![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে, অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে-
চারিদিকে নোট ও গাইড বই বন্ধের ব্যাপারে যে পরিমাণ জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য আমাদের শিক্ষাবিদগণের কাছ থেকে শুনে আসছি গত কয়েক বছর ধরে, তাতে করে গাইড বই বিষয়ে এবার মুখ খোলা অত্যন্ত প্রয়োজন বলে বোধ করছি!
১.
শুরুতে আসা যাক গাইড বই বন্ধের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহের সদিচ্ছা কতটুকু— সে ব্যাপারে! এখানে অত্যন্ত মজার একটা ব্যাপার আছে; দারুণ একটা লুকোচুরি খেলা আছে! মাঝেমধ্যেই দেখা যায়, গাইড বই বন্ধের নামে এখানে-ওখানে অভিযান চালানো হচ্ছে! খেয়াল করলে দেখবেন, এ সকল অভিযানই পরিচালিত হয় বইয়ের দোকানগুলোতে! সেখানে প্রশাসনের দু-চারজন কর্মকর্তা গিয়ে দোকান থেকে গাইড বইগুলো তুলে নিয়ে যান, কিছু টাকা জরিমানা করেন এবং আসার সময় 'সতর্ক' করে দিয়ে আসেন! আমার প্রশ্ন হচ্ছে, বইয়ের দোকানে অভিযান কেন?? আপনার যদি সত্যিই সদিচ্ছা থেকে থাকে, তাহলে, আপনি তো জানেন কারা কোথায় এগুলো তৈরি করছে; সরাসরি কারখানায় গিয়ে কারখানাগুলো বন্ধ ও সিলগালা করে তার লাইসেন্স বাতিল করে দিচ্ছেন না কেন? যে সকল শিক্ষক এ গাইডগুলোতে লেখক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন, তাঁদের কেন জরিমানা করছেন না, তাঁদের চাকরি হতে অব্যাহতি দেয়ার আইন কেন করছেন না? যে সকল স্কুল/কলেজ এর শিক্ষক গাইড বইয়ের সাথে যুক্ত থাকেন, সে স্কুল/কলেজগুলোকে 'সতর্ক' করছেন না কেন? তাদের শাস্তির বিধান রেখে আইন করছেন না কেন??
আমি তো দেখি, মুখে গাইড বই বন্ধের কথা বলে উল্টো গাইড বইয়ের ব্যবসায়কে সহায়তা করা হচ্ছে! আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, আমি যখন নবম শ্রেণিতে পড়ি, তখন বাংলা বিষয়ে আমি যে গাইড বইটা পড়তাম সেটার নাম ছিলো 'টিটন'স বাংলা গাইড'! সে গাইড বইটা আমার মেজো আপা পড়েছেন, তারপর আমার ছোটো আপা পড়েছেন, এরপর চাচাতো ভাই অপু (সে তখন দশম শ্রেণিতে) ও আমি একসাথে ব্যবহার করেছি! তখন বেশিরভাগ পরিবারেই এভাবেই চলতো! এটা সম্ভব হতো, কারণ বোর্ড বইগুলো বছর বছর পরিবর্তন হতো না, সিলেবাসও দিনরাত্রির আবর্তনের সমানুপাতে পরিবর্তন হতো না!
এখন যেটা হয়েছে, প্রতি বছর বোর্ড বইগুলো পরিবর্তন করা হচ্ছে; কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় সব এক রেখে একটা-দুটো টপিক পরিবর্তন করে 'নতুন বই' দেয়া হচ্ছে! ফলে একই গাইড বই একাধিক শিক্ষাবর্ষে পড়ার উপযোগী থাকছে না; প্রতি বছর গাইড বইয়ের নতুন নতুন কপি বাজারে ছাড়া হচ্ছে, চলছে শত শত কোটি টাকার গাইড-বাণিজ্য! এবং আমি কোনোভাবেই মনে করি না, এত বড় বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট সরকারি ও প্রশাসনিক বিভাগসমূহের কোনো স্বার্থ ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে!
তাই, লোক দেখানো 'গাইড বই বন্ধ নাটক' মঞ্চস্থ করার মাধ্যমে জনসাধারণকে বোকা বানানোর চেষ্টা হীনতার পরিচায়ক বলেই মনে করি!
২.
গাইড বই বিষয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হচ্ছে, গাইড বইয়ের প্রয়োজন আদৌ আছে কি না; অথবা বিপরীতভাবে বললে, গাইড বই নিষিদ্ধের কোনো প্রয়োজন আছে কি না!
প্রকৃতপক্ষে, গাইড বই কনসেপ্টটিই একটি ক্ষতিকারক কনসেপ্ট! গাইড বইয়ের অর্থ হচ্ছে শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রটিকে সীমাবদ্ধ করে দেয়া! একজন শিক্ষার্থীর স্বশিক্ষা ও সৃজনশীলতা চর্চার ক্ষেত্রে এটা একটা বিরাট হুমকি! তাই, ব্যক্তিগতভাবে আমি একমত যে গাইড বই অবশ্যই না থাকা উচিত! তবে এ ক্ষেত্রে গাইড বইয়ের অনুপস্থিতিতে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্ভাব্য সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবতে হবে! ভাবনার প্রথম যে বিষয়টি, তা হলো আমাদের পাঠ্যবই; আমাদের পাঠ্যবইগুলো কোনোভাবেই পূর্ণরূপে শিক্ষাবান্ধব নয়! আমাদের স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা পাঠ্যবই নিজে নিজেই অধ্যয়ন করে ভালো ফলাফল করবে এমন সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে! উদাহরণ হিসেবে প্রশ্নোত্তর অনুশীলনের ব্যাপারটি সামনে আনা যেতে পারে! গাইড বইতে যেখানে প্রতিটি অধ্যায়ে গড়ে প্রায় ১৫-২০টা করে সৃজনশীল রচনামূলক প্রশ্ন এবং প্রতি অধ্যায়ে গড়ে প্রায় ৪০০+ বিভিন্ন ধরণের সৃজনশীল বহুনির্বাচনি প্রশ্ন উত্তরসহ করে দেয়া থাকে, সেখানে বোর্ড বইতে কোনো অধ্যায়ে ১টা বা কোনো অধ্যায়ে সর্বোচ্চ ২টা সৃজনশীল রচনামূলক এবং প্রতি অধ্যায়ে গড়ে সর্বোচ্চ ৫-৭টা সৃজনশীল বহুনির্বাচনি প্রশ্ন দেয়া থাকে! বহুনির্বাচনির যে নানান ধরণ রয়েছে, সবগুলো ধরণের একটি করে প্রশ্নও বোর্ড বইয়ের অধ্যায় শেষে পাওয়া যায় না! আর প্রশ্নগুলো থাকে উত্তরবিহীন; একটি সৃজনশীল বহুনির্বাচনি প্রশ্নের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে একজন শিক্ষার্থী কীভাবে কোন বিষয়গুলো বিবেচনার মাধ্যমে উত্তর করবে সে ব্যাপারে সে দিক-নির্দেশনা পাবে কোত্থেকে? যে একটা-দুটো সৃজনশীল রচনামূলক প্রশ্ন বোর্ড বইতে থাকে সেগুলোর উত্তর কীভাবে করবে, সে দিক-নির্দেশনা একজন শিক্ষার্থী কোত্থেকে পাবে? এ প্রশ্ন করছি এ কারণে যে শিক্ষাবিদগণ কোচিং ও প্রাইভেট টিউটরদের প্রয়োজনও অনুভব করেন না! একটা সাধারণ উত্তর তাঁরা দেবেন জানি— "স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের কাছ থেকে শিখে নেবে!"
তাহলেই হয়েছে! সৃজনশীল বিষয়ে আমাদের দেশের বেশিরভাগ শিক্ষকের যে প্রশিক্ষণ রয়েছে (?!), তাতে করে নতুন সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করে দেয়ার মতো পরিশ্রমসাধ্য কাজ তাঁরা করবেন কি না বা করতে পারবেন কি না সেটাই যখন প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে সঠিকভাবে বইয়ের প্রতিটি সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর উক্ত শিক্ষকগণ কর্তৃক বিশ্লেষণপূর্বক শিক্ষার্থীদের শিখিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়াটির ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিশ্চয়তা ও আশঙ্কা রয়েছে বৈ কি! তাছাড়া, আমাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষাব্যবস্থার সনাতনী কাঠামো আদৌ সুশিক্ষাবান্ধব কি না, সে বিষয়েও প্রশ্ন তো রয়েছেই!
আমার অবস্থানও গাইড বই বাতিলের পক্ষেই; কিন্তু তার আগে পাঠ্যবইগুলোকে স্বশিক্ষাবান্ধব করে তোলা ও স্কুল-কলেজে শিক্ষার যথাযথ কাঠামো নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই! আগে ভিতটা উপযোগী করুন, তারপর যত তলা খুশি বিল্ডিং তুলুন!
আর হ্যাঁ, এসব নিয়ে 'নাটক' মঞ্চায়নটা দয়া করে আগে বন্ধ করুন!
©somewhere in net ltd.