নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি সাদামাটা মানুষ। ভালবাসার কাঙ্গাল। অল্পতেই তুষ্ট। সবাই আমাকে ঠকায়, তবুও শুরুতে সবাইকে সৎ ভাবি। ভেবেই নেই, এই মানুষটা হয়ত ঠকাবেনা। তারপরেও দিনশেষে আমি আমার মত...

অপলক

তত্ত্ব, তথ্য ও অনুভূতি ভাগাভাগি করা আমার অভিপ্রায়। কারও যদি ইচ্ছে হয় তবে যে কেউ আমার এই ব্লগের যে কোন কিছু নিজের সংগ্রহে রাখতে পারে।

অপলক › বিস্তারিত পোস্টঃ

অতিপ্রাকৃত ঘটনা: সময়কাল ১৯৬০-৮০

১৩ ই জুলাই, ২০২৫ রাত ২:০৭

অনেক সত্য ঘটনা মাথা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। বয়স হচ্ছে, হয়ত এক সময় আরও হারিয়ে যাবে। তাই আবারও লিখতে বসলাম।




ঘটনা ১.
মা বাবার বিয়ের পরপর এই ঘটনা। ঘটনাটা তাদের কাছেই শোনা। দাদার শহরের বাসাতেই সবাই তখন থাকতো। গ্রামের বাসায় শুধু ফসল তোলার সময় বা বিশেষ প্রয়োজনে যেত। কিন্তু সে সময় শহরের যে বাসা, সেটা তখনকার পৌরসভার শেষ বাসা। মোটামুটি এখনকার গ্রামের মত অবস্থা ছিল। কারন আমি নিজেও সে সময়ের রাস্তা ঘাট, ঘর বাড়ির অবস্থা বা ডিজাইন মনে করতে পারি।

যাইহোক, দাদার শহরের বাসাটা তখন আধা কাঁচা টিনের বাসা। বিয়ের সময় দাদা বেঁচে ছিলেন না। দাদি আর আব্বা মিলে বিশাল সংসার সামাল দিতেন। অন্যদিকে আমার নানা বাসা একই শহরের একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত ছিল। ইটের পাকা বাসা। কারেন্ট ছিল নামে মাত্র। বিয়ের পর মা কে দাদার বাসায় উঠতে হয়, যেখানে আবার কারেন্ট নেই, বাসাটাও পুরো পাকা নয়। সরকারী চাকুরে বরের যেসব সুবিধা বিয়ের আসরে, সেটা তখনও ছিল, এখনও আছে।


বিয়ের ১-২ দিন কোন সমস্যা হল না। বাসাটা সুন্দর গোছানো, চারপাশে ঘর আর দেয়াল দিয়ে ঘেরা, মাঝখানে কাঁচা উঠোন। বাসার এক কোনায় রিংয়ের পায়খানা। গোছল খানা আর টিউবয়েল ছিল অন্যপাশে। বাসার চারপাশে নানা জাতের গাছ লাগানো ছিল। তাই সকাল হয় দেরিতে, সন্ধ্যা নামে তাড়াতাড়ি। সব সময় শীতল পরিবেশ।

এরপর মা এক রাতে শুনলো, টিনের চালে মচমচ করে শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ হাটাহাটি করছে। মা ভাবল, হয়ত ধেরে ইঁদুর বা বানর টানর হবে। এদিকে আব্বা তখনও ফেরেনি। কিছুক্ষণ পর, দাদি একটা লাঠি আর হেরিকেন নিয়ে মা'র ঘরে এসে আজাইরা সব গল্প সল্প শুরু করল। ফুফু আর চাচারা তখন ঘুমে। আব্বার সেদিন বাসায় ফেরে রাত ১১ টায়। সে সময় রাত ১১ টা মানে অনেক রাত।

পরের রাত গুলোতেও এশার আযানের পরপর এরকম লাফালাফি হাটাহাটি হতেই থাকে। কোন দিন দাদী আসে, তো কোন দিন বড় ফুফু এসে তাদের ভাবীর সাথে বসে থাকে। মা তার বড় ননদকে শেষে জিজ্ঞেস করেই বসল, টিনের চালে প্রতি রাতে এগুলা কি চলাচল করে? সবাই বলে, ও কিছু না। কাঠবিড়ালী হবে হয়ত।

মা বলে, এই অসময়ে কাঠ বিড়ালী টিনের উপর কি করবে, তাও এত জোড়ে জোড়ে? বাসার চারপাশে তো আম, পেয়ারা আর তেঁতুল গাছ। কোন গাছেই তেমন কোন ফল নেই। বাসার মেয়ে লোকেরা বিশেষ কিছু বলে না।



একদিন ঐ রকম লাফা লাফি শুরু হলে, সাহস করে হেরিকেন দরজায় রেখে উঠোনে যায়। সেদিন চাঁদনি রাত ছিল। মা দেখতে চাইছিল, কি এত জোরে জোরে হাটে। মা খেয়াল করল যে টিনের চালে হাটার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু ঝকঝকে চাঁদের আলোতেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ঠিক ঐ সময় ছোট চাচা বাইরে থেকে এসে দরজায় টোকা দিতে থাকে। মা গিয়ে বাসার মেইন গেট খুলতেই, চাচা নাকি মা কে বলে, ভাবি তুমি নতুন বউ, তুমি একা গেট খুলতে আসবা না। মা নাকি বলেছিল, আমি কি তোমার গলা চিনি না? আমি একা খুলতে আসলে কি সমস্যা?

চাচা কোন উত্তর না দিয়ে বলে, সমস্যা কিছু না। এরপর থেকে একা আসবা না। সাপ টাপ থাকতে পারে। চাচাও আসল কথা এড়িয়ে যায়।

এভাবেই আরও কিছু দিন কাটল। এক রাতে মা সিলভার জগে পানি ভরাতে বের হয় টিউবয়েলের দিকে। তখন রাত ৮ টার মত হবে। পানি নিয়ে ফেরার সময় উঠোনে হঠাৎ করে ধুপ করে কাল কিছু একটা লাফিয়ে পড়ে। সাথে সাথে হেরিকেন নিভে যায়। মা ভাবছে, তার দেবর হয়ত ভয় দেখাতে দুষ্টমি করছে। দাদী হয়ত বুঝতে পারছিল। সাথে সাথে ঘরের দরজার লম্বা খিল আর হেরিকেন নিয়ে উঠোনে চলে আসে।

তারপর চিৎকার করে দাদী নাকি এদিক সেদিক তাকিয়ে বলেছে, খবরদার আমার বউয়ের সামনে আসবি না। তাইলে কিন্তু সব বোতলে ভরামু। হারামজাদা তোরা তোদের মত থাক... আর একবারও যাতে না দেখি। এরপর দাদি মা কে বকাঝকা করে, কেন একাএকা পানি আনতে বের হইছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর থেকে কয়েক রাতে আর সমস্যা হয়নি। কিন্তু নতুন উপদ্রব দেখা দিল। ভোরে আর সন্ধ্যার আযানের আগে ভাগে ১০-১২হাত লম্বা গোখরা সাপ বাসার এপাশ থেকে ওপাশ ঘোরাঘুরি করে। দাদী ফুফু দেখলে পানি ছিটিয়ে দেয়, নয়ত মাটিতে পা দিয়ে জোরে জোরে শব্দ করে। তখন তাড়াতাড়ি চলে যায়। সাপ দেখার পর থেকে, ভয়ে মা বিকেল বেলাতেই মশারি খাটিয়ে ভেতরে বসে থাকে।

এরপর এক সকালে বড় চাচা এক চারি গুড়া মাছ নিয়ে আসছে। মা মাঝ উঠোনে বসেছিল। জ্যান্ত মাছ সব লাফালাফি করছিল। মা'র যেহেতু এসব করে অভ্যাস নেই, তাই খুব দেরি হচ্ছিল কাটাকুটি করতে। এদিকে বাসায় কেউ নেই। ছোট চাচা ফুফুরা স্কুল কলেজে, আর দাদী কোন এক কারনে বাসায় নেই। চাচা গোসল সেরে মা'র পাশে বসছে। এ গল্প সে গল্প, কিন্তু আর নড়েনা। মাছ কুটতে কুটতে দুপুর। তখন আবার টিনের চালে ধুপধাপ শব্দ। চাচা গলাফাটিয়ে চিৎকার করে বলে: এই কে রে?



চাচা এক সময় বলে বসল, ভাবি আমাকে দুটা টাকি মাছ দাও, আর মাথায় ঘোমটা দাও। আমি একটু আসতেছি। এই বলে চাচা নাকি দুটো মাছ নিয়ে বাসার পিছে যায়। তারপর খালি হাতে ফিরে আসে। আর কোন লাফালাফি নেই। এবার মা মাছ ধুতে কলের পারে গিয়ে, শুধু হিস হিস শব্দ শুনলো কিন্তু কিছু দেখতে পেল না। চাচাও শুনছে। তখন মা কে জোর করে তাড়িয়ে দিয়ে ঘরে পাঠাল। পরে চাচাই মাছ গুলা ধুয়ে পরিস্কার করতে শুরু করে। এর মধ্যে দাদী চলে আসে। দরজা খোলাই ছিল।

মাছ দেখেই বলে, বাড়িত কেউ নাই, আর তুই এতগুলা মাছ আনছু ক্যা? বউয়ের কিছু হলে? এই বলে দাদী গালাগালি করল। মা তখনও নিশ্চিত ছিল না, আসলে সমস্যা টা কই।

এর কিছুদিন পর দাদী জানালো, আসলে এই বাসায় সমস্যা আছে। আগে ছিল না। তোমার মেজ ননদের উপর নজর আছে। সে বড় হবার পর থেকেই শুরু হইছে। তারা যায় না। ভয় দেখায়। কিন্তু আজও কোন ক্ষতি করেনি। তারপর আব্বা দাদির কথামত কার্বলিক এসডি , ব্লিচিং পাউডার এসব মাঝে মাঝে ছিটাতো। কিন্তু তবুও এক জোড়া সাপ উঠোনে মাঝে মাঝেই দেখা যেত। আব্বা বাসার পেছনের কলা গাছ, আম গাছ কেটে দিল। অন্য যে গাছ ছিল, সেগুলো ডাল ছেটিয়ে ন্যাড়া করে দিল।

শহরে বেড়ে ওঠা মেয়ে, গ্রামের আবহাওয়ায় থাকা সত্যিই কষ্টকর। তাই আব্বা বছর খানেক পর মাকে নিয়ে শহরের পাকা ভাড়া বাসায় ওঠে। যতদিন ছিল, মা কম বেশি ঐ সব অতিপ্রাকৃত সমস্যা মেনে নিয়েই ছিল। এক সময় মা'র গা সওয়া হয়ে যায়। এই হল প্রথম ঘটনা।





ঘটনা ২.

এই ঘটনার সময়কাল আরও আগের যখন আমার মা বা বড়ফুফু ক্লাস থ্রি ফোরের ছা্ত্রী্। ঘটনাটা দাদির মুখে শোনা। ছোটবেলায় ফুফু অসম্ভব রুপবতী ছিলেন, তার প্রমাণ এখনও তিনি অনেক সুন্দর। তার মাথা ভর্তি চুল, খাড়া নাক, দারুন ফর্সা, যে কেউ দেখলেই পছন্দ করত। তখন দাদিরা গ্রামের বাড়িতেই থাকতেন। আব্বা তখন কলেজে পড়ে, তাই শহরে থাকে।

বাসার পাশেই বিশাল পুকুর। বড় মানুষ ছাড়া এক বারে পুকুরের একপাশ থেকে অন্য পাশে সাঁতরে যাওয়া যায় না। আমি নিজেও সেখানে গিয়েছি। পুকুরটা আসলেই অনেক বড়। টলমলে পানি। কোন শাপলা শালুক বা কচুরিপানা নেই।

ঘটনার দিন আর সবার মত দুপুর বেলায় স্কুল থেকে ফিরে গ্রামের বউ ঝি দের সাথে ফুফুও গোসল করতে নামে। গ্রামের মেয়ে হওয়ায় খুব ভাল সাঁতার জানত। এর ভেতরে আমার মেজ ফুফু জেদ ধরে যে শাপলা ফুল নেবে। মেজ ফুফু বড় ফুফুর চেয়ে ২ -৩ বছরের ছোট।

সে সময় নাকি পুকুরের ঠিক মাঝ খানে কিছু শাপলা ফুল ছিল। মাঝে মাঝে তুলে এনে খেত। বাচ্চারা ছিড়ে খেলতো, মালা বানাতো। তো মেজ ফুফুর আবদারে বড় ফুফু সাঁতরে মাঝ পুকুরে যায়। কয়েকটা শাপলা ছিড়ে তীরের কাছে আসতে থাকে। ঘাটের ১৫-২০ হাত দূরে থাকতে থাকতে ফুফু হাবুডুবু খেতে থাকে। ঝাপাঝাপি শুরু হয়। মহিলারা সেটা খেয়াল করে, তারা সাঁতরে যেতে যেতে ফুফু ডুবে যায়। এদিকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ঘাটের কিছু পুরুষ লোক, বাসার কামলরা ঝাপ দিয়ে খোজাখুজি শুরু করে। পরে ডুব সাঁতার দিয়ে একজন ফুফুর ডুবে যাবার ৩-৪মিনিট পর হাত ধরে টেনে তুলে আনে।



তারপর পেট থেকে পানি বের করা হয়। ফুফু দম ফিরে পায়। কিন্তু দেখা গেল, ফুফুর নাক ফোলা, রক্ত পড়ছে, ধীরে ধীরে সেটা কাল হয়ে গেল এবং ভীষণ জ্বর শুরু হল। পানি থেকে তোলার পর থেকেই কোন জ্ঞান ছিল না। এদিকে দাদা তখন কোলকাতায়। দাদীর বাবা রাজশাহীতে। কোন উপায় না দেখে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা চলে আর জ্বর পট্টি দেয়।

টেলিগ্রাম করা হলে ফুফুর নানা ফেরেন ৩দিন পর। এসেই তিনি দেখেন নাতির অবস্থা যায় যায়। তিনি বাসার কোন মেয়ে লোক ছাড়াই দেরি না করে নাতিকে নিয়ে চলে যান রাজশাহী মেডিকেলে। ঘটনা তখন ৪ দিন গড়িয়ে গেছে। রাজশাহী মেডিকেলের অধ্যাপক বুড়া নানার বন্ধু। সব দেখে বললেন, তোমার নাতনির বাঁচার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ওর নাকে আর কপালে ব্লাড জমে আছে। মনে হয় হাড় ভেঙ্গে গেছে, মুখে ইনফেকশন ছড়িয়ে গেছে, ব্রেনরে ক্ষতি হয়েছে কিনা এখনি বলা যাচ্ছে না। অপারেশনের পর যদি বেঁচেও যায়, তবু মুখের সেপ নষ্ট হওয়াতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে না।

যাই হোক, ডাক্তার দেরি না করে অপারেশন করেন। নাকের হাড় নাকি পচে নিজ থেকেই বেরিয়ে এসেছিল। জায়গাটা ফাকা হওয়ায় ব্লাড বা পুজ টুজ না কেটে ক্লিন করে ফেলে। ঘটনার ১১ দিন পর ফুফুর জ্ঞান ফেরে। ১৫ দিনের দিন মেডিক্যাল থেকে গ্রামের বাসায় ফেরেন।

সুস্থ্য হলে ফুফু জানায় যে, যখন শাপলা তুলছিল তখন নাকি একটা কাল সাপ শাপলার ডান্ডিতে পেঁচিয়ে থাকতে দেখে। ভয়ে সে ৩ টা শাপলা নিয়েই চলে আসে। কিন্তু কে যেন তার পা পেঁচিয়ে নিচের দিকে টানতে থাকে। যখন নিচে চলে যায়, তখন সেখানে সে একটা কন্ঠ শুনতে পায়। সেই কন্ঠ বলছিল, ঐ ছেড়ী তুই ফুল তুলছু ক্যা? আজ আমার পুজার দিন। এসব বলতে বলতে নাকি কোন কিছুর সাথে তার মাথাটা আছড়াতে থাকে। তারপর আর কিছু মনে নেই।

বুড়া নানা ব্যারিস্টার ছিলেন। খুব উচু মহল থেকে ডাক পড়লে তিনি যেতেন। অন্যথায় নিজের সম্পত্তি দেখ ভাল করতেন এবং কবিরাজি করতেন। কবিরাজি শিখেছিলেন কোথা থেকে দাদি জানেন না। তবে সেই কবিরাজি শুধু নিজের পরিবার আর বংশের লোকদের বিপদে ব্যবহার করতেন। ফুফুর ডুবে যাওয়ার আগে যখন বুড়া নানা বাড়ি ছেড়ে যান, তখন তিনি তার জ্বীনদের বাসা দেখভাল করতে রেখে যান। কিন্তু দুর্ভাগ্য বসত সে সময় তারা যুহরের নামায আদায়ে যায়। যখন ফুফুর বিপদের কথা জানতে পারে, তখন সেই জ্বীনরা ঐ মেয়ে জ্বীনের কাছ থেকে ফুফুকে ছিনিয়ে আনে।

বুড়া নানা বলেছিলেন, টেলিগ্রাম পাবার আগেই তিনি তার নাতির খবর পেয়েছিলেন জ্বীনের মাধ্যমে।কোর্টের সব কাজ ছেড়ে যখন তিনি ঘোড়ার গাড়ির টমটমে চড়ছিলেন, তখন পিয়ন তাকে টেলিগ্রাম দেয়। তিনি জ্বীনদের নাকি শাস্তি দিয়েছিলেন। আর ঐ মেয়ে জ্বীনকে বন্দী করেছিলেন। পুকুরের সব শাপলা মূল সহ তুলে ফেলেছিলেন।

দাদী কে যখন বললাম, টেলিগ্রাম ৩ দিন পর হাতে পাইছে। তাইলে জ্বীনেরা খবর এত দেরিতে দিল কেন? দাদী বলল: ভয়ে। কারন আমার বাবার খুবই রাগ ছিল। রাগ উঠলে উনি কিছু মানেন না। কে কত বড়, না কি সম্মানি সেটা দেখত না। তার উপর উনি জ্বীনদের দায়িত্ব দিয়ে গেছে বাসার সবার খেয়াল রাখতে। সেখানে ওরা এক সাথে সবাই নামাযে গেছে কেন, সেই ভয়ে জানানোর সাহস পাচ্ছিল না ওরা। যখন দেখেছে যে, তোর ফুফুর জান যায় যায়, তখন নিজেদের বাঁচানোর তাগিদে জানায়ছে।

ফুফু সে যাত্রায় বেঁচে যান। তবে নাকটা কিছুটা থ্যাবড়া। কাউকে না বললে বুঝবে না যে, তার নাকের অপারেশন হয়েছিল। ফুফু দি্ব্বি ঘর সংসার করছেন। এখনও বেঁচে আছেন। আসলে আয়ু থাকলে মানুষ যে কোন অছিলায় বেঁচে থাকে।





ঘটনা ৩:

ফুফুর ঐ ঘটনার পর দাদীর আবার এক ছেলে সন্তান হয়। তাকে দেখভাল করার জন্যে নতুন এক কাজের মহিলা রাখা হয়। সে সময় আঁতুর ঘর বাসার ভেতরেই আলাদা একটা ঘরে থাকত। সে ঘরে নবজাতক, তার মা আর হেল্পিং হ্যান্ড কেউ একজন থাকত। বাসার পেছনে বাঁশের টয়লেট, তার পেছনে বিশাল এক মিষ্টি তেঁতুল গাছ আর এক অজানা গাছ, যার গায়ে আঘাত করলে লাল রক্ত বের হয়। আর বৈঠক খানার পাশে, মানে বাসার বাইরে গোঁয়াল ঘরে ৪০-৫০টা গরু মহিষ, তার পাশে হাঁস মুরগির ঘর।

ঘটনার দিন বিকেলে ঐ বুয়া টয়লেটের পিছনে গিয়ে তেঁতুল পেড়ে আনে। রাতে যেহেতু জেগে থাকতে হয়, সে আচার মাখিয়ে খাবে। এই হল নিয়াত। এই ঘটনা সে দাদীকে জানায়নি। আবার খালি পায়ে চলাচল করে, নাপাকি লেগেছিল কিনা, ঠিক মত পরিষ্কার করেছিল কিনা, সেটার হদিস নেই। এদিকে নতুন হওয়ায়, বাসার কোন ঘরে কে থাকে বা কোথায় কোন জিনিস পাওয়া যাবে, ঠিক মত জানত না।

যাই হোক, এশার নামাজের পরে দাদী তার নবজাতককে তেল মাখাতে গিয়ে দেখেন তেল প্রায় শেষ। ওটা ছিল পড়া তেল। দাদি পড়া তেলে নতুন তেল মিশিয়ে বাচ্চাকে মাখাবেন ভেবে ঐ বুয়াকে বলে পাশের রুম থেকে তেল আনতে।

এখন পাশের রুমে তেল না পেয়ে তার পাশের রুমে যায় ঐ বুয়া, যেটা কিনা ছিল দাদির বাবার। উনি তখন রংপুর গেছেন কোন একটা কাজে। বলেই গেছেন ৩ দিন পর ফিরবেন। সেটি ছিল ২য় দিনের দিবগত রাত। সেই রুমে পালঙ্কের নীচে অনেক বোতল দেখে ঐ বুয়া একটা একটা করে খোলে আর শুকে দেখে কোনটাতে সরিষার তেল আছে। অকাম যা করার ঐ মহিলা করে ফেলে। সে আসলে বোতলে বন্দী করা সব জ্বীনকে মুক্ত করে দেয়।

বোতল নিয়ে আঁতুর ঘরে ঢোকার আগেই প্রচন্ড ঝড়তুফান শুরু হয়। মনে হয়, বাড়ি ঘর উড়ে নিয়ে যাবে। দাদি তো কাজের বুয়ার অঘটনের কথা জানে না। কিন্তু মনে মনে ভাবছেন, এই শীতের সময় কাল বৈশাখী জড় উঠছে কেন?

ঝড় থামলে, শুরু হয় ঢিলাঢিলি। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখেন, পুরো উঠোন গবরের বড় বড় শুকনো চাক দিয়ে ভরে গেছে। সেগুলো আকাশ থেকে যেন বৃষ্টির মত পড়তেছে। দাদি বুঝে গেলেন, এটা দুষ্ট জ্বীনদের ব্যাপার। এদিকে বাচ্চাটি তেল মাখানোর পর থেকে ভীষণ কান্নাকাটি করছিল। যত রকম দোয়া দরুদ জানতেন তিনি জোরে জোরে পড়ছিলেন আর নিজেও কান্নাকাটি করছিলেন।


ফজরের আগে ভাগে, বাচ্চার কান্না থামে। ঝড় বৃষ্টি ঢিলাঢিলি সেসবও থামে। বাচ্চাকে শুইয়ে নিজেরাও শুয়ে পড়েন। কাক ডাকা ভোরে বুড়া নানা বাসায় এসে হাজির। তার ডাকে সবাই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। কিন্তু আঙ্গিনায় চলাচলের মত অবস্থা ছিল না। বুড়া নানার প্রথম কথাই নাকি ছিল নাতির কি খবর?

দাদি বললেন সে ঘুমাচ্ছে। বুড়া নানার মুখ শুকনা, বললেন, নিয়ে আসো আমার ঘরে। বিছানায় গিয়ে দাদি দেখেন তার সন্তানটি আর বেঁচে নেই। কান্নার আওয়াজ শুনেই বুড়া নানা বের হয়ে এসে ঐ কাজের বুয়াকে বললেন, তোমার বাসায় যাও। তোমার বড় ছেলের খোঁজ নাও। এ কথা বলতে না বলতেই, বুয়ার স্বামী দৌড়ে এসে বলেন, রাতে তার ছেলেকে কখন না জানি সাপে কাটছে। সকালে দেখে মুখে ফেনা উঠে মরে আছে।

বুড়া নানা তার সব কামলা কিষান কে ডাক দিলেন, কাছারি ঘর থেকেও খবর দিয়ে লেবার নিয়ে আসালেন। বললেন, দুপুরের ভেতরে পুরো বাড়ি পরিস্কার করো। আসরের আগে সব গরু মহিষ বাথানে ছেড়ে আসবা। মাগরিবের আগেই সবাই ঘরের ভেতরে ঢুকবা। কেউ ভোর না হওয়া পর্যন্ত বের হবা না, যা কিছু ঘটে ঘটুক।

কোন ক্রমে ঐ মৃত দুই বাচ্চাকে দাফন করা হয়। বাসায় কোন রান্না বাটি নেই। কামলাদের নিজ নিজ বাড়িতে চলে যেতে বলা হয়েছে। বুড়া নানা ঘটনার রাতেই তার জ্বীনদের মাধ্যমে বাসার খবর পান। তখন সে রাতেই রংপুর থেকে ঘোড়ার গাড়িতে বাসায় রওনা দেন। জ্বীনরা নাকি বলেছিল, ফজরের আগে তিনি যদি পৌঁছান তবে তার নাতি বাঁচবে। দু:খের বিষয় তিনি পৌঁছাইছেন ফজরের পরে।

মাগরিবের আগে বুড়া নানা বলেন, দরজার বাইরে পিতলের ঘটিতে/বদনায় অযুর পানি ঢেকে রাখতে। তিনি যদি ঘর থেকে দিনে রাতে কখনও বের হন, তার সাথে যাতে কথা না বলা হয়। উঠোনে দাঁড়িয়ে কেউ যেন কথা না বলে। তিন দিন তিন রাত পর যেন তার ঘরে খোঁজ নেয়া হয়। বেঁচে না থাকলে কোথায় কবর হবে সেটাও বলেন।

সেই তিন দিন নাকি বিভিন্ন কন্ঠের কথা বার্তা চিৎকার চেচামেচি শোনা যায়। ঘরের ভেতর থেকে জিকির , কোরআন তেলওয়াত এসব সবাই শুনতে পায়। ৩ দিন পর ফজরের নামায শেষে তিনি ঘর থেকে বের হন। গোসল দিয়ে এসে সবাই কে বলেন, বিপদ কেটে গেছে। আজ তোমরা সাবাই ১০০ রাকাত করে নফল নামাজ পড়বা। আ্ল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করবা।

এদিকে বাথানের কিছু গরু মহিষ খোলা মাঠে মরে পরে ছিল। অনেক হাস মুরগি মরে পরে ছিল। জ্বীনরা নাকি, ঐসব সুস্থ্য সবল প্রানীর প্রাণ দাবি করেছিল। এরপর আর বড় কোন অঘটন বুড়া নানার জীবদ্দশায় ঘটেনি।



দাদী স্মৃতিচারন করে বলেছিলেন, সেই রক্ত ঝরা কষের বিশাল গাছটি কোন এক ঝড়ে উপড়ে পরে। তার কাঠ নাকি লাল টকটকে। দাদিরা ঐ গাছ ব্যবহারের সাহস করেননি। কিছু গরীব লোক গাছটা চিড়ে রান্নার জন্যে খড়ি নিয়ে যায়। কিন্তু তারা নাকি সেটা পোড়াতে পারেনি। ভীষণ ধোয়া আর বিকট দুর্গন্ধ বের হত চুলায় আগুন দিলেই। তারাও ভয়ে এক সময়, ডোবার ভেতরে সেই কাঠগুলো ফেলে দেয়।




***লেখাটা অনেক লম্বা হল। যা যা মনে পড়ল, সব টুকুই লিখে রাখলাম। আজ দাদী বেঁচে নেই। আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুন।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই জুলাই, ২০২৫ রাত ২:৪৮

গোবিন্দলগোবেচারা বলেছেন: :| রাতের বেলায় এসব পড়ে আমার তো খবর হয়ে গেল

১৩ ই জুলাই, ২০২৫ সকাল ৮:৪৭

অপলক বলেছেন: ভাই এখন কি অবস্থা ? ঠিক আছেন তো?

২| ১৩ ই জুলাই, ২০২৫ রাত ২:৫২

এইচ এন নার্গিস বলেছেন: বিরাট গল্প । তবে পড়তে গিয়ে গ্রামের বাড়ীর একটা সুন্দর দৃশ্য মনে চলে আসে। যা ঠিক আমার শ্বশুর বাড়ীর মতো।

১৩ ই জুলাই, ২০২৫ সকাল ৮:৪৯

অপলক বলেছেন: এটা গল্প না, সত্য ঘটনা আপু।

আপনার শ্বশুড় বাড়ি নিশ্চয় অনেক সুন্দর। গ্রাম আমার বরাবরই ভাল লাগে।

৩| ১৩ ই জুলাই, ২০২৫ দুপুর ১:৫৯

Sulaiman hossain বলেছেন: পড়লাম,অনেক মজা পেলাম পড়ে

১৩ ই জুলাই, ২০২৫ দুপুর ২:০৭

অপলক বলেছেন: লেখাটা লিখতে অনেক সময় লেগেছে। ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলতেছিলাম।

'মজা পেয়েছেন' কোন অর্থে লিখেছেন জানি না। ধরেই নিলাম, আপনার ভাল লেগেছে।


ধৈর্য্য নিয়ে পড়ার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.