![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ডায়েরীর ছেঁড়া পাতা থেকে
- যাযাবর জীবন
ছোট্ট এক টুকরো জমি, বাবার কেনা। সেই অনেক অনেক কাল আগের। তখন আমার জন্মও হয় নি। স্কুল শিক্ষক বাবা অনেক কষ্টের টাকা জমিয়ে এক টুকরো
জমি কিনেছিলেন এই ঢাকা শহরে। এখন তা সোনার খনি। ওনার টিউশনির টাকায় টিনের ঘর তুলেছিলেন মাথা গোঁজার ঠাই হিসাবে। সম্ভবত ওনার সংসার হিসেবেও।
দুটি শয়ন কক্ষ, একটি বৈঠকখানা, এক চিলতে বারান্দা আর সামনে ঘাসের লন। ওপরে পাকা ছাঁদ দেবার টাকা ছিল না তাই টিনে চাল। মনে আছে ছোট বেলায়
মা ঘুম পাড়াতেন গান গেয়ে, একদিকে টিনের চালে বৃষ্টির রিমঝিম অন্যদিকে মায়ের গুনগুন। কখন যে চোখ লেগে যেত ঘুমে নিজেই জানতাম না। আমি বাবা আর মা;
এই তিন জনের ছোট্ট সংসার। ভালোই চলছিল। তারপর কালের স্রোতে জীবন গড়িয়ে চলল - বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরিয়ে কর্পোরেট ভুবনে ঢুকে গেলাম। বাবার
অনেক ইচ্ছে ছিল, ছেলে যেন তার মত শিক্ষক হয়। ওনার মত সৎ মানুষ হয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মানুষ হওয়ার শিক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত করি। না হয়
বাস্তব জীবনে থাকুক কিছু পয়সার টানাটানি! তবুও তো সৎ উপার্জনে দুটি অন্ন বস্রের সংকুলান হয়ে যাবে। পছন্দ হয় নি সেদিন বাবার কথা, ছোট বেলা থেকে দেখে
আসা টানাটানির সংসারের বোঝা; এ যেন আমার জন্য না। আমার জন্য অন্য এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছি আমি নিজে। তাই গা ভাসালাম কর্পোরেট যুগে।
এরপর ছেলের বিয়ে দেবার জন্য মা উঠে পড়ে লাগলেন। এক সময় বাধ্য ছেলের মত বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়লাম।
বড় শোবার ঘরটা বাবা-মা ছেড়ে দিয়েছিলেন আমার জন্য সেই অনেক কাল আগেই; যেদিন বিয়ে করে নতুন বৌ ঘরে তুলেছিলেম। ওনারা নিজেদের সরিয়ে
নিয়ে গিয়েছিলেন দ্বিতীয় শোবার ঘরে। তখনো আমাদের মাত্র দুটি শোবার ঘর। বাবার সারাজীবনের সৎ উপায়ের সঞ্চয়ে এর থেকে বেশী কিছু করার সামর্থ্য ওনার
ছিল না। তবুও একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা। ওনাদের পঁচিশ বছরের সংসার পাতা শোবার ঘরটা নির্দ্বিধায় সাজিয়ে দিয়েছিলেন আমাকে; এখনো মনে আছে।
সেও তো প্রায় পঁচিশ বছর হয়ে গেছে।
এর মধ্যে সংসার বড় হয়েছে কলেবরে, ছেলে মেয়ে এসেছে সংসারে। বড় ছেলে আর বড় মেয়ে দুটোই বিশ্ববিদ্যালয়ে, ছোট মেয়েটা এবার ও লেভেল দেবে।
সময়ের স্রোত গড়িয়ে আমি এখন অনেক উঁচু পদে, বেসরকারি চাকরিতে। বসেদের তেল মেখে মেখে। আজকের যুগের কর্পোরেট সভ্যতা, তেল ছাড়া
কোথায় কবে উপরে উঠতে পারে? বেতন মাশাল্লাহ ভালই পাচ্ছি, অফিসের গাড়ী আমার নিজের যাতায়াতের জন্য। এছাড়াও বেগম সাহেবার জন্যও গাড়ী হয়েছে
লোনের বদৌলতে। যদিও দরকার ছিল না কোন; তবু ট্যাক্সের উকিলের পরামর্শ। লোনের কিছু বোঝা নিজের গাঁয়ে অযাচিত চাপানো, এটাও নাকি আজকের
যুগের কর্পোরেট সভ্যতার অংশ। আমার কি? টাকা যোগায় ভুতে, আমি তেলের উপর আছি। অধঃস্থনদের তেল খাই আর ঊর্ধ্বতনদের তেল মাখি। কর্পোরেট সভ্যতার
ধ্বজাধারী। সারাদিন অফিস করি, একটু মদ্যপানের অভ্যাস কর্পোরেট ক্লায়েন্টের বদৌলতে (শাক দিয়ে মন ঢাকি, আমি আবার মদ খাই নাকি?); মাঝে মধ্যে
অনেক রাতে বাড়ি ফেরা, মাঝে মধ্যে সুন্দরী রমণীর বাহুডোরে পাঁচ তারা হোটেল কক্ষে। কর্পোরেট ব্যবসার নামে, ক্লায়েন্ট খুশি করতে। এক রুমে আমার ক্লায়েন্ট,
আরেক রুমে আমি। দুজনাই দুই তন্বী সুন্দরীর বাহু-বন্দি। টাকা যোগায় অফিস, ব্যবসা হতে হবে যে! আমার যেন কেমন এক ঘোরের রাত কাটে আর টাকার দিন।
বুঝতে পারি নিজেই এখন আমার অনেক অনেক সুদিন। বসেরাও খুশি, ক্লায়েন্টও খুশি আমি তো আহ্লাদে ষোলোখানা। দিন যাচ্ছিল এভাবেই কালের স্রোতে ভেসে।
দিন দিন ঐ ছোট্ট বাসায় দম বন্ধ লাগে, যদিও এর মধ্যে টিনের বাসা ভেঙে ফেলেছি সেই কবেই। লোনের বোঝা মাথায় নিয়ে এখন ছয়-তালা বিল্ডিং শোভা পাচ্ছে
আমার বাবার জায়গায়। একমাত্র ওয়ারিশান আমি। পুরো একটি তালা জুড়ে আমাদের বসবাস, চার চারটি শোবার ঘর অথচ স্থান সংকুলান হচ্ছে না
যেন এত বড় বাসাতে কিছুতেই; কিংবা হয়তো মন সংকলন। বৌ এর নিত্য কানাকানি, তোমার বাবা এই করেছেন তোমার মা ঐ করেছেন - হরদম এ যেন
জীবনের অংশ হয়ে গেছে। ইদানীং আর মন লাগে না সংসারে কিছুতেই। তবুও সংসার নামের এক জঞ্জালে বসবাস, সং সেজে নিজে। মাঝে মাঝে শাশুড়ি বৌ এর
ঝগড়া যেন তুঙ্গে ওঠে। যথারীতি বৌ তার বাপের বাড়ি, আমি ঘরে ফিরে দৌড়াই বৌ ফিরিয়ে আনতে; প্রয়োজনে হাতে পায়ে ধরি। আরে তেল দিতে দিতে আমি এখন
তুখোড় তৈলমর্দনকারী। বড় বড় সাহেবদের মন গলে যায় আর এ তো ঘরের বৌ, আমার কাছে বড্ড বেশী ছেলেখেলা। খারাপ লাগে না মাঝে মাঝে একটু কপট চেহারা
নিজেরই। খুব মাঝে মাঝে আয়নায় চেয়ে দেখি - কাকে দেখা যায়? মানুষ না তেলের ব্যাপারী?
মাঝে মধ্যে ঝগড়া চরমে ওঠে, ছেলে মেয়েগুলো মায়ের সাথে জুটে; আমার মা অসহায় চোখে ছেলে বৌ এর কাণ্ড দেখে, নাতি নাতনীদের স্বরূপ দেখে - আর
খুব অগোচরে আঁচলে চোখ মোছে, যেন বাবা কিছু জানতে না পারে। আর বাবা! সব দেখে, সব বোঝে; ইদানীং কেমন যেন বোবা হয়ে গেছে। অনেক আশায়
মানুষ করা ছেলের অমানুষ রূপ দেখে। খুব মাঝে মাঝে তাদের জন্য আমার করে দেওয়া ছোট্ট ঘুপচি কামরাটায় ডাকে। বেশিরভাগ সময়, সময় হয় না আমার হাতে।
কিংবা হয়তো সময় থাকে, তবুও মনের খুব গোপন কোথায় যেন এক অপরাধ বোধ কাজ করে - ভয় লাগে বাবার মুখোমুখি হতে। একদিন তো সরাসরি জিজ্ঞাসাই
করে ফেললেন - "বাবারে, শিক্ষক পিতার পুত্র তুমি আজ কোন শিক্ষায় শিক্ষিত হলে, একটু বুঝিয়ে বলবে আমায়? পুরনো দিনের মানুষ আমি আমার মাথায়
ঢোকে না তোমার আলাদীনের চেরাগের কাহিনী"। আমি আমতা আমতা করি, বলি - ও তুমি বুঝবে না বাবা। হাতে চেরাগ আমার কর্পোরেট সভ্যতা। এখানে ঠিক মত
ঘষা দিতে পারলে আজকের যুগে টাকার নহর বয়ে যায়, আর ঘসতে না পারলে জীবন বয়ে যায় অর্ধাহারে আর অনাহারে। বাবা খুব তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রয়
আমার চোখের দিকে, আমি চোখ নামিয়ে ফেলি; সইতে পারি না বাবার ঐ দৃষ্টি।
ইদানীং যেন শাশুড়ি বৌ এর দা কুমড়ো সম্পর্ক (কি জানি আজকালকার স্যাটেলাইট সভ্যতার সিরিয়ালের বদৌলতে কি না কে জানে?)। একদিন বাসায় ফিরতে হলো
বাবার ফোন পেয়ে। বাসায় ঢুকে দেখি বৌ এর অগ্নিমূর্তি, কাঁচের গ্লাস প্লেট সারা ডাইনিং রুম জুড়ে পড়ে আছে ভাঙাচোরা হয়ে। মা এক কোনে বসে থরথর কাঁপছে, আর
আঁচলে চোখ মুছছে। বাবা নিশ্চুপ এক কোনায় ঠায় দাঁড়িয়ে। বৌ আমার ডাইনিং টেবিলের উপরে বসে আছে অগ্নিমূর্তি হয়ে। ছেলে মেয়েগুলো মায়ের পাশে - আজ যেন
এর একটা হেস্তনেস্ত করবেই।
আমি ঘরে ঢুকে থ। কার পক্ষ নেব? নিত্য দিনের এই তু তু ম্যা ম্যা আর কাঁহাতক সয় প্রাণে?
মায়ের পাশে দাড়াই, বৌ এর হুঙ্কার-ধ্বনি, লেজ গুটিয়ে চলে আসি বৌ এর আঁচলের তলায়। এবার হুঙ্কার ধ্বনি আমার - প্রতিদিন তোমরা কি শুরু করেছ?
একটা দিনও কি একটু শান্তিতে থাকতে দেবে না আমায়? বাবার চোখে বিস্ময় দেখি, মায়ের চোখে পানি - তাঁদের একমাত্র ছেলের স্বরূপ দেখে চোখে অবিশ্বাস।
বাবা যেন এবার অন্যমানুষ, বাবা হয়ে ওঠে আমার। এই প্রথম বার তিরস্কারের স্বর শুনি মুখে বাবার। তেলের ওপর তৈলমর্দন পেছনটা হয়ে আছে বড্ড নরম।
বাবার তিরস্কারে তাই বড্ড লাগে যেন সেখানে, মনের মাঝে হঠাত যেন এক অমানুষ গর্জে ওঠে। হিতাহিতশুন্য কোথা থেকে কি জানি বলে ফেলেছিলাম সেদিন।
কাল হয়ে গিয়েছিল বাবা সন্তান সম্পর্ক পারিবারিক বন্ধনের ডোর। বাবাও গর্জে বলেছিলেন - রে মূর্খ দূর হয়ে যা এখনি। কোলে পিঠে মানুষ করেছিলাম তোকে
আজকের দিন তখন দেখিনি।
কি হতো সেদিন প্রতি উত্তর না দিলে, না হয় সয়েই যেতাম বাবার তিরস্কার একদম মুখ বুজে। তখনো বুঝিনি শুধু মূর্খই নই মানুষই আমি হইনি, তাইতো বাবার
মুখের ওপর সেদিনই বলে দিয়েছি। দূর হতে হলে তুমি দূর হও, খেতে পড়তে কমতি রাখিনি এত দম্ভ কোথায় পাও?
বাবা শুধু মনে করিয়ে দিয়েছিলেন সেদিন - আমার বাড়িতে বসে আমাকেই ভয় দেখাও?
মনের শয়তান মুখে বমি করে আজেবাজে কথাগুলো সব আমার মুখে ফোটে। কি? কার বাড়ি? কাগজ দেখেছ কি? ব্যাঙ্কের কাছে যাও গচ্ছিত আছে তোমার দলিল দস্তাবেজ,
পাওয়ার অফ এটর্নি নিজের হাতে দিয়েছিলে আমায় লিখে, মনে পড়েছে কি? এত বড়াই কেন - কি আমার সাধের সম্পত্তি!
সেই থেকে শুরু তারপর ক্রমাগত একের পর এক।
আলাদা হলো অন্ন, আলাদা বাসস্থান, চিলেকোঠার ঘরে হলো বুড়োবুড়ির স্থান।
এক বাড়িতে বসবাস আমাদের, আমার ঘরে উচ্ছিষ্ট খাবার পড়ে রয়।
বুড়ো এই বয়সে টিউশনি ধরেছে বুড়ির অন্ন কখনো হয় কখনো নয়।
একই বাসায় থাকি এখনো, চিলেকোঠায় বুড়োবুড়ি; আলিশান আমার বাড়ি।
আমি আর এর মধ্যে নেই, খুব মাঝে মাঝে ঘরে ঢুকতে বের হতে চোখে চোখে দেখা হয়।
দিন পার হয়
দিন পার হয়
কালের স্রোতে বয়ে চলে সময়।
ইদানীং যেন চুলে ধরেছে পাক, মনেতে শয়তান গেড়েছে বসবাস।
ছেলে মেয়েগুলো উচ্ছন্নে গেছে আমার তাতে কি?
যার যার জীবন করছে যাপন, আমি মানিয়ে নিয়েছি।
কোন এক রাতে ঘুম ভেঙে গেল বৌ এর ডাকে, কান্নার আওয়াজ কোথা থেকে যেন আসে - চিলেকোঠায় কি?
বৌ বলে, চল না একটু খবর নিয়ে দেখি।
দুজনে যাই একসাথে, ছোট্ট ঐ চিলেকোঠার ঘরে।
প্রথম বারের মত দেখতে বুড়োবুড়ির সংসার
সারাটা জীবন আমি সেজে ছিলাম সং, আর আমার বৌ দম্ভের গাছে ঢেলেছে সার
তাইতো এতদিনে একবারও হয়নি আমাদের সময় চিলেকোঠায় আসার
অহংকার, আসলে সবই অহংকার।
যাই হোক ঘরে ঢুকে দেখি পা ছড়িয়ে কাঁদছে আমার মা বুড়ি
নিথর বাবার শরীরটা পড়ে আছে মাটির ওপর বেছানো তোষকে
খাট কেনার সাধ্য তাঁদের ছিল না আর এই বয়সে
বুড়ো বুড়ির তো আর বাসর শয্যা নয়
এই বয়সে এই ভালো মাটির কাছাকাছি, মাটির সাথে পরিচয়।
এখন দিন বদলেছে, যুগ বদলেছে এত সময় আছে কার
মরার পরে দেরি করিনি খুব বেশী বাবার গোর দেবার
সকাল হতেই মাটি চাপা দিয়েছি আজিমপুরের গণ কবরে
আসার পথে দেখে এসেছি আমার জন্য কিনে রাখা অনেক দামের জমিটারে
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, তৈলমর্দনে নিজের জায়গা সংরক্ষিত
একটু যেন শঙ্কা লাগে কে দেবে কবরে প্রদীপ ঘৃত।
যাক বাবা, অনেক দিন বেঁচেছিলে অনেক জ্বালায় জ্বলে
এখন নিশ্চয়ই শান্তিতে ঘুমুবে
মনকির নকীরের পালা শেষ হলে;
হঠাত এ কথা মনে এলো কেন?
এই ড্রাইভার এ,সি টা বাড়াও একটু ঘামছি যেন।
তারপর সারাদিন মান অনেক পরিশ্রম অফিসের জ্বালা সয়ে
তৈলমর্দনের পালা চলেছে সারাদিনই একটু একটু রয়ে
বাসায় ফেরা হলো ক্লান্তি শেষে
হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম
এবার যেন বাস্তব চিন্তা মাথায় কিছু নিলাম।
বুড়োতো গেল, এখন আবার বুড়ির উপায় কি?
নতুন করে আবার নাকি শুরু হয় অশান্তি
বড্ড উচাটন মন
চিলেকোঠায় গেলাম।
বুড়ি একঠায় বসে এখনো সেভাবে
সকালে যেমন রেখে গিয়েছিলাম।
কি জানি হলো মনের মাঝে একটু ধাক্কা খেলাম
অনেক দিন পর গাঢ় স্বরে "মা" বলে ডাকলাম।
সারাদিনে কিছু খেয়েছ মা?
বুড়ি ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে রয়
যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়,
আলতো করে আমার মাথার ওপর হাত রাখে
তুই খেয়েছিস বাবা?
হুম, আমি তো এই মাত্র খেয়ে তোমাকে দেখতে এলাম।
ওতেই আমার খাওয়া হয়ে গেছে রে পাগলা, আমার জন্য চিন্তা করিস না।
দেখ না, সবাই মিলে কেমন ফাঁকি দিয়ে চলে যায়।
তুই ফাঁকি দিলি নিজে ফাঁকিতে পড়ে
সংসারের যাঁতাকলে
তোর বাবা ছিল হাতের লাঠি
সেও হঠাতই দিয়ে গেল ফাঁকি
আমি ভাবছি এবার আমার হবে কি?
ডাক আসতে আর কতদিন বাকি?
কেমন যেন অন্যরকম এক মায়া হলো, মায়ের জন্য।
অনেক অনুনয় করে বললাম - মা আমার ঘরে চলো, এখানে কেও নেই তোমার
এতদিন বাবা ছিলেন দুজন দুজনকে দেখাশোনা করার;
এখন অভিমান ছাড়, আমার ঘরে চলো। জীবনটা একা পাড়ি দিতে পারবেনা।
মা জিজ্ঞাসা করলেন - ওখানে কে দেখবে আমায়?
নাতি নাতনী সব গেছে তো যার যার চুলায়
এখন বিশাল বাড়িতে শূন্যতা ঘোরে
তুই আর তোর বৌও দুজন দু ঘরে
সময়টা কেমন পালটে গেল আমাদের, নারে?
হ্যাঁ মা, সময় পাল্টেছে, পাল্টে গিয়েছে জীবনধারা
এ জগতে কেও কারো নয়
স্বার্থ দেখায় নিজ নিজ চেহারা।
হ্যাঁ রে বাবা, তাই তো এতদিন দেখে এসেছি;
মায়ের চোখে চোখ রাখতে পারিনি
মাথা নিচু করে চলে এসেছি।
তারপর সময় ঘড়িতে আরো কিছু কাঁটা ঘোরে
ঘুরি আমিও জীবনের পাঁকে পড়ে
সংসার চলে সংসারের মত
চলছে দিন মা আর বৌ এখনো মিলেমিশে
আমার মনেতে কোথা থেকে যেন এক ভয় কুঁকড়ে থাকে;
একদিন ভয় রঙ দেখায়
সাদাকালো জীবনে রঙ্গিন ছবি শোভা পায়
বৌ এর পুরাতন চেহারা ফুটে ওঠে
মায়ের আঁচল যথারীতি চোখ মুছে
আমি অসহায় শূন্য চোখে
কিংকর্তব্য-বিমুখ।
শেষমেশ অনেক আলাপ আলোচনার পর "মা" কে রেখে এলাম বৃদ্ধাশ্রমে।
মাথা থেকে যেন একটা বোঝা নেমে গেছে।
আবার নির্ঝঞ্ঝাট সংসারে আমি সং সেজে থাকব
অহংকারের গাছে আমার বৌ সার ঢালবে
দুজনে মিলে সংসার করব
খাওয়া দাওয়া একসাথে
রাতে শোয়া দুজন দুঘরে দু-বিছানাতে
ঘুমের বড়ির নেশায় ঘুমাই দুজনে।
জীবনটা কি এমনই?
কোনো এক রাতে হঠাতই ঘুম ভেঙে যায়, অন্ধকারের মাঝে আয়নায় চোখ যায়
আমি ধীরে ধীরে উঠে বসি
আয়নার সামনে যাই
ওখানে কাওকে দেখা যায় নাকি?
নাকি ওটা আমারই প্রতিচ্ছবি।
ঠিক যেন বিশ বছর আগের বাবা চেয়ে আছে আমার দিকে
দেখে একটু চমকে উঠি
রক্ত কথা বলে
বাবার জিনের কিছু কি এখনো আমার ভেতর রয়ে গেছে?
নইলে অপরাধ-বোধের এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় ঘুম ভাঙ্গায় কে?
ক্রিং ক্রিং টেলিফোন বেজে ওঠে
ধরব না ধরব না করেও হাত বাড়াই মুঠোফোনের দিকে
ওপাশ থেকে বৃদ্ধাশ্রমের সুপারভাইজারের গলা ভেসে আসে
"আপনার মা একটু আগে মারা গেছে"
হুম, ঠিক আছে; আমি পৌঁছে যাব সকালে।
আয়নার প্রতিচ্ছবি যেন আমায় ব্যঙ্গ করে
একটু ভয় পাই যেন
লাইট জ্বালাই
খুব ভালো করে চেয়ে দেখি - এ আমি নই
আসলে বাবাই এসেছিলেন আমাকে মায়ের মৃত্যু সংবাদ দিতে।
অন্যভূবনে গিয়েও সন্তানের প্রতি ভালোবাসাটুকু ঠিকই ধরে রেখেছেন।
পুনঃশ্চঃ
এটা গল্প না কবিতা না ডায়েরীর ছেঁড়া পাতা তা জানি না
কারো জীবনের সাথে মিল আছে কি না তাও জানি না
তবে কেন যেন ইচ্ছে করল মনে মনে ডায়েরী লেখার
আজ অনেক দিন পর অন্য কোন কবিতা বা গল্প না লেখে না হয় ডায়েরীই লিখলাম
কিংবা মনে মনে একটু একটু করে না লেখা ডায়েরির কিছু ছেঁড়া পাতা থেকে পাঠ করলাম
কেও পড়লো তো পড়লো না
শুনলো তো শুনল না
বুঝলো তো বুঝলো না
তাতে আমার কিছুই আসে যায় না
কেন জানি এ লেখাটি লিখতে গিয়ে বার বার চোখ ভিজে উঠেছিল - নিজেই জানি না।
এমনই কি হবে আমার জীবনের পরিণতি?
কিংবা তোমার?
কিংবা তার?
সংসারের গতি আজ কোন মুখি?
জানি না
বড্ড জানতে ইচ্ছে করে।
২| ২৭ শে আগস্ট, ২০১৩ রাত ১:৩৪
নাজিম-উদ-দৌলা বলেছেন:
সন্তান থাকতে একজন বাব বা মায়ের বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়াটা কতটা বেদনাদায়ক তা ধারনার বাইরে! কোন বাবা মাকেই যেন এমন নিয়তির সম্মুখিন না হতে হয়।
©somewhere in net ltd.
১|
২৬ শে আগস্ট, ২০১৩ রাত ৮:৩৫
আশিক মারুফ বলেছেন: । আমি নিয়মিত ব্লগে অন্যের লেখা পড়লেও মন্তব্য কম করি। শুধু এটুকুই বলি, অসাধারন লাগল।