![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি মাঝে-মধ্যেই একটি দুঃস্বপ্ন দেখি। তা হল, আমি স্কুলের উপরতলা থেকে নিচ তলায় যেই না নামতে ধরলাম, তখনই সিঁড়িগুলো সব চেপে আসতে শুরু করল। অস্বাভাবিকভাবে লম্বা হতে লাগল। উপরতলা আর নিচতলার মাঝখানে সিঁড়িটা যেন লম্বভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আমি সিঁড়ির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে অনেক কষ্টে নিচে নামার চেষ্টা করছি। দম বন্ধ হয়ে আসছে প্রায়। আর তখনই ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। আবার ঘুম ফিরে আসতে বেশ সময় লাগে।
স্বপ্ন একটি খুবই সাধারণ ঘটনা। স্বপ্ন সবার ঘুমেই আসে। যেমন, পাহাড় থেকে পড়ে যাবার স্বপ্ন কম-বেশি সবাই দেখে। সাধারণত দুশ্চিন্তায় থাকলে মানুষ এমন স্বপ্ন দেখে। আবার গ্যাসট্রিক এর সমস্যা থাকলে নাকি মানুষ স্বপ্নে দেখে তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে!
স্বপ্ন নিয়ে অনেক ভালো-মন্দ ব্যাখা আছে। অনেক মনীষী অনেকভাবে এগুলো লেখার চেষ্টা করেছেন। আমার কাছে এগুলোর বেশিরভাগই সত্য মনে হয় না। তবে একটি কথা সত্য বলে মনে হয়, যে যাকে বেশি ভালোবাসে, তাকে নিয়ে সে বেশি দু:স্বপ্ন দেখে। আমি তো আমার স্কুলকে অনেক বেশি ভালোবাসি, তাই এটুকু দু:স্বপ্ন দেখতে আমার আপত্তি নেই।
২
আজ শুধু ভালোবাসার কথাই লিখব। আর ভালোবাসার কথা লিখতে গেলে স্মৃতিকাতর হতে আমি বাধ্য।
লিখতে বসেছি স্কুল জীবনের স্মৃতিগুলোর কথা। কিন্তু এ কি বাস্তবে সম্ভব? কেউ যদি আমাকে কোনদিন রাতের আকাশের তারা গুণে শেষ করতে বলে, আমি তাকে পাল্টা বলব, আপনি আগে আপনার স্কুলজীবনের স্মৃতিগুলো গুণে শেষ করুন। তারপর আমি আকাশের তারা গুণব।
তবুও অগণিত তারার মধ্যে থেকে ধ্রব, অরুন্ধুতী, কালপুরুষ- এগুলোর নাম যেমন আগে মনে পড়ে, তেমন অগণিত স্মৃতির মধ্যে থেকেও কিছু স্মৃতি মনে হরহামেশাই বাড়াবাড়িরকমভাবে উঁকি দেয়। আজ নাহয় সেগুলো লিখেই পৃষ্ঠা ভরাই।
তখন সেভেনে পড়ি। আমার প্রিয় বন্ধু রছি, আমাকে নিয়ে একটি ব্যঙ্গাত্মক কবিতা লিখে ফেলল। কবিতাটি খারাপ নয়, তবে আমাকে রাগান্বিত করার জন্য যথেষ্ট। ধীরে ধীরে সে কবিতা অন্যরাও জেনে গেল, এমনকি রছির ছোটভাইও কবিতাটি মুখস্ত করে নিল। স্কুল থেকে ফেরার পথে ওর বাড়ির সামন দিয়ে যখন যাই, তখন শুনি, ওরা দুই ভাই মিলে অনেক যত্নে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে কবিতাটি আবৃত্তি করছে।
আমার রেগে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমি রাগি নি।পৃথিবীতে কিছু মানুষ রাগ করতেপারে না। এটা তাদের সীমাবদ্ধতা।
ক্লাসে কে কোন বেঞ্চে বসবে এটা মোটামুটি ঠিক করাই ছিল। কেউ কারও বেঞ্চে বসত না।আমি, আরিফ, রছি আর সৌমেন্দ্র বকশী, এক সাথে বসতাম। রছি আর সৌমেন্দ্র দুজন বেঞ্চের দুকোনায়, আমি আর আরিফ মাঝখানে।রছি আর সৌমেন্দ্রর মাঝে চলত বেঞ্চ দখলের ঝগড়া। ওরা বেঞ্চে দাগ দিয়ে সীমা টেনে দিত। একজন আরেকজনের সীমানায় ভুলেও চলে গেলে ঝগড়া করত। হাতাহাতিও হত।
আরেকটি ঘটনা। ব্যাখ্যা করে বোঝানো যাবে না, তাই উদাহরণ দিয়ে বোঝাই। ধরা যাক, আমার সাথে রিশাদের ঝগড়া হয়েছে। আমি একটু আগেভাগে এসে নিজের জায়গায় ব্যাগটা রেখে অন্যদেরকে রিশাদ যে বেঞ্চে বসেওখানে বসিয়ে দিলাম। ফলে কি হল, রিশাদ এসে দেখল তার বসায় জায়গা নেই। তাকে পিছনের একটি বেঞ্চে যেয়ে বসতে হল। (আমার রিশাদের সাথে কখনওই ঝগড়া হয় নি, শুধুই ঘটনার স্বার্থেবললাম)
রিশাদের কথা যখন চলেই এল, তখন একটু অনধিকারচর্চা করি। বিধাতা যে ওকেকি দিয়ে বানিয়েছেন, তা শুধু তিনিই জানেন। ও হয়ত ওর থেকে মেধাবী কাউকে খুঁজে পেয়েছে, কিন্তু আমার সে সৌভাগ্য এখনও হয়নি।
৩
হাইস্কুলে উঠে আমরা একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার শিখে ফেললাম, সমবেত হয়ে চিৎকার করা, বা কোরাস করা।
ব্যাপারটি যতটা না ভয়ঙ্কর, তার থেকেও বেশি বিপদজ্জনক। ধরা যাক, কিছু ছেলে দল বেঁধে কোরাস করল। খুব স্বাভাবিক, স্যার গেলেন রেগে। স্যারের রোষানল পড়ল এমন একজনের উপর, যে হয়ত কিছুই করেনি।আমি নিজেই এর শিকার। আবার স্যার যে ছেলেটিকে খুব ভালো মনে করেন, একদিন দেখলেন, সেই ছেলেটিও কোরাস করছে, মুখে হাত চেপে, যেন বোঝা না যায়। স্যারকে তখন খুব অসহায় লাগত। কিছু বলতেও পারতেন না, সইতেও পারতেন না।
সে সময় আমি আর তাসনিম, দুজনেই বেশ স্বাস্থ্যবান ছিলাম (তাসনিম এখনও স্বাস্থ্যবান, আমি শুকিয়ে গেছি)। দুজনে মিলে একজন শুকনো ছেলেকে দুপাশ থেকে ধাক্কা দিলে কেমন হয়, এটা জানার জন্য আমরা এই ভয়ানক কাজটা করতে শুরু করে দিলাম। ক্লাসের শুকনো ছেলে রিয়েল, একদিন ওকে দুজন দুপাশ থেকে ধাক্কা দিলাম। ছেলেটার মুখের অবস্থা দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নেই, এ কাজ আর করা যাবে না।
আবার হরহামেশাই আমরা একেকজনের একেকটা নাম দিয়ে ফেলতাম। তবে এই বিকল্প নামগুলো আবার অদ্ভুতভাবে তাদের চরিত্রের সাথে বা দৈহিক অবয়বের সাথে মিলে যেত। কার কি নাম ছিল, সেটা বলে দেয়াটা রুচিহীন কাজ হবে, তাই একটু অন্যভাবে বলার চেষ্টা করি। সেসময় আমি খুব ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলাম, আর স্বাস্থ্যবান মানুষদের কমন নাম ‘মোটা’। আমাকেও সেইনামে ডাকা হত। আবার ক্লাসের চিকন,শুকনো ছেলেটার নাম দেয়া হত……। আর বোধহয় না এগিয়ে যাওয়াই ভালো।
আমরা শুধু যে দুষ্টুমিই করতাম, তা কিন্তু নয়। গাইবান্ধা জেলার যেকোন পরীক্ষায় আমার ব্যাচ আমার স্কুলকে প্রথম করত। অনেকেই অবাক হয়ে যেত, এরা পারে কি করে।
৪
ক্লাস এইটে ওঠার পর চারদিকে যেন প্রেমের হাওয়া বইতে লাগল। বন্ধু-বান্ধবীরা দলে দলে প্রেমে পড়তে লাগল। দেখতে ভালোই লাগত। লোকে বলে, স্কুলজীবনের প্রেম নাকি বেশিদিন টেকে না। কথাটাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। আমি নিজেই তো দেখছি, স্কুলজীবনের কয়টি প্রেম টিকে আছে, আর কয়টি নেই। তবে যারা টিকিয়ে রেখেছে, তারা হয়ত মহাপুরুষের কাছাকাছি।
আমি নিজে এ প্রলোভনে পা বাড়াইনি। বয়স অল্প, ইচ্ছে ছিল না, এমন মিথ্যাচার করব না। তবে সাহস অনেক বড় ব্যাপার। প্রেম করার জন্য অনেক সাহসী হতে হয়। আমি ভীরু মানুষ। আমি সবকিছুকেই ভয় পাই।
একবার আমার দুই বন্ধুর মাঝে ঝগড়া লাগল। ভাবলাম, হয়ত কিছুই না। কিন্তু ঝগড়ার পরিসরটা ছোট না থেকে অনেক বড় হতে লাগল। ফলাফলটাও মারাত্মক। একজন আরেকজনকে আঘাত করার জন্য উদ্যত। একদিনতো এক বন্ধু আরেক বন্ধুর গায়ে হাত দিয়েই ফেলল। সেসময় ওদের মধ্যে খুব বিদ্বেষ। একজন আরেকজনকে দুচোখে দেখতে পারেনা।
বড় হয়ে ওরা দুজন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে্র একই বিভাগে ভর্তি হল। এখন ওরা খুবই ভালো বন্ধু। তা জেনে তো আমি অবাক। ছোট বয়সের প্রেম যেমন ছোট, মানুষ সহজেই ভুলে যেতে পারে; তেমনি অভিমান বা ক্ষোভগুলোও সাধারণত ছোটই হয়। ভুলে যেতে খুব বেশি অসুবিধা হয় না।
যেদিন স্কুলে শেষ ক্লাস করলাম, সেদিন কিছুই বুঝিনি। খুব মজায় কেটেছে দিনটা। জীবন থেকে কি হারিয়ে গেল, তা বুঝতে শুরু করলাম পরদিন থেকে। সকালে উঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি, ছেলে-মেয়েরা সাদা শার্ট-নীল প্যান্ট পড়ে স্কুলে যাচ্ছে। দীর্ঘ বারো বছর আমি এভাবেই স্কুলে গিয়েছি। আর কোনদিনও আমি এভাবে হাঁটব না। এভাবে স্কুলে যাবো না। এত বড় একটি স্কুলে আমার জন্য কোন ক্লাসরুম আর নেই। এতবড় স্কুলে কোন শিক্ষকের ক্লাস আমি আর করতে পারব না।
বন্ধুরা অধিকাংশই বেশ ভালো জায়গায় আছে, ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে। তাদের কথা শুনে ভালো লাগে। আবার কিছু বন্ধুএলোমেলো জীবন-যাপন করতে গিয়ে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। তাদের কথা ভাবলে বেশ কষ্ট লাগে। আর কিছু বন্ধু আমার মত কষ্ট করে নিজেকে ধরে রেখেছে এখনও। ওদের কথা ভাবলে জীবনে লড়াই করার সাহস পাই।
৫
আমরা আমাদের বিদ্যালয়টিকে এমন সময় থেকে দেখে আসছি, যখন তার রূপ, জৌলুশ, নামডাক কিছুই ছিল না। দুপাশে দুটো লম্বা টিনের ঘর। তাতে কয়েকটি ক্লাসরুমে ছেলে-মেয়েরা পড়ত। ধীরে ধীরে প্রাথমিক পর্যায় পেরিয়ে হাইস্কুল খোলা হল। তারপর মহাবিদ্যালয়।
স্কুলটিকে এগিয়ে নিতে কাদের অবদান আছে, সেটা সবাই জানেন। তবে আমি আমার কয়েকজন প্রিয় শিক্ষকের নাম বলব। প্রথমেই বলব, কাসেম স্যার আর সামাদ স্যারের কথা। এককথায়, ওনারা অসাধারণ। শুধু এই দুজন স্যারকে ঘিরেই আমাদের ভালা-মন্দকোটি কোটি স্মৃতি জমা হয়ে আছে।এখানে সেগুলো লেখার পরিসর নেই। গণি স্যার, শুধু ক্লাস এইটে তাঁর ক্লাস করেছিলাম। সেজন্য আমরা সৌভাগ্যবান। আমাদের পরে আর কেউ তাঁর ক্লাস পায়নি। বারি স্যার, ওনার শেষ ক্লাস করি সেভেনে। উনি আমাদের কৃষি ক্লাস নিতেন।
যাদের নাম বললাম, তাঁরা কেউই আজ পৃথিবীতে নেই।জীবিত মানুষের থেকে মৃত মানুষ নাকি বেশি শ্রদ্ধা পান। তবে ওনারা যদি আজও পৃথিবীতে থাকতেন, তবে আমরা যে তাঁদেরকে শ্রদ্ধা কম করতাম, এটা মিথ্যে কথা।
ছোটথেকে আজ পর্যন্ত কত মানুষকেই তো হারিয়ে যেতে দেখলাম। স্কুল ঢুকতে সবার আগে যেই দেলোয়ার চাচার সাথে দেখা হত, আজ তিনি নেই। অল্পকিছুদিন আগে চলে গেলেন ফুলকাক্কুও। প্রথম দিন যার হাত ধরে ছো্ট্ট আমি স্কুলে এসেছিলাম, সেই তিনিও আজ নেই। মানুষ হারিয়ে যায়। তার স্থান নেয় নতুন কেউ। শুধু ভালোবাসাটাই টিকে যায়। ওটাকে হারানো যায় না।
এই ভালোবাসার টানেই আমরা বারবার ফিরে আসি, বারবার এক হই, পুণর্মিলনীর আয়োজন করি।
৬
বিদ্যালয় জীবন শেষ করেছি আজ সাত বছর হয়ে গেল। আমরা এখন যৌবনে পা দিয়েছি। কিন্তু এখনও আমরা ঠিক আগের মতই আছি। উদাহরন দিই, রছি আমাকে দেখলে মাঝে-মধ্যেই এখনও ওর লেখা কবিতাটা পড়ে শোনায়। আাবার, বন্ধুরা দেখা হলে এখনও আমাকে সেই স্কুলজীবনের দেয়া নামগুলো ধরেই ডাকে। আমি রাগতে পারিনা, তাই হাসি।
বিদ্যালয় সবার কাছেই প্রিয়। যে ছেলেটি বা মেয়েটি কলাগাছের ভেলায় চেপে নদী পেরিয়ে বিদ্যালয়ে যায়, তার কাছেও তার বিদ্যালয় খুবই প্রিয়। যে ছেলেটির বা মেয়েটির বিদ্যালয় প্রতিবছর বন্যার জলে ভেসে যায়, বন্যা শেষে আবার সে তার বিদ্যালয় যায়, কারণ তার কাছে তার বিদ্যালয় খুবই প্রিয়।
আমাদের জন্যও তাই। আমরা আমাদের বিদ্যালয়কে ভুলতে পারিনা। আমরা পৃথিবীর যেখানেই থাকি না কেন, আমাদের মনের কোনে, ঘুমের ঘোরে, চেতনেবা অবচেতনে বিদ্যালয় আর তার অগণিত স্মৃতি- হরহামেশাই ভেসে ওঠে।
প্রার্থনা করি, বিধাতা যেন কোনদিন এই স্মৃতিগুলো আমাদেরকে ভুলিয়ে না দেন। জীবন আর কতদিনের। এই ছো্ট্ট সময়ে এত মজা আর আনন্দের স্মৃতি আমি কোনভাবেই হারাতে রাজি না।।
(বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের পুনর্মিলনী উপলক্ষে একটি লেখা।)
০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১২:২০
পেলব চক্রবর্তী বলেছেন: ধন্যবাদ ।
২| ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:২৪
অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: আপনার স্মৃতিকথা ভালো লাগলো খুব । স্কুলের নাম জানা হল না !
ভালো থাকবেন ভ্রাতা ।।
০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১২:২০
পেলব চক্রবর্তী বলেছেন: আমার বিদ্যালয়ের নাম 'আহম্মদ উদ্দিন শাহ্ শিশু নিকেতন স্কুল এন্ড কলেজ'। দেশের উত্তরের জেলা গাইবান্ধা শহরের একটি নামকরা স্কুল।
আপনিও ভালো থাকবেন।
৩| ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১২:৩৩
কলমের কালি শেষ বলেছেন: স্মৃতির গল্পে ভাল লাগলো ।
০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ৯:৪৭
পেলব চক্রবর্তী বলেছেন: কষ্ট করে লেখাটা পড়েছেন। ভালো লাগলো। আপনাকে ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১|
০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:১১
পার্সিয়াস রিবর্ণ বলেছেন: ভালো লাগলো লিখাটা ।