নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইস আমি তো ভুলতে পারিনি

পিকেকে টিটু

পিকেকে টিটু › বিস্তারিত পোস্টঃ

[আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার] আমার আমি -সৈয়দ আবুল মকসুদ

০৬ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ১:৫৬

সৈয়দ আবুল মকসুদ বাংলাদেশের ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। দেশের প্রধান লেখক, চিন্তাবিদ ও গবেষকদের একজন। বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য। পেয়েছেন আরও অনেক পদক-পুরস্কার। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৪০টির মতো। গবেষণা করেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মওলানা ভাসানী, মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশে তিনি পথিকৃৎ। আরও গবেষণা করেছেন ও জীবনী লিখেছেন উনিশ শতকের কবি হরিশচন্দ্র মিত্র ও গোবিন্দচন্দ্র দাস সম্পর্কে। পথিকৃৎ নারীবাদী খায়রুন্নেসা খাতুন সম্পর্কেও গবেষণা করেছেন। একজন বামপন্থি চিন্তাবিদ। সামাজিক আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যন্ত সক্রিয়। ইন্দো-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, পশ্চিমী ভোগবাদ, পশ্চিমী সংস্কৃতি ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তিনি ২০০৩ সাল থেকে গান্ধীবাদী সত্যাগ্রহ শুরু করেছেন। বর্জন করেছেন পাশ্চাত্য পোশাক। সুশাসন ও পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের তিনি একজন প্রধান নেতা। কর্মময় তাঁর জীবন। নীতি-আদর্শের প্রশ্নে আপসহীন। তাঁর ব্যক্তিজীবন, দর্শন ও চিন্তাধারা নিয়ে প্রকাশিত হলো এই সাক্ষাৎকার



সাপ্তাহিক : কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে নয়, সাপ্তাহিক-এর পক্ষ থেকে আমরা আপনার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলব। তাতে প্রসঙ্গক্রমে আসবে আপনার বেড়ে ওঠার কথা। অর্থাৎ কীভাবে আপনি সৈয়দ আবুল মকসুদ হয়ে উঠলেন। আপনার কর্মজীবন, লেখকজীবন। আসবে আপনার দর্শন এবং আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভৃতি বিষয়ে আপনার চিন্তাধারার কথা। সামাজিক কর্মকাণ্ডে আপনার কর্মকাণ্ডের কথা। যা হোক, জন্ম কখন কোথায়?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : এই যে জন্মের কথা বললেন, এ এক অপার রহস্য। এই যে জগৎ, জীবন ও কাল বা সময়Ñ এসব রহস্যের কোনো শেষ নাই। আমাদের যে জন্ম হয়Ñ অনাদিকাল থেকে হচ্ছে মানুষের জন্ম পৃথিবীতেÑ কেউই সে সম্পর্কে কিছু জানি না। নিজের জন্মের কথা অন্যের কাছ থেকে জানতে হয়। আমার জন্ম ২৩ অক্টোবর ১৯৪৬-এ। বুধবার সন্ধ্যা ৬.১৫ মিনিটে। ৬.১৪ মিনিটেও আমি পৃথিবীতে ছিলাম না। থাকলেও ছিলাম মাতৃগর্ভে। তার দশ মাস আগেই বা আমি কোথায় ছিলাম? জন্ম মানিকগঞ্জ জেলার এলাচিপুর গ্রামে। শিবালয় থানায়। আরিচাঘাটের মাইলখানেকের মধ্যে। এখন জায়গাটি নদীর মধ্যে। সেই জায়গায় চলে সারাদিনরাত ফেরি, নৌকা ও লঞ্চ। ওখানে আমার জন্ম হওয়ার কথা নয়। আমার জন্ম হওয়ার কথা কলকাতায়। সেখানকার কোনো মাতৃসদনে কিংবা কলকাতার কোনো হাসপাতালে অথবা বাড়িতেই। কার জন্ম কোথায় হবে, কখন হবে, কারও কোনো হাত নেই। তাই বাবা-মা ও অন্য সবাই ঠিক করে রাখলেন জন্ম হবে কলকাতায়, ভূমিষ্ঠ হলাম এলাচিপুরের পদ্মাপাড়ের এক বাড়িতে।

সাপ্তাহিক : কলকাতায় কেন জন্ম হওয়ার কথা?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : আমার বাপ-দাদাদের বাড়ি এলাচিপুরে মুঘল আমলের আগে কোনো এক সময় থেকে। আমার নানা ছিলেন কলকাতার মানুষ। কলকাতারও নয়, উত্তর প্রদেশের ফয়েজাবাদ, লক্ষেèৗয়ের কাছে। তিনি অবাঙালি-উর্দুভাষী। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার কারণে ১৯২৬ সালে তিনি তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে অর্থাৎ আমার নানিকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে থেকে যান। আমার মা সালেহা বেগমের জন্ম হওয়ার কথা ছিল ফয়েজাবাদ, হলো কলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকার মেহের আলী স্ট্রিটে। এরই নাম নিয়তি। ওতে কারও হাত নেই। যা হোক, আমার নানা ছিলেন মধ্যবিত্ত। একটি ছোট ছাপাখানা ছিল। তিনি অকালে মারা যান। তার প্রেস দেখাশোনা করতেন তার শ্যালক। আমি যখন মায়ের পেটে তখন আমার সেই নানা, আম্মার মামা ব্যবস্থা করেছিলেন সাত মাসের গর্ভবতী অবস্থায় আম্মাকে কলকাতায় নিয়ে যাবেন। সব ঠিকঠাক। বাকশো-পেটারা বাঁধাছাঁদা শেষ। বাড়ির ঘাটে নৌকা। কারণ আমাদের বাড়ি ছিল পদ্মার পাড়ে। নৌকায় আব্বা-আম্মা যাবেন শিবালয় বা আরিচা স্টিমারঘাটে। সেখান থেকে গোয়ালন্দ। গোয়ালন্দ থেকে শিয়ালদা। নিয়তির কি পরিহাস। দিনটি ছিল ১৭ আগস্ট। তার আগের দিন ছিল ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে বা মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস। কেউ ভাবেনি ওইদিন উপমহাদেশের মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যাবে। কলকাতায় ১৬ তারিখে গোলমালের কথা শুনে আম্মার যাওয়া মুলতবি হয়। ঠিক হয় দু’চারদিন পরে পরিস্থিতি শান্ত হলে যাবেন। ১৯৪৬-এর ১৬ থেকে ১৯-২০ আগস্ট পর্যন্ত কলকাতায় যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড হয় শুধু উপমহাদেশ নয়, মানবজাতির ইতিহাসে তার তুলনা বিরল। চার-পাঁচ দিনে হাজার বিশেক হিন্দু-মুসলমান পরস্পরের হাতে নিহত হয়। দাঙ্গা পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও রক্তপাত কমবেশি হতেই থাকে। আমার মায়ের আর কলকাতায় যাওয়া হয়নি। তখনও নয়। কোনো দিনই নয়। আমারও জন্ম বাংলাদেশের মাটিতেই হলো।

আমার মা তাঁর জন্মস্থান এবং প্রিয়তম শহর কলকাতায় আর কোনোদিন যাননি। ১৯৪৮ সালের ২০ নভেম্বর মাত্র ২২ বছর বয়সে পৃথিবীকে ভালো করে জানার আগেই তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুও অপমৃত্যুই বলা চলে। তিনি ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। যথাসময়ের আগেই একটি মৃত কন্যাসন্তান প্রসব করার সময় একলেমশিয়া বা প্রসবকালীন ধনুস্টঙ্কার হয়ে তিনি মারা যান। আমার বয়স তখন দুই বছর দুই মাস। তিনি তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে পৃথিবীর কূলকিনারাহীন এক উত্তাল সাগরে ফেলে রেখে চলে গেলেন। আমি জানলাম না আমার সবচেয়ে আপনজন চিরদিনের জন্য আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন এমন কোথাও যেখান থেকে আর কোনো দিন ফিরবেন না।

বিস্ময়কর মনে হবে, আমি যে মাতৃহীন সে কথা আমি জানলাম প্রায় পনের বছর বয়সে, মায়ের মৃত্যুর এক যুগ পরে। আমার বিমাতা, বেগম রোকেয়া আখতার ছিলেন নিঃসন্তান। অতিশয় স্নেহশীল। তিনি আমাকে তাঁর বুকে টেনে নিয়েছিলেন নিজের পেটের সন্তানের মতো। তিনিই আমার মা। তাঁকে মা ছাড়া আমি আর কিছ্ইু ভাবতে পারি না। ১৯৮০’র মে মাসে তিনি মারা যান।

আমার মায়ের মৃত্যুও একটি রহস্যের মতো। কোনো নোটিশ না দিয়ে তাঁর কাছে মৃত্যু আসে। তাঁর মৃত্যুর সপ্তাহখানেক আগে আব্বা পদ্মার চরে পাখি শিকারে যান। শিকারে তাঁর শখ ছিল। হাতও ভালো ছিল। সেদিন কয়েকটি বেলেহাঁস ও মাত্র একটি ঘুঘু শিকার করেন। ঘুঘুটি ছিল যমজ-ঘুঘুর একটি। শিকার ঘুঘুটির জোড় ঘুঘুটি নদীর চর থেকে আব্বার নৌকার পিছে পিছে আমাদের বাড়িতে আসে। একপর্যায়ে ঘুঘুটি আমাদের উঠানে ছটফট করতে থাকে। ঘুঘুটির ছটফটানি দেখে আম্মা বিচলিত হন। রাতে কি এক স্বপ্ন দেখেন। সকালে আব্বাকে বলেন, ঘুঘুটি মারা ঠিক হয় নাই। আরও বলেন, তিনি আর কয়েকদিন আছেন। তাঁকে যেতে হবে। আমাকে দেখিয়ে আব্বাকে বলেন, ওকে রেখে যাচ্ছি। দেখে রাখবেন। ১৭ নভেম্বর, হঠাৎ তাঁর ব্লিডিং শুরু হয়। ২০ তারিখে মারা যান। কয়েকদিন আগে আমাদের পারিবারিক ডাক্তার নিবারণচন্দ্র সাহা পোদ্দার আমাকে একটি জাপানি কাগজী লেবুর চারা দিয়েছিলেন। সেটি আব্বা-আম্মার শোবার ঘরের সামনে উঠানের এককোণায় আম্মার কথামতো লাগানো হয়েছিল। সেই লেবু গাছটির পাশে ওই রাতেই আম্মাকে শুইয়ে দেয়া হয়। ওই গাছটি পরে অনেক বড় হয়। শত শত লেবু ধরত। পেকে পড়ে যেত। ওই গাছটির প্রতি আব্বার এত দরদ ছিল যে বাড়ি যখন নদীতে ভেঙে যায়, অন্য জায়গায় গিয়ে বাড়ি করা হয়, ওই গাছটিকে বহু কষ্টে তুলে নিয়ে সে বাড়িতে লাগান তিনি। কিন্তু সেখানে গিয়ে গাছটি বাঁচেনি। লেবুর চারাটি যিনি দিয়েছিলেন সেই নিবারণ ডাক্তার ছোটবেলা আমাকে পড়াতেনও। ছিলেন আমার কাকার মতো। ছোটকাকার সহপাঠীও ছিলেন। তাঁকে ১৯৭১-এর জুনে পাকিস্তানি সেনারা পদ্মানদী থেকে গুলি করে হত্যা করে। তিনি ধুতি পরে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

জীবন ও জগতের অনেক ব্যাপারেই কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হয় না। অনেক ব্যাপারে কার্যকারণ থাকলেও, অনেক কিছুই ঘটে যার কোনো অর্থ নেই। এ জন্যই সম্ভবত ফরাসি অস্তিত্ববাদী দার্শনিক জা-পল সার্ত্রে মানুষের সংজ্ঞা দিয়েছেন ‘আ ইউজলেস প্যাশন’ বা এক অর্থহীন ভাবাবেগ বলে।

জাতিসত্তার দিক থেকে আমার মা বাঙালি ছিলেন না। তাঁর মাতৃপিতৃভাষা ছিল উর্দু। আমার নানা-নানি ছিলেন ভারতের উত্তর প্রদেশের ফয়েজাবাদের অধিবাসী। ১৯২৫-২৬ সালে উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়। সেই দাঙ্গার সময় আমার মা ছিলেন মায়ের পেটে। তখন দাঙ্গার উপদ্রব থেকে বাঁচতে আমার অন্তঃসত্ত্বা নানিকে নিয়ে নানা কলকাতা আসেন। আম্মার জন্ম কলকাতায়। নানা-নানি আর ফয়েজাবাদে যাননি। আম্মা কলকাতায় বেড়ে উঠলেও একটুও বাংলা জানতেন না। উর্দুই ছিল তাঁর একমাত্র ভাষা। ইংরেজি বুঝতেন ও কোনো রকমে পড়তে পারতেন। আমার দাদা ও তার পূর্বপুরুষ বহু শতাব্দী যাবত মানিকগঞ্জের অধিবাসী। আমাদের সেই গ্রাম এলাচিপুর তিরিশের দশকের শুরুতে পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে যায়। তখন কাছেই আর একটি বাড়ি করা হয়েছিল। সেই বাড়িতেই আমার জন্ম। সেটিই এখন নদীর মধ্যে। আরিচা পাটুরিয়া থেকে ফেরিতে পারাপারের সময় আমার বাড়ির উপর দিয়ে যেতে হয়।

সাপ্তাহিক : শৈশবে আপনাদের বাড়ির পরিবেশ কেমন দেখেছেন?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : শৈশবের বাড়ির পরিবেশের কথা বলার আগে একটি অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে চাই। একটি জিনিস আমি ভেবে দেখেছি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা আমার খুব বেশি পীড়িত করে। কোথাও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা শুনলে আমি বিচলিত হই। ছুটে যাই।

সাপ্তাহিক : সে তো দেখছিই। যে কোনো দুর্গত মানুষের পাশে আপনাকে...

সৈয়দ আবুল মকসুদ : যে কোনো দুর্গত এক কথা আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা অন্য জিনিস। যে কথা বলছিলাম, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্যে আমার মায়ের জন্ম। আমার জন্ম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়। এই কারণেই আমার ধারণা জন্মগতভাবে আমি সাম্প্রদায়িক বিবাদ-বিসম্বাদের প্রতি খুবই সংবেদনশীল। বাংলার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে একটি বই লেখার ইচ্ছা আমার বহুদিনের।

শৈশবের বাড়ির পরিবেশের কথা বলছিলেন। সেকালের যে কোনো গ্রামীণ মধ্যবিত্তের বাড়ির মতোই। ভিন্ন শুধু ওইটুকু যে গ্রামেও আমাদের বাড়িতে বই ও পত্রপত্রিকা পড়ার পরিবেশটা ছিল। আম্মা যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন বাড়িতে কলকাতা থেকে তিন ভাষার পত্রিকাই আসত। আম্মার জন্য উর্দু পত্রিকা। বাড়ির অন্যদের জন্য বাংলা, ইংরেজি। আব্বা, সৈয়দ আবুল মাহমুদ, পদ্যচর্চা করতেন। পত্রপত্রিকা পড়া ছিল প্যাশন। তখন রেডিও ছিল না। আগের দিনের কাগজ পরদিন বিকেলে শিবালয় আসত। গোয়ালন্দ থেকে বড় বড় স্টিমার আসত আরিচায়। তাতে ডাক আসত। সেই শিবালয় বা আরিচাঘাট নেই। নদীর মধ্যে। তা ছিল একটি বন্দরের মতো। সন্ধ্যার পরে আব্বা খবরের কাগজ নিয়ে বসতেন। পড়ে খবর অন্যদের বলতেন। শৈশবে অনেক দৈনিকের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা, স্টেট্সম্যান ও ইত্তেহাদ। পরে ঢাকার আজাদ, ইত্তেফাক ও মর্নিং নিউজ। সব কাগজ একসঙ্গে থাকত না। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। কিছুদিন একটা, তারপর আরেকটা। প্রতিদিন সন্ধ্যার আগে ডাকপিয়ন পত্রিকা ও চিঠিপত্র থাকলে তা নিয়ে আসতেন। প্রতিদিন তাকে দেখতে দেখতে তার সঙ্গে আমার ভাব হয়ে গিয়েছিল।

আমার গর্ভধারিণী মায়ের কথা বলেছি। তাঁর কোনো স্মৃতি নেই আমার। যে মা আমাকে লালনপালন করেছেন তাঁর কাছে আমার ঋণ অপরিশোধ্য। চৌদ্দ বছর বয়সে প্রথম জানলাম তিনি আমার আপন মা নন। কীভাবে তা সম্ভব? আমার আব্বা বিত্তবান ছিলেন না। কিন্তু সমাজকর্ম করায় এলাকায় তাঁর বিশেষ প্রভাব ছিল। মানুষ খুব ভালোবাসত। সেকালের মানুষ এখনকার মতো বিশ্বাস ভঙ্গ করত না। রাত একটার মধ্যে আম্মার দাফন হয়ে যায়। বাড়ির উঠানে ওই লেবুগাছের কাছে। জানাজার সময় আব্বা উপস্থিত জনতাকে একটি অনুরোধ করেন। তিনি বলেছিলেন, ঘরসংসার করতে আমাকে হয়ত কখনো আবার বিয়ে করতে হতে পারে। আপনারা আমার ছেলেটিকে দয়া করে বলবেন না যে ওর মা নাই। আত্মীয়স্বজন ও গোটা উপজেলার লোক আব্বার সেই অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। আরও রহস্যজনক যে আমার বিমাতারও কোনো সন্তানসন্ততি ছিল না। তিনি আমাকে এতই স্নেহ করতেন যে মাতৃস্নেহের অভাব কখনো বোধ করিনি। আমি যখন নবম শ্রেণীতে পড়ি তখন আব্বার অতি গোপনীয় কিছু কাগজপত্রের মধ্যে তাঁর একটি ডায়েরি পাই। সেখানে ১৯৪৮ এর ২০ নভেম্বরের এন্ট্রি থেকে জানতে পারি মায়ের মৃত্যু সংবাদ। তা জেনেও আমার বিশেষ খারাপ লাগেনি। তা নিয়ে আমি আর কারও সঙ্গে আলোচনা করিনি। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমার স্নেহময়ী বিমাতার জীবদ্দশায় মায়ের সম্পর্কে তাঁর মৃত্যু নিয়ে কারও সঙ্গে কোনো কথা বলব না। ১৯৮১-র মে’তে আমার এই আম্মা মারা যান। সেই দিনটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে শোকের দিন। তাঁর মৃত্যুরও কয়েক বছর পরে এক রাতে, বাড়িতে কেউ ছিল না, কাজের লোকও নয়, প্রবল বর্ষণ হচ্ছিল, আমি আমার মায়ের মৃত্যুর কথা তুলেছিলাম। আব্বা নীরব রইলেন। আমিও চুপ থেকে অন্য প্রসঙ্গে গেলাম। পরে চাচা-চাচি ও আত্মীয়স্বজনের থেকে আম্মা ও নানা-নানি সম্পর্কে জেনেছি।

সাপ্তাহিক : কীভাবে বেড়ে উঠলেন। শৈশবে পড়াশোনা প্রভৃতি...

সৈয়দ আবুল মকসুদ : আমি স্কুলে ভর্তি হয়েছি অনেক দেরিতে। একেবারে ষষ্ঠ শ্রেণীতে। আব্বা মানুষের কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত থাকতেন যে আমাকে পড়ানোর সময় তাঁর ছিল না। আমার হাতেখড়ি হয় আমাদের পারিবারিক নাপিতের হাতে ও পারিবারিক ডাক্তারের কাছে। সেকালে গ্রামীণ জীবনে ধোপা, নাপিত হতেন বংশানুক্রমিক। অতীতে কোনো এক সময় কোনো নাপিতকে দু’এক বিঘা জমি লিখে দেয়া হয়েছিল। তারপর বছরে ধানের মৌসুমে মণ দুই ধান দেয়া হতো। নাপিত সারা বছর বাড়ির সব লোকের, চাকরবাকরদের, সবার চুল কাটত। আমাদের নাপিতের নাম ছিল লোকনাথ শীল। কাকের মতো কালো ছিলেন দেখতে। কর্কশ তাঁর কণ্ঠস্বর। আমাকে পড়াতেন : আÑম, পড়ো-আম। সারাদিন তিনি গ্রামে গ্রামে ক্ষৌরকর্ম করতেন। বিকেলে আমাকে পড়াতেন। তাকে দেখলে বড়ই বিরক্ত হতাম। তিনি সেটা টের পেতেন। আব্বার ভয়ে কিছু বলতেন না। আব্বা যখন বলতেন, কী লোকনাথ, তোমার ছাত্র পড়ে ঠিকমতো? লোকনাথ কাকা বলতেন, আজ্ঞে, খুব ভালো করতেছে। মাথা তো ভালো। আসলে আমি ভালো করতাম না। আমার অমনোযোগ সহ্য করে কোনো রকমে ‘বর্ণবোধ’ ও ‘আদর্শলিপি’ তিনি শেষ করান। তারপর রাশি রাশি বাল্যশিক্ষা বই কলকাতা থেকে ছোট চাচা পাঠাতেন। ছোট চাচা ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এক উড়িষ্যার মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁর সহপাঠী ছিলেন ওই যে নিবারণ ডাক্তারের কথা বললাম, একাত্তরে শহীদ হন, তিনি আমাকে পড়াতেন। প্রত্যেক দিন নয়Ñ সপ্তাহে ৩-৪ দিন। আমার শিক্ষার ভিত্তি তিনি তৈরি করেন। তিনি একটি পয়সাও নেননি কোনোদিন। আমি তাঁর কাছে ঋণী। আমার মনে আছে, একদিন অপরাহ্ণে তিনি আমাকে পড়িয়ে যাচ্ছিলেন। আব্বার সঙ্গে কথা বললেন। আব্বাকে বললেন, দাদাবাবু ও তো কবি হবে, লেখক হবে। যখন তিনি এ কথা বলেন তখন কবি ও লেখক কি তা আমি জানতাম না। তারপরে আরও বহু শিক্ষকের কাছে আমি পড়েছি। তাঁরা বৈতনিক শিক্ষক। দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র। আমাকে গড়ে তুলতে কোনো বিশেষ ভূমিকা পালন করেননি।

সাপ্তাহিক : তারপর প্রথম কোন স্কুলে ভর্তি হলেন?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : ঝিটকা আনন্দমোহন হাই স্কুলে। তখন ওটা মানিকগঞ্জের ভালো স্কুল ছিল। তার হেডমাস্টার ছিলেন কালীপ্রসাদ ভৌমিক। তাঁর মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোনো ভাইস-চ্যান্সেলর যদি এখন আমাদের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পেত আমরা ধন্য হতাম। আমি ভালো ছাত্র ছিলাম না। তবু তিনি আমাকে স্নেহ করতেন। আমাদের স্কুলে ছিল লাইব্রেরি। তাতে বহু বই ছিল। তার যিনি চার্জে ছিলেন, সেই সংস্কৃতের পণ্ডিতের সঙ্গে আমি ভাব জমিয়েছিলাম। ওই ঘরে বসে বই পড়ার সুযোগ পেতাম। সেখানে আর বিশেষ কেউ যেত না। পাঠ্যবই মুখস্থ করায় আমার কোনো আগ্রহ ছিল না। তার পরিণতি অবশ্য ভালো হয়নি।

সাপ্তাহিক : ঢাকায় এলেন কখন?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য আমার চাচাত ভাইদের ঢাকায় বাসা নিতে হয়। ভাইয়েরা ছিলেন সাতজন। আমি একা। সবাই মনে করত এবং এখনও করে আমরা আট ভাই। পাকিস্তান আগে এবং পরেও কয়েক বছর আমাদের পরিবারের ঢাকার চেয়ে কলকাতার সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল বেশি। আত্মীয়স্বজনের বেশিরভাগই থাকতেন কলকাতায়। আমি জীবনে প্রথম ঢাকায় আসি বাহাত্তরের মার্চে। ভাষা আন্দোলনের পনের বিশ দিন পরে। তখন এবং ষাটের দশক পর্যন্ত আমরা যাতায়াত করতাম স্টিমার ও লঞ্চে। যা বলছিলাম। একুশে ফেব্রুয়ারির কয়েকদিন পরে ঢাকায় আসি। শহীদ রফিক ছিলেন মানিকগঞ্জের মানুষ। একুশে ফেব্রুয়ারির পরপরই গোটা দেশ শোকে নিমজ্জিত হয় এবং ক্রোধে ফেটে পড়ে। রফিককে নিয়ে আব্বা লিখেছিলেন একটি পদ্য। পনের ষোল পৃষ্ঠার মতো। সেই পদ্য ছাপতে ঢাকায় আসেন। আমাকেও নিয়ে আসেন। পাটুয়াটুলিতে আমাদের আত্মীয়দের কয়েকটি ছাপাখানা ছিল। স্বাধীনতার আগে তা ছিল কলকাতায়, ’৪৭-এর পর এক্সচেঞ্জ করে তাঁরা ঢাকায় আসেন। কবিতাটি নজরুলের অনুকরণে রচিত হয়েছিল। দুটি লাইন আমার মনে আছে। যেমনÑ

মহারম মাস আসিতে যদিও

এখনো অনেক দেরি,

আমার বাড়ির আঙিনায় আজ

কোন্ কারবালা হেরি।

ঢাকায় আমাদের বাসা ছিল লালবাগ শাহী মসজিদের কাছে শেখ সাহেব বাজারের সঙ্গে হরমোহন শীল স্ট্রিট। আমাদের বাসার উল্টো দিকেই ছিল রাশেদ খান মেননের শ্বশুরের বাড়ি। তিনি আমাদের প্রতিবেশী হওয়ায় তখন নয় পরবর্তীকালে ষাটের দশকে আমার রাজনৈতিক জীবন নির্মাণে উপকারই হয়েছিল। তাঁর বাড়িতে খুলনা থেকে কয়েকজন আত্মীয় আসতেন। তাঁরা ছিলেন মার্কসবাদী। তাঁদের থেকে মার্কসবাদের দীক্ষা নিই।

ঢাকায় আসি সন্ধ্যার পরে। ফতুল্লা থেকে দেখতে পাই নক্ষত্রের মতো রাশি রাশি আলো। ঢাকার আলো দেখে শিহরিত হই। পরদিন সকালে নাস্তা খেয়ে আব্বা ও আমার এক ভাইয়ের সঙ্গে বের হই। শহীদ মিনারের বেষ্টনী দেয়া জায়গাটি দেখি। সারা শহর শোকে দুঃখে থমথমে। ওখান থেকে মেডিকেল কলেজ, কার্জন হল, হাজী শাহবাজের মসজিদ ও মাজার, রমনা কালীবাড়ি দেখে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে এসে অনেকক্ষণ ঘুরে দেখি। এসব দেখে মনটা ভরে যায়। প্রথমবার দিন পাঁচেক ছিলাম ঢাকায়।



সাপ্তাহিক : রাজনীতি সম্পর্কে কখন সচেতনতা আসে?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : আমার বাবা ছিলেন রাজনীতিসচেতন মানুষ। সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। স্থানীয় নেতা। ১৯২১ সালে ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগে যোগ দিয়ে জেল খেটেছেন। ১৯৪৪-এর এপ্রিল পর্যন্ত কংগ্রেস করতেন। তারপর মুসলিম লীগে যোগ দেন। কিন্তু ফজলুল হকের প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ শ্রদ্ধা। বিশেষ করে কৃষকদের জন্য ঋণসালিসী বোর্ড করায় তাঁর প্রতি আব্বার শ্রদ্ধা ছিল গভীর। ১৯৫০ এ তিনি কৃষক প্রজা পার্টিতে যোগ দেন। তখন ওই দলের সাংগঠনিক অবস্থা ছিল দুর্বল। মুসলিম লীগের জোর বেশি, আওয়ামী লীগেরও উত্থান ঘটছিল। যে কোনো কারণেই হোক মওলানা ভাসানীর প্রতি আব্বা প্রসন্ন ছিলেন না। বলা চলে বিরূপ ছিলেন। অবশ্য তিনি মৃত্যুর আগে দেখে গেছেন তাঁর পুত্রই মওলানাকে নিয়ে গবেষণা করে বই লিখেছে। সে বই প্রকাশে তাঁরও কিছু ভূমিকা ছিল। মওলানাকে আব্বা মনে করতেন ছদ্মবেশী কমিউনিস্ট। যা হোক, নির্বাচনী রাজনীতি কি তা প্রথম দেখি চুয়ান্নর নির্বাচনের সময়। ওই সময় দেখি তিন জাতীয় নেতাকেÑ ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দী। তখন মানুষ একসঙ্গে বলত ‘হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী’। আমাদের বাংলা ঘরে বসে কর্মীরা সাদা কাগজে পোস্টার লিখতেন। ‘নৌকা মার্কায় ভোট দিন’। সেই কাগজ মসজিদ, ইস্কুলের দেয়ালে এবং বড় গাছের গুঁড়িতে সেঁটে দেয়া হতো। সেকালের নির্বাচন এখনকার মতো ছিল না। আমাদের এলাকায় লীগের জনপ্রিয় প্রার্থী রাজা মিয়া হেরে গিয়েছিলেন যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী কৃষক প্রজা পার্টির আবদুল লতিফ বিশ্বাসের কাছে। শিবালয় একটি প্রধান স্টিমারঘাট হওয়ায় বড় নেতারা সব ওই পথেই যাতায়াত করতেন। শেখ মুজিবকেও আমি তখনই প্রথম দেখি। ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়াকেও দেখি। অনেক নেতার মধ্যে মোহন মিয়াকে আব্বা শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। নির্বাচনের কয়েকদিন পর লতিফ বিশ্বাস কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী হন। তাঁকে মানিকগঞ্জ সিনেমা হলে সংবর্ধনা দেয়া হয়। আমার আব্বা কবিতার মানপত্র পাঠ করেন। তখন জানলাম মন্ত্রী কাকে বলে। মন্ত্রী হওয়ার আগে যিনি ছিলেন আমাদের কাছের মানুষ। রাতারাতি মন্ত্রিত্বের কারণে হয়ে গেলেন দূরের মানুষ। তাঁর কাছে যাওয়া যায় না আগের মতো। লতিফ বিশ্বাস বিএনপি নেতা এম কে আনোয়ারের শ্বশুর।

সাপ্তাহিক : সেইকালের রাজনীতি কেমন দেখেছেন। সমাজ কেমন ছিল। রাজনীতি কেমন বুঝতেনÑ সে সম্পর্কে কিছু বলুন?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : সেকালের রাজনীতি সম্পর্কে তো আমার কোনো অভিজ্ঞতা নাই। কোনো আগ্রহও ছিল না। কিছু কিছু অবস্থা সম্পর্কে জানা আছে। সমাজ এখনকার মতো ছিল না। পঞ্চাশের দশকের কথা বলছি। ভয়াবহ দারিদ্র্য দেখেছি। শতকরা ৭০ জন মানুষ অতি গরিব। একটার বেশি জামা ছিল না অধিকাংশ মানুষের। পঞ্চাশ ভাগ লোক জুতা কি জিনিস জানত না, অন্যকে পায়ে দিতে দেখেছে। প্রায় প্রতি বছর বন্যা হতো। ১৯৫০ সালের বন্যার কথা এবং ভূমিকম্পে আমাদের গাছপালা সব পদ্মা নদী দিয়ে বাংলাদেশে আসার দৃশ্য দেখেছি। আমাদের কাজের লোকরা সেই কাঠ নদী থেকে কুড়িয়ে স্তূপ করে রেখেছেন। ৭-৮ বছর ওই কাঠ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বন্যার সময় সব বাড়িতে পানি উঠত। আমাদের বাড়িতে চারবার পানি উঠেছে। দু’বার ঘরের ভেতরে। সে এক সাংঘাতিক অবস্থা। ঘরের মধ্যে সাপ নড়াচড়া করে। মাছ লাফায়। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে হয় পুল দিয়ে। অথবা ছোট ডিঙিতে। পঞ্চাশের দশকে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে কয়েকবার। সরকারি রিলিফের চাল আমাদের বাংলাঘর থেকে বিতরণ করা হতো। সেই যে ক্ষুধার্ত মানুষকে দেখেছি দু’সের চাল নিতে এসে সকাল থেকে দাঁড়িয়ে যেত। সে চালও অন্য রকম। সাদা ধবধবে। বার্মা বা মিয়ানমার থেকে আমদানি করা বরফের মতো সাদা। হাড় জিরজিরে সব মানুষ দেখে আমার জীবন সম্পর্কে একটা ধারণা হয়। পরে যে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় ঝুঁকি তা ওইসব দেখে।

সাপ্তাহিক : সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকলেন কখন, কিভাবে?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : পঞ্চাশের দশকে এখনকার মতো মিডিয়া ছিল না। দু’তিনটি দৈনিক ছিল তা খুব অল্প লোকে পড়ত। মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল না। কিন্তু অভাব থাকায় মানুষের মধ্যে সরকারের প্রতি ক্ষোভ ছিল। অন্যদিকে সেই ক্ষোভকে পুঁজি করে বিরোধী নেতারা রাজনীতি করতেন। ক্ষমতার রাজনীতির কামড়াকামড়ি। পাকিস্তানে প্রথম দিন থেকেই সেনাবাহিনী রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সেনাবাহিনী। তার পেছনে ছিল মার্কিন-ব্রিটিশ নয়া-সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। তারা জেনারেল আইয়ুব খানকে দিয়ে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়। ১৯৫৮-র ৭ অক্টোবর। কয়েকদিন ইস্কানদার মির্জা ক্ষমতায় ছিলেন। তারপর ২৭ অক্টোবর তাঁকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আইয়ুব নিজেই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। সে যে কী ক্ষমতা তা এখন বোঝানো সম্ভব নয়। আমাদের বাড়ির সংলগ্ন বিঘা দুই জমিতে শ’খানেক বছরের জঙ্গল ছিল। ওতে কেউ কোনো দিন হাত দেয়নি। সেই জঙ্গল সাফ করে ফেললাম আমরা তিন দিনে। কারণ মার্শাল ল’ শাসকদের থেকে জঙ্গল পরিষ্কারের হুকুম ছিল। যার বাড়িতে জঙ্গল ও যার পুকুরে ডোবায় কচুরিপানা পাওয়া যাবে তাকে বেত্রাঘাত। সারা দেশের কচুরিপানা সাত দিনে পরিষ্কার। অনেক রাজনৈতিক নেতাও বেত্রাঘাত খেয়েছেন। নারায়ণগঞ্জে কারও মাথায় গোবর গুলিয়ে ঢেলে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়েছে আর্মির লোক। কিন্তু এত অগণতান্ত্রিক আচরণের পরেও অল্পদিনেই আইয়ুব জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। বাংলাদেশের সব বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক তাঁকে প্রশংসা করে লিখেছেন। সেসব লেখা আমি পড়েছি। শুধু পড়ি নাই, কেটেও রাখতাম। আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের দল বেঁধে পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণ করিয়েছে আইয়ুব সরকার। তাঁরা খুব খুশি। এখন যেমন আওয়ামীপন্থি কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা খুব খুশি। এখনকার অনেকেও তখন আইয়ুব খান থেকে সুবিধা নিয়েছেন। সফরনামা লিখেছেন। শওকত ওসমান, মুনীর চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান, আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী প্রমুখ আইয়ুব সরকারের প্রথম দিকে সহযোগিতা দিয়েছেন। লেখালেখি করেছেন। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র চিরকালই এক রকম। এখন যা দেখছেন তখনও তাই ছিল। তখন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি লাহোর সফর করাকে তাঁরা স্বর্গযাত্রা মনে করতেন, এখন ভারতের দিল্লি বোম্বে সফরকে মনে করেন। চরিত্র বদলায় নাই। শুধু ভেন্যু বদল হয়েছে একাত্তরের পর।

সাপ্তাহিক : তা বামপন্থিদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ কিভাবে?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : সেটা আইয়ুব খানের আমলেই। ষাট-একষট্টিতে আমাদের এলাকায় কয়েকজন কমিউনিস্ট নেতা আত্মগোপন করা অবস্থায় যান। তাঁরা ছিলেন নিষিদ্ধ ঘোষিত পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। এক রাতে ঘিওর নন্দীবাড়িতে তাঁদের সঙ্গে কথা হয়। রাশিয়ার ও চীনের সমাজতন্ত্রের ইতিহাস বলেন। তার আগে আমি ওই দুই সমাজতান্ত্রিক দেশের বিপ্লব সম্পর্কে জানতাম না। শুনে সেই যে সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হই, আজো একই রকম আছি। তারপর ষাটের দশকে খোকা রায়, অনিল মুখার্জি, জ্ঞান চক্রবর্তী প্রমুখ নিবেদিত বাম নেতাদের কাছে থেকে দেখার সুযোগ পাই। আরও পরে দেবেন সিকদার, অমল সেন, মোহাম্মদ তোয়াহা, আবদুল মতিন, আলাউদ্দিন আহমদ প্রমুখের রাজনীতিতে আকৃষ্ট হই।

সাপ্তাহিক : বাম ছাত্ররাজনীতিতে কখন থেকে যুক্ত হলেন। কী ভাবে?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : আমাদের বড় ভাইদের কেউ কেউ ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে শুরু থেকেই যুক্ত ছিলেন। তাঁদের কথাবার্তায় অনুপ্রাণিত হয়েছি। এর মধ্যে হামদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করেন। আমাদের প্রবেশিকা পরীক্ষা সামনে। শুরু হলো আন্দোলন। ওই আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হই। কয়েক মাস আন্দোলন উত্তেজনা চলেছে। নেতৃত্ব দিলেন কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরীরা বাম ছাত্রদের দিক থেকে। এর মধ্যে আজাদ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক এম. আনিসুজ্জামান একদিন কার্ল মার্কসের ক্যাপিটাল বইটি দেখান। তাঁর বাসাও আমাদের বাসার কাছেই শেখ সাহেব বাজার ছিল। মেনন ভাইয়ের শ্বশুরের কয়েকজন আত্মীয় খুলনা থেকে প্রায়ই আসতেন। তাদের সঙ্গে আমরা বারান্দায় বসে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করতাম। এইভাবেই ওই রাজনীতির একজন কর্মীতে পরিণত হই। ১৯৬৪-তে একবার ছাত্র ইউনিয়নের এক মিছিল থেকে অনেকের সঙ্গে আমি গ্রেফতারও হয়েছিলাম। আমাদের মামলার জামিনের ব্যবস্থা করেছিলেন আইনজীবী জহীর উদ্দিন, খন্দকার দেলোয়ার হোসেন প্রমুখ। জহীর উদ্দীনকে স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে বাংলাদেশের প্রথম হাইকমিশনার নিয়োগ দেন।

সাপ্তাহিক : যা আপনার প্রধান কাজের ক্ষেত্র সেই সাহিত্য সম্পর্কেই জানা হলো না। কখন থেকে সাহিত্যচর্চা করছেন। কখন প্রথম লেখা ছাপা হয়?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : কবে থেকে লিখছি তা স্মরণ নেই। অতি ছোটবেলায় লেখালেখি শুরু করি। কবিতা-টবিতা লিখেছি। একটু বড় হয়ে গল্প লিখি। যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন রবীন্দ্রনাথের চৈতালি কাব্যগ্রন্থের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ওই ধরনের একটি কবিতার বই লিখেছিলাম। তখন থাকতাম ইছামতি নদীর তীরে। প্রথম কবিতা ছাপা হয় সাপ্তাহিক পাক জমহুরিয়াত পত্রিকায়। একটি কবিতা। সেটা ১৯৬১-র অক্টোবরে।

সাপ্তাহিক : গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কখন যুক্ত হলেন?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : ষাটের দশকে আইয়ুব খানের শাসনামলে। পাকিস্তানে তখন দুটি ধারায় আন্দোলন হচ্ছিল। একটি শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। আর একটি মওলানা ভাসানী ও বামদের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। আমি বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সমর্থন করতাম। তাতে ছয় দফারও সমর্থনের প্রশ্ন আসত। তবে প্রধানত ছিলাম বাম সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে, স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। তোয়াহা সাহেবের সঙ্গে কাজ করি কিছুদিন। ’৬৮-৬৯-এর দিকে। এই করতে করতেই এলো ঊনসত্তরের গণআন্দোলন। তারই ধারাবাহিকতায় একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের কমান্ডার ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী বাম চিন্তাধারার ছিলেন। মস্কোপন্থি ন্যাপ করতেন। বাহাত্তরে অনেকেই খেতাব পেলেন। হালিম চৌধুরীকে কোনো খেতাব দেয়া হলো না। কারণ তিনি আওয়ামী লীগ করতেন না। তিনি মনে কষ্ট পান। আমরাও পাই। তাঁর সঙ্গে বাহাত্তরে বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গেছি। বঙ্গবন্ধু তাঁকে মূল্যায়ন করলেন না।

সাপ্তাহিক : নারীর নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ প্রভৃতির বিরুদ্ধে আমাদের নারী নেত্রীদের সঙ্গে আপনাকেও প্রতিবাদ মানববন্ধন সভা-সমাবেশ করতে দেখা যায়। কখনো নির্যাতিতের বাড়িতেও ছুটে যান। আমাদের নারীবাদীদের সম্পর্কে কিছু বলুন। বাংলাদেশের নারীবাদী আন্দোলন সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : নারীর সামাজিক অর্থনৈতিক প্রভৃতি অধিকার নিয়ে কথা বলা আর নারীবাদী আন্দোলন এক জিনিস নয়। পশ্চিমের নারীবাদী আন্দোলনের দার্শনিক ভিত্তি রয়েছে। পশ্চিমেও নারী হাজার হাজার বছর গৃহবন্দী ছিল। অধিকারবঞ্চিত ছিল। ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ পৃথিবীর দুর্বল জনগোষ্ঠী থেকে শোষণ করে সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে তাদের দেশকে সমৃদ্ধ করেছে। সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনের চর্চা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা একের পর এক যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচন এবং জীবন ও জগৎ নিয়ে দার্শনিকরা অবিরাম কাজ করেছেন। রচিত হয়েছে মহান সাহিত্য। চিত্রকলা সঙ্গীতে চূড়ায় উঠে গেছে পশ্চিম ইউরোপ। আবির্ভাব ঘটেছে আইজাক নিউটনের মতো মহান দার্শনিকের। শেক্সপীয়ার, মিল্টন, এডমুণ্ড স্পেন্সার, ক্রিস্টোফার মার্লো, জন ড্রাইডেন, জনাথন সুইফ্ট, আলেকজাণ্ডার পোপ, বায়বন, শেলী, কীট্স জন্মগ্রহণ করেন ব্রিটেনে। জার্মানিতে তারকার শেষ নেই। সেই ষোল শতকে নিকোলা কপার্নিকাসের মতো বিজ্ঞানী, মার্টিন লুথারের মতো সংস্কারক, জোহানেস কেপলারের মতো জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বাখ্ বা বিথোফেনের মতো সঙ্গীতজ্ঞ; গোয়েটে ও শিলারের মতো কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকার; কান্ট, হেগেল, লেসিং, লাইবনিজ, শোপেনহাওয়ার বা নীৎসের মতো দার্শনিক। ব্রিটেনে কত বড় বড় দার্শনিক। বেকন, বার্কলি, হিউম, মিল, বেনথাম, লক্ প্রমুখ। আবির্ভাব ঘটেছে হল্যান্ডে যুগান্ত সৃষ্টিকারী দার্শনিক দেকার্তে-এর। আরও অগণিত প্রতিভা। ইতালীয় রেনেসাঁর কথা বাদই দিলাম, আঠার শতকের জ্ঞানবিভাসিত যুগ বা এজ অব এনলাইটেনমেন্টের পরেও ইউরোপে নারীর অবস্থা শোচনীয়ই ছিল। তাদের অধিকার ছিল না। শিল্পবিপ্লব হলো কিন্তু নারী তার আগের অবস্থানেই পড়ে রইল। দেশে দেশে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো। কিন্তু সেখানে নারীর মতামতের মূল্য ছিল না। তাদের ভোট দেয়ার অধিকার ছিল না। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছিল না। সামাজিক স্বাধীনতা ছিল না। ওই প্রেক্ষিতে ইউরোপে নারীর মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আবির্ভাব ঘটে নারীবাদীদের। তাঁরা বললেন, নারীর প্রধান পরিচয় সে মানুষ। তার যোগ্যতা লিঙ্গনিরপেক্ষ। পুরুষের যে যোগ্যতা তারও সেই যোগ্যতা আছে। তাকে দমন করে রাখা হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্বার্থে। হরণ করা হয়েছে তাঁর মানবিক অধিকার। সে পুরুষের ভোগ্যদ্রব্য। নারীর শরীরই যেন নারী। যেন তার অন্য সত্তা নেই। এর প্রতিবাদে সেখানে নারীবাদী আন্দোলন।

পশ্চিমী নারীবাদী আন্দোলনের জননী মেরী ওলস্টোনক্র্যাফ্ট। তিনি আঠার শতকের শেষ অর্ধেকের মানুষ। কার্ল মার্কসের ক্যাপিটাল যেমন বদলে দেয় পৃথিবীর রাজনীতির চরিত্র, তেমনি মেরীর ভিন্ডিকেশন অব দ্য রাইট্স অব উইম্যান নারী জাতির স্বাধীনতার ইশতেহার। তার আগে নারীর অধিকার ও স্বাধীনতা নিয়ে আর কেউ অত জোরালোভাবে বলেনি। বইটি প্রকাশের পর প্রগতিবাদী অনেকে তাঁর প্রশংসা করেন। তাঁকে অভিনন্দন জানান। রক্ষণশীলরা খুব স্বাভাবিকভাবেই ক্ষিপ্ত হন। বইটি যখন লেখেন তখন মেরীর বয়স ৩৩ মাত্র। ১৭৯২ সালে প্রকাশিত হয়। পাঁচ বছর পর তিনি মারা যান। কিন্তু নারী জাতির মধ্যে জ্বালিয়ে দিয়ে যান যে আগুন তা আজও নির্যাতিত নারী সমাজকে আলো দিচ্ছে।

মেরীর রাইট্স অব উইম্যান যখন বের হয় তখন পৃথিবীতে দেশে দেশে পুরুষদেরও বড় বড় আন্দোলন চলছিল। যুগান্ত সৃষ্টিকারী সব রাজনৈতিক ও সংস্কারমূলক আন্দোলন। আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছে তার কয়েক বছর আগে। তা সংহত করার চেষ্টা চলছে ব্যাপকভাবে। ইউরোপে আসছে জাগরণ। মেরীর এক শ বছর পরে বাংলাদেশে আবির্ভাব বেগম রোকেয়া, খায়রুননেসা খাতুন প্রমুখ নারী নেত্রীর। আমাদের যে নারী আন্দোলন তা বেগম রোকেয়া ধারার আন্দোলন। তার সঙ্গে নতুন যুগের নতুন উপাদান যোগ হয়েছে। পশ্চিমের অনুসরণ ও অনুকরণ করছেন। আমাদের নেত্রীরা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা পর্যালোচনা করেননি। করার প্রয়োজন মনে করেন না।

বেগম রোকেয়া বা বেগম সুফিয়া কামাল নারীর শিক্ষা, স্বাধীনতা, অধিকারের জন্য আন্দোলন করেছেন। তাঁরা কোনো এনজিওর মালিক ছিলেন না। নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলেন যাঁরা তাঁরা সবাই এনজিওর মালিক। বাংলাদেশে এনজিও এক মধুর নাম। সেই মধুর স্বাদ যে একবার পেয়েছে সে নানা বিষয়েÑ যেসব বিষয়ে ইউরোপ আমেরিকা থেকে অর্থ পাওয়া যায়Ñ সেই বিষয়েই কাজ করবে। আমাদের এনজিওর যে মধু তা ইউরোপের ফুল থেকে সংগ্রহ করা হয়।

বেগম রোকেয়া ও তাঁর অনুসারীরা ছিলেন উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত নারীদের নেত্রী। তাঁরা তাঁদের শ্রেণীরই প্রতিনিধিত্ব করেন। সব শ্রেণীর নারীর জন্য তাঁদের উদ্বেগ নেই। রোকেয়াও কিষানী, জেলেনী প্রভৃতি ছোটলোকদের নিয়ে কাজ করেননি। বরং তাঁদের থেকে থেকেছেন দূরে।

নারীর সমস্যা নিয়ে কাজ করে এমন এনজিওর সংখ্যা আজ বাংলাদেশে অনেক। এনজিও একটা ব্যবসা, স্রেফ বাণিজ্যিক ব্যাপার। টাকাপয়সা বানাবার উপায়। আজকাল অনেকে অন্য ব্যবসা না করে এনজিওতে নামেন। অন্য ব্যবসা করতে গেলে পুঁজি নিজেকে জোগাড় করতে হয়। কিছু বিক্রি করে বা ধার করে ক্যাপিটাল সংগ্রহ করতে হয়। নারী বিষয়ে হোক বা অন্য বিষয়ে হোক এনজিও গড়লে ফান্ডের চিন্তা নাই। বিদেশ থেকে পাওয়া যায়। নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে আজকাল মাইক্রোক্রেডিট দেয়া হয়। বড়লোক ভদ্রমহিলারা গরিব নারীদের মধ্যে ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে মনে করেন তাদের বড় উপকার করলেন। সে হিসেবে তো বড় নারীবাদী ড. ইউনূস। এগুলোকে নারীবাদ বলে না। এর নাম সুবিধাবাদ। নারী সংগঠনগুলোর নেত্রীরা আজ বিপুল সম্পদের মালিক। দামি গাড়ি হাঁকান। পঞ্চাশ লাখ টাকার জিপে চড়ে সারা দেশ ঘুরে নারীর দারিদ্র্য মোচনের কথা বলেন। নারীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারের কথা বলেন। এসব কথার সামান্য দাম আছে। খুব বেশি দাম নেই। মধ্যবিত্ত নারীর বেশি বেশি চাকরি চাই, কোটা চাই, প্রমোশন চাইÑ এসব নারীবাদ নয়। শিক্ষিত মধ্যশ্রেণীর নারীর সুবিধাবাদ। তাঁরা বৈষম্যের অবসান চান। বৈষম্যমূলক আইনের সংশোধন চান। তাঁরা সম্পত্তিতে ছেলের সমান চান। এসব দাবি ন্যায়সঙ্গত। কিন্তু যে নারী ফুটপাতে বসে সারাদিন ইট ভাঙে, ইটের ভাটায় মাথায় করে টুকরিতে মাটি টানে, গ্রামের ক্ষেতখামারে কাজ করেÑ তাদের জন্য আমাদের মধ্যশ্রেণীর নারীনেত্রীদের উদ্বেগ নেই। তবে গরিব কারও অত্যাচার হলে, ধর্ষণ-নিপীড়ন হলে, এসিডে ঝলসালে তাঁরা প্রতিবাদ করেন। ওগুলো করতে হয় তাঁদের এনজিও চালানোর স্বার্থেই। নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলে, সেমিনার করে, আজ কোটিপতি হওয়া যায়। কিন্তু বেগম রোকেয়া নিজের অর্থসম্পদটুকু বিলিয়ে দিয়ে নিঃস্ব অবস্থায় মারা গেছেন, সুফিয়া কামালও এনজিও করে অর্থ বানাননি। সাদাসিধা জীবনযাপন করেছেন।

বাঙালি আজ আর এক নতুন মধুর সন্ধান পেয়েছে। বিদেশ ভ্রমণ। বাঙালি নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলার জন্য আমাদের এনজিও মালিকরা বিরামহীন বিদেশ ভ্রমণ করছেন। সমস্যা বাঙালি নারীর, তাঁরা ছুটছেন জেনেভা, লন্ডন, ব্রাসেল্স, টোকিও, নিউইয়র্ক ও স্কেনভিনেভিয়ার দেশগুলোতে। সেখানে গিয়ে টাকার ব্যবস্থা হচ্ছে তাদের এনজিওর। আর আসার সময় বড় বড় স্যুটকেস ভরে যাচ্ছে পরিবার-পরিজনদের জন্য কাপড়চোপড় প্রভৃতিতে। বিদেশে ঘন ঘন যাতায়াত করলে আত্মীয়স্বজনের কাছে মর্যাদা বাড়ে। বেগম রোকেয়া বিদেশে যাননি। আজকাল যাতায়াতের সুবিধা যখন আছে, বিদেশি স্পনসর যখন পাওয়া যায় তখন বিদেশে যাওয়া দোষের নয়। কিন্তু সমস্যা বাঙালি নারীর। কাজটা করতে হবে বাংলাদেশেই। গ্রামেগঞ্জে ঘুরে ঘুরে।

সাপ্তাহিক : তা হলে আমাদের নারী আন্দোলনের সমস্যাটা কোথায়? এর থেকে উত্তরণের উপায় কী?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : নারীমুক্তির জন্য গোটা সমাজের পরিবর্তন দরকার। পুরনো রাষ্ট্রব্যবস্থা, পুঁজিবাদী রাজনীতি, পুরনো সমাজ রেখে নারীর মুক্তি সম্ভব নয়। আমাদের নেত্রীরা পুরনো সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা ভাঙার কথা বলেন না। তাঁরা পুরনো ব্যবস্থা রেখে সেখান থেকে শাসকদের চাপ দিয়ে সুবিধা আদায় করতে চান। যতটা সুবিধা আদায় করা যায়Ñ সেটাই আমাদের নারী আন্দোলন। আমাদের নেতারা তাদের প্রগতিশীলতা প্রকাশ করতে কিছু গরম কথাবার্তা বলেন। পুরুষের কিছু অন্যায্য সুবিধা খর্ব করার কথা বলেন। ওতে নারী সমাজের কোনো লাভ নাই। লাভ খুব অল্পসংখ্যক উচ্চশ্রেণীর নারীর। কোনো মহিলা কোনো একটি বড় পদ পেলে তাঁরা খুশি হন। নারীসমাজের তাতে কিছু যায় আসে না।

নারীর মুক্তির জন্য সামাজিক সম্পর্কের ধারণায় আসতে হবে পরিবর্তন। তাও আসছে কিছু কিছু। আরও আসবে। সমাজ বসে থাকে না। নানাভাবে বদলায়। অনেকের দ্বারা বদলায়। নারী আন্দোলনের সমস্যার কথা বা সীমাবদ্ধতার কথা বলছেন। সীমাবদ্ধতা অনেক। এটা হলো ব্যবসা-বাণিজ্যের যুগ। এনজিওর মাধ্যমে নারী আন্দোলন করলে বিদেশের টাকা পাওয়া যায় বলেছি। বিদেশ সফর করার মওকা হয়। এভাবে হবে না। সমাজবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা ছাড়া নারীর মুক্তি নেই। নারীমুক্তি আন্দোলন হতে হবে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশ। আমাদের সমাজে নারীর মতোই শোষিত শ্রমিক-কৃষক প্রভৃতি শ্রমজীবী শ্রেণী। সব শোষণ বলবৎ রেখে নারীকে শোষণমুক্ত করার চিন্তা ভুল। আমাদের বিদেশি অর্থে চালিত নারীনেত্রীরা চান পুঁজিবাদী ব্যবস্থাও থাকুক এবং তা থেকে নারী কিছু সুবিধা পাক।

তা ছাড়া আর একটি জিনিস আমাদের নারীমুক্তির পথে বড় বাধা। অধিকাংশ এনজিওর নারীনেত্রীরা দলীয় সুবিধাবাদী রাজনীতিতে লিপ্ত। কেউ আওয়ামী লীগপন্থি, কেউ বিএনপিপন্থি, কেউ মৌলবাদী জামায়াতপন্থি। আওয়ামীপন্থি নারীনেত্রীরা মনে করেন তারা প্রকাণ্ড প্রগতিশীল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বিএনপি-জামায়াতপন্থি নেত্রীরা সরকারের সমালোচনা করেন। আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল কাজগুলোরও বিরোধিতা করেন। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগপন্থিদের তৎপরতা বাড়ে। দিনাজপুরের ইয়াসমিন হত্যাকাণ্ড নিয়ে তাঁদের ভূমিকার কথা স্মরণ করা যায়। তাঁরা সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করেন। ওই সময় আমি চীন সরকারের আমন্ত্রণে বেইজিং গিয়েছিলাম এক প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়ে। বেইজিংয়ে বিশ্ব নারী সম্মেলন তখনই শেষ হলো। বিমানবন্দরে গিয়ে দেখি বাংলাতে লেখা প্লাকার্ড ‘ইয়াসমিন হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।’ নেত্রীরা দেশে ফিরছিলেন। ওই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও গিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের নেত্রীরাও। আওয়ামীপন্থি এনজিও নারীনেত্রীরা দেশের রাজনীতি সেখানে নিয়ে গেছেন। সন্ধ্যাবেলা রাষ্ট্রদূত মোস্তাফিজুর রহমান বললেন, নারী সম্মেলনেও আওয়ামী-বিএনপির রাজনীতি। তিনি মুক্তিযুদ্ধপন্থি ছিলেন। তবুও বিব্রতবোধ করেছেন স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির সেদিনের নারী সম্মেলনে ভূমিকায়। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেই দল বেঁধে গিয়েছিলেন। এভাবে নারীমুক্তি আসে না। দলের ক্যাডার হলে নারীনেত্রী হওয়া যায় না। ইয়াসমিনের মতো আরও কত হতভাগিনী একইভাবে সম্ভ্রম ও জীবন দিচ্ছে। সে সম্পর্কে নারীনেত্রীরা রাজপথ উত্তাল করেন না। মৃদু রুটিন প্রতিবাদটুকু করেন বা করেন না। কারণ তাতে তাদের পছন্দের দল বিব্রত হবে।

আমাদের নারীমুক্তির পথে আরেক বাধাÑ সবচেয়ে বড় বাধা মৌলবাদÑ ইসলামি মৌলবাদ। আজকাল তাদেরও বহু এনজিও আছে। তারাও নারীনেত্রী। তারা নারীকে ইসলামি জীবনযাপনের কায়দা শেখান। হেজাব-বোরকার উপকারিতা ও আবশ্যকতার কথা বলেন। গরিবদের মধ্যে বোরকা বিনামূল্যে বিতরণও করেন। নারীকে এমন সব উপদেশ দেন যাতে গত একশ বছরে যা অর্জিত হয়েছে তা নস্যাৎ হয়ে যায়। আজ আমাদের গ্রামগুলো ভরে গেছে ধর্মান্ধ কাঠমোল্লায়। তার সঙ্গে যোগ হয়েছেÑ আগে যা ছিল না তাইÑ মহিলা মোল্লানী। এরা আমাদের অশিক্ষিত অল্পশিক্ষিত মেয়েদের মধ্যযুগে নিয়ে যেতে চান। বাইরে যেতে বারণ করেন। নারীশিক্ষার বিরোধিতা করেন। আমাদের একশ্রেণীর এনজিও নারীশিক্ষা, নারীর স্বাস্থ্য প্রভৃতি নিয়ে পল্লী এলাকায় কিছু কাজ করছে। মেয়েরা এনজিও কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার একটি ইতিবাচক দিক আছে। তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার কথা ভাবছে। মৌলবাদীরা তাদের বাধা দেন।

আমাদের নারী আন্দোলনের আর একটি সমস্যা আছে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-ধর্মীয় পরিবেশের কথা বিবেচনা না করে এনজিওর কর্মীরা অতি প্রগতিপনা দেখাতে গিয়ে এমন সব বুদ্ধি মেয়েদের দেন তাতে উপকারের চেয়ে ক্ষতি হয়। এমনও আমি শুনেছি কোনো কোনো এলাকায় সংসার পর্যন্ত ভেঙে গেছে। এনজিওবাদীরা বলেন, তোমার সংসার ভাঙলে ক্ষতি কি? তুমি যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হও কোনো সমস্যা নেই। এতে সাংসারিক সমস্যা শুধু নয়, সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। নারীর নগ্নতা নিয়ে তাঁরা কিছু বলেন না। মনে করেন ওসব আধুনিকতা। এনজিওবাদীদের বিদ্যাসাগরদের কার্যকলাপ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। তারা পশ্চিমীদের শিখিয়ে দেয়া কথা বলেন। পশ্চিমের অনুকরণ করে এনজিওবাদীরা নারীমুক্তি আনতে পারবেন না। এনজিওবাদ আর নারীবাদ দুই জিনিস।

সাপ্তাহিক : রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিসহ যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপনার নেতৃত্বে ছাত্র-যুব সমাজের শহীদ মিনারে আন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলনটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ, আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম প্রমুখ ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, ‘সৈয়দ আবুল মকসুদকে বাংলাদেশের আন্না হাজারে হতে দেব না।’ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলায় সাধারণ মানুষ বলছিল আপনি বাংলাদেশের আন্না হাজারে। তখন ভারতে আন্না হাজারেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক গণআন্দোলন করছিলেন। কিন্তু আপনি আন্দোলনকে বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যাননি। টিআইবিসহ বিভিন্ন সংগঠন বলছে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে সেরা। এ সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : ঈদের দিন শহীদ মিনার থেকে সমাবেশ করে যে আন্দোলন আমরা শুরু করি তাতে ব্যাপক জনসমর্থন ছিল। ওই আন্দোলন থেকে যে বার্তাটি জনগণ পায় তা হলো বাংলাদেশে দুর্নীতি হচ্ছে এবং তার প্রতিবাদও হচ্ছে। আমাদের ওই আন্দোলনের সময়ই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে ঘুষের অভিযোগ আনে। প্রধান অভিযুক্ত আবুল হোসেন। প্রকৃতপক্ষে আবুল হোসেন একা নন। তারা অনেকে। দুর্নীতিবাজদের বাঁচানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান সবাই তৎপরতা দেখান। তাতে জনগণ বুঝতে পারে একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সবাই মিলেমিশেই দুর্নীতি করেন। আমরা দুর্নীতির অভিযোগ করায় সরকার ক্ষিপ্ত হয়। বিশেষ করে আমার উপরে। অথচ অভিযোগটি ছিল সব সৎ মানুষের। আন্না হাজারে ভারতে যে আন্দোলন করেন তাতে ত্রুটি ছিল। তিনি একজন নিষ্ঠাবান গান্ধীবাদী। বারো বছর আগে দিল্লিতে তাঁর সঙ্গে আমি এক ঘরে এক সপ্তাহ ছিলাম। তখন তিনি বিখ্যাত হননি। সততার পরাকাষ্ঠা। কিন্তু কেজরিয়ালসহ তাঁর সঙ্গের অনেকেই নির্মল চরিত্রের মানুষ নন। কেজরিয়ালের রাজনৈতিক উচ্চাশা ধরা পড়ে। কোনো রাষ্ট্রের দুর্নীতি, সরকারে উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি ব্যক্তিবিশেষের আন্দোলনে দূর করা সম্ভব নয়। আন্দোলন শুধু সমাজের চেতনায় নাড়া দিতে পারে। জনমত গঠনে সহায়ক হয়। কিন্তু দুর্নীতি কেন ব্যাপকতা পায় তার কারণ খুঁজে বের করে তা দূর না করে দুর্নীতি দূর করা যায় না। টিআইবি বিদেশি শক্তির সহায়তায় যে কাজটা করে, দুর্নীতিতে এক নম্বর দুই নম্বর মার্কা দেয়া, ওটা একটা ছদ্মবেশী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কাজ। তাদের ওই রিপোর্টে দুর্নীতি কমা-বাড়ার ব্যাপারে কোনো ভূমিকা রাখে না। কিছু হৈচৈ হয় মাত্র। তাদের জরিপের কথা কাগজে ফলাও করে বের করে। কর্তাদের সাক্ষাৎকার কয়েকদিন ধরে ছাপা হতে থাকে। দেশ সম্পর্কে দেশের মানুষের মধ্যে একটি নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ সরকারকে চাপে রাখতে বিদেশি প্রভুদের তা কাজে লাগে। সরকারকে বিব্রত করা হয়। সরকারি খাত তো অবশ্যই দুর্নীতিবাজ। লুটপাটের আখড়া। কিন্তু আমাদের দেশে বেসরকারি খাতে যে দুর্নীতি হয়, যে দুর্নীতির সঙ্গে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো জড়িত, সে সম্পর্কে টিআইবি নীরব। কে না জানে পুলিশ, বিচার বিভাগ, শিক্ষা বিভাগ, রেলওয়ে প্রভৃতি প্রায় সব বিভাগে দুর্নীতি হচ্ছে না? ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালকে কে টাকা দেয় জানি না। আমেরিকার টিআইকে টাকা দেয় সে দেশের কর্পোরেট সংস্থাগুলো। যেমন লকহিড, বোয়িং প্রভৃতি। শেভরনের মতো মহাদুর্নীতিবাজ প্রতিষ্ঠানও দেয়। কর্পোরেট দুর্নীতি সম্পর্কে টিআইবি কিছু বলে না। লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংস করে শেভরন। জনগণ এবং আমরা জাতীয় কমিটি থেকে প্রতিবাদ করলেও শেভরন প্রভৃতি দুর্নীতিবাজ বহুজাতিক কোম্পানি সম্পর্কে টিআইবি নিশ্চুপ। বিশ্বব্যাংক একটি দুর্নীতিবাজ অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সংস্থা। তার এজেন্ট রয়েছে দেশে দেশে বাংলাদেশেও। আমলা, খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ প্রমুখ বিশ্বব্যাংকের স্থানীয় এজেন্ট। এই গোত্রটি একটি মুৎসুদ্দি শ্রেণী। পরজীবী।

সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে পৃথিবীর বহু সম্ভাবনাময় দেশকে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’, ‘অকার্যকর রাষ্ট্র’ ভধরষবফ ংঃধঃব বানানোর ষড়যন্ত্র বহুদিনের। সে এক বিরাট নীলনকশা। ভারতবর্ষসহ যেসব দেশ এক সময় বহুদিন পশ্চিমী উপনিবেশ ছিল সেখানে নিচের দিকে দুর্নীতি শুরু হয় তখন থেকেই। দেড় শ বছর আগে একজন দারোগা ঘুষ খেতেন দুই চার টাকা। আজ থানার ওসি একটি খুনের মামলায় ঘুষ খায় দুই কোটি টাকা। তফাৎটা রকমগত বা গুণগত নয়, পরিমাণগত। সরকারি খাতের দুর্নীতি নিয়ে হৈচৈ একটি আন্তর্জাতিক কৌশল। বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা, যেখানে লুটপাট হবে বেশি। কানাডীয় কোম্পানি নাইকো মাগুরছড়ায় ১২ হাজার কোটি টাকার গ্যাস ধ্বংস করে। তার কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করছি আমরা। সরকার সে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারে না। টিআইবি সে সম্পর্কে চুপ। নিচের আদালত প্রাঙ্গণে যে দুর্নীতি হয় তাতে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, থানার দুর্নীতিতেও তাই। কিন্তু বিশ্বব্যাংকসহ বিদেশি সাহায্যপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলোর দুর্নীতিতে বিদেশিরাও জড়িত।

সাপ্তাহিক : তা হলে আপনি বলতে চাইছেন, টিআইবি বা ওই জাতীয় প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিবিরোধী তৎপরতায় দেশের সার্বিক অবস্থার কোনো উন্নতি হবে না। তা হলে উপায় কী?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : টিআইবির সঙ্গে দেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিরা জড়িত। ব্যক্তিগতভাবে তাঁরা আমার ঘনিষ্ঠ। ভালো মানুষও। কিন্তু তাঁদের অনেকের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ আছে। তাঁদের ক্ষমতার জন্য আগ্রহ থাকা অস্বাভাবিক নয়। রাজনীতিকদের হেয় করে যদি অরাজনৈতিক বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত কোনো সরকার বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গৃহীত হয়, তা হতে পারে রাজনৈতিক দলের নেতাদের অনৈক্য ও কোন্দলের কারণে, তা হলে টিআইবির সঙ্গে যাঁরা যুক্ত তাঁদের কেউ কেউ যোগ দিতে পারেন সেই সরকারে। কিন্তু আমি নিশ্চিত ওই ধরনের সরকার বাংলাদেশ থেকে ১০ ভাগ দুর্নীতিও কমাতে পারবেন না। হয়ত তাঁরা নিজেরা দুর্নীতি করবেন না। ব্যাপারটা সিস্টেমের। সিস্টেম না বদলালে কিছুই বদলায় না। দুর্নীতি দমন কমিশনের কোনো কোনো কর্মকর্তার দুর্নীতির অভিযোগের কথা কাগজে পড়েছি।

পাকিস্তানি আমলে যতটা দুর্নীতি ছিল, স্বাধীনতার পরে দুর্নীতি আরও বাড়ে। অঙ্গীকার ছিল কমানোর। মুজিব সরকারে দুর্নীতি ছিল। আমেরিকা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তাঁকে সরিয়ে দেয়। বসায় এক পুতুল সরকারকে। তারপর আসে জিয়া সরকার। তারা মুজিব সরকারের অনেক নেতাকে দুর্নীতির অভিযোগে জেলে ঢোকায়। মোশতাকও জিয়ার সময় জেল খেটেছেন দুর্নীতির অভিযোগে। জিয়া ব্যক্তিগতভাবে সৎ ছিলেন। সে জন্য দেশে-বিদেশে তাঁর খ্যাতি হয়। কিন্তু তাঁর সরকার ছিল মুজিব সরকারের মতোই বা তার চেয়েও বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। কারণ তাঁর সময় বিদেশি সাহায্যের পরিমাণ ছিল বেশি। দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করেন জেনারেল এরশাদ। এরশাদ সরকারকে আমেরিকা, বিশ্বব্যাংক, পশ্চিমী পুঁজিবাদী দাতাগোষ্ঠী ব্যাপক ঋণ দেয়, যা ছিল একটি অবৈধ সরকার। ঝঃৎঁপঃঁৎধষ অফলঁংঃসবহঃ চৎড়মৎধসসব বা কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচির আওতায় সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক অনুদান পায় এরশাদের সামরিক সরকার এবং তখন থেকেই পলিটিক্যাল ও কর্পোরেট করাপশন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। সেই দুর্নীতি থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন বাংলাদেশের বিখ্যাত বিদ্বানরা। যাঁদের আমরা নাম দিয়েছি বুদ্ধিজীবী। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শদাতা ও সুবিধাভোগীতে আজ গিজ গিজ করছে বাংলাদেশের প্রশাসন ও নাগরিক সমাজ।



ট্রান্সপারেন্সির জরিপ হাস্যকর মনে হয়। নিউজিল্যান্ডকে তারা অতিশয় সাধু রাষ্ট্র মনে করে। নিউজিল্যান্ডের আকার হলো এক লাখ চার হাজার বর্গমাইল। প্রতি বর্গ মাইলে বাস করে ৩০-৩২ জন মানুষ। সেখানে দুর্নীতি কেন হবে? দুর্নীতি হলেই বরং তা হতো বিস্ময়কর। বাংলাদেশ আকারে নিউজিল্যান্ডের অর্ধেকÑ ৫৬ হাজার বর্গমাইল। জনসংখ্যার ঘনত্ব পৃথিবীতে সর্বোচ্চÑ প্রতি বর্গমাইলে প্রায় দুই হাজার, নিউজিল্যান্ডের ৬৬ গুণ। সাধারণ মানুষ এখানে বা ভারতে বা নেপালে দুর্নীতি করবে না তো কোথায় করবে? কোন ট্রাফিক পুলিশ ট্রাকঅলার থেকে ৩০ টাকা ঘুষ নিল তাতে দেশ রসাতলে যায় না। কাজ না করে বড় বড় প্রকল্পের শত শত কোটি টাকা তুলে নিয়ে ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছে, তাতে শুধু দেশের ক্ষতি নয়, সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। কাউকে রাতারাতি বড়লোক হতে দেখে নিরীহ তরুণটিও যে কোনোভাবে চুরিচামারি লুটপাট করে টাকা রোজগারে প্রলুব্ধ হয়।

আর একটি দিক হলো নৈতিক। যে সমাজে ন্যূনতম নৈতিকতা নাই সেখানে শুধু টাকা পয়সার দুর্নীতি নয়, সব ধরনের দুর্নীতি হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কনসালট্যান্সি করে টাকা রোজগার করেন। ওই রোজগারটা চুরি নয়Ñ বৈধ আয়। কিন্তু তিনি তো বড় দুর্নীতিবাজ। দুর্নীতি জিনিসটি সিস্টেমের ব্যাপার। খারাপ সিস্টেমে খুব বেশি দুর্নীতি হয়। তাই সিস্টেম বদলানো প্রয়োজন আগে। জরিপ করে গোটা দেশকে এক নম্বর দুই নম্বর দুর্নীতিবাজ দেশ বানিয়ে কোনো লাভ নেই। জনগণের মধ্যে নিচের দিকে পশ্চিমে দুর্নীতি কম সিস্টেমের কারণে। উপরে কর্পোরেট দুর্নীতি খুবই হয়। তা হয় আমেরিকায়, জার্মানিতে, ফ্রান্সে, ব্রিটেনে, জাপানে সব দেশে। সুইজারল্যান্ড নাকি এত ভালো। তারা বিশ্বের দুর্নীতিবাজদের অবৈধ উপার্জিত অর্থ তাদের ব্যাংকে রাখে কেন? আমাদের বড় বড় কাগজ ও চ্যানেলগুলো বহুজাতিক কোম্পানির দুর্নীতির কথা লেখে না। কারণ তাতে বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যাবে। বন্ধ হয়ে যাবে অন্যভাবে প্রাপ্ত ভাতাও। সুতরাং কোনো জরিপ ও সংবাদ সম্মেলনে দুর্নীতি কমবে না। গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করতে হবে। জীবিকার জন্য, সমাজে প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তারের জন্য অনেককেই অনেক কিছু করতে হয়। এনজিও করতে হয়, জরিপ করতে হয়, মানববন্ধন করতে হয়, সেমিনার করতে হয়, ঘন ঘন বিদেশে যেতে হয়, ক্ষতিকর বৈদেশিক শক্তির সঙ্গে যোগসাজশ ও ষড়যন্ত্র করতে হয়। টিআইয়ের জরিপকে অন্য কোনো দেশে কোনো দাম দেয় না। টিআইবি একটি স্রেফ এনজিও।

সাপ্তাহিক : আপনি এমন কিছু কিছু বিষয়ে প্রতিবাদ করেছেন সম্পূর্ণ ব্যক্তিগতভাবে, অথচ সেসব বিষয়ে দলমত নির্বিশেষে সব মানুষেরই মৌন সমর্থন ছিল। যেমন র‌্যাবের তথাকথিত ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে আপনি প্রেসক্লাবের সামনের ফুটপাতে গলায় সংবিধান ঝুলিয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আপনাকে জোরপূর্বক রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়। এমনকি প্রেসক্লাবের প্রাঙ্গণেও ক্লাবের কর্তৃপক্ষ আপনাকে বসতে দেয় না। সেটা জোট সরকারের শেষ দিকের কথা। বর্তমান সরকারের সময় আপনার আরেকটি প্রতিবাদ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সৌদি আরবে কয়েকজন বাংলাদেশির শিরñেদ ঘোষণার পর আপনি গুলশানে সৌদি দূতাবাসে তাদের মৃত্যুদণ্ড মওকুফের জন্য প্রতিবাদ জানাতে যান। গুলশান ২নং চত্বরে আপনি একটি প্রতিবাদী মানববন্ধন করেন। তারপর দূতাবাসের দিকে স্মারকলিপি দিতে গেলে পুলিশ আপনাকে বাধা দেয়। এসব আন্দোলন ও প্রতিবাদ আপনি ব্যক্তিগতভাবে করেন। এ রকম প্রতিবাদ সাধারণত আমাদের দেশে আর কোনো বুদ্ধিজীবী কখনও করেননি। কোন বিবেচনা থেকে এসব আন্দোলন করেন?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : আমি বহু সংগঠনের সঙ্গেও আন্দোলন প্রতিবাদ করি। তাদের কর্মসূচিতে সমর্থন দিয়ে সংহতি প্রকাশ করি। কিন্তু কিছু কিছু বিষয় যখন বিভিন্ন সংগঠনের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় অথবা যে কোনো কারণেই তারা তাদের প্রতিবাদ জানাতে আগ্রহ দেখায় না তখন সেসব বিষয়ে প্রতিবাদ আমাকে নিজের উদ্যোগে করতে হয়। বিএনপি জামায়াত সরকার যখন ক্রসফায়ারে অথবা তথাকথিত এনকাউন্টারে মানুষ মারতে থাকে তখন আমাদের একশ্রেণীর মানুষ তাতে নীরবে সমর্থন দেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আনন্দউল্লাসও প্রকাশ করে। কারণ যাদের হত্যা করা হচ্ছিল তারা চিহ্নিত অপরাধী এবং দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। অনেকে বিবেচনা করেননি যে এসব সন্ত্রাসী ও মানুষকে তাদেরকে বিনাবিচারে গুলি করে হত্যা করার অধিকার রাষ্ট্রের নেই। যেকোনো মানুষকে বিনা বিচারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা হত্যা করা জঘন্য রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। মানবাধিকারের লঙ্ঘন তো বটেই। অপরাধীকে গ্রেফতার করে দ্রুতবিচার আইনে মৃত্যুদণ্ড দিলেও কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু আমাদের সরকার বিনা বিচারে মানুষ খুন করে বলছে ক্রসফায়ারে মারা গেছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র দুটি অপরাধ করছে। এক. স¤পূর্ণ বেআইনিভাবে মানুষ মারছে যা রীতিমতো খুন বা হত্যাকাণ্ড। দুই. রাষ্ট্র মিথ্যাচার করছে। মিথ্যাচারটা হলো আসলে মানুষগুলোকে ধরে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে মারছে। হয়তো ঐ ব্যক্তি সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। কিন্তু রাষ্ট্র বলছে লোকটি ক্রসফায়ারে মারা গেছে। অর্থাৎ ঐ ব্যক্তির সঙ্গে র‌্যাবের লোকদের গোলাগুলি চলেছিল। সেই গোলাগুলিতে ওই ব্যক্তি মারা গেছেন। এ যে কত বড় মিথ্যাচার তা সকলেই জানেন। আজ পর্যন্ত কোনো ‘ক্রসফায়ার’ অথবা ‘এনকাউন্টার’ করে কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ মারা যায়নি। বিষয়টি আমার বিবেককে নাড়া দেয়। তাই আমি সংবিধান বুকে ঝুলিয়ে রাস্তায় বসে প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলাম। অবশ্য সেদিন আমার ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ আন্দোলন ড. কামাল হোসেন, সিপিবি সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান খান এমন কি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল এবং বাম প্রগতিশীল ছাত্রযুগ সংগঠনের নেতারাও সংহতি জানান। ঢাকা পুলিশ কমিশনার এবং পুলিশের আইজি মোবাইল ফোনে পুলিশ কর্মকর্তাদের বলতে থাকেন ‘ওনাকে প্রেসক্লাবের সামনে তো নয়ই ঢাকার বা দেশের কোথাও বসতে দেয়া হবে না।’ পুলিশ আমাকে ঠেলতে ঠেলতে প্রেসক্লাবের বাগানে নিয়ে যায়। সিপিবি নেতা রুহুল হোসেন প্রিন্স ও ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট প্রভৃতির নেতাদের সঙ্গে পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়। সেদিন বিএনপিপন্থি প্রেসক্লাবের কর্তৃপক্ষ আমার সঙ্গে সঠিক আচরণ করেনি।

সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের বিশেষ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। লাখ লাখ বাংলাদেশি সৌদি আরবে শ্রমিকের কাজ করছেন। তাতে আমাদের বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন হচ্ছে। ওই যে তারা কাজ করছেন সেটা কোনো দয়া দাক্ষিণ্যের ব্যাপার নয়। আমরা যেমন বৈদেশিক মুদ্রা পাচ্ছি, তেমনি আমাদের শ্রমিকরা সৌদি অর্থনীতিতে এবং অন্যান্য আরব দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখছে। বিষয়টি পারস্পরিক সুবিধার। আমি যখন শুনলাম পাঁচ ছয়জন শ্রমিকের প্রকাশ্যে হাজার হাজার মানুষের সামনে শিরñেদ করা হবে তখন খুবই বিচলিত হই। ঘুমাতে পারিনি। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ কোনো ভূমিকাই পালন করেনি হতভাগ্য শ্রমিকদের জীবনরক্ষায়। আদালতে তাদেরকে বাংলাদেশ সরকার আইনি সহায়তা দেয়নি, আমাদের বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় চরম অপদার্থ। বিষয়টি নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্যই করল না। আমি দুই তিন দিন দৌড়াদৌড়ি করলাম এদিক-ওদিকে। আমাদের রাজনৈতিক দলের নেতারা যারা দল বেঁধে মাসে মাসে সৌদি আরবে উমরা করতে যান তারা নীরবতা অবলম্বন করলেন। কারণ সৌদি সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কথা বললে তারা আর উমরা পালনের দাওয়াত পাবেন না। সেজন্য বাধ্য হয়ে আমি একাই প্রতিবাদ করি। আমার সঙ্গে যুবসমাজের অনেক প্রতিনিধি ছিলেন। তাছাড়া বহু পথচারী স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেদিনের মানববন্ধনে যোগ দেন। একটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। বহির্বিশ্বের মিডিয়ায়ও আমার প্রতিবাদের কথা আসে। তাতে কিছু কাজ হয়েছিল। ওই হতভাগ্যদের সকলকে বাঁচানো যায়নি কিন্তু বেশ কয়েক জনের জীবনরক্ষা হয়েছিল। সৌদি সরকার শিরñেদের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করেছিলেন। অনেক সময় সাংগঠনিকভাবে যা সম্ভব হয় না ব্যক্তিগত প্রতিবাদে বরং কাজ হয়। আমি মহাত্মা গান্ধীর মতো ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহে বিশ্বাসী।

সাপ্তাহিক : বেশ ভালো কথা বলেছেন। আপনাকে বলা হয় ‘বাংলাদেশের গান্ধী’। আপনি কখন গান্ধীর অনুসারী হলেন? গান্ধীর সম্পর্কে আপনার গবেষণামূলক বইও আছে। এ সম্পর্কে কিছু বলুন।

সৈয়দ আবুল মকসুদ : গান্ধীর সঙ্গে অর্থাৎ গান্ধীর নামটির সঙ্গে আমার পরিচয় ছোটবেলায়। আমার বাবা গান্ধী এবং জিন্নাহ্র অনুরাগী ছিলেন। উভয়ের প্রতি ছিল তার গভীর শ্রদ্ধা। প্রথমে ছিলেন গান্ধীর অনুসারী। ১৯২১-২২ সালে যখন তিনি জামালপুরের সরিষাবাড়ির আরডি হাইস্কুলের উপরের শ্রেণীর ছাত্র তখন অনেকের মতো গান্ধী-মহাম্মদ আলীর অসহযোগী খিলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়ে মাসখানেক কারাবরণ করেন। লবণ সত্যাগ্রহ সার্চে অংশ নিয়েছিলেন তিরিশের শুরুতে। কিছুদিন চরকায় সুতাও কেটেছেন। আমি বাড়িতে ছোটবেলা চরকা দেখেছি। খদ্দরের কাপড় পরতেন। গান্ধী ও অন্যান্য স্বাধীনতা সংগ্রামী সম্পর্কে পড়াশুনা করেছি কিন্তু দীর্ঘদিন গান্ধীকে নিয়ে বিশেষ ভাবিনি। এর মধ্যে ১৯৭৮ সালে চৌমুহনী কলেজের অধ্যক্ষ তফাজ্জল হোসেইন একদিন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় আমার সঙ্গে এসে দেখা করেন। তাঁকে সম্ভবত আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব থিয়েটার নাট্যগোষ্ঠীর রামেন্দু মজুমদার। তখন তার একটি বই, স্মৃতিকথামূলক রচনা ছাপা হচ্ছিল। এর মধ্যে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ফোনে বললেন- তুমি প্রিন্সিপাল সাহেবকে একটু সাহায্য কর। তিনি একজন গান্ধীভক্ত মানুষ। ১৯৪৬-৪৭ সালে নোয়াখালীতে দাঙ্গার সময় তিনি গান্ধীজির সান্নিধ্যে এসেছিলেন। অধ্যক্ষ সাহেবের সঙ্গে কথা বলে আমার ধারণা হলো গান্ধীজির মতোন একজন মহামানব বাংলাদেশে এসে তিন-চার মাস রইলেন অথচ তাকে নিয়ে কেউ কোনো কাজ করল না, কেউ একটি ছোট নিবন্ধও লিখল না কোনো কাগজে তিরিশ বছরেও। বিষয়টি আমাকে ভাবিত করে ও ব্যথিত করে। আমি মহাত্মা গান্ধীর নোয়াখালীর কর্মকাণ্ড নিয়ে গবেষণা শুরু করি। নোয়াখালীর বিভিন্ন থানা থেকে ’৪৬-৪৭ সালের পুরনো কাগজপত্র সংগ্রহ করতে থাকি। তারপর কলকাতা যাই। ১৯৮০ সালে সোদপুর খাদি প্রতিষ্ঠান থেকে এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গান্ধীবাদী প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক লাখ টাকা খরচ করে মূল্যবান পুরনো কাগজপত্র সংগ্রহ করি। আমার আগে গান্ধীজিকে নিয়ে বাংলাদেশে আর কেউ কোনো রকম লেখালেখি করেননি। তিনটি বই তাঁর সম্পর্কে আমার প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত থেকে। দুটি বই ইংরেজিতে। তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতাবিরোধী আন্দোলনের শীর্ষনেতা। তাঁকে বাদ দিয়ে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ইতিহাস হয় না। সুতরাং তাঁকে নিয়ে আমি গবেষণা করছি বহু বছর যাবৎ। শ পাঁচের পৃষ্ঠার একটি বই এ বছরই ঢাকা ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত হবে।

সাপ্তাহিক : আপনি আগাগোড়া বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এবং বেশ ভালোই সক্রিয়। দেশের বাম আন্দোলনের আপনি একজন কর্মী। সামনের সারিতেই থাকেন বিভিন্ন আন্দোলনে সংগ্রামে সমাবেশে। আপনার মার্কসবাদী অবস্থানের সঙ্গে গান্ধীবাদী অবস্থান মেলাল কি ভাবে?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : কোনো সমস্যা হয় না। বাংলাদেশের সব বামপন্থি যেমন মার্কসবাদী নন, আমিও তেমনি ষোলআনা মার্কসবাদী নই। আমাদের সমাজ পরিবর্তনে মার্কসীয় দর্শনের যতটা প্রয়োজন ততটাই গ্রহণ করার পক্ষে। আমি মৌলবাদী মার্কসবাদী নই। একইভাবে আমি সনাতন গান্ধীবাদী নই। গান্ধীজির চিন্তাধারার সবকিছু আমি গ্রহণ করতে পারব না। করলে বর্তমান যুগে সমাজ এগোবে না। কিন্তু গান্ধীর অহিংসা, সত্য, ন্যায় ও শান্তিবাদী চিন্তাধারা এবং কর্মকাণ্ড থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় তাঁর সব পথ অবশ্য অনুসরণীয়। গান্ধীজি বলেছেন, বাংলা থেকে শেষবার যাবার আগে তিনি বলেছেন গু ষরভব রং সু ঢ়যরষড়ংঢ়যু. আমি তাঁর জীবন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অধ্যয়ন করেছি। তাঁর লেখা পড়েছি। তাঁর কথা ও কাজ গ্রহণযোগ্য নয় বর্তমান বাস্তবতায় কিন্তু যতটা গ্রহণযোগ্য ততটা যদি নেয়া যায় সমাজ ও জাতি উপকৃত হবে। সমাজে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। সমাজ থেকে হিংসা বিদ্বেষ দূর হবে। আমরা সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে বাস করি। সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করে শান্তিতে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে বসবাস করতে গান্ধীজির আদর্শের মূল্য বিরাট। সেগুলো করলেই যদি গান্ধীবাদী বলা হয় তা হলে আমি একজন গান্ধীবাদী। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা স্টাইলে যদি বলা হয় মার্কসবাদীÑ তাহলেও আমি এক মার্কসবাদী।

সাপ্তাহিক : বাংলাদেশের মুসলমানপ্রধান সমাজে আপনি গান্ধীচর্চার পথিকৃৎ। আপনি কি মনে করেন আপনার পথ ধরে এখানে গান্ধীচর্চা হবে?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : হওয়া তো উচিত ইতিহাসচর্চার প্রয়োজন। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে নয়। কেউ কেউ মনে করেন গান্ধীকে নিয়ে লেখালেখি করলে ভারতীয় ভিসা পাওয়া সহজ হবে, তা হলে ও রকম গান্ধীচর্চা না হওয়াই ভালো। বিশ্বাস থেকে, দায়িত্ববোধ থেকে, উপমহাদেশের মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরিতে যদি গান্ধীজিকে নিয়ে কাজ হয় তা হবে প্রশংসার কাজ। কোনো রকম উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে নয়। আমি স্থায়ীভাবে গান্ধীচর্চার একটা ব্যবস্থা করছি। কিন্তু টাকা কোথায়? আজকাল যে কোনো কাজে হাত দিলে টাকা লাগে। কেউ দিতে চায় না। ভারতের টাকায় বাংলাদেশে গান্ধীচর্চা করা আমি সংগত মনে করি না। তা বাংলাদেশের মানুষের জন্য লজ্জার।

সাপ্তাহিক : আপনার জীবনে অর্থকড়ি কেমন দেখেছেন? জীবনে সুযোগ পেয়েও উপরে ওঠার বাসনা ছেড়েছেন এমন কিছু ঘটনা বলুন। আপনার বর্তমান সম্পদ-সম্পত্তি সম্পর্কে একটা ফিরিস্তি দেন।

সৈয়দ আবুল মকসুদ : কখনোই খুব বেশি দেখিনি। বরং টাকাকড়ি অনেক সমর যতটা প্রয়োজন ততটাও কাছে থাকে নাই। আগেই বলেছি বিত্তবান পরিবারে জন্মগ্রহণ করিনি। অসচ্ছলতায় প্রায় সব সময়ই ছিলাম। অর্থকড়িকে কখনই আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে করি নাই। এই না করাটাও একটি জেনেটিক ব্যাপার। মানুষের কিছু কিছু মৌলিক আশাআকাক্সক্ষা তার পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পায়। যে কোনো ধরনের লোভলালসা বিষয়সম্পত্তির জন্যে উচ্চাভিলাষ প্রভৃতি পূর্বপুরুষদের থেকে মানুষ পেয়ে থাকে। আমার পূর্ববর্তী অন্তত পাঁচ পুরুষের কথা জানি যারা কেউ অর্থকড়িকে অর্থাৎ বিষয়সম্পত্তিকে গুরুত্ব দেননি। তা আমি আমার বাবার মধ্যে দেখেছি। আমার পিতামহের মধ্যেও ছিল। তার বাবার মধ্যেও ছিল। জমিজমার আয় থেকে চলবার মতো অবস্থা সবসময় ছিল। আমার দাদা উনিশ শতকে বর্তমান মানিকগঞ্জ জেলার প্রথম হাইস্কুল তেওতা একাডেমির শিক্ষক ছিলেন। তিনি পড়াশুনা করেছেন সিপাহী বিদ্রোহের পরে কলকাতা মাদ্রাসায়। চাকরি করার কোনো প্রয়োজন ছিল না তার। ছোট তালুকের মতো ছিল। জমিদারি শব্দটি ব্যবহার করলাম না। তা থেকেই তাঁর চলত। কিন্তু আধুনিক শিক্ষাকে তিনি গুরুত্ব দিতেন। তেওতার জমিদাররা কংগ্রেস নেতা কিরণ শংকর রায়ের বাবা কাকারা ওই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বলা হতো হাই ইংলিশ স্কুল। মাদ্রাসা বলতে এখন যে জিনিসের চেহারা আমাদের চোখে ভেসে ওঠে ক্যালকাটা মাদ্রাসা তা ছিল না। সেটি ছিল ইংরেজ শাসকদের প্রতিষ্ঠিত উপমহাদেশে প্রথম আধুনিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তারপরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। তারপরে হিন্দু কলেজ ও প্রেসিডেন্সি কলেজ। দাদা আরবি, ফারসি, উর্দু ভালো জানতেন, বাংলা ইংরেজি তো বটেই। তিনি শিক্ষকতা করতেন ও ফারসিতে পদ্য লিখতেন। কলকাতায় কোনো কোনো কাগজে বাংলাতেও পদ্য লিখেছেন। টাকাপয়সার গুরুত্ব দেননি। তাঁর বাবা সিপাহী বিদ্রোহের আগে পুলিশের দারোগা ছিলেন। মহাবিদ্রোহের পরে তাঁর মনের পরিবর্তন ঘটে। তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। মোটামুটি নির্জন জীবন যাপন করতেন। লোকে বলত দরবেশ হয়ে গেছেন তিনি। এ কথাগুলো বললাম এজন্য যে আমাদের বংশে কেউই টাকাপয়সাকে কখনও বিশেষ মূল্য দেয় না। পরিবারে আমার চাচাত ভাইয়েরা অফিসের ছোট কর্মকর্তা থেকে মন্ত্রণালয়ের সচিব পর্যন্ত ছিলেন। প্রায় সবাই সরকারি কর্মকর্তা। ব্রিটিশ আমলে। পাকিস্তান আমলে। বাংলাদেশ আমলে। তাদের কাউকেই টাকাপয়সার দিকে বিশেষ নজর দিতে দেখিনি। সবারই চলে যাওয়ার মতো অবস্থা। আমারও তাই। সবসময়ই চলে গেছে। কারণ প্রয়োজন আমার সীমিত। এক সময় কাপড়চোপড়ে কিছু শখ ছিল। তাও ত্যাগ করেছি অনেক আগে।

জীবনে উপরে ওঠার সুযোগ? যেকোনো মানুষের জীবনে কম হোক বেশি হোক কখনও সুযোগ আসে। কেউ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারে, কেউ পারে না। কেউ করেন সুযোগের অপব্যবহার। আমার কোনটিই করার প্রয়োজন হয়নি। ৭১-এর ডিসেম্বর থেকে আজ পর্যন্ত শাসক শ্রেণীর সকলের সঙ্গেই আমার জানাশোনা ব্যক্তিগত। বঙ্গবন্ধুর সরকারের সঙ্গে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। মন্ত্রীদের সঙ্গে ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। জিয়াউর রহমানের মন্ত্রীদের অনেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। এরশাদ সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গেও ছিল। তার পরবর্তী সব সরকারের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। এখনো যে সরকার ক্ষমতায় তাদের মন্ত্রীদের উপদেষ্টাদের প্রায় সকলের সঙ্গেই আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কে কি দিতে চেয়েছিলেন সে প্রসঙ্গ অপ্রাসঙ্গিক। কারো কাছেই আমার চাইবার কিছু ছিল না। চাইলে অনেকেই কিছু দিতেন। অনেকের মধ্যে সে আগ্রহ দেখেছি। আমার প্রয়োজন হয়নি। কখনো কোনো পদের প্রতি আমার কোনো আগ্রহ ছিল না।

আমি প্রায় সব সরকারের সময় সরকারের কিছু কিছু কার্যক্রমের প্রতিবাদ করেছি। তাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করেছি। ব্যক্তিগতভাবে কারো প্রতি আমি কোনো বিদ্বেষ পোষণ করি না। দেশের স্বার্থে যা ভালো মনে করি, জনগণের স্বার্থে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করতে দ্বিধা করি না। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিভিন্ন সরকারের ক্ষমতাবানরা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে অমর্যাদা করেন না, এটা বলতে গেলে আমার এক বিরল সৌভাগ্য। কারো কাছ থেকে কোনো সুবিধা নেয়া প্রয়োজন আগেও হয়নি এখনও না।

আমার বর্তমান বিষয়সম্পত্তি সম্পর্কে জানতে চাইছে। কি হবে তা জানিয়ে? আমি আমার নিজের ১৬শ’ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটে বাস করি। আমার পৈতৃক সম্পত্তি সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে এটাই আমি কিনে ছিলাম। এছাড়া এই জগতে আমার আর কোনো বিষয়সম্পত্তি নেই। আর আছে আমার বিশ বাইশ বছরের পুরনো একটি গাড়ি। সেই গাড়ি মাসের মধ্যে সপ্তাহখানেক খারাপ হয়ে থাকে। মাঝেমধ্যেই মেকানিক দেখাতে হয়। কিছু বইপত্র আছে। আমার মেয়ে ও ছেলে চাকরি করে। দুজনই ব্যাংকে। আমার কোনো অভাব নেই। লিখে কিছু রোজগার হয়। আমি কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত নই। এনজিওর সঙ্গে নয়। কোনো কিছুর সঙ্গেই নয়। কোনো কন্সালট্যান্সি করি না। বিদেশ ভ্রমণের আমন্ত্রণ আমি সবিনয়ে ফিরিয়ে দেই। দেশের মধ্যেই কাজ করে সময় পাই না। আমি চাকরি বাকরি কিছুই করি না, কিন্তু তার পরেও আমি সময় পাই না। ঘর-সংসারের কাজ, বাজার করা প্রভৃতি সব আমার স্ত্রী করেন। তারপরেও আমি বহু জরুরি কাজ করার সময় পাই না।

সাপ্তাহিক : পেশাগত জীবনের পুরো সময়টাই, তিন দশকের বেশি, আপনি সাংবাদিকতায় ছিলেন। হঠাৎ করে হুমায়ুন আজাদকে আহত করার প্রতিবাদে আপনি তাৎক্ষণিকভাবে চাকরি ছেড়ে দেন। শুধু চাকরি নয়, সাংবাদিকতা পেশাই ছেড়ে দেন। পেশাগত জীবনে দেশ-বিদেশে অনেককিছু দেখেছেন। সাংবাদিকতা বেছে নিয়েছিলেন কেন? ছাড়লেনই বা কেন?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : স্বাধীন থাকব, স্বাধীন উপার্জন করব এবং স্বাধীনভাবে লেখালেখি করে জীবিকা নির্বাহ করব- এ রকম একটি সিদ্ধান্ত আমার ছাত্রজীবনেই আমি নিয়েছিলাম। আমাদের প্রেসটা ৭১-এর জুনে রাজাকাররা লুট করে মেশিনসহ নিয়ে যায়। আমি ২৭শে মার্চ থেকেই ঢাকার বাইরে। ১৬ ডিসেম্বরের সপ্তাহখানেক পরে ঢাকা আসি। ঢাকা তখন শোকে, দুঃখে, বেদনায় স্তব্ধ। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনসহ প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা কলকাতা থেকে আসেন। যেদিন আসেন তার পরদিন তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়। কুশল ইত্যাদি জিজ্ঞেস করেন। বললেন, সবাইকে এখন দেশ গড়ার কাজে লেগে যেতে হবে। আমার আগ্রহ কোন্ দিকে জানতে চাইলেন, বললাম কিছু ঠিক করিনি। লেখালেখি করব। নয় মাস যে সব কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী, চাপের মুখে জীবন বাঁচাতেই হোক বা বিশ্বাস থেকেই হোক, পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সহযোগিতা করেছেন, সভা-সমাবেশ করেছেন, রেডিও ও টেলিভিশনে কথিকা প্রচার করেছেন, তাদের সেইসব কাগজপত্র সংগ্রহ করছি। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, খুব ভালো। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখায় প্রয়োজন হবে। আমার কাছেই ছিলেন বেবী চৌধুরী, পাকিস্তানি অবজারভারের সিনিয়র সাংবাদিক, পুরো নাম সৈয়দ মাহবুব আলম চৌধুরী, পরে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সম্পাদক হয়েছিলেন, বাংলাদেশ টাইমসের সম্পাদক হয়েছিলেন এবং দিল্লিতে বাংলাদেশ হাই কমিশনে মিনিস্টার প্রেস ছিলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিজি ইপিও ছিলেন। সুশিক্ষিত, সৎ, মার্জিত ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সাংবাদিক ছিলেন। দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এসএম আলীর পরে বেবী চৌধুরীর মতো আর কাউকে দেখা যায় না। যা হোক তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, ভারত সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে একটি মিডিয়া সেল খোলা হয়েছে। পূর্বাণী হোটেলে তার অফিস করা হয়েছে। আপনারা ওখানে যান। ওদের সহযোগিতা করুন। আপাতত বেতনভাতা নিয়ে ভাববেন না। সব হবে। একটু গুছিয়ে নেই। সময় লাগবে। তাজউদ্দীন সাহেবের কথামতো তখনই বেবী চৌধুরীর সঙ্গে পূর্বাণী হোটেলে যাই। গিয়ে দেখি যেখানে কয়েকজন ভারতীয় বেসামরিক কর্মকর্তা, সেনাবাহিনীর অফিসার এবং বাংলাদেশ সরকারের কেউ কেউ। দু’জন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তার কথা মনে আছে। ব্রিগেডিয়ার কৈলাশ পাণ্ডে এবং কর্নেল ব্রার। ব্রিগেডিয়ার পাণ্ডেকে তাঁর আড়ালে সবাই টম পাণ্ডে ডাকতেন। তাঁরা ঢাকার কিছুই চিনতেন না। কী ব্যাপারে তখনই তাঁদের সঙ্গে টিকাটুলি রামকৃষ্ণ মিশনে যাই। দুই ট্রাক পুরনো কাপড় তখনই কলকাতা থেকে সেখানে পৌঁছে ত্রাণ সামগ্রী হিসেবে। তা নিয়ে একটি ছোট প্রতিবেদন তৈরি করি। শুরু হয়ে গেল আমার নবপর্যায়ের সাংবাদিকতার জীবন। তিন সপ্তাহ অবেতনে মিডিয়া সেলে পূর্বাণীতে কাজ করি। তারপর সংবাদ সংস্থায় নিয়মিত চাকরিতে যোগ দেই। দুজনের কাছে কাজ শিখি। একজন বিহারি মোহাম্মদ ওজায়ের এবং আর একজন চৌধুরী আবুল ফজল হাজারী। ওজায়ের সাহেব বেশিদিন ছিলেন না বাংলাদেশে, তাঁর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় ছিল। স্বাধীনতার আগে তিনি ছিলেন নিউজ এজেন্সি এপিপির চিফ রিপোর্টার। তাঁর বাড়িঘরের একটা ব্যবস্থা করে তাঁকে সরকারের লোকরাই মার্চ মাসের শেষের দিকে ভারতে চলে যেতে সাহায্য করেন। সেখান থেকে তিনি পাকিস্তানে চলে যান।

সাপ্তাহিক : সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতা কিছু বলুন? কাদের খুব কাছে থেকে দেখেছেন? তাঁদের দোষ, গুণ, দুর্বলতাÑ

সৈয়দ আবুল মকসুদ : অভিজ্ঞতা বলতে গেলে তো অনেক কথা। প্রকৃতপক্ষে একাত্তরের ডিসেম্বরেই যে সাংবাদিকতার শুরু তা নয়। ওটা হলো নিউজ এজেন্সি সাংবাদিকতা, ষাটের দশকে ছাত্র অবস্থায় বিভিন্ন পত্রিকায় খণ্ডকালীন বা ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা মাঝে মাঝে করেছি। শুরু করেছিলাম ১৯৬৪ সালে এম আনিসুজ্জামান সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘নবযুগ’-এ। ওটি তখন ছিল পাকিস্তান সোস্যালিস্ট পার্টির মুখপত্র। আমিও ওই পার্টির সদস্য বা কর্মী ছিলাম। কিছু কাজ করেছি ব্যারিস্টার শওকত আলী খানের সাপ্তাহিক জনতায়। ওটি ছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সমর্থিত পত্রিকা। মওলানা ভাসানী সমর্থিত কাগজ। সম্পাদনা করতেন আনোয়ার জাহিদ। আমি কোনোদিন রিপোর্টিং করিনি। বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ফিচারধর্মী নিবন্ধ লিখতাম। তাতে ২৫-৩০ টাকা পেলেই বর্তে যেতাম। পেশাগত সাংবাদিকতার শুরু একাত্তরের ডিসেম্বরে। তবে একাত্তরের কলকাতা থেকে প্রকাশিত আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মান্নানের ‘জয়বাংলা’ ও অন্য দু’একটি কাগজের জন্যও কিছু প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। ওটাকে সাংবাদিকতা বলা যায় না। আমার প্রধান লেখালেখি কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ প্রভৃতি।

সাপ্তাহিক : তা সাংবাদিকতা একেবারে ছেড়ে দিলেন কবে এবং কী কারণে?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : তিন দশকের বেশি বার্তা সংস্থায় ছিলাম। সেই একাত্তর থেকে ২০০৮ সালের ২ মার্চ পর্যন্ত। সম্পাদকের র‌্যাঙ্কেও চাকরি করেছি অনেক বছর।

সাপ্তাহিক : ছাড়লেন কেন?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : বিপিআই বা বিএসএস-এ আমি সম্পাদকীয় বিভাগে ছিলাম। সাংবাদিকতা করেছি ইংরেজিতে। কিন্তু সবসময়ই লেখালেখি করেছি বাংলায়। কবিতা, প্রবন্ধ, সমালোচনা প্রভৃতি। আশির দশক থেকে কলাম লিখছি। এরশাদের স্বৈরশাসনের সময় থেকে। কলাম ছিল আমার প্রতিবাদের হাতিয়ার। একুশের বইমেলার মধ্যে হুমায়ুন আজাদকে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে জখম করে। আমি ছিলাম ঈশ্বরদী ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্রের গেস্ট হাউজে ওইদিন। আমার ছেলে রাতে আমাকে ফোনে জানায়, খুবই মর্মাহত হই এবং খুবই বিচলিত। রাত ১১টার নিউজে আহত হুমায়ুনকে দেখে আমি হতবাক হই। হুমায়ুন ছিলেন আমার ছাত্রজীবনের বন্ধু। সেই ঢাকা কলেজ থেকে। অন্যের কাছে তিনি দুর্মুখ বলে পরিচিত হলেও আমার সঙ্গে ছিল তাঁর অন্য রকম ভালো সম্পর্ক। তাঁর বন্ধুবান্ধব ছিল না বললেই চলে। আমার অবস্থাও তাই। কিন্তু হুমায়ুন ও আমি ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম। পরদিন সকালে ওই হত্যাপ্রচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রথম আলোতে আমি একটি কলাম লিখি। সরকারের ও মৌলবাদীদের সমালোচনা ছিল। সকালে অফিসে গেছি। নতুন এক এমডি ওদিনই জয়েন করেন। তাকে ফোন করে তথ্যমন্ত্রী তরিকুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী বলেন, আমি যেন কলাম-টলাম না লিখি। গিয়াস কামাল চৌধুরীও তাঁদের সঙ্গে ছিলেন ও সরকারকে সমর্থন দেন। আমার লেখায় সরকারের ক্ষতি হয়। কলাম ছাড়া অন্য লেখা লিখতে বাধা নেই।

আমি লেখালেখি করছি ১৯৬১ থেকে। কত সরকার এলো গেল। আইয়ুব মোনায়েম সরকার গেল, মুজিব সরকার গেল, জিয়া সরকার, এরশাদ সরকার, খালেদার প্রথম সরকার, হাসিনার প্রথম সরকার- কেউ লেখালেখি নিয়ে কোনো নির্দেশ দিল না। ওই রকম নির্দেশের প্রতিবাদে এক ঘণ্টার মধ্যে আমি পদত্যাগ করি। পদত্যাগে বলেছিলাম : আমাকে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করা এবং চাকরি করাÑ এই দুইটির মধ্যে একটি বেছে নিতে হবে বলে আমার বিবেক বলছে। আমি প্রথমটিই বেছে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাকে হয় জনগণের পক্ষে থাকতে হবে নয়ত সরকারের পক্ষে। আমি প্রথম পক্ষে আছি। আমাকে মুক্তি দিন। সেই দিনই আমি বাসস থেকে বেরিয়ে আসি। আর যাইনি। কাগজে আমার দীর্ঘ পদত্যাগপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। ৯ মার্চ ২০০৪ আমার পদত্যাগপত্র গৃহীত হয় এবং সে চিঠি অফিস থেকে দিয়ে যায়। চাকরি ছাড়ার পর কাগজে লেখালেখি হয়েছিল এবং দেশের নানা জায়গায় প্রতিবাদ হয়।

সাপ্তাহিক : চাকরি ছাড়ার পর আপনার কষ্ট হয়নি?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : সংসারে আমি একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি। সঞ্চয় ছিল সামান্য। মেয়ে ও ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়ত। চাকরি ছাড়ার সময় আর্থিক গচ্চা দেয়ার পরেও যে টাকা পাই তাতে ছেলেমেয়ে পড়া শেষ করে বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত দেড় দু’বছর চলত। তখন থেকেই আমার প্রয়োজন সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনি।

একটি ১২-১৪ বছরের পুরনো গাড়ি ছিল, সেটিও বিক্রি করে দেই। কারণ ড্রাইভার রাখা সম্ভব ছিল না। ছেলেও পড়িয়ে কিছু উপার্জন করতো। আমি লিখেও কিছু পেতাম। এর মধ্যে একদিন চট্টগ্রাম থেকে সাংবাদিক আবুল মোমেন এলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। তিনি বললেন চট্টগ্রাম থেকে একটি নতুন দৈনিক বের হচ্ছে, প্রকাশকরা চান আমি সম্পাদক হিসেবে যোগ দেই। তিনি আবুল ফজলের ছেলে। আমার ভ্রাতৃপ্রতীম। তাঁর বিশেষ অনুরোধ উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। চট্টগ্রামে গেলাম উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলতে। তাঁরাও এত ভালো মানুষ যে ওদের খুব ভালো লেগে গেল। সবাই প্রগতিশীল ও আধুনিকতামনস্ক। আমার সম্পাদনায় ২০০৪-এর শেষ দিকে বের হয় দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ। প্রকাশক ছিলেন রুশো মাহমুদ। বড়ই সৎ, সজ্জন ও অমায়িক মানুষ। নীতি আদর্শ রয়েছে। পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আরও একদল তরুণ। কাগজের আর্থিক অবস্থা বিশেষ ভালো না। তবু ওরা আমার জন্য এক আধুনিক ফ্ল্যাট ভাড়া করলেন জামাল খান সড়কে। তা আসবাবপত্র কিনে সাজালেন। আমার পেছনে বেশ খরচ করতেন, কিন্তু কাগজের আয় কম। মাসে ১০-১২ দিন চাটগাঁ থাকতাম। প্লেনে বা ট্রেনে-বাসে যাতায়াতে অনেক ব্যয়। আমি ছেড়ে দিতে চাই, ওরা ছাড়েন না। বছর দেড়েক ছিলাম। মানুষ চাকরির জন্য পীড়াপীড়ি করে, আমি ছাড়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলাম। তারপর সুপ্রভাত ছেড়ে দিই এবং শপথ করি আর কোনো বাঁধা কাজ নয়। দিনের অর্ধেক সামাজিক কাজে ব্যয় করব, আর অর্ধেক লেখালেখি ও পড়াশোনা। সেইভাবেই চলছে আটটি বছর। বিভিন্ন জায়গায় ডাকাডাকি করেছে। আর কোথাও যাইনি। নানা সামাজিক সংগঠন আমাকে টানাটানি করে। তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যাই। তবে যখন দেখি কেউ আমাকে ব্যবহার করতে চায় তখন বিরক্ত হই।

সাপ্তাহিক : কিছু ব্যতিক্রম প্রশ্ন। আপনার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা কোথায় পড়াশোনা করেছেন। এখন কি করেন?

সৈয়দ আবুল মকসুদ : আমার স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে পাস করেছেন। কিছুকাল অগ্রণী বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তবে ছেলেমেয়েদের গড়ে তোলার জন্যই তার অবদান খুব বেশি। মেয়ে জিহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স এবং মাস্টার্স করেছেন। ব্যাংকে চাকরি করেন। ছেলে নাসিফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স এবং মাস্টার্স করেছেন। ভালো রেজাল্ট ছিল ওর। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি এবং স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়েছেন বছর দুই। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ-ও করেছেন। এখন ইবিএল-এ সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার। দুই ভাই-বোনই ব্যাংকার। ওদের পড়াশোনা করানো বা কোনো কিছুতেই আমার কোনো অবদান নেই। ওরা নিজেরাই করেছেন। বৃত্তিটৃত্তি পেয়েছেন। চাকরিও করেছেন ছাত্রাবস্থায়। আমি নীতিগতভাবে ওদের বিদেশে পাঠাইনি। দেশেই রয়েছেন সবার সঙ্গে

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.