![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নিরালা সিনেমা হল। জামালপুরের এক সময়কার জমজমাট বায়োস্কোপঘর। তারই পাশ ঘেঁষে একটা সরু পাকা রাস্তা চলে গেছে পশ্চিমে। রাস্তার নাম দেয়া হয়েছে 'হুদা সড়ক'। রাস্তার মাথায় একটা টিনের জীর্ণ ঘর। সেই ঘরটা হুদা স্যারের। হুদা স্যারের কথা প্রথম শুনি ইস্কুলে পড়ার সময় আমার ইংরেজী শিক্ষকের কাছে। জীবনের কাছে কিছু না পেয়েও যে গুটিকয়েক মানুষ সুখী তার একজন হুদা স্যার। ষাটের দশকের এক আঞ্চলিক নাট্যকার, নান্দিনা স্কুলের বাংলার শিক্ষক হুদা স্যার। জামালপুরের মঞ্চে সেই সময়ের সাড়া জাগানো সব নাটকের রচয়িতা হুদা স্যার। এই যদি হয়, বই চোর, রেশমী রুমাল, এবং শয়তান, ঝাড়ে বাশ নাই সহ অজস্র নাটকের রচয়িতা এই মানুষটি। আঞ্চলিক ভাষায় রচিত 'এই যদি হয়' নাটকের সংলাপ আমার শিক্ষকদের মুখে শুনতে শুনতে স্যার সম্পর্কে জানার ইচ্ছে হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একদিন হুট করেই চলে গেলাম হুদা সড়কের সেই বাসাটায়। ঘরে ঢুকতেই পেন্সিলে স্কেচ করা একটা বিরাট ছবি চোখে পড়লো। এই আমার মানসপটে আঁকা হুদা স্যারের সাদাসিদে পোট্রেট। হালকা পাতলা গড়নের মানুষ, মাথায় হালকা বাবড়ি আর চোখে আজন্ম হাহাকার। আমি তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তার স্ত্রী এলেন। আমি বিস্তারিত বললাম। আথিতেয়তাও পেলাম। স্যারের জীবনসঙ্গীনিটি খুব সাদাসিদে একজন আটপৌড়ে বাঙালী নারী। হয়ত স্বামীর পাশে জীবনের বড় অংশটা কাটিয়ে দিয়েও কখনও বুঝতে পারেনি মানুষটিকে। হয়তো কোন সন্ধাবেলায় সেজেগুজে কখনও এক শো সিনেমা দেখারও সৌভাগ্য হয়নি এই নারীটির। হয়তো খুব রাত করে থিয়েটার করে এসে স্যার এলে উনি হাতে তালপাতার পাখা নাড়াতে নাড়াতে তখন ঘুমের রাজ্যে হাবুডুবু খেতেন। আমি স্যারের কিছু বই চাইলাম। নাহ, স্বামীর কোন সৃষ্টিকর্মই নেই উনার ভান্ডারে। ঐ লেখালেখিই হয়তো এখনও তার কাছে সতীনতুল্য হয়ে আছে। আর সতীনকে কেউ এতকাল পোষে রাখেনা। স্যারের ছোট ছেলের সাথে দেখা করে শেষমেষ একটা নাটকের পাত্তা পাওয়া গেলো। একটাই কপি আছে তার কাছে। আমি ভাবলাম ফটোকপি নিবো। কিন্তু সে আমাকে অরিজিনাল কপিই দিয়ে দিল আর ফিসফিস করে বললো, পঞ্চাশটা টাকা দ্যান। আমি বের করে দিলাম টাকাটা। আর অবাক হয়ে দেখলাম কিভাবে পঞ্চাশ টাকায় ছেলে তার বাবার অমুল্য বস্তুটা বেঁচে দিল আমার কাছে। তবু স্বস্তি পেলাম এই ভেবে যে আমার কাছে এলে অন্তত লেখাটা রক্ষা পাবে। বইয়ের পাতা উল্টালাম আর স্যারকে আবিস্কার করতে থাকলাম। আশির দশকে ছাপা নাটকটা। একজন স্কুল মাস্টারের সততা আর চারদিকে কদাকার সমাজের ভয়াল থাবা। মাস্টার চরিত্রটা হয়তো স্যারের নিজেরি জীবনের প্রতিচ্ছবি। দেখলাম কিভাবে অনর্গল রবীবাবুর নির্ঝরে স্বপ্নভঙ্গ ব্যাবহার করেছেন সংলাপে, কিভাবে ক্রমশ সততায় রক্ত ঝরছে আমাদের সমাজের আঘাতে। বোঝা গেল বেশ অভিমানী স্যার সমাজের কালো দিকগুলোর উপর। তারপরও বাতিটা জ্বালিয়ে রেখেছেন মঞ্চে আর লেখনীতে। বাকি বইগুলো সংগ্রহের জন্য পাবলিক লাইব্রেরীতে যাই। অনেক খুজে শেষ অব্দি আরেকটা বই পাই। ওটার ফটোকপি সংগ্রহ করি। এখানে আবিস্কার করি মধ্যবিত্তের জীবনসংগ্রামের এক অনবদ্য চিত্রকল্প। প্রতিটি বাক্যে আমি হৃদয় বুলাতে থাকি আর স্যারকে অনুভব করতে থাকি। আমাদের সোনার মানুষগুলো কোথায় গেলো! ভেবে চোখে জল আসে। প্রতিটি শব্দে আমি ফিরে পায় আমার হুদা স্যারকে। পড়া শেষে ট্রাংক এ বন্দি করে রাখি সেই অমুল্য দুটি গুপ্তধন। জানতে পারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক সৌমিত্র শেখরও হুদা স্যারের খোজে এসেছিলেন। পরে সৌমিত্র শেখরের সাথে যোগাযোগ করে আমার মত অভিজ্ঞতার কথাই জানতে পারি। আমি আর সৌমিত্র শেখর স্যার কিছুক্ষণ হুদা স্যারকে স্মরণ করে চুপ হয়ে যাই ফুটপাতে দাড়িয়ে। পরে জীবনের কোলাহলে আবার ভেঙে পড়ে সে নিরবতা। আমার মাথায় আবার ভীড় করে টিউশনি, বিসিএস কিংবা এমবিএ প্রিপারেশনের চিন্তা। সেই ট্রাঙ্কটা ফেলে একদিন সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পাড়ি দিয়ে চলে আসি ইউরোপে। তবু কোন কোন নির্জন ক্ষনে হুদা স্যার ভীড় করে মগজের কোষে। আমি তখন সম্মোহিতের মত কেবল ভাবতে থাকি, কি অদ্ভুত সম্পর্ক হুদা স্যার আর আমার। নব্বইয়ের দশকে স্যার চলে যান পৃথিবী নামক এই মায়াবী গ্রহটার মায়া ছেড়ে আর আজ ২০১৩। অথচ একটা ছেলে আজও হঠাৎ হঠাৎ চুপ করে স্যারের জীবন আকাশে উঁকি মেরে দেখতে যায় স্যারের সেই মায়াবী জগতের টিপটিপ দিপের আলোটুকো। স্যারের কবরের কাছে গিয়ে আজ খুব বলতে ইচ্ছে করে, স্যার, আপনি আমার দুরসম্পর্কের মেঘ।
©somewhere in net ltd.