নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পামাআলে

অতি সাধারণ

পামাআেল

অতি সাধারণ বান্দা

পামাআেল › বিস্তারিত পোস্টঃ

। একুশ পালনের স্মৃতি।

২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:৪২

আমার জন্ম গ্রামে। গ্রামেই বেড়ে উঠা। প্রান্তিক কৃষক পরিবারের সন্তান আমার মা-বাবা দু’জনই। পড়ালেখা করার সুযোগ তেমন হয়নি উনাদের। তাই বলতে দ্বিধা নেই, মা-বাবা বা পরিবারের অন্যদের কাছ থেকে ভাষা আন্দোলনের কথা শুনার সুযোগ আমার হয়নি। ভাষা শহীদ দিবসের কথা প্রথম শুনি স্কুলে ভর্তি হবার পর। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারী আসলে, শ্রেনী শিক্ষিকা বলতেন, ‘আগামীকাল শহীদ দিবস। সবায় কাল ব্যাজ পড়ে স্কুলে আসবে। কোন বই-খাতা আনতে হবে না তবে স্কুলে আসতে হবে ঠিকই। যদি কেউ না আস, তবে পরদিন স্কুলে আসলে শাস্তি পেতে হবে।’ একুশের কাল ব্যাজের বাণিজ্যিকীকরণ তখনও শুরু হয়নি। আমরা পুরোনো ছাতার কাপড় কেটে ব্যাজের কাজ চালাতাম। মা ব্যাজ তৈরী করে দিতেন। মায়ের একটি ভাল কেচি ছিল। দরিদ্র জনপদে কোন পরিবারে একটি কেচি থাকাও ছিল দুর্লভ ব্যাপার। আমার বাবা কোলকাতা থেকে মাকে ঐ কেচিটি এনে দিয়েছিলেন। আমাদের প্রতিবেশী অনেকেই মায়ের কেচি দিয়ে একুশের ব্যাজ কাটিয়ে নিতে আসতো। মাও জানতেন একুশ আসলে দরকার হবে তাই আমার হিসেবি মা যত্ন করে পুরোনো ছাতার কাপড় তুলে রাখতেন।

আরও একটু উপরের ক্লাশে উাঠার পর, শিক্ষকগন ব্যাজ পড়ার সাথে ফুল নিয়ে আসতে বলতেন, ভাষা শহীদবৃন্দকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। স্কুলের শহীদ মিনারটির স্মৃতি আজও মনে জ্বল জ্বল করছে। আকৃতি এবং নির্মাণশৈলীর বিচারে এমন আহামরি কিছু ছিল না সেটি। তবু আমার কাছে এ যাবৎ দেখা শ্রেষ্ঠ শহীদ মিনার ওটি। তখনকার শহীদ দিবস পালন মানে নগ্ন পায়ে শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়ানো। নগ্ন পা উল্লেখ না করলেও চলে কারণ তখন প্রতিদিনই নগ্ন পায়েই স্কুলে যেতাম। আমাদের জনপদে জুতো বা ছেন্ডেল পড়ে স্কুলে যাবার চল তখনও শুরু হয়নি। তারপর সারি বেঁধে ফুল দেয়া। দু’একটি বক্তব্য শুনা আর কমন পাঁচ-ছয়টি গান গাওয়া। মোটামোটি ঘন্টা খানেকের মধ্যে শহীদ দিবস পালন শেষ হয়ে যেত। গানগুলোর মধ্যে প্রধান ছিল ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...‘, ‘ সালাম সালাম হাজার সালাম শহীদ ভাইয়ের স্মরণে.... প্রভৃতি আর কিছু দেশাত্ববোধক গানও গাওয়া হতো।

শিক্ষকদের নির্দেশনায় যতই প্রভাত ফেরীতে যাই না কেন, যতই ব্যাজ ধারণ করি না কেন, যতই গান গাই না কেন- একুশের প্রকৃত মর্ম তখন বুঝিনি। একুশ তখন অন্য দশটা দিবসের মতই আর একটি দিবস ছাড়া আর কিছুই ছিল না আমার কাছে। কলেজে পড়ার সময় আরও সুনিদিষ্ট করে বলা যায় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়ার পর প্রকৃত ভাবে একুশ পালনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব যথেষ্ট মাত্রায় অনুধাবন করতে সক্ষম হই। মনে এ উপলদ্ধি আসে, আমার গ্রামের ও এলাকার মানুষদের মধ্যেও একুশের চেতনা জাগিয়ে তুলতে হবে, তাদেরকেও যথাযথভাবে একুশে পালন করতে উদ্বোদ্ধ করতে হবে। চলে যাই এলকায়। সেখানকার যুবসংঘকে সঙ্গে নিয়ে আরও অর্থপূর্ণভাবে একুশ পালনের উদ্যোগ গ্রহন করি। শহীদ মিনারের পাদদেশে আয়োজন করি একুশের চেতনামূলক অনুষ্ঠানমালার। যেখানে ছিল গান, নাটিকা, আবৃত্তি, বক্তৃতা আর স্মৃতিচারণ। আমাদের সকলের মতামতে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একশে ফেব্রুয়ারী’, ‘ওরা আমার মুখের কথা কাইরা নিবার চায়’, ‘মরণ সাগরে পারে তোমরা অমর’, ‘বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রীষ্টান, বাংলার মুসলমান’ প্রভৃতি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ গানগুলো গাওয়ার জন্য মনোনীত করা হয়। গানগুলো একুশের ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে সম্মিলিতভাবে গাওয়ার সময় মনের মধ্যে যে অনুভূতি হয়েছিল, সে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আজও গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। সেই যে আমরা শুরু করেছিলাম সে ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে প্রতি বছর ঐ রকম অর্থপূর্ণভাবে একুশ পালিত হতে থাকে। যত দিন আমি ঢাকায় ছিলাম তত দিন প্রতি বছর গ্রামে গিয়ে একুশের অনুষ্ঠানমালায় নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে চেষ্টা করেছি। এমনই এক একুশের অনষ্ঠানের জন্য আমি লিখে ফেলি একটি একুশের জারি গান। আমাদের যুবসংঘের সদস্যদের নিয়ে সে জারিগান শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে পরিবেশন করি। গানটি মানুষের মনে ধরে। ফলশ্রুতিতে পরে বেশ কয়েক বছর গানটি একুশ পালনে ব্যবহৃত হয়। গানের যে কয়েকটি লাইন আজও মনে করতে পারছি তা নীচে তুলে দিলামঃ



। একুশের জারি গান।



একুশের শহীদেরা রাখলো বাংলা ভাষার মান

(ভাই) রাখলো বাংলা ভাষার মান

গাইব আজি শহীদ ভাইদের গান

দিয়া মনপ্রাণ, গাইব আজি শহীদ ভাইদের গান।



১।

দেশটা যবে স্বাধীন হ’ল

ইংরেজেরা চলে গেল,

শোষণের নাহি হ’ল অবসান......।

পশ্চিমারা নূতন করে

শোষণ করতে শুরু করে

বাংলার করে অপমান,

(ভাই) বাংলার করে অপমান

গাইব ...........



২।

বলেন পাকিস্তানের জিন্নাহ বাদশা

উর্দু হবে রাষ্ট্র ভাষা,

সর্বস্তরে করতে হবে উর্দুর ব্যবহার ......।

শুনে ইহা বাঙালীরা

ক্রুধে হয়ে দিশেহারা,

বাংলা ভাষার দেয় শ্লোগান

(ভাই) বাংলা ভাষার দেয় শ্লোগান

গাইবো ....



৩।

বায়ান্ন’র একুশে ফেব্রুয়ারীতে

ছাত্র-জনতা এক সাথে

বৃহৎ ভাবে গড়ে তুলে আন্দোলন ....।

দেখে ইহা পশ্চিমারা

জারি করে চুয়াল্লিশ ধারা,

রাস্তায় ফাঁটায় স্টেনগান

(ভাই) রাস্তায় ফাঁটায় স্টেনগান

গাইবো ......



আজ এত বছর পরে একুশের এ মহান দিনে ঐ সব কথা মনে করে স্মৃতি-কাতর হয়ে পড়ি। একুশকে আরও গভীরভাবে ভাবতে থাকি। মনে হতে থাকে আমরা বোধ হয় এখনও আমাদের দেশবাসীকে কাঙ্খিত মাত্রায় একুশের চেতনা সমৃদ্ধ করতে পারিনি। আর পারিনি বলেই বোধ হয় দেশ এখনও সমস্যা সংকুল। যেদিন আমরা দেশবাসীকে সন্তোষজনক মাত্রায় একুশের ভাবধারায় গড়ে তুলতে পারব সেদিন তো দেশে কোন রাজনৈতিক সমস্যা থাকার কথা নয়। থাকার কথা নয় ক্ষমতা দখলের জন্য বা দখলকৃত ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য মানুষ পোড়ানোর মত মর্মান্তিক ক্রিয়াকলাপ, থাকার কথা নয় যুদ্ধাবপরাধীর বিচার নিয়ে কোন ধোঁয়াশা। যারা একুশের চেতনায় রাজনীতি করতে ব্যর্থ হবে তারা এমনিতেই একুশের চেতনা সমৃদ্ধ দেশবাসীর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে রাজনীতির আস্তাকুড়ে নিমজ্জিত হবার কথা।

তাই আসুন আমরা সবায় আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশবাসীকে প্রকৃত একুশের চেতনায় (কোন রাজনৈতিক স্ট্যান্ডাজির অংশ হিসেবে নয়) গড়ে তুলতে ব্রতী হই।



- পামাআলে

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.