![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জাতীয় বিদ্যুৎ সপ্তাহে ইন্টার ইউনিভার্সিটি ইনোভেশন কমপিটেশনে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর কাছ থেকে রানার আপ অ্যাওয়ার্ড নিচ্ছেন শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী
আধুনিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো বিদ্যুৎ। পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশকে এই জায়গাটায় এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ)। তবে তাদের ভূমিকা গতানুগতিক ধারা থেকে ব্যতিক্রম। যে গ্রামগুলোতে আপাত দৃষ্টিতে বিদুৎ সরবরাহ অসম্ভব বলে মনে হয়, সেখানেই তাদের কার্যক্রম। সচ্ছল গৃহস্থ ঘর হওয়ার পরেও বিদ্যুৎহীন জীবনযাপনে যারা কষ্ট করছিলেন তাদের স্বস্তি এনে দিয়েছে ‘ইউআইইউ’-এর নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প। যেটি গ্রামবাসীর কাছে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বলে পরিচিত। তবে সৌরবিদ্যুৎ বলতে সাধারণ মানুষের যে ধারণা তার থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পগুলো আলাদা।
কংক্রিটের খুঁটির মাথায় মোটা তার বসিয়ে গ্রামের পর গ্রাম বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। সৌরবিদ্যুতে চলছে কম্পিউটার, টিভি, ফ্রিজ সবই। এমনকি পানি তোলা, ওয়েল্ডিং করাসহ সব ভারী যন্ত্রপাতিও চালানো হয় এই বিদ্যুৎ দিয়ে। ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যান চলছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। ইউআইইউর কারিগরি সহযোগিতায় বর্তমানে সারা দেশে ১০টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এ ছাড়া কার্যক্রম শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে আরো ১৭টি প্রকল্প।
যার উদ্যোগে ইউআইইউ এই প্রকল্প শুরু করে, তিনি হলেন, শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী। সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে বিদুৎ উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি দিয়ে শুরু হয়েছিল তার কর্মজীবন। বিভিন্ন জায়গায় কাজের সূত্রে ঘুরে বেড়াতে গিয়ে দেখলেন, বেশির ভাগ গ্রামেই বিদ্যুৎ নেই, উৎপাদনেও ঘাটতি আছে। আমাদের প্রাথমিক জ্বালানি (গ্যাস) সীমিত এ কথা মনে হওয়ার পর ভাবলেন, বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণের জন্য আদর্শ বিকল্প হতে পারে নবায়নযোগ্য জ্বালানি। কোনো দিনও নিঃশেষ হয়ে যাবে না (সূর্যের আলো, বাতাস, সাগরের ঢেউ ইত্যাদি) এমন জ্বালানি নিয়ে গবেষণার জন্য ২০০৪ সালে জার্মানির ওল্ডেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলেন। ‘কপার ইনডিয়াম গ্যালিয়াম ডাই সেলেনাইড (সিআইজিএস)’ নামের সৌরকোষ নিয়ে গবেষণা করলেন। এটি সোলার প্যানেলের দাম কমানোর একটি উপাদান, যা দিয়ে প্লাস্টিক বা কাপড়ের মতো নমনীয় মাধ্যমের ওপরও সৌরকোষ তৈরি করে সূর্যালোক থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। তবে গবেষণা করতে গিয়ে শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী দেখলেন, এ থেকে খুবই কম বিদ্যুৎ তৈরি হয়। ২০০৬ সালে মাস্টার্স থিসিসের অংশ হিসেবে ৯ মাস গবেষণা করে নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন এবং এটি দিয়ে ১৪ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হলেন। মাস্টার্সে ৮৭ শতাংশ নম্বর পেয়ে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রথম হওয়ার পর অসাধারণ ছাত্রটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে যেতে বলেছিল কর্তৃপক্ষ; কিন্তু নিজের দেশের মানুষের ভাগ্য ও জীবনযাপন বদলে দেবেন বলে তিনি দেশে ফিরে এলেন, ‘যা শিখেছিলাম সেটি দেশের মানুষের কাজে লাগানোর জন্য ফিরেছি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি এ দেশের নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়াটাও আমার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।’ নতুনদের নিয়ে কাজ করার জন্য আরামের সরকারি চাকরিও ছেড়ে দিলেন। দেখা করলেন বুয়েটে তার শিক্ষক ও ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভিসি ড. রেজওয়ান খানের সাথে।
শিক্ষককে স্বপ্নের কথা শোনালেন ছাত্র, ‘স্যার, আমি নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়টিকে অনার্স লেভেলে পাঠ্য করতে চাই এবং এ বিষয়ে গবেষণার জন্য একটি গবেষণাগার তৈরি করতে চাই। সেখানে নতুনরা গবেষণা করবে এবং তার ফলাফল দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজে লাগানো হবে।’ ড. রেজওয়ান নিজেও এ বিষয়ে কাজ করেন। তাই মেধাবী ও কর্মঠ ছাত্রকে ফেরালেন না। শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরীর উদ্যোগে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে ‘সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ (সিইআর)’ চালু হলো। এখন বিশ্বব্যাংক, জিআইজেড ও সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অনুদানে সেখানে বেশ ক’টি গবেষণা প্রকল্প চলছে। এটি এখন দেশের অন্যতম প্রধান নবায়নযোগ্য জ্বালানি গবেষণা ও পরামর্শ প্রতিষ্ঠান। ৫০টি প্রকল্পের কাজ সফলভাবে শেষ করেছে, ১৬টি গবেষণা প্রকল্প চলছে। ইউআইইউতে যোগদানের পরই নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারের জন্য ইডকলের (ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড) কারিগরি পরামর্শক হিসেবে ‘সোলার হোম সিস্টেম’-এর কারিগরি ত্রুটিবিচ্যুতি চিহ্নিত করেন শাহরিয়ার এবং সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন। এ কাজের অংশ হিসেবে মানিকগঞ্জ, নোয়াখালী, কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জ, ফরিদপুর, নরসিংদী, রাজশাহীর গ্রামগুলোতে ঘুরে দেখেছিলেন, সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করে তিন-চারটি বাতি জ্বালাতে পারলেও চার-পাঁচ ঘণ্টার বেশি সে আলো থাকে না। বিদ্যুতের অভাবে কলকারখানা গড়ে ওঠে না। মানুষের কাজের ব্যবস্থা হয় না। এসব দেখে তিনি কিভাবে শহরের মতো গ্রামাঞ্চলেও ২৪ ঘণ্টাই বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দেয়া যায় ভাবেন। গ্রাম এলাকায় ছোট ছোট শিল্পকারখানা গড়ে তোলাও তার লক্ষ্য ছিল। ইডকলের আর্থিক সহায়তায় ২০১৪ সালের ডিসেম্বর থেকে নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার পারাতলী ইউনিয়নে সৌর বাংলা লিমিটেডের নতুন প্রকল্প চালু হয়। সেখানে সৌরশক্তি ব্যবহার করে ১৪১ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে, দিনরাত পাঁচ শ’র বেশি বাড়িঘর, দোকানপাটে আলো জ্বলছে। রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলার গড়গড়ি ইউনিয়নের পলাশী-ফতেহপুর গ্রামও ১৪১ কিলোওয়াট বিদ্যুতে আলোকিত হয়েছে। ভোলার মনপুরা উপজেলায় বাংলাবাজার, মাস্টার হাট ও আশপাশের এলাকায় সোলার ইলেকট্রো বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রকল্পের মাধ্যমে ১৭৭ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। ৬৬১ জন গ্রাহক এ প্রকল্পের মাধ্যমে বাড়ি, দোকানপাট, দু’টি বাজার আলোকিত রাখবেন, একটি বরফকল চলবে। এমন আরো প্রকল্পের কথা বলতে গিয়ে শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরীর চোখ স্বপ্নে ভরে উঠল, ‘কোনো দিন যদি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার নারায়ণপুর চলে যান, দেখবেন গ্রামের আলো লিমিটেডের প্রকল্পের মাধ্যমে ১৭টি পাম্প চলছে, ৭৩৯টি বাড়ির ছেলেমেয়েরা সৌরশক্তির আলোয় লেখাপড়া করছে। এটুকুই আমি চেয়েছিলাম, যেন এ দেশের শিশু-কিশোরেরা আলোতে জীবন যাপন করতে পারে, কৃষকেরা যেন উৎপাদন করতে পারেন, মানুষ যেন আধুনিক সভ্যতার সুবিধাগুলো নিয়ে বাস করতে পারে।’
তবে তিনি ও তার দল সাফল্যের গর্বে ভেসে যায় না। তারা আরো ১৭টি প্রকল্পের কাজ শেষ করে এনেছে। আগামী মাসে ৩টি প্রকল্প উদ্বোধন হবে। যেমন মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুর উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নে আগামী মাসে থেকে ‘সুপারস্টার’ প্রকল্পের মাধ্যমে ৮৭৫ জন গ্রাহক ২৪০ কিলোওয়াট সৌরবিদ্যুৎ পাবেন। ১৫টি পাম্প খটখটে জমিতে পানি পৌঁছে দেবে, স মিল কাঠ কাটবে, ১২টি স্কুল-কলেজ ও মাদরাসায় ভালোভাবে লেখাপড়া হবে। ২০১৬ সালের শেষ নাগাদ শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরীর ডিজাইন করা ২০টি সৌরবিদ্যুৎ মিনি গ্রিড প্রকল্পের মাধ্যমে ১৫-২০ হাজার পরিবার, গ্রাম্য বাজার ও ছোটখাটো কলকারখানা চলবে। ইউআইইউতে ২০০৯ সাল থেকে এক বছর পর পর নাবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর আন্তর্জাতিক সেমিনার হচ্ছে। গত বছর ২২টি দেশের গবেষক এসেছিলেন। এ ছাড়া শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী ও তার গবেষকেরা নানা ধরনের সৌরচালিত প্রযুক্তিও আবিষ্কার করছেন। সিইআর ১০টি সৌরশক্তিচালিত প্রকল্পের ধারণা তৈরি করেছে। এগুলোর অন্যতম সৌরশক্তিচালিত নৌকা।
ডিজেল ইঞ্জিনের বদলে সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে নৌকার মোটর চালানো হবে। বিশ্বব্যাংকের অনুদানে প্রকল্পের আরো উন্নয়নকাজ চলছে বলে জানালেন শাহরিয়ার আহমেদ। ২০১৪ সালের ‘ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড ২০১৪’ মেলাতেও নৌকাটি দেখেছে সবাই। ইউআইইউয়ের ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এই সহকারী অধ্যাপকের নেত্বত্বে ১০-১২টি বাড়িতে বিদ্যুৎ দেয়ার জন্য সোলার ন্যানোগ্রিড প্রকল্প, মাটির আর্দ্রতা পরিমাপ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেচ পরিচালনা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এখানে সুলভে সৌরবিদ্যুৎ ইনভারটার তৈরি করা হচ্ছে।
লিনক : Click This Link
©somewhere in net ltd.