![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : ১. এবার ধরা দাও (২০০০) ২. উচ্ছ্বাস(২০০১) ৩. পরিত্যক্ত পদাবলি(২০০২) ৪. এক বিকেলে(২০০৪) ৫. নিঃসঙ্গ নির্জন(২০০৫) ৬. ভাঙনের শব্দ(২০১১) ৭. আমার সন্তান যেন দুধেভাতে(২০১২) ৮. চারিদিকে জীবনে সমুদ্র-সফেন(২০১২) গবেষণা গ্রন্থ : ১. শওকত আলীর উপন্যাস : কলাকৌশল ও বিশেষ বৈশিষ্ট্য( প্রকাশের অপেক্ষায়) ২. বাংলাদেশের উপন্যাস : নারীর স্বাধিকার চেতনা
স্যার যেদিন প্রথম ক্লাশে ঢুকলেনÑ মনে হলো, সদ্য বিবাহিত নব্য লাজুক জামাতার মতো। হাত দু’টি পিছনে মোড়ানো। গায়ে পাঞ্জাবি। রংটা মনে নেই। সম্ভবত ঘিয়ে রং। সাদা পাজামা। চোখে-মুখে-চুলে ভয় ও লজ্জার আভাস। সাদা ধবধবে ফর্সা উজ্জল মুখে ভয় কিছুটা ভর করায় কিঞ্চিৎ বিবর্ণতা তাকে গ্রাস করেছে। হেড স্যারের সাথে ক্লাশে ঢুকলেন। হেড স্যার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ইনি তোমাদের নতুন স্যার। ইনি তোমাদের ইংরেজি পড়াবেন। Ñবলে হেড স্যার চলে গেলেন।
স্যার বললেনÑ আমি তোমাদের ইংরেজি স্যার। তোমাদেরকে ইংরেজি পড়াবো। আমার নাম হাবিব। বাড়ি উত্তর ধর্মপুর। ইত্যাদি বলে স্যার বললেন, তেমাদের ক্লাশে ফার্স্ট বয় কে? অগত্যা উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, আমি স্যার।
স্যার বললেন, তোমার নাম কি?
বললাম, অনুপ্রাস।
এর পর সেকেন্ড বয়, থার্ড বয় ইত্যাদি পরিচয় নিয়ে স্যার বললেন, আজ তোমাদের কি পড়া আছে?
আমারা সবাই একসাথে বললাম, স্টোরি স্যার।
স্টোরি বইটা স্যারকে দেওয়া হলো। স্যার বললেন, তোমাদের কোন স্টোরি পড়ার কথা ছিলো?
স্টোরি দেখানো হলো। স্যার পানির মতো ইংরেজি পড়ে গেলেন। অতঃপর আমাদের বঙ্গানুবাদ করে মানে বুঝালেন। গর্ধব মলিন ছাড়া আমরা সবাই স্টোরিটা বুঝলাম।
সাদাকে বললামÑ কিরে তোর বাড়ির কাছে স্যারের বাড়ি? স্যার তো নতুন স্যার। কোনদিন কোথাও পড়ায়নি। সৌদি আরব থেকে সবেমাত্র চাকরি থেকে দেশে এসে আমাদের স্কুলে ঢুকেছে। কি করে এত ভালো ইংরেজি পড়াতে পারে? স্যার আমাদের ক্লাসে আসার আগে তোর কাছে গিয়েছিলো নাকি? তুই বলেছিস, এই স্টোরিটা আজ পড়ানো হবে? স্যার বাসায় পড়ে এসে আমাদেরকে এত সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলো।
রানাÑ আরে স্যার ভালো ইংরেজি জানে।
আমি বললামÑ ইংরেজি জানে তো ভালো। এত কঠিন স্টোরি এর কাহিনী হঠাৎ করে কে এসে পড়াতে পারে বল? স্যার কন্ঠস্থ মুখস্থের মতো, পানির মতো, নরম ভাতের মতো ইংরেজি পড়িয়ে গেলেন।
সাদা তো মিথ্যা কথা বলেনা? স্যার কি আসলেই ভালোা ইংরেজি জানে?
পরদিন স্যার ক্লাসে ঢুকলেন। বললাম, স্যার আপনি তো সৌদি আরব ছিলেন? সৌদি আরবের ভাষা তো আরবি? আপনি সেখানে কোন ভাষায় কথা বলতেন স্যার?
Ñ কেন আরবি।
Ñআরবি? তবে স্যার আপনি ইংরেজি কথা বলতেন না?
Ñকেন, বলতাম মাঝে মাঝে।
Ñআপনি ভালো ইংরেজি জানেন স্যার।
Ñতুমিও পড়। তুমিও ভালো ইংরেজি জানতে পারবে।
Ñস্যার, ক্যালসিয়াম মানে কি স্যার?
Ñক্যালসিয়াম মানে শক্তি।
Ñজানেন স্যার, আমাদের পুরনো বৃদ্ধ যে স্যারটা ছিলো তাকে আমি বলেছিলাম, ক্যালসিয়াম মানে কি? স্যারটা একটু হেসে উত্তর দিয়েছিলো ‘শক্তি’। স্যারটা কেনো হেসেছিলেন স্যার?
Ñহেসেছিলো, তুমি ফাস্ট বয় আর ভালো ছাত্র বলে।
Ñসত্যি স্যার, ক্যালসিয়াম মানে শক্তি? তাহলে ক্রোমোজোম মানে কি স্যার?
Ñক্রোমোজোম মানেও শক্তি।
Ñতাহলে এনার্জি মানে কি স্যার, স্ট্রেন্থ মানে কি স্যার?
Ñ এনার্জি আর স্ট্রেন্থ মানেও শক্তি।
Ñতাহলে কোন শক্তি কোন কাজে লাগে স্যার?
Ñতুমি বড় হও, কোন শক্তি কোন কাজে লাগে জানতে পারবে।
Ñআমাকে রাগ করেছেন স্যার?
Ñনা আমি কখনো রাগ করিনা।
আমি ঠিকই জানতাম কোন শক্তি কোন কাজে লাগে। গ্রামের গেঁয়ো পরিবেশে ইচড়ে পাকা হয়েছিলাম সকাল সকাল।
কথাগুালো বেশ ক’বছর আগের। যখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়তাম। সপ্তম শ্রেণীতে সবেমাত্র উঠেছি। আমার প্রথম কবিতা লেখার বছর।
স্যার ছিলেন যেমন কর্মঠ, তেমনি মিতব্যায়ী। কথা বলতেন, নরেণ বিশ্বাসের ছাত্রের মতো। শুদ্ধ তার বাচন ভঙ্গি। ক্লাশে যখন কবিতা পড়াতেন, মনে হতো আবৃত্তি করছেন। স্যার বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন না। তবে শব্দ, ছন্দ অলংকার, মাত্রা এসব যে কোথায় শিখেছিলেন, বলা মুশকিল।
আমি কবিতা লেখা শুরু করলাম। প্রথম কবিতা ‘যাযাবর’। যার প্রথম স্তবক, আমগাছে চড়ে ছড়ার ছলে মিলিয়ে মিলিয়ে লেখা। দ্বিতীয় কবিতা ‘আমি গাই তারি গান’। স্যারকে কবিতা দেখালাম। তিনি আবৃত্তি করে ক্লাশে সবাইকে শুনালেন। আমার সহপাঠীরা সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনলো। শুনলো না দুই একজন Ñযারা আমাকে ক্লাশের ক্যাপ্টেন থেকে অপসারণ করতে চায়, আমাকে ডিঙ্গিয়ে ফাস্ট বয় হতে চায়। স্যার বললেন, তুমি চর্চা চালিয়ে যাও সফলকাম হবে।
স্যারের সম্মতি পেয়ে ভাবলাম, আমি তো কবি হয়ে গেলাম। বড় বড় কবিরা নাকি এই বয়সেই কবিতা লিখতে শুরু করে। রবীন্দ্রনাথের নাকি বার বছর বয়সে বনফুল কাব্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। দুখু মিয়া খুব ছোট বেলায় লেটোর দলে গান গাইতেন, কবিতা ছড়া-লিখতেন।
আমি দীঘির পার, ঝিলের পাড়, নদীর তীর প্রভৃতি জায়গায় গিয়ে একা একা বসে থাকতে লাগলাম। সন্ধ্যার বাতাস খাওয়া শুরু হলো। জোনাকীর মিটমিট প্রজ্জ্বলতা, তারার প্রজ্জ্বলন, চাঁদের আলো প্রভৃতি ভালো লাগতে লাগলো। ভোর ভোর ঘুম থেকে ওঠা শুরু হলো । বাঁশের ঝাড়, পাখিদের কুজনÑ আমার ভেতর কে যেন একজন আমাকে উতলা করত। আমাকে লিখতে বলতো। মেয়েদের চুলের দিকে, চোখের দিকে তাকাতে বলতো। বাতাসে ওড়না ওড়ার দৃশ্য দেখতে বলতো।
একদিন এক মেয়ে আমাকে দেখছে, ভালো করেই দেখছে। ছুটির শেষে চোখে চোখ রেখে দেখছে। আমি লিখলাম:
তুমি দ্যাখো আমার দু’নয়ন
তোমারই দিয়া মন
মনে হয় আজ তুমি
আমারে লয়ে কিছু ল্যাখো।
ইতোমধ্যে আমি ক্লাশ নাইনে উঠেছি। রোল এক থেকে নামিয়ে দুই হওয়ার কথা ছিলো । তা আর হলো না। আমি নাইনে উঠলাম। হ্যাঁ, নাইনেই উঠলাম। আমি কবি হয়ে গেলাম যেন। স্যার আমাকে দেখে বললেন, কবি হয়ে গেলেন? অন্য দুই/একজন স্যার বলতেন, সাহিত্যিক হয়ে গেলেন? অবশ্য তারা আমাকে এসব কথা ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ করেই বলতেন।
স্যার আমাকে ডাকলেন। নির্জন নিভৃতে ডাকলেন, বললেনÑ স্কুল পালিয়ে সবাই রবীন্দ্রনাথ হয় না। স্যারকে বললামÑ স্যার বুঝলাম না।
স্যার বললেন, কবিতা লিখে সময় ব্যায় করলে পরীক্ষায় ভালো মার্কস পাওয়া যায় না । কবিরা পরীক্ষায় ফেল করে। যেমন করেছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মানিক ও সুকান্ত। তুমি তো এবার পিছিয়ে যেতে। মন দিয়ে লেখাপড়া করো । বড় হলে অবশ্যই কবি হবে।
স্যারের কথা শুনলাম না।
স্যার দশম শ্রেণীর ষান্মাসিক পরীক্ষায় বাংলা দ্বিতীয় পত্রে আমাকে সেকেন্ড বয়ের চেয়ে তিন মার্কস কম দিলেন। খাতা হাতে পেয়ে আমি তো পাগল পারা। খাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। কোথায় কোন প্রশ্নে দুই-চার মার্কস বেশি পাওয়া যায়। অবশেষে আমাকে আর খুঁটতে হলোনা। স্যার ভুল ক্রমে দুটি বাগধারা কেটে দিয়েছেন। স্যারকে ব্যাকরণ বই খুলে দেখালাম। স্যার বাধ্য হয়ে আমাকে চার মার্কস বেশি দিলেন। আমি সেকেন্ড বয়ের চেয়ে এক বেশি পেয়ে ফার্স্ট হলাম। দুরু দুরু ফার্স্ট।
একদিন স্যার ক্লাশে এসে বললেন, ফাস্ট বয়, সেকেন্ড বয়, থার্ড বয় এন্ড---বয় ----। আপনাদের হেড স্যার ডেকেছেন চলুন।
আমি, সাদা, তানজিমুল, ইউনিট সবাই গেলাম হেড স্যারের কক্ষে। পাশে দেখলাম একজন ভদ্রলোক। বিএসসি টিচার। উচ্চতা সাড়ে তিনফুট। কেউ তাকে বলে ‘বাওয়াই বিএসসি।’ যার দু’জন মেয়ে আমাদের স্কুলে পড়ে।
স্যার প্রথমে ইউনিট পরে সাদা, অতঃপর তানজিমুলকে পুলিশের রিমান্ডের আসামীর মতো পেটালেন। গজারি কাঠের লাঠি ভেঙ্গে গেলো। স্যার হাঁপাতে শুরু করলেন। মনে হলো তাকেই কেউ যেন বেত্রাঘাত করছে।
ওরা কেউ পেটানোর কারণ জিজ্ঞাসাবাদ করলোনা স্যারকে। হয়তবা ওরা ওদের অপরাধ খুঁজে পেয়েছে। তাই জিজ্ঞাসা করার সাহস হয়নি। আর অপরাধ না থাকলেও হেড স্যারের কাছে এসে যে কেউ কথা বলবে সে সাহস কারো ছিলো না। ওরা মার খেয়ে লালে লাল হয়ে গেলো। ভাবলাম এইবার তো আমার পালা। আমাকে কারণ জিজ্ঞাসা করতেই হবে। মার খাবো, কারণ জানার পর খাবো।
আমি স্যারকে বললাম, আমার অপরাধ কি স্যার?
স্যার বললেন, অপরাধ তুমি ফাস্ট বয়, তোমাকে বিনামূল্যে পড়ানো হয়Ñ এই তোমার অপরাধ।
স্যার বিনামূল্যে পড়ার সাথে এই মার-পিটের কী সম্পর্ক?
কোন সম্পর্ক নেই Ñবলে স্যার মার শুরু করলেন। আমি কিছুক্ষণের জন্য পুলিশের রিমান্ডের কিংবা ধর্ষণের আসামীর মতো প্রহৃত হলাম।
পাশে সেই বাওয়াই বিএসসি নামক লোকটি বেশ শান্তি বোধ করলেন। তার শরীর থেকে এক বছরের রাগ কমে গেলো যেন।
আসলেই কি ভদ্র লোকের মেয়ে দু’টিকে কেউ ধর্ষণ করেছে? কারণ খুঁজে বের করতেই হবে।
সাদাকে বললাম, কি রে ব্যাপার কি? স্কুল ছুটি শেষে টাংকি মারিস তোরা, তোরা শিস দিস, চোখ টিপিসÑ তোদের শাস্তি না হয় তোরা মেনে নিলিÑ আমার দোষটা কীসের?
মেয়েদের নবযৌবন এলে অহংকারী হয়, নিজেকে অনেক বড়ই মনে হয়। মনে করে সব ছেলে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে। রূপচর্চাটা চলে সারা দিনমান।
স্যার বললেন, কবিতার শব্দ ছন্দ অলংকার খুঁজছিলেন, তাই স্কুলের অফিসটা থানার রিমান্ড কক্ষ হয়ে গেলো।
আমার শরীরে তাজা রক্ত টগবগ করে উঠলো। উথলে উঠলো। চোখমুখ লাল হয়ে উঠলো। দোষে অপরাধে মার খেলে হয়তবা সহ্য হতো। বিনা অপরাধে মার খাওয়া অসহ্য মনে হলো। বিদ্রোহী হয়ে উঠলাম। রেগে স্যারকে বললাম, আপনিও ব্যাঙ্গ করছেন স্যারÑ বলে কেঁদে ফেলেছি, টের পাইনি।
স্যার কাছে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, দুষ্ট মেয়েদের সাথে দুষ্টুমি করতে নেই।
Ñস্যার আমি ভুলে কোনদিন ওদের সাথে দুষ্টুমি করিনি। হেড স্যার আমার কোন কথা শুনলেন না।
Ñ তুমি ওদের সাথে চলাফেরা করো, তাই হয়তবা তোমাকে দোষী ভেবে স্যার শাস্তি দিয়েছে।
প্রবেশিকা পরীক্ষা দিবো। ইতিমধ্যে বেশ কিছু কবিতা লিখে ফেলেছি। কালবোশেখী, তুমি এখনো, সেই বৃষ্টি, ব্যাথা মাখো ইত্যাদি।
একদিন সময় করে কয়েকটি কবিতা নিয়ে স্যারের বাড়িতে গেলাম। স্যার কোথাও যেতে রওয়ানা দিয়েছিলেন। আমাকে দেখে ফিরে এসে বসতে বললেন।
একটু পরেই ফিরে এসে বললেন, এবার বলো কি খবর? বললাম, কয়েকটা কবিতা আপনাকে দেখাতে এসেছি স্যার।
Ñসামনে তোমার পরীক্ষা। তুমি আবার কবিতা লেখা শুরু করেছো?
Ñশুধু শুরু নয় স্যার, অনেক কবিতা লিখে ফেলেছি।
স্যার কবিতাগুলো পড়লেন। বার বার পড়লেন। মনে হলো, স্যার বুঝি কবিতাগুলো বুঝে উঠতে পারছেন না। তাই কাঁচা ছাত্রের মতো কবিতাগুলো বার বার পড়ছেন। এরই মধ্যে তার মেজো মেয়েটি বেশ ক’বার বাবার কাছে পড়া বুঝিয়ে নিয়ে চলে গেছে। মনে হলো পড়া বোঝা হয়তো লক্ষ্য নয়। উনি লেখাপড়ায় কেমন তা আমাকে বোঝানো।
আমাকে আর বেশি বোঝাতে হলো না। বুঝলাম ছাত্রী হিসেবে ভালোই হবে। জ্যোতিষীর মতো মনে মনে বললাম, জীবনে ও কোন ফার্স্ট গার্ল হয়ে থাকবে।
ইতোমধ্যেই স্যার কবিতাগুলো পড়ে ফেলেছেন। মনে মনে ভাবলাম স্যার হয়ত কবিতাগুলো বুঝে উঠতে পেরেছেন, এতক্ষণে। বললেন, দুষ্ট আর কবিতা লিখবে না।
Ñকেন স্যার এগুলো কবিতা হয়নি?
Ñএগুলো কিছুই হয়নি।
ততক্ষণে আমি রাগে-লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছি। বার বার পড়া বুঝে নেওয়া মেয়েটি বাবার পাশে এসে দাঁড়ালো। মিটমিট হাসলো। ভাবলাম, আমার লেখাগুলো কবিতা না হওয়ায় মেয়েটি হাসছে। আমাকে ভীষণ লজ্জা গ্রাস করলো । আমি আর থাকতে পারলাম না। আমি ‘আসি স্যার’ বলে রওয়ানা দিয়েছি। স্যার বললেন, দাঁড়া দুষ্টু। একটু দাঁড়া। দাঁড়ালাম মাথা হেট করে। স্যার আমার কান মলে দিলেন। বললেন, এমন কবিতা তোমাকে কে লিখতে বলেছে?
স্যারের কানমলা খেয়ে ভাবলাম, আর তো কোন ভাবনা নেই। লেখাগুলো সত্যি কবিতা হয়েছে।
প্রবেশিকা পাস হলো। সাতশ বার পেয়ে ফার্স্ট ডিভিশন পেলাম। এবার শহরের পথে যাত্রা। মনে বড় বড় স্বপ্ন আমাকে উতলা করে তোলে। মনে মনে ভাবি, এবার সত্যি কবি হয়ে উঠবো। শহরের ছাপাখানায় বই ছাপে। প্রকাশকরা সবাই শহরে থাকে।
নাটোর নবাব সিরাজ উদ দৌলা সরকারি কলেজে ভর্তি হলাম। নতুন শহরের গন্ধ আমার চোখে মুখে লেগে উন্মনা করে তোলে। বিকেলে বেড়াতে বেরুই। কখনো সাঁকো পার হই, কখনো পিচঢালা মসৃণ পথÑ কখনো রেললাইনের দিকে যাইÑ আবার কখনো শহরের মাঝামাঝি বয়ে যাওয়া নদীতে স্নান সারিÑ আবার কখনো আম্র কাননের ছায়ায় সারাদিন কেটে দিই। মাঝে মধ্যে জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেনকে খুঁজতে হন্য হয়ে বেড়াই সমস্ত শহর। আমার কবি মন প্রকৃতির অপরূপ রূপে ছটফট করে ওঠে। কখনো অস্থির অস্থির লাগে। স্যারের কথা মনে হয়। তার নির্দেশনা পবিত্র গ্রন্থের মতো বুকে ধরে পথ চলি। স্যারকে প্রায় সময়ই গাইতে শুনতাম ‘আমার মনের বেদনা বন্ধু ছাড়া জানেনা/ কোন দেশে গেলে পাবো তারে।’ আমারও কবি মনে গাইতে ইচ্ছে হয়, মাঝে মাঝে গুনগুন করে উঠি।
একবার শহর থেকে বাড়িতে যাই। শুনি : স্যার একদিন বাজার থেকে মস্ত দুটি ইলিশ নিয়ে এসে স্ত্রীকে বলে, খুব সুন্দর করে রান্না করবে। এর পর রাতের খাবার শেষে স্যার ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে যথারীতি স্যারের স্ত্রী ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। সকালের নাস্তা তৈরি করেন। ঘরে ঢোকেন। দেখেন, স্যার অঘোর ঘুমুচ্ছেন। কী শান্ত নীরব ঘুম তার। সকালের তেজহীন মিস্টি রৌদ্র জানালার ভেতর দিয়ে স্যারের মুখের ওপর পড়ছে। মিস্টি রোদে ফর্সা লোকটিকে কী অপরূপ দেখাচ্ছে আজ। স্যারের স্ত্রী তাকে ডাকলেন না। ভাবলেন, ঘুমাচ্ছে তো ঘুমাক। কতদিন তো লোকটা শান্তিতে ঘুমাতে পারে না। স্কুলের সময় পার হয়ে যায়, স্যার ঘুম থেকে উঠছেন না। স্যারের স্ত্রী তাকে ডাকতে গেলেন ‘এ্যাই, এ্যাই উঠছোনা কেন? ওঠো। তোমার স্কুলের সময় তো পার হয়ে যাচ্ছে।’ কয়েক বার ডেকে তার ডাক বন্ধ হয়ে যায়। সে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। বাড়ির লোকজন জড়ো হয়। ততক্ষণে স্যার পৃথিবীর মায়া ভুলে প্রস্থান করেছেন আরেক অজানা লোকে।
স্যারকে সমাহিত করা হলো। কয়েকদিন পর স্যারের মৃত্যু নিয়ে গ্রামের কতিপয় লোকজন প্রশ্ন তুললো। সন্দেহ ঘনিভূত হয়। কেউ বলে আতœহত্যা, কেউ বলে হত্যা। আবার কেউ বলে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের টানাপোড়েন।
কিন্তু স্যারের লাশ আর কবর থেকে ওঠানো হয়নি। ময়না তদন্ত করাও হয়নি।
সময় চলে যায়। সাহিত্যে বিশ্ববিদ্যালয় লেখাপড়া শেষ করি। কয়েকটি কাব্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। একদিন এক পাঠিকার নিমন্ত্রণ পেয়ে রংপুরে যাই। পাঠিকা মেয়েটিকে ভালোবেসে ফেলি। পাঠিকা মেয়েটির এক বান্ধবী আমার সাথে পরিচিত হতে আসে। নাম ‘আইরিন’ বলে বাড়ির কথা বলতেই বলি, থাক আর বলিস না। আজ থেকে তুই আমার বোন। ওকে আজ থেকে ভাবি বলে ডাকবি।
স্যারের মেয়ে আইরিন আজ কত বড় হয়েছে। ও আমাকে ভাইয়া বলতেই চোখ ছলছল করে উঠলো। ওকে বললাম, ঢাকা চল। তোকে আমি আমার অফিসে চাকরিতে ঢুকাবো। ও আমার সাথে ঢাকা আসে। ওকে আমার কলেজে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করি। আমরা দু’ ভাইবোন একই কলেজে অধ্যাপনা করি। একসাথে কলেজে যাই। বাবার কথা বলি। তার আদর্শ পালনে বদ্ধ পরিকর হই।
আমার কলেজের এক প্রভাষক ওকে পছন্দ করে। আমি তাকে বলি, ‘আমার বোনকে আমি দেখে শুনে বিবাহ দেবো।’
©somewhere in net ltd.