস্থান হতে চ্যুত হয়ে অন্যস্থানে উদয় হওয়াকে বুঝানো হয়েছে। একে বুদ্ধ প্রতীত্যসমুৎপাদ বলেছেন। 'দীঘনিকায়ের মহানিদান সুত্র' এ বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বুদ্ধের 'প্রতীত্যসমুৎপাদ' সঠিকভাবে জ্ঞাত না হলে মানুষের এইরূপ ভ্রান্তি হবেই।

প্রশ্নঃ বৌদ্ধদর্শনের সাথে জন্মান্তরবাদ নিহিত নাকি প্রক্ষিপ্ত?

উত্তরঃ বুদ্ধের আবির্ভাবের বহু পূর্ব হতেই সমগ্র ভারতবর্ষে বহুবিধ ধর্মদর্শনের প্রচলন ছিলো। প্রথমদিকে ছিলো যাগ-যজ্ঞ। যাগ-যজ্ঞ করে দেবতাদের মনতুষ্টি, প্রাণ বলী প্রথা ইত্যাদি ধারনা ছিলো তৎকালীন ভারতবর্ষের মানুষের ধর্মিয় মনোভাব। এসবের সাথেই যুক্ত ছিলো জন্মান্তরবাদ সহ বহু প্রথা। বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর সমগ্র জম্বুদ্বীপে যে বুদ্ধ শিক্ষা ছড়িয়ে পড়ে তা নয়। বুদ্ধের শিষ্য-প্রশিষ্যদের মুখে মুখেই বুদ্ধের বাণী ও দর্শন তখন প্রবাহমান থাকে। এর মধ্যে বহু শিষ্য ও প্রশিষ্যরা মারা যাচ্ছেন এবং তাদের পরবর্তি শিষ্যদের দ্বারাই একইভাবে বুদ্ধের দর্শন প্রচারিত হচ্ছিলো প্রায় ৪০০ বছর ধরে। এই ৪০০ বছরে দীর্ঘ কালের পরিক্রমায় বুদ্ধের বাণীর বহুপ্রকার অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন হয়ে যায় গুরু-শিষ্য পরম্পরার ধারায়। গুরুর মুখ থেকে শিষ্য শুনে যেটুকু মনে রাখা সম্ভব সেটুকুই মনে রেখেছে, বাকীটুকু ব্যক্তির চিন্তার ব্যায়াম। এখানে যারা বুদ্ধের মুখনিঃসৃত বাণীকে প্রচার করতো তারা অনেকাংশে নিজেদের সংযোজিত কথামালাও বুদ্ধের উক্তি বলেই চালিয়ে দিতো। কারণ সে ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজে বুদ্ধের শিক্ষার গবেষণার যথেষ্ট অভাব ছিলো এবং ক্ষমতাধরের ভয় ছিলো। যে সকল ভীক্ষুরা বুদ্ধের বাণী প্রচার করছিলো তারা তো আর বুদ্ধ না, তারা বুদ্ধের বাণীগুলোকে হুবহু অব্যাহত রাখতে পারেন নি, তারা বিভিন্ন সময়ের আঞ্চলিক ধ্যান-ধারণার প্রভাবে প্রভাবিতও ছিলো। সে ধারণার সাথে বুদ্ধের দর্শনের এক জগাখিচুড়ি ফসল তারা মানুষের মাঝে প্রচার করে আসছিলো, কারণ বুদ্ধ কোথাও তার একটি উক্তিও লিখে যান নি। তাহলে কোথা থেকে বা কিসের উপাত্ত হতে বুদ্ধকে তারা তুলে ধরবেন সেই মূর্খ ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজে? তার কোন সুযোগই যে ছিলো না। যার ফলে ত্রিপিটকে বহু উক্তি, সুত্র এবং গাথা আছে যা বুদ্ধের চরিত্রের সাথে যায় না, বহুলাংশে সাংঘর্ষিক।
কিন্তু তৎকালীন প্রচলিত জন্মান্তরবাদের সাথে জড়িত রয়েছে চুড়ান্ত ব্রাহ্মণ্যবাদের ভোগবাদী চক্রান্ত, যা এখনো শ্রাদ্ধ বা 'মৃতের উদ্দেশ্যে কর্ম' বলে চলে আসছে, এমনকি তা বৌদ্ধ সামাজিক বলয়ের মধ্যেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। যেখানে আত্মার ভূমিকা নাই , সেখানে শ্রাদ্ধ বা মৃত্যের উদ্দেশ্যে কর্ম করার নামে যে দানছত্র খুলে রাখার ঐতিহ্য, তা শুধুমাত্রই ভিক্ষুদের ভোগবাদী সিস্টেমের প্রধান উপায়। এর সাথে মৃতের কোন সম্পর্কই নেই। মৃত দর্শনে যে সুত্র পাঠ করা হয় তাও বুদ্ধের অনিত্য দেশনা, এই সদ্য মৃতটিকে দেখিয়ে জীবিতদেরকে এই জগতের অনিত্যতা দেখানোর দেশনা। মানুষকে সত্য জানালে তারা তো অচিরেই মৃতের জন্য কর্ম ক্রিয়া বন্ধ করে দিবে এবং তাদের রাজত্ব ধ্বংস হয়ে যাবে। একটু লক্ষ করলেই দেখবেন যে ভীক্ষুদের কাজই মৃতের জন্য সংঘদান, বিশাল দান আয়োজন, মৃতের জন্য সাপ্তাহিক, মাসিক এমনকি বাৎসরিক কর্ম করাও। যা ব্রাহ্মণ্য প্রথা, এখানে ভীক্ষুরাই তাতে দিনরাত্র লিপ্ত। এখানে বাধ্যবাধকতাও রয়েছে যে - মৃতের জন্য এসব কর্ম না করা হলে তাদের আত্মার উদ্ধার হয় না। আরে বাবা আত্মা থাকলেই তো উদ্ধার হবে। এসব ধ্যান-ধারণাই বৌদ্ধদর্শনকে কলুষিত করে। চর্যাপদের কবিরা বলেন - "এরা লোক ঠকাইয়া খায়"। এরা হিংস্র ও লোভী। এরা মানুষকে একদিকে অন্ধ করে পরজন্মের লোভ ও ভয়ে ভোগবাদ প্রতিষ্ঠিত করে, অন্যদিকে এসব না করলে পাপ-পূণ্যের ঠেলা আর পারমীর সংকটে নির্বাণের স্বপ্ন দেখায়। সবকিছুই ভোগবাদ এবং তাদের ভোগবাদের চাকা সচল রাখার ধান্ধা। এসব মিথগুলো মূলত এভাবেই বুদ্ধবাদের সাথে যুগ যুগ ধরে প্রক্ষিপ্ত অবস্থায় রয়েছে, যা থেকে মানুষকে স্বচ্ছ ধারণা দেয় না, তাদের ভোগবাদ সচল রাখার উদ্দেশ্যে। যাকে পরিষ্কার করে বললে দাঁড়ায়- পৌরোহিত্ববাদ।

আর উক্ত সমস্যাদি হতে উত্তরণের সিঁড়ি হিসেবে বুদ্ধ ভাষিত "কালাম সুত্ত" এর ব্যবহার যখন করছি, তখনই পুরোহিতদের ভোগবাদের সাম্রাজ্য ধ্বসে পড়ে, আর সাথে সাথে কেউ কেউ কবিতায় বা ছন্দে নানাভাবে এই মূল্যবান সূত্রের সকলের প্রতি দৃষ্টি দুর্বল করতে শুরু করে ঢোল পেটানো।

নিন্মে জানুন এই কালাম সুত্রের জন্ম কিভাবে-
একদিন যোদ্ধাজাতি কালামগণ বুদ্ধকে দর্শন করতে এসে তারা বুদ্ধকে বললেন - 'ভদন্ত, আমাদের এখানে যেসব সাধুসন্ন্যাসী ও শাস্ত্রবিদগণ আসেন, তারা সবাই নিজেদের মতবাদকে বড় করে দেখান, ফলাও করে বলেন, সমালোচনায় উড়িয়ে দেন, তাতে শুধু আমরা বিভ্রান্ত হই, কার কথা সত্য- মিথ্যা বা কার কথা গ্রহণীয়- বর্জনীয় আমরা বুঝতে পারি না'।
তখন বুদ্ধ বললেন -
হে কালামগণ, শোনা কথায় বিশ্বাস করিও না। বংশপরম্পরায় প্রচলিত বলে বিশ্বাস করিও না। সর্বসাধারণে বলছে বলে বিশ্বাস করিও না। ধর্মগ্রন্থে লিখিত আছে বলে বিশ্বাস করিও না। গুরুজন বা বয়োজ্যেষ্ঠরা বলছে বলে বিশ্বাস করিও না। কারো ব্যক্তিত্বের প্রভাবে অভিভূত হয়ে বিশ্বাস করিও না। তর্কের চাতুর্য্যে বিশ্বাস করিও না। নিজের মতের সাথে মিল আছে বিশ্বাস করিও না। দেখতে সত্য বলে মনে হয়- একারণেও বিশ্বাস করিও না।
হে কালামগণ- নিজের বিচার বুদ্ধি, বিচক্ষণতা প্রয়োগ করে যদি দেখতে পাও এগুলো যুক্তির সাথে মিলে এবং নিজের ও সকলের জন্য মঙ্গলজনক ও কল্যাণকর, তাহলে সেটা গ্রহণ করবে এবং সেই অনুযায়ী জীবন যাপন করবে।
(বুদ্ধের এই কথোপকথন "কালামসূত্র" হিসেবে লিখিত আছে পালিতে, যাকে বাংলায় অনুবাদ করলে এটিই পাওয়া যায়।)


স্বল্প তথ্য সংগ্রহঃ
১. বিশুদ্ধ দীঘনিকায় (বাংলা অনুবাদ) - করুণা প্রকাশণী, কলকাতা-৯।
২. উপনিষৎ ও বুদ্ধ - সাধনকমল চৌধুরী।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.